অচিন(১ম পর্ব )

আমার স্ত্রীর ইদানীং শখ হয়েছে পুরানো আমলের কাঠের আসবাবপত্র সংগ্রহ করা। ফেসবুকে চৌকাঠ নামের একটা পেজ আছে সেখানে পুরানো ফার্ণিচার কেনাবেচা হয়। মিলির কাজ হচ্ছে সেই পেজ থেকে বাহারি ডিজাইনের ড্রেসিং টেবিল,আলমিরার ছবি স্কিনশট দিয়ে রাখা এবং আমি অফিস থেকে ফিরলেই কানের কাছে ঘ্যানরঘ্যানর করা,
-এটা কিনে দাও ওটা কিনে দাও।
-আচ্ছা। তুমি সিলেক্ট করে অর্ডার করো আমি পেমেন্ট করে দিচ্ছি।
কয়েক সেকেন্ড ভেবে মিলি নিজের থেকেই বলে,
-থাক! কতগুলা অযথা খরচ হবে আমরা পরের মাসে কিনব।
আমি হ্যা বা না কিছুই বলি না মিলির পাগলামি সহ্য করি। সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহবধূর মত মিলির ঘর সাজানো বা গহনা কেনার শখ প্রচুর কিন্তু টাকার অঙ্ক শুনে পিছিয়ে আসে। যদিও ওর মাটির ব্যাংকে বিশ টাকা,পঞ্চাশ টাকা রাখা আমার দৈনন্দিন রুটিন।সোনার ভরি সত্তর হাজার অত টাকা খরচ করে বউকে সাজানোর সামর্থ্য নাই৷ এক মুঠো কাঁচের চুড়ি,শিউলি ফুলের মালা বা ওর পছন্দের ডেয়ারি মিল্ক চকোলেট বাড়ি ফেরার সময় পকেটে থাকে। মিলি দরজা খুলেই প্রশ্ন করবে,
-আমার জন্যে কি আনছ?
দশ টাকা দামের সস্তা টিপের পাতা বের করি।
মিলি টুপ করে সেখান থেকে লাল টিপ কপালে দিয়ে মিষ্টি করে হাসবে,
-দেখো তো, কেমন দেখাচ্ছে?
ঠিক ওই মুহূর্তে সাত বছরের পুরানো স্ত্রীকেও রুপকথার রাজকুমারীদের মত অপরুপা মনে হয়৷ মনে মনে উচ্চারণ করি,
-বেঁচে থাকা মন্দ কিছু নয়।
লোকে বলে সংসার সুখের হতে রমণীর গুণ,অর্থকড়ি,সন্তানাদি,পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আরো ঢের কিছু প্রয়োজন। আমি বিশ্বাস করি,দুজন মানুষ বছরের পর বছর একই ছাদের নীচে কাটিয়ে দেয় স্রেফ একজন অন্যজনের সঙ্গ পাবার লোভে। কর্মব্যস্ত মানুষ ক্লান্ত দিনের শেষে ঘরে ফিরে দু’দণ্ড শান্তির আকাঙ্খায়। ঘরের ভেতর নিজের শরীরের আধেক খানা অংশ দিব্যি ঘুরে বেড়াবে। তার সাথে কথার মারপ্যাঁচে ঝগড়া চলে আর জাপ্টে ধরে গায়েে গন্ধ না শুঁকলে ঘুম আসে না একে সম্ভবত ভালোবাসা বলে বা ভালোবাসাবাসির চেয়ে বেশি কিছু। বারান্দায় বসে এক কাপ চা খাওয়া, বালিশ হাতড়ে অন্যজনের শরীরটাকে কাছে টেনে আনা খুব সাধারণ কিছু কিন্তু এই সাধারণ অংশটুকুই আপনার কাছে উপভোগ্য না হয় তাহলে ভেবে নিবেন রেশ কেট গেছে স্রেফ সমাজ,পরিবার ইত্যাদির চোখ রাঙানির ভয়ে দাম্পত্য জীবনের অভিনয় করে যাচ্ছেন।
মিলির সাথে আমার বিয়ে হয়েছে ছয় অথবা সাত বছর। সঠিক হিসাব, দিনক্ষণ আমার মনে থাকে না, মিলির থাকে। রোববারে অফিস যাবার সময় এক বাটি পায়েস খাবার টেবিল হাজির করে বলবে,
-দুই চামচ পায়েস খেয়ে তারপর রুটিতে হাত দাও।
-কেন?
-আজ ২১ শে আগস্ট৷ আমাদের বিবাহবার্ষিকী।
এই হল আমার প্রিয়তমা স্ত্রী। কোনো রাগ নাই অভিমান নাই স্রেফ কিছুদিন পর পর একটা উদ্ভট শখ ওর মাথায় চেপে বসে।
বেশ কিছুদিন আগে বনসাই গাছের বাগান করবে বলে এখানে ওখানে ঘুরে মাটি সংগ্রহ করে আনল। ডুমুর,হিজল, বট কোনো গাছ চেষ্টা করে উপকার পায় নাই৷ একটু ঝোঁপের মত হয়েই মরে যায়।
ইদানীং আবার উঠেপড়ে লেগেছে পুরানে ফার্নিচার সংগ্রহে। আজ এটা কাল ওটা পছন্দ করে ছবি বাছাই করেছে। জানি না এই পাগলামি কতদিন স্থায়ী হয়।
এক বন্ধু কিছু টাকা ধার নিয়েছিল প্রায় দুই বছর পর শোধ করল। বাড়ি ফিরলাম মিলির পছন্দের চাইনিজ নিয়ে। ফিরে দেখি বউ আমার জন্যে এরচেয়েও বড় সারপ্রাইজ নিয়ে অপেক্ষা করছে। শোবার ঘরে জানালার পাশে আলিশান আলমিরা শোভা পাচ্ছে। ঝকঝকে বার্নিশ করা,কুচকুচে কালো রঙ। জিনিসটা পুরানো হলেও বেশ মজবুত। বউ আমার দিকে চেয়ে হাসছে।বলল,
-কিগো, কেমন ভড়কে দিলাম? তুমি তো বলো আমি অনলাইনে শপিং করে খালি করি। অরজিনাল চিটাগাং সেগুন কাঠে তৈরি। মিস্ত্রী ডেকে যাচাই করে নিয়েছি।
-এরমধ্যে পরীক্ষাও করে ফেলেছ? কত দাম নিল?
-মাত্র দশ হাজার!
-মিথ্যা বলছ।
-উহু! রিসিট দেখো।
এবার সত্যি অবাক হলাম।যথেষ্ট পুরু দেয়াল, পেল্লাই সাইজের দুইখানা দরজা। আমাদের গ্রামে অভিজাত হিন্দু গৃহস্থের বাড়ি এমন ভারী আসবাব শোভা হত।।এটাও নিশ্চয়ই কোনো বনেদি বাড়ির গৃহকর্তা কারিগর ডেকে বানিয়েছিলেন। বছর ঘুরতে ঘরের ফার্নিচার পরিবর্তন করা আজকাল বড়লোকদের ট্রেন্ড। এই আলমারিটাও সম্ভবত সেরকম কেউ জলের দামে বিক্রি করে দিয়েছেন।
আলমারি নিয়ে গল্প করতে গল্প করতে এদিকে আমার সারপ্রাইজের কথা ভুলে গিয়েছি। মিলিকে বললাম,
-তোমার জন্যে চাইনিজ এনেছি।
মিলি খুশি হল।বলল,
-তুমি হাতমুখ ধোও। আমি গরম আনছি।
মধ্যবিত্ত ঘরে সুখে থাকার উৎস নিতান্ত সামান্য। মিলি নতুন ফার্ণিচার কিনেছে। পুরানো হোক তবু তো আমাদের সংসারে নতুন। ও ঝেড়েমুছে ভিতরের ড্রয়ার পুরানো খবর কাগজ বিছাচ্ছে। শাড়ি,সালোয়ার কামিজ সযত্নে গুছিয়ে রাখছে।আমি বিছানায় শুয়ে ওর কাণ্ডকারখানা দেখছি,মজাও পাচ্ছি।দেখতে দেখতেই সম্ভবত ঘুমিয়ে পরছিলাম।ঘুম ভাঙল মাঝরাতে। লাইট বন্ধ।।জানালার ফাঁক গলে ল্যাম্পপোস্টের সামান্য আলো আসছে। সেই আলোতে দেখতে পেলাম মিলি ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করছে।নির্ঘাত বোবায় ধরেছে। ওর গায়ে স্পর্শ করলাম,
-এই মিলি! মিলি!উঠো।
-উহু!
মিলি ধড়ফড় করে উঠে বসল।
-কি হয়েছে তোমার? এমন কাতরাচ্ছিলে কেন?
-শোনো! স্বপ্নে দেখলাম আমার বিয়ের বেনারসি শাড়ি কে যেন দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে কুটিকুটি করছে।
-দুঃস্বপ্ন দেখেছ। পানি খাবে?
-হু!
আমি পানি নিয়ে এসে দেখি মিলি আলমারির চাবি ঘোরাচ্ছে।আমায় দেখে বলল,
-দেখো না,কিছুতেই দরজা খুলতে পারছি না। কি হল!
আমিও কিছুক্ষণ চাবি নিয়ে লম্ফঝম্প করলাম। দরজা খুলল না। পুরানো আলমারিতে সমস্যা থাকতে পারে।
-সকালে মিস্ত্রি ডেকে দেখাইও।এত রাতে তোমার আলমারি খোলার কি দরকার!
-আমার বিয়ের শাড়িটা বের করে দেখতাম।মনের ভেতর কেমন খুঁতখুঁত করছে।
-মিলি সকালে আমার অফিস আছে? দয়া করে লাইট অফ করে ঘুমাতে আসবে?
-হু!
মিলি পাশে শুয়ে বেড়ালের মত ওর হাত-পা আমার শরীরের ভেতর সেধিয়ে দিল। খুব ভয় পেলে বা খুব খুশি থাকলে মিলি এমন করে। আমি কিছু বললাম না ওর হাতখানা শক্ত মুঠোয় চেপে ঘুমিয়ে গেলাম।
পরদিন ঘুম ভাঙল মিলির চেঁচামেচিতে।
-এই দেখে, আলমারি খুলে গেছে।নবে কোনো সমস্যা নাই।আমার শাড়িও ঠিক আছে।রাতে ঠিক কি হয়েছিল,বলো তো!
উত্তর দিলাম না। একবার কথা বলা শুরু করলে মিলিকে থামানো মুশকিল।
বৃহস্পতিবার হাফবেলায় অফিস ছুটি। সপ্তাহে তিনটে দিন আমি টিউশনি করি।অবশ্যই মিলির অজান্তে। ও জানে শুক্র,শনি দুদিন নিয়ম করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতে যাই।গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে দশ মিনিট কথা বলি সত্যি তারপর সোজা ছাত্রের বাসায় ঢুকি। আজ ছাত্রের মায়ের হাতে ভরপেট নাস্তা খেয়ে বাড়ি ফিরলাম। এদিকে আমার ঘরের রাণীও বিরিয়ানি রান্না করে বসে আছেন। বউর মন রাখতে হাঁসফাঁস পেটে দেড় প্লেট বিরিয়ানি সাবাড় করলাম।।ভাবলাম,ছাদে গিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলে হজম হবে দ্রুত। মিলি সাথে আসতে চাইল না। ওর ঘরে কি যেন কাজ আছে। কাজ বলতে নতুন আলমারি আবার সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা।
আধাঘণ্টার ছোট্ট হণ্টণপর্বের পর ঘরে ফিরে দেখি বিবিসাহেবা ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসে খুব মন দিয়ে কাজল পরছে। আমার চোখে চোখ পরতেই মুচকি হাসল। ওর এই হাসিটা দেখে অনুভব হয় প্রেমে পরা আর প্রেম করবার কেনো বয়স হয় না। লাইট অফ ওর কাছাকাছি আসতেই ও থমকে দাঁড়াল।
-মিলি কি হয়েছে?
ওর হাতপা থরথর করে কাঁপছে।
-নিশাত, আমাদের কেউ দেখছে।
-কি বলছ!

-হ্যা, তোমার মনে হচ্ছে না?
আমারো মনে হচ্ছিল পিছনে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে ঘুরলাম। কালো আলমারিটা অন্ধকারের সাথে মিশে গিয়ে অশরীরী এক রুপ নিয়েছে। মিলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম,
-ঘুমাও। তোমার শরীর খারাপ লাগছে।
মিলি আমার বুকের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেল।আমার ঘুম আসল না। তন্দ্রার মত এসেছিল তীব্র একটা গন্ধ নাকে আসায় আবার ঘুম ভাঙল।কুপিতে কেরোসিন কমে আসলে সলতে পুঁড়ে যেমন একটা গন্ধ হয় অনেকটা তেমন। আর আলমারির ভেতর হিসহিস শব্দ। মিলিকে সরিয়ে এক পা দু’পা করে আলমারির কাছে এসে দাঁড়ালাম।হাতলে হাত রাখতেই সব শব্দ বন্ধ। মুহূর্তে ঘরটা নীরব হয়ে গেল। মিলি বালিশ হাতড়ে আমায় ডাকছে।
-নিশাত! নিশাত!
-এইতো আমি! ঘুমাও।
ও ঘুমিয়ে গেলে আবার সেই অনুভূতি। কেউ যেন আলমারির আড়াল থেকে আমাদের দেখছে।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প