কবর থেকে বের হয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলাম।বাড়িটাকে আমি আগে কখনো দেখিনি।অনেক কষ্টে মেইন রাস্তা খুঁজে বের করলাম।
কিছু সময় পর বাড়িতে গিয়ে দেখি রিতু তখনো কান্না করছে।আমাকে দেখার সাথে সাথে উঠে চলে আসলো।আমার সারা শরীরের অবস্থা দেখে বললো,
-তুমি রাতে কোথায় ছিলে?এই অবস্থা কেন?
-আমি রাতে কোথায় ছিলাম এটা এখন না শোনাই ভালো তোমার জন্য!
তুমি পানি তোলো,আমি গোসল করবো।
রিতুকে এভয়েড করে আমি গোসলে গেলাম।গোসলে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে লাগলাম ‘বিক্রম’ আর ‘ V ‘ সাইনের মানে কি?
গোসল শেষ করে আমি গার্ডের সাথে দেখা করার জন্য বাড়ি থেকে বের হলাম।প্রথমে পার্কে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখি তিনি পার্কে আসে নাই।পার্ক থেকে তার বাড়ির ঠিকানা নিয়ে তার বাড়িতে গেলাম।কিন্তু এ কি?এতো ভীড় কেন?
ভীড়কে পাশ কাটিয়ে ভেতরে গিয়েই দেখলাম মাটিতে গার্ড চাচাকে শোয়ানো।কাহিনী কি জিজ্ঞাসা করতেই একজন বললো,,
-রাতে কোথায় যেন গিয়েছিল!সারারাত বাড়ি না ফেরাতে খোঁজ নিতে বের হলে দেখা যায় একটা রাস্তার পাশে তার মৃতদেহ পড়ে আছে।
তারমানে কি রাতে চাচাকে মেরে ফেলা হয়েছে!ও আল্লাহ,কেন এমনটা হলো তার সাথে।তার মেয়ের কান্না আমি সহ্য করতে পারলাম না।চলে আসলাম।
মাথাটা কাজ করছিলো না।’বিক্রম’ আর ‘V’ সাইনকে নিয়ে ভাবতে লাগলাম।এক বয়স্ক লোকের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম তিনি বিক্রম নামে কোনো কিছুর নাম শুনেছে কিনা?
অনেক ভেবেচিন্তে তিনি বললেন,
-ওদিকটাই একটা বাড়ি ছিলো। নাম বিক্রম ভিলা!
-চাচা, কোনদিকে বলতে পারেন?
-কাটাবনের পাশ দিয়ে গিয়ে পাশের গ্রামটাই।আমি কখনো যাইনি বাবা।
লোকটা ভাঙা ভাঙা গলায় উত্তর দিলো।
আমি আর দেরী না করে কাটাবনের পাশ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।আমি আশ্চর্য হলাম এটা ভেবে যে, রাতে আমি যেই বাড়িতে ছিলাম।এখন ঠিক সেই বাড়ির সামনে আমি!
তারমানে এটাই কি সেই বিক্রম ভিলা?
কিন্তু এ বাড়িটা তো অনেকদিনের পুরোনো বাড়ি।পরিত্যক্ত বাড়ি,মনে হয় ৪০ বছর ধরে কেউ এখানে থাকে না।দেখতেই ভুতুড়ে লাগে।
কিন্তু এর সাথে৷ ‘V’ সাইনের কি যোগসূত্র আছে?
আমাকে আগে এর রহস্য ভেদ করতে হবে।তা না হলে আমি কিছুই বের করতে পারবো না।
আর রহস্য ভেদ করতে হলে আমাকে ম্যানেজার শুভ এর বাসায় যেতে হবে।তার বাড়িতে কোনো না কোনো প্রমাণ অবশ্যই পাওয়া যাবে।
ম্যানেজার শুভ এর বাড়িতে গিয়ে দেখি সকাল সকাল বাড়িটাকে পুলিশ সিলগালা করে দিছে।জন সাধারণের প্রবেশ নিষেধ।
দুজন পুলিশ পাহারায় আছে সামনের দিকটাই।আমি লুকিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।
ঘরের ভেতর সেই আগের রাতের মতোই সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা।
একটা আলমারি দেখে সেটার দিকে এগিয়ে গেলাম।আলমারির ড্রয়ার খুলতেই সেখান থেকে একটা খাতা পেলাম।ভাগ্য ভালো, সেটা পার্কের কিছুর হিসাব।কোন জিনিস কোথা থেকে নিয়ে আনা হয়েছে সেটার নাম ঠিকানা সব লেখা।
পর্যায়ক্রমে খুঁজতে গিয়ে পার্কের দোলনার নাম দেখে চোখ আটকে গেল।
ঠিকানা ঃবিক্রম ভিলা,খোকসা।
এবার আমি পুরোপুরি শিউর হলাম এই দোলনা বিক্রম ভিলা থেকে নিয়ে আসা।কিন্তু কোন দিক দিয়ে যাবো আমি?
দিনের বেলাতেই আমি ম্যানেজারের একটা রুম থেকে দোলনার ক্যাচক্যাচ শব্দ শুনলাম।রুমটার দিকে আগানোর সাহস আমার হলো না।আমি পিছনের দরজা দিয়ে আবারো বের হয়ে আসলাম।
আমি আবারো সেই পুরোনো বাড়ির কাছে চলে গেলাম।ম্যানেজারের দেয়া V সাইনের মানে খুঁজতে লাগলাম।আমি যেদিকটা থেকে এসেছি,তার পাশ দিয়েই আরেকটা রাস্তা চলে গেছে।অনেক ভাবার পরে আমি আবিষ্কার করলাম এটাই সেই V সাইনের রুপ।ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যাবে এটাই V।
আমি সেদিকটাই পা বাড়ালাম।রাস্তাটা গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গেছে।একদম গা শীতল করা পরিবেশ।আমি আস্তে আস্তে পা ফেলাতে থাকলাম।মনে হচ্ছে এদিকটাই ১০ /১২ বছরেও৷ এদিকে কেউ আসে নাই।হঠাৎ করে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল।আমি থমকে দাঁড়ালাম।এই অন্ধকার হওয়া কোনো অশনী সংকেত নয় তো?
হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম তাই।রাস্তার মাঝখানে এ তো সেই দোলনার মেয়েটা।আমাকে তো সামনে এগোতেই হবে।কিন্তু কিভাবে যাবো?মেয়েটা আমার সামনে একটা দোলনা নিয়ে বসে আছে।আমি তাকে দেখে দুই পা পিছিয়ে গেলাম।একটা বাতাস এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো।বাতাসে একটা বিশাল গাছ ভেঙে পড়লো আমার মাথার সোজাসুজি। কোনোমতে সেটা থেকে বাঁচলাম।আমার জীবন মনে হয় আজকেই শেষ হয়ে যাবে!
নিজের কাছে নিজেকে প্রশ্ন করলাম।
-ভয় পেয়ো না রাশেদ।তুমি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দৌঁড় দাও।আমি আছে তোমার সাথে।
সেই কণ্ঠটার সাহস পেয়ে আমি দৌঁড় দিলাম।পিছনে এক প্রকার ঝড় উঠে গেলো।তবুও আমি পিছন ফিরে তাকালাম না।একটা সময় আমি একটা বাড়ি দেখতে পেলাম।হ্যাঁ, এটাই সেই বাড়ি।বড়বড় হরফে লেখা বিক্রম ভিলা।
বাড়ির বিশাল বড় ফটক।চারিদিকে প্রাচীর,দুই পাল্লার একটা বিশাল গেট।যাতে ঝুলছে বড় একটা তালা।
দেয়ালটা কোনোমতে টপকিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।নিস্তব্ধ পরিবেশ,শান্ত বাড়ি।এক পা, দু পা করে যখন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম তখন মনে হলো ভেতরে কেউ কথা বলছে।কে কথা বলছে এটা দেখার জন্য তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম।কিন্তু কেউ নেই।
অজানা ভয়,আর অশেষ আতঙ্ক আমাকে ভাবিয়ে তুললো আমি এ বাড়িতে একা।
ক্রমেই কয়েকজন মানুষের মাঝে কথা বলার পরিমাণ বেড়ে গেল।কিন্তু কে কোথায় কথা বলছে তা আমি ধরতে পারছিলাম না।বাড়ির ভেতরের উপরের বিশাল লাইট টা হঠাৎ করে ভেঙে পড়লো।সারা রুমে কাচ ভর্তি হয়ে গেল।
এবার একটা পুরুষ কণ্ঠ বলে উঠলো,
-তোর মৃত্যু এখনো হয়নি?
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠের এই কথা শুনে এবার আমি ভয় পেয়ে গেলাম।কারণ পরিচিত কণ্ঠটা বললেও একটা কথা ছিল।কিন্তু এই অপরিচিত কণ্ঠটার মালিক কে?
-কে,কে আপনি?
-আমি এই বাড়ির মালিক।
৪০ বছর ধরে এ বাড়িতে আছি।
মাথার মধ্যে একটা বুদ্ধি খেলে গেলো।ইনি আমি কিছু জিজ্ঞাসা না করতেই বলে দিচ্ছে।ইনাকে দোলনার কথা জিজ্ঞাসা করলে কেমন হয়?
-আচ্ছা,এ বাড়ির সাথে কি কোনো দোলনার সম্পর্ক আছে?
-দোলনার জন্যই তো তোমার মৃত্যু হচ্ছে।আর কিছু সময় পরেই সেটা হবে!
কথাটা বলেই হেঁসে উঠলো।
-কিন্তু কেন এই দোলনাটা অভিশপ্ত?
-আজ থেকে কয়েকবছর আগেও আমাদের এই বাড়িটা ভালো ছিল।সুখে ছিলাম আমি,আমার মেয়ে ও আমার স্ত্রী।কিন্তু একটা ঝড় আমাদের সবাইকে শেষ করে দিয়েছে।
-কি সেই ঝড়?
-একদিন এই এলাকায় ঘুরতে আসে একটা লোক।রাতে বাড়ি ফিরতে না পারায় সে আমার বাড়িতে উঠে।আমার মেয়ে তখন বাইরের দোলনাতে বসে ছিল।লোকটার চোখে সেটা আটকে যায়।সে আমার মেয়ের দিকে একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে কিছু সময় দেখে।এরপর সেদিকটাই এগিয়ে গিয়ে বলে, এটা খুব সুন্দর।প্রথমে ভেবেছিলাম আমার মেয়েকে বলছে,কিন্তু পরে দেখি না।সে আমাদের তৈরি রুপার দোলনাটিকে এই কথাটা বলছে।সে কিভাবে দোলনাটা দূর থেকে দেখে বুঝল এটা রুপার তৈরি,এটা আজও আমাদের কাছে ধাঁধা।
তারপর আমার কাছে এসে বলে এই দোলনাটা আমরা নিয়ে যেতে চাই।টাকাও দিতে চায়।কিন্তু এ তে বাঁধ সাধে আমার সদ্য ১৮ তে পা দেয়া মেয়ে।ও দোলনাটাতে কাউকে বসতে পর্যন্ত দিত না।সেই জায়গায় ম্যানেজার দোলনা নিয়ে যেতে চায়।আমরা সবাই এটা দিতে অস্বীকৃতি জানাই।এতে ম্যানেজার রেগে গিয়ে একদল সন্ত্রাসী ভাড়া করে আনে।আমার মেয়েটাকে দোলনার উপরেই পিটিয়ে হত্যা করে।
আমাদের দুজনকেও পিটিয়ে হত্যা করে।সেইদিন আমরা তিনজন অনেক আহাজারি করেছিলাম।কিন্তু কেউ বাঁচাতে আসেনি।
মেয়েটা মৃত্যুর সময় অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিলো,
-এই দোলনা যতদিন থাকবে,এতে যেই বসবে তাকেই হত্যা করা হবে।
কিন্তু ম্যানেজার এই দোলনা নিয়ে গিয়ে বসতে নিষেধ করে রেখেছিল কেন?রুপার দোলনা দেখার জন্য কি তার পার্কে বেশি লোক আসতো?
-তুমিও সেই ভুলটাই করেছো।তোমাকেও মরতে হবে!হা হা হা
আকাশ বাতাস উতাল করে লোকটি হাসতে লাগলো।
হঠাৎ করে ডানদিকের জানালা ভেঙে কিছু একটা রুমে প্রবেশ করলো।এবার আমি আমার সামনে স্পষ্ট তিনটা মানুষের অবয়ব দেখতে পেলাম।
তারা সবাই একসাথে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।
সেই সময়ে সেই আমার পিছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো,
-আমি আছি রাশেদ।
পরিচিত কণ্ঠস্বর পেয়ে পিছনে তাকাতেই আমি যা দেখলাম, তাতে আমি খুব অবাক হলাম।আমার ছোট মা আমার পিছনে।
আমার ছোট কাকার বউ।যিনি আমাকে খুব ভালোবাসতেন।আমি যখন ছোট ছিলাম তখন সে মারা যায়।মারা যাওয়ার আগে আমার হাত ধরে বলে গিয়েছিল,
-তোর ছোট মা তোর পাশে থাকবে সবসময়!
-ছোট মা,তুমি?