অভিশপ্ত দোলনা(৩য় পর্ব)

গার্ডের চেঁচানোর শব্দ শুনে লোকটার বাড়ি থেকে তার বউ ও ছেলেমেয়েরা ছুটে আসলো।ঘটনার আকস্মিকতা তারা কেউ বুঝতে পারছিলো না।সবাই শকড হয়ে গেছে।
-কিভাবে এটা হলো?আব্বু এখানে কেন?
লোকটার ছেলে বলে উঠলো।
-আমরা তো জানিনা বাবা,আমরা দেখে এখানে আসলাম।
ওনি আত্মহত্যা করলো কেন?
-জানিনা,,,ও একটু আগে বললো বাইরে দোলনার শব্দ হচ্ছে।আমি দেখে আসি।এটা বলে ঘর থেকে বের হয়েছে।কিন্তু আমার কি হয়ে গেলো।
লোকটার স্ত্রী এভাবে বিলাপ করতে থাকলো।
গার্ড চাচাকে সাথে নিয়ে জায়গাটা থেকে দ্রুত প্রস্থান করলাম।
-চাচা,এইভাবে লোক মারা যাওয়ার কারণ কি আমরা কোনোদিন বের করতে পারবো না?
-ধৈর্য ধরেন স্যার।
-আচ্ছা, এক কাজ করলে কেমন হয়?আপনাদের ম্যানেজারের বাড়িতে চলে গেলে কেমন হয়?
-স্যার,বড় স্যার শুনলে রাগ করবে!
-আরে টের পাবে না,আপনি বাইরে থাকবেন।
-আচ্ছা,চলেন।স্যারের বাসা শহরের শেষ প্রান্তে।
৩ ঘণ্টার পথ বাড়ি দিয়ে ম্যানেজারের বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ১ টা বেঁজে গেলো।নিরিবিলি বাড়ি,আশেপাশে কারো বাড়ি নেই।আমরা গেটের সামনে গিয়ে দেখলাম গেটে তালা ঝুঁলছে।তারমানে কি কেউ নেই ভেতরে?
দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে যখন ফেরত আসছি,হঠাৎই বাড়ির ভেতর থেকে দুমদাম আওয়াজ ভেসে আসলো।দুজনেই থমকে দাঁড়ালাম।বাড়ির গেট লক করা,ভেতর থেকে আওয়াজ আসে কেন?
-চাচা,ভেতর থেকে শব্দ আসছে মনে হলো।
-ও কিছু না,চলেন।
আবারো সেই শব্দ,এবার সাথে সেই পরিচিত হাসি।গার্ড চাচা কাচুমাচু করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-বাড়িতে আমার একটা ছোট মাইয়া আছে।আমার জন্য প্রতি রাতে অপেক্ষা করে।দেরী করে বাড়ি ফিরলে ওর মায়ের সাথে ঝগড়া করে ঘুমিয়ে পড়ে।আমি চলে যাচ্ছি।
বুঝলাম চাচা ভয়ে যেতে চাচ্ছে না।কিন্তু আমাকে পিঁছু হটলে হবে না।আমার জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমি।হয়তোবা আজকে কোনো ক্লু পেতে পারি আমি।
গার্ড চাচাকে বিদায় করে দিলাম।
-চাচা,তাইলে যান।আমি ভেতর থেকে ঘুরে আসি।
-না, রাত অনেক হয়েছে।চলেন স্যার বাসায় ফিরে যাই।আপনার বউও তো একা বাসায়?
-আপনি যান।রিতুকে দেখার লোক আছে।
আমি গেলাম।
ম্যানেজার বাড়ির উঁচু দেয়াল টপকে ভেতরে যেতে একটু বেগ পেতেই হলো।পড়ে গিয়ে হাত পা ছিলে গেলো।
তখনো বাড়ির ভেতর থেকে দুমদাম আওয়াজ আসছেই।আমি কয়েক কদম এগোতেই পেছন থেকে কিছু হেঁটে যাওয়ার আওয়াজ পেলাম।ঘুরে দেখতে গিয়ে দেখি কিছুই নেই।
আবারো সামনে হাঁটা ধরলাম,কিন্তু এবার শুকনো পাতার উপর দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে যেভাবে মড়মড় শব্দ হয় সেটা হতে লাগলো।
আয়তুল কুরসী পড়ে বুঁকে ফুঁ দিতে থাকলাম।কিন্তু শব্দ ও অন্যান্য জিনিস বেড়ে যেতেই থাকলো।আরো কিছুদূর এগোতেই বামে একটা দোলনা নজরে আসলো।যেটা থেকে শব্দ আসছিলো।ভালো করে তাকাতেই দেখি সেই মেয়েটা।
ওহ মাই গড,এতটা বীভৎস রূপে আমি তাকে কখনো দেখিনি।মুখটা থেতলানো,দু চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।একবার কল্পনা করুন,কতটা বীভৎস রুপ।তাকে না দেখার ভান করে আমি ম্যানেজারে দরজায় টোকা দিলাম।ভেতর থেকে উত্তর আসার বদলে মেয়েটার কণ্ঠে উত্তর আসলো আমার পিছন থেকে।
-বাঁচার খুব শখ!কিন্তু আজ তোকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।কেউ না,
তোকে অনেকদিন সময় রেখে দেয়া হয়েছে।আজ আর না।মরার জন্য প্রস্তুত হ!
আমি দৌঁড়ে বাড়ির ভেতর চলে গেলাম।ঘরে ঢুকতেই মনে হলো আমি কোনো ভাগারে এসেছি।যা ইচ্ছে অবস্থা রুমের।চারিদিকে শুধু নোংরা আর নোংরা।
কোনোমতে হাতরে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে রুমের লাইট জ্বালালাম।
যা ভেবেছিলাম না, তাই দেখলাম।একটা লোকের রক্তাক্ত দেহ মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।কিন্তু মেয়েটা এখানে কেন?এই ম্যানেজারের সাথে কি তার কোনো সম্পর্ক আছে?
মাথায় থাকা প্রশ্ন নিয়েই রক্তাক্ত লোকটির কাছে গিয়ে বললাম,
-কে আপনি?
-আমি শুভ।
আপনি কি ইভানা পার্কের মালিকের ম্যানেজার?
-হ্যাঁ, আমাকে বাঁচান ভাই।আমি বাঁচতে চাই।
-তার আগে আমাকে বলুন,কেন ওই দোলনায় যে বসে সে মারা যায়?
-ভাই আমি সব বলবো,প্লিজ আমাকে বাঁচান।
লোকটার আকুতি আমার সহ্য হচ্ছিলো না।তাকে কোনোমতে কোলে তুলে বাইরে আসার জন্য রেডি হলাম।দরজার সামনে আসতেই খুব জোরে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
লোকটাকে সাইডে নামিয়ে দরজা কোনো মতেই খুলতে পারলাম না।
কাঁচের জানালার একটা কাঁচ চেয়ার দিয়ে ভেঙে ম্যানেজারকে নিয়ে বের হয়ে হাসপাতালে যেতে চাইলাম।কিন্তু হঠাৎ মেয়েটার অবয়ব এসে আমাকে গলা টিপে ধরলো।আমি দুই হাত দিয়ে শুভকে ধরে আছি।আর এদিকে ছায়াটা আমার গলা টিপে ধরে আছে। শ্বাস নিতে সমস্যা হওয়ার শুভকে নামিয়ে হাতটাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম।কিন্তু কোনোমতেই পারছিলাম না।চোখের সামনে সমস্ত কিছু ভেসে উঠছিলো।বিশেষ করে রিতুকে ভীষণ মনে পড়ছিলো।
কিন্তু হঠাৎ করে আরেকটা ছায়া এসে মেয়েটার ছায়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।ছিটকে পড়ে গেল মেয়েটা।
গলা ছেড়ে দেয়ার সাথে সাথে আমার কাশির পরিমাণ বেড়ে গেল।
-তুই চলে যা রাশেদ।তোরা এখান থেকে যা।আমি দেখছি।
এই কথাগুলো ওই অবয়ব থেকে ভেসে আসলো।কণ্ঠটা অতি পরিচিত আমার কাছে।
তাহলে কি সেই আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করছে?
কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব। একটা মৃত মানুষ, এত বছর পর এসে আমাকে এভাবে বাঁচাবে কেন?
লোকটাকে সাথে নিয়ে তার গেট থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে আমি চারিদিকে খোঁজ করতে লাগলাম।
বেশি সময় আমার প্রশ্নটাকে মুখের ভেতরে চাপিয়ে রাখতে পারলাম না।
-ভাই, বলেন না প্লিজ।এই দোলনার সাথে আপনার আর ওই মেয়ের সম্পর্ক কি?
লোকটা কোনো কথা বলতে পারছিলো না।শুধু গলা দিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করলো।যেটা শুনতে অনেকটা ‘বিক্রম’ শব্দটার মত শোনালো।
কথাটি বলার পরে লোকটির চোখ বড় বড় হয়ে গেল।মূহুর্তের মধ্যে তার নাক,মুখ ও চোখ দিয়ে রক্ত পড়ার পরিমাণ বেড়ে গেলো।ছটফটানি করতে করতে ম্যানেজারের দেহ থেকে প্রাণটা বেড়িয়ে গেল।
সেই মূহুর্তে আমার কি করা উচিত আমি তা বুঝতে পারছিলাম না।আমার বিশ্বাসই হচ্ছিলো না যে, এক রাতের মধ্যে কিভাবে আমার জীবনে এত কিছু ঘটে গেল।কিন্তু আরো কিছু যে বাকি ছিল,তা আমি কস্মিনকালেও ভাবতে পারিনি।
মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে মাটির দিকে ধরতেই একটা অদ্ভুত জিনিস আমার চোখে বাধলো।মনে হচ্ছিলো ম্যানেজার মারা যাওয়ার আগে হাত দিয়ে একটা সাইন আকার চেষ্টা করেছে।সাইনটা অনেকটা V এর মতো।হ্যাঁ , এটা পরিষ্কার V।
কিন্তু এর মানে কি?
আমি ওখানে আর এক মূহুর্তও থাকলাম না।ম্যানেজারের লাশটাকে ভীতুর মতো ফেলে রেখে আমি আমার পথে পা বাড়ালাম।
এক পা, দু পা করে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে পিছন থেকে রিতুর কণ্ঠে একটা ডাক ভেসে আসলো।
এখানে রিতু আসবে কিভাবে?
-রাশেদ,আমাকে বাঁচাও।আমি আর পারছি না।
-হ্যোয়াট!
আমি ভুল ক্রমে পিছনে তাকালাম।যেটা ছিল সবচেয়ে বড় ভুল।
রাস্তার মাঝখানে একটা দোলনা।সেই দোলনার উপরে সেই মেয়েটি বসে আছে।আমি পিছন ফিরে তাকানোর সাথে সাথে এবার কান্না করা শুরু করলো।
আমি একটুও দাঁড়ালাম না।উলটো পথে দৌঁড় দিলাম।দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আমি একটা বাড়ির সামনে এসে পড়লাম।মনে হচ্ছে কেউ এখানে থাকে না।আমার পিছন থেকে তখনো সেই কান্না,হাসি এসব আসছেই।
আল্লাহর উপর ভরসা করে আমি সেই বাড়িতে ঢুকে গেলাম।মোবাইলের আলোতে লক্ষ্য করলাম বাড়ির ভেতরে একটা কবর।
আমি জানতাম কবরস্থান একটা পবিত্র জায়গা।তাই কোনো চিন্তাভাবনা না করেই আমি সেই কবরের প্রাচীরের মধ্যে ঢুকে গেলাম।এখন শুধু চারপাশ দিয়ে ঝড়ো বাতাস বয়ে যাচ্ছে।কিন্তু আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি,সেখানে কিছুই হচ্ছে না।
আমার হুশ ফিরলো সূর্যের আলো চোখে লাগার পরে।আমি তখনো ওই কবরের মধ্যে।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প