আমার স্ত্রীকে দেখছিলাম নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাচ্ছে। মিলির সাথে আমার সাত বছরের সংসার জীবনে এরকম কখনও হয় নি৷ ঝগড়া হয়,বিছানা ভাগাভাগি হয় আবার ফ্লোরে কাঁথা-কম্বল বিছিয়ে শুয়ে অপেক্ষায় থাকে মাঝরাতে ওকে আমি কাছে টেনে নিব। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তো রক্ত বা আত্মীয়ের সম্বন্ধ থাকে না। নিত্যনতুন মান-অভিমানে বন্ধন অটুট থাকে। সেখানে আজ সপ্তাহখানেক মিলি আমার সঙ্গে ঠিকমত কথাই বলছে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি জলখাবার তৈরি, মিলি শুকনো কাপড় দিয়ে ওর শখের আলমিরা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করছে। আগের মত খাবার টেবিলে পাশে বসে টুকিটাকি গল্প করে না।
-নিয়ে খাও।
দুই কথার এই বাক্য দারুণ পীড়াদায়ক। মিলি বুঝে না। রাতে বাড়ি ফিরে দেখতে পাই মিলি ভয়ে কুঁকড়ে আছে।
-কি হয়েছে তোমার?
-কিছু না।আজ দুপুরে..
-দুপুরে কি?
-আলমারির ভেতরে থেকে একজন মহিলা বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানি গাইছে।বিশ্বাস করো! আমি নিজে কানে শুনেছি।
বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হয়। মিলিকে বোঝাই এটা ওর মনের ভ্রম। সংসার জীবনে আল্লাহপাক আমাদের সন্তান দান করেন নাই। তাই একটা ছোট্ট বাচ্চার কান্না শুনে মিলির যেমন রাতে ঘুম ভাঙে তেমনি ভরদুপুরে মায়েদের ঘুমপাড়ানি গান শুনতে পায়।
তবে আশ্চর্য লাগে সামান্য একটা কাঠের আলমারির মত জড়বস্তুকে ঘিরে মিলির আজকাল ধ্যানধারণা আবর্তিত হয়।ছোট একটা উদাহরণ দেই, রাতে দুজনে কাছাকাছি এলে ওর ধারণা আলমারির আড়াল থেকে কেউ একজন আমাদের দেখছে। ওকে বললাম,
-চলো আলমারিটা বসার ঘরে সেট করি।
মিলি আঁতকে উঠল।
-নাহ। বাচ্চাটা রাতে একা ভয় পাবে।
-কোন বাচ্চাটা!
মিলি উত্তর দেয় না। সারাদিন অফিস তারপর ছাত্র পড়িয়ে ক্লান্ত শরীরে মরার মত রাতে ঘুমাই। শেষরাতে আমার একবার বাথরুমে যাবার অভ্যাস।বিছানা ছেড়ে উঠে দেখি,
-মিলি আলমারিতে আলতো করে হাত বুলাচ্ছে।
মিলি চমকে উঠে। ঠিক তখন আমি কেমন পোলাওয়ের চালের গন্ধ পাই। ভেতরটা কেমন শিরশির করে উঠে।বিষধর সাপের গন্ধ অনেকটা সুগন্ধি চালের মত।চার তলার উপর সাপ আসবে কেমন করে!
যাই হোক,আমরা ভালো ছিলাম না অথবা কুচকুচে কালো স্তম্ভের মত আলমারিটা আমাদের দাম্পত্য জীবনে কালসাপর মত প্রবেশ করেছে।ওটার ভেতর মিলি তিন-চার বছরের একটা শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। শুনেছি মেয়েরা পোষা প্রাণী, এমনকি গানের চারাগাছের মধ্যেও মাতৃসুলভ আনন্দ খুঁজে পায়৷
যাই হোক, মিলি ওর অন্তত পছন্দের আলমারির ভেতর থেকে শিশুর কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছে এবং তাকে ঘিরে সময় কাটাচ্ছে। বিয়ের পর থেকে দেখছি,মিলি সাধারণ একটা সুতির শাড়ি,কুন্দলের গহনাকে ঘিরে এক সপ্তাহ ব্যস্ত সময় পাড় করে। সেক্ষেত্রে আলিশান এক সেগুন আলমারি মিলির কাছে বিশাল কিছু।
মিলির গৎবাঁধা পাগলামিতে বিরক্ত হয়ে ফোন করলাম শাহেদকে। শাহেদ আমার ছোটোবেলার বন্ধু, ব্যক্তিজীবনে বিশেষ কোনো উন্নতি করতে পারে নাই কিন্তু অন্যদের জীবনের সকল সমস্যার সমাধানে উঠে পড়ে কাজ করবে। শাহেদ শুনে বলল,
-এটা কোনো ব্যাপারই না। ভাবীকে কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দে আর এই ফাঁকে তুই আলমারি বিক্রি করে দে।
কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান। মিলিকে কুড়িগ্রাম যাবার কথা বলতেই ও এককথায় রাজি হয়ে গেল।সত্যি বলতে আমার খাবার-দাবারের কষ্ট হয় এবং ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারি না বিধায় মেয়েটা কোথাও বেড়াতেও যেতে পারে না। এক শুক্রবার ওকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ও নেই বাসা খালি খালি লাগছিল আবার ওর ভেতর যে মানসিক সমস্যা তৈরি হয়েছে তা দূর করার মাধ্যম পেয়ে আরামও লাগছিল।
টিভি ছেড়ে এস্ট্রে নিয়ে আরামে বিছানার উপর সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে বসলাম।মিলি থাকলে এতক্ষণে আমি খুন হয়ে যেতাম। আলমারি বেচারার দিকে তাকিয়ে হাসি পেল। গর্দভের মত একটা কাঠের আসবাবের জন্যে স্ত্রীকে ছাড়া থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ভেবেছিলাম, ঘটনার সমাপ্তি এখানেই কিন্তু সূত্রপাত যে এখান থেকেই ঘটবে ভাবতে পারি নি। দিনটা আমার এখনও মনে পড়ে। দুঃখিত,দিন নয় রাত।
৫ মে,২০১৬-
টিভিতে সালমান শাহর সিনেমা দেখালে আমি কখনও মিস করি না। পরদিন অফিস ছিল তবু চ্যানেলের পর চ্যানেল পাল্টিয়ে প্রিয় নায়কের সিনেমা পেয়ে দেখতে বসে গেলাম। “এই ঘর এই সংসার” দেখতে দেখতে রাত দেড়টা বাজল। বউ বাড়িতে না থাকলে মাঝরাতে ক্ষুধাটাও বেশ যন্ত্রণা দেয়। রান্নাঘরে গেলাম ডিমভাজি করতে।
শোবার ঘরে থপাস করে মেঝেতে কিছুআঘাত করার শব্দ শুনে দ্রুত ঘরে এলাম।মিলি আলমারির উপর আমাদের বিয়ের লাগেজ রেখেছিল,ব্যালেন্স হারিয়ে নীচে পরে গেছে।সামান্য একটা দূর্ঘটনা তবু মনের ভেতরটা খচখচ করতে লাগল।লক্ষ্য করতেই দেখলাম আলমারির দরজার ফাঁক গলে একটা লাল শাড়ির আঁচল বের হয়ে আছে।মিলির শাড়ি! মিলিরই তো হবে!
আমি লাইট অফ করে ঘুমাতে এলাম। সেরাতে ঘুম হল ছাড়া ছাড়া। যতবার ঘুম ভাঙে মনে হচ্ছিল আটপৌরে একজন মহিলা ঘোমটা টেনে বিছানার এক কোণে বসে আছে। ঠিক যেখানটায় আলমারির ছায়া এসে পরেছে সেইখানে!
সকালে ঘুম থেকে উঠতে কালরাতের ঘটনা নিজের কাছেই হাস্যকর লাগল। ভয় সংক্রামক৷ মিলির মত আমাকেও জেঁকে বসেছে। শাড়ির আঁচল আজকে দেখতে পেলাম না। মিলিকে ফোন করলাম।।টুকিটাকি খবরাখবরের পর একদম ক্যাবলার মত প্রশ্ন করলাম,
-মিলি,তোমার লাল শাড়ি আছে?
-লাল আমার সবচেয়ে পছন্দের রঙ। একটা না পাঁচটা লাল শাড়ি আছে। গত ম্যারিজ ডেতেই তো তুমি একটা কিনে দিলা।মনে করতে পারছ না!
-ইয়ে.. লাল বেনারসির মত!
-আজব! আমার বিয়ের শাড়ি সবুজ কাতান!। তুমি ভুলে গেছ!
-না না। ভুলি নাই। ভুলব কেমনে!
যাক বেনারসি না হোক লাল শাড়ি তো আছেই আমারি রাতে দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছিল।
পরদিন কেন জানি শোবার ঘরে একাকী ঘুমানোর সাহস হল না।বৃষ্টির রাত। ইলেকট্রিসিটি নেই। মোমবাতি জ্বালিয়ে বসার ঘরে শোবার ব্যবস্থা করছি। একটা সোফার সাথে আরেকটা সোফা টেনে নিয়ে মোটামুটি ঘুমানোর মত বিছানা তৈরি। গাঢ় ঘুমে যেন তলিয়ে না যাই।
হোটেল থেকে খাবার অর্ডার করেছিলাম।।বৃষ্টির রাত বলে ডেলিভারি বয়ও আসছিল না। অপেক্ষা করতে করতে ঝিমুনি এসে পরেছিল। খিলখিল করে হাসির শব্দ তন্দ্রা কেটে গেল। মিলি নয় অচেনা নারীর গলা। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না শোবার ঘর থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছে। সাথে সারা ঘরে তীব্র একটা গন্ধ। জেসমিন ফুলের মত নেশা ঘ্রাণ। একজন মহিলা সুরে সুরে গান গেয়ে বাচ্চাকে ঘুম পাড়াচ্ছে। গানের কখাগুলা স্পষ্ট নয় কিন্তু সুর বড় চেনা।
আমার যেন কি হয়েছিল ঘোর লাগা শরীরে পায়ে পায়ে শোবার ঘরে উঁকি দিলাম।দেখলাম, একজন মহিলা আলমারিতে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে বাচ্চাকে ঘুম পাড়াচ্ছে। বাচ্চার দিকে তাকাতে,নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। বাচ্চাটার ধড়ের উপর মাথাটা থেতলে আছে। জমাট জমাট রক্ত পরছে। এক পলক দেখে জ্ঞান হারালাম।