অদৃশ্য_এক_অসুখ_তুমি (০২)

রাতে মেঘকে রক্ষা করার ঘটনার ঠিক পরদিনই থানায় এক অভিযোগ যায়—আরিয়ান এক লোককে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।মৃত নয়, কিন্তু আশঙ্কাজনক।
এটা ছিল পরিকল্পিত।শফিক চৌধুরী তার লোকজন দিয়ে থানা-পুলিশে চাপ দেয়।আরিয়ানকে ফাঁসাতে হবে।পুলিশ এসে কুঁড়ে ঘরের সামনে দাঁড়ায়।মেঘ তখন দরজা খুলে দাঁড়ায়,চোখে ঘুম নেই, তবুও বুকভরা সাহস।কেন এসেছেন?আরিয়ান সাহেব কোথায়? তার নামে মারধরের অভিযোগ আছে। মেঘ বলেনি কিছু, কিন্তু ভিতরে গলা শুকিয়ে যায়।
আরিয়ান এগিয়ে এসে পুলিশের সামনে দাঁড়ায়, হালকা হাসে, আর বলে—আমি জানি, আমাকে সরালেই তারা নিশ্চিন্ত।কিন্তু মাফ করবেন, আমি সহজে হারার লোক না।
ঘটনার রাতে মেঘ চুপচাপ রান্না করে,প্রথমবারের মতো নিজে হাতে আরিয়ানের সামনে খাবার রাখে।আর বলে—
তুই যা করছিস সবই আমার জন্য…তবুও আমি তোকে ঘৃণা করি।তুই চাইলে চাইতিস না— আমি তোকে ভালোবাসিস,
আরিয়ান চমকে যায়।তুই কী বললি?”আমি কাজ করতে চাই, নিজের খরচ নিজে চালাতে চাই।তুই যদি সত্যিই ভালোবাসিস, তবে আমাকে আমার ইচ্ছে মতো চলতে দিবি।আরিয়ান মৃদু হেসে মাথা নিচু করে:তুই কাজ কর, স্বাধীন থাক…কিন্তু যদি কেউ তোকে কষ্ট দেয়— আমাকে খবর দিবি।কারণ তুই আমার বউ, আর তোর চোখের কান্না আমার মৃত্যুর চেয়েও কষ্টের।
মেঘ শহরের এক বুটিক হাউজে কাজ শুরু করে।
সাধারণ সেলস গার্ল, কিন্তু নিজের ভেতর অসাধারণ সাহস আর মেধা নিয়ে।সহকর্মীরা তার রূপ, রুচি, ব্যাবহার দেখে মুগ্ধ হয়।কিন্তু মেঘ কাউকে পাত্তা দেয় না।তার কাছে কেউই আর নিরাপদ না— শুধু একজন বাদে, আরিয়ান।
যাকে সে ঘৃণা করেই ভালোবাসে!
রাতে আরিয়ান এসে দেখে মেঘ ক্লান্ত হয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছে।সে পাশে বসে চুপচাপ তার মুখের দিকে তাকায়।
সামান্য একটা চুল গালের পাশে নেমে এসেছে,সে হাত বাড়িয়ে সেটাকে সরিয়ে দেয়।তারপর ফিসফিস করে বলে…
তুই যদি জানতিস আমি তোর থাপ্পড় খেয়ে প্রেমে পড়ছি…
তাহলে হয়তো তুই কখনো সেই থাপ্পড় মারতি না, মেঘ।
মেঘ এখন শহরের এক জনপ্রিয় বুটিক হাউজে চাকরি করে।তার মেধা, রুচি আর চেহারা খুব অল্প সময়েই তাকে আলাদা করে তোলে।কিন্তু তার ভেতরটা এখনো আগুনে পোড়া ছাইয়ের মতো—বিশ্বাসহীন, জড়, নিঃশব্দ।
এই অফিসেই প্রথম পরিচয় হয় জিদান নামের এক ছেলের সঙ্গে।ভদ্র, শিক্ষিত, মার্জিত—আর প্রথম দিন থেকেই মেঘকে একটু বেশিই খেয়াল করে।আপনার চোখে এত গল্প লুকিয়ে থাকে,যেন আপনি হাসলেও কান্না ঝরে পড়ে…
জিদানের এমন কবিতার মতো কথা শুনে মেঘ চুপ করে থাকে।সে কিছুই বলছে না, কিন্তু তার চোখের কোণায় অদ্ভুত একটা অস্বস্তি জমে।
আরিয়ান এসে দেখে মেঘ আয়নায় দাঁড়িয়ে চুল বেঁধে অফিসের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।হালকা কাজল, ঠোঁটে একফোঁটা লিপস্টিক।আরিয়ান হেসে বলে—তুই তো এখন বেশ স্টাইল করিস…মেঘ জবাব দেয় না।আরিয়ান একটু পর হঠাৎ বলে—আজকে এক ছেলে তোকে নামিয়ে দিয়ে গেলো?মেঘ তাকায় না, মুখ নিচু করে শুধু বলে,হ্যাঁ, অফিসের নতুন কলিগ।
আরিয়ান চুপ।তার বুকের মধ্যে কী যেন গর্জে ওঠে।
সে বুঝতে পারে না—কেন একজন মেয়ে যাকে সে জোর করে বিয়ে করেছে, যার ঘৃণা তার রক্তে বসানো,
তাকে নিয়ে হঠাৎ এমন অসহ্য একটা অধিকারবোধ কেন জন্ম নিচ্ছে?
সে শুধু ফিসফিস করে বলে—তুই কি তাকে পছন্দ করিস?
মেঘ ধীরে বলে—না… কিন্তু তোকে তো করি না।তাই অন্য কেউ করলে কি দোষ?আরিয়ান আর কিছু বলে না।
সে কাঁপা হাতে সিগারেট ধরায়।তার চোখে অন্ধকার… বুকের ভেতর দাউ দাউ আগুন।
এক সন্ধ্যায় মেঘ অফিস থেকে ফিরছে।হঠাৎ একদল ছেলে তার পিছু নেয়।ভয় পেয়ে সে ছুটতে থাকে।ঠিক তখনই পেছন থেকে একটা বাইক এসে দাঁড়ায়।আরিয়ান।তার চোখে আগুন।মুখে কোনো শব্দ নেই।সে বাইকে উঠিয়ে মেঘকে নিয়ে যায় একেবারে নদীর ধারে।
সেখানে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বলে—তোর পিছু নেয়া ছেলেগুলোর একজন যদি তোকে ছোঁত, আমি খুন করে ফেলতাম।তুই কে?মেঘ চিৎকার করে, তুই কে আমাকে এমন বলার?তোর স্বামী…আরিয়ান গর্জে ওঠে,জোর করে হইছি, কিন্তু এখন তোর জন্য জানও দিয়ে দিতে পারি!
মেঘ কিছু বলে না।সে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরে আসে।
আরিয়ান পেছন থেকে এসে বলল—তুই চাইলে আমি সব ছেড়ে দিতে পারি,কিন্তু তুই কি একটিবারও বিশ্বাস করবি,
আমি তোর আসলেই কিছু?মেঘ ঘুমায় না।আরিয়ানও না।
তারা দুজনেই দুদিকে শুয়ে।কেউ কারও দিকে ফিরছে না।
কিন্তু তাদের মাঝখানে…একটা অদৃশ্য সেতু তৈরি হচ্ছে,
যেটার নাম— ভয়ংকর সত্য, ভয়ংকর ভালোবাসা।
সকালবেলা আরিয়ান উঠে দেখে—মেঘ রান্নাঘরে।
সে চুপ করে ভাত বসাচ্ছে, ডাল ফুটছে, সবজি কেটেছে।
আরিয়ান হঠাৎ হেসে বলে—আজকে কী হয়েছে? রান্না করছিস?মেঘ কোনো উত্তর দেয় না।আজকে বুঝি মুড ভালো?
মেঘ কাঁপা গলায় শুধু বলে—তুই আমার জন্য লড়ছিস…
আমি হয়তো তোকে এখনো ক্ষমা করতে পারি না,কিন্তু… আমি চাই না, তোর কিছু হোক।আরিয়ান প্রথমবার তার চোখে কিছু দেখে…স্নেহ… না, হয়তো এক বিন্দু ভালোবাসা।
অফিসে জিদান মেঘকে এক কোণে ডেকে বলে—তুমি হাসো না কেন?এই মুখে তো পুরো পৃথিবী বসতে পারে…
মেঘ বিরক্ত হয়।আপনি এসব বলতে আসেন কেন?
জিদান এবার সরাসরি বলে—তুমি কী জানো, আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?তুমি চাইলে… আমি তোমায় এই বিয়ে থেকে মুক্ত করতে পারি।তোমার এখনো সময় আছে। আমার হাত ধরো মেঘ!
মেঘ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে…তারপর ধীরে ধীরে বলে—
আমি কারো হাত ধরার মতো মানুষ নই আর, জিদান।
আমার কাঁধে এমন বোঝা, যেটা ভালোবাসা দিয়ে মুছা যায় না।প্লিজ, আমাকে আর টান দিয়েন না…
বৃষ্টির বিকেল।মেঘ ভিজে অফিস থেকে ফিরছে।আরিয়ান দরজা খুলে দাঁড়ায়, মেঘের অবস্থা দেখে তার বুক কেঁপে ওঠে।সে ছুটে গিয়ে তোয়ালে দিয়ে মেঘের মাথা মুছাতে যায়।মেঘ ধাক্কা দিয়ে বলে—তুই সব সময় হিরো সাজিস কেন? আমি তো তোকে ঘৃণা করি!
আরিয়ান জোরে কিছু না বলে শুধু বলে—ঘৃণা করিস, ঠিক আছে…কিন্তু ঠাণ্ডা লাগলে তো আমি ছুটে আসবই, তুই না চাইলেও।দুটো মানুষের মুখের মধ্যে ঘৃণার শব্দ,কিন্তু চোখের মধ্যে জমে থাকা ভালোবাসার জল কেউ দেখছে না।
রাতে মেঘ আচমকা চিৎকার দিয়ে উঠে বসে—একটা দুঃস্বপ্ন!আরিয়ান দৌড়ে আসে।কি হয়েছে?আমি দেখেছি… তুই নাই!তুই কি ভয় পেয়েছিস?মেঘ হঠাৎ জড়িয়ে ধরে আরিয়ানকে…কাঁদতে কাঁদতে বলে—তুই মরিস না, প্লিজ মরিস না, আরিয়ান…
আরিয়ান স্তব্ধ।এই প্রথমবার, মেঘ তাকে নিজের ইচ্ছায় ছুঁয়েছে।সে শুধু চোখ বন্ধ করে বলে—তুই কি বুঝছিস, এই মুহূর্তেই আমি সব ছেড়ে দিতে পারি…শুধু একবার বল, তুই তো আমাকে একটু হলেও ভালোবাসিস?
মেঘ কিছু বলে না।চুপ করে থাকে…কিন্তু তার চোখের ভেতর ঝরে পড়ে সেই “অদৃশ্য ভালোবাসা” যা সে প্রকাশ করতে পারে না।অফিসে মেঘ এখনো নিজের মতো কাজ করে।চোখ নিচু, কথা কম, হাসি নেই।জিদান দিন দিন অস্থির হয়ে উঠছে।
সে একদিন মেঘকে অফিস শেষে বাইরের ক্যাফেতে যেতে বলে।মেঘ প্রথমে না করে, পরে না চেয়েও যায় ।সেখানে গিয়ে জিদান হঠাৎ বলেই ফেলে—তুমি আমাকে পাত্তা দাও না ঠিক আছে,কিন্তু তুমি বুঝতে পারো না,তোমাকে না পেলে আমার ভেতরের মানুষটা মরছে প্রতিদিন।
মেঘ রেগে উঠে বলে—ভালোবাসা মানে কি দাবি করা?
তুমি কে আমাকে এমনভাবে আটকে ধরার?
জিদানের চোখে অদ্ভুত রাগ—এই প্রথম… সেই মিষ্টি ছেলেটা অন্ধকার লাগছে মেঘের কাছে।আরিয়ান তোকে ভালোবাসে?না কি তুই ভয় পেয়ে তার পাশে আছিস?
এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিন, মেঘ অনুভব করে কেউ তাকে অনুসরণ করছে।রাতের বাসে ফিরলেও, পেছনে একটা বাইক থেমে থাকে,রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেও কারো ছায়া টের পায়।একদিন সাহস করে সে পিছনে তাকায়—জিদান।তার চোখে অদ্ভুত একটা অন্ধকার,যেটা ভালোবাসার নয়— দখলের।
মেঘ তার মুখের সামনে বলেই দেয়—একটা কথা শোনো…
আমি ভালোবাসতে পারি না,আমি শুধু আরিয়ানকে ঘৃণা করতে পারি—কিন্তু তোমায় ভয় পাই।প্লিজ, আমাকে ফলো করা বন্ধ করো!জিদান হাসে…তুমি তো এখনো বোঝোনি, ভালোবাসা যত বেশি অস্বীকার করো, তত গভীর হয়…
সেদিন রাতে, মেঘ আরিয়ানকে কিছু বলেনি।কিন্তু আরিয়ান ওর মুখ দেখে সব বুঝে ফেলে।সে শুধু জিজ্ঞেস করে—কে ছিল আজকে তোর পেছনে?মেঘ কাঁপা গলায় বলে—একটা ছায়া…
আরিয়ান রাগে ফুসে ওঠে।তুই আমার একটা কথা রাখবি?
কি?তুই যদি একদিন না ফিরিস, আমি এই শহরটাই জ্বালায়ে ফেলব…কারণ তোরে হারানোর মানে আমি নিজেকে হারানো…
রাতে টিনের চালে বৃষ্টি পড়ছে।মেঘ ভেজা চুলে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।আরিয়ান পাশে আসে।একটাও শব্দ নেই।তখন হঠাৎ মেঘ বলে ফেলে—তুই আমায় ভালোবাসিস?আরিয়ান ধীরে তার দিকে ফিরে তাকায়…
তারপর হঠাৎই…এক চুমু… মেঘের কপালে।তুই যদি আমার না হোস…তবুও তোকে আমার বলেই মনে হবে সারাজীবন।
মেঘ তার দিকে তাকিয়ে থাকে…চোখে জল, কিন্তু ঠোঁটে এক বিন্দু শান্তি।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প