-হ্যাঁ, আমি।আমিই তোকে ওদের হাত থেকে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছি।তোকে আজকেও আমি বাঁচাবো।তুই পালিয়ে যা!
-কিন্তু ছোট মা?
-কোনো কিন্তু নেই,তুই পালা!
মেয়েটার আত্মা বলে উঠলো, যতদিন এই বাড়ি ও দোলনা থাকবে ততদিন কেউ আমাদের কিছু করতে পারবে না!
বলেই হেঁসে উঠলো।
-আর যদি কিছুই না থাকে।(ছোট মা)
ছোট মা আমাকে বললো,
তুই এই বাড়িটাকে ধবংস করার কোনো ব্যবস্থা কর।
-কিভাবে?
-তুই কোনোভাবে আগুন ধরিয়ে দে!তারপর দোলনা টাকে শেষ করে দিবি!
আমি বাড়ি থেকে যখনই বের হতে যাবো, তখনই রুমের দরজা জানালা সব বন্ধ হয়ে গেল।আর পুরো রুম অন্ধকার হয়ে গেল।আমি নিজের শরীরটাকেও দেখতে পাচ্ছিলাম না।মনে হচ্ছিলো আমি এক অন্ধকার জগতে তলিয়ে গেছি।
রুমের ভেতরে কারো দাপাদাপির আওয়াজ স্পষ্ট আমার কানে আসছিলো। হঠাৎ একটা কাঠের টুকরা এসে আমার মাথায় লাগলো। আমি মাথা ধরে রুমের মধ্যে বসে পড়লাম।কখন আমি জ্ঞান হারিয়েছি আমি নিজেও জানিনা।
আমার যখন জ্ঞান ফিরলো রিতু তখন আমার মাথায় পানি ঢালছে।চোখ মেলে আমি আমার রুম দেখতে পেলাম।
-রিতু, আমি এখানে কিভাবে?
-তা তো জানিনা,বাইরে কারো গোঙানির আওয়াজ শুনে বাইরে যাই!গিয়ে দেখি তুমি পড়ে আছো।মাথা দিয়ে রক্ত পড়ছে।
আমার তখন মনে হলো ছোট মা আমাকে নিয়ে আসছিলো হয়তোবা।নাহলে আমার কি হতো কে জানে?
*
একটা বিষয় আমার কাছে কোনোভাবেই পরিষ্কার হচ্ছিলো না।সেটা হলো, যেই দোলনা নিয়ে এতকিছু হয়ে যাচ্ছে।সেই ঘটনা কি পার্কের মালিক জানে না?না তিনি জেনেও চুপ করে আছে।আমাকে এ বিষয়ে জানতে হবে!কিন্তু তার কাছে পৌঁছানোর উপায়?
সেদিন মাথার ব্যথার যন্ত্রণায় আমি বিছানা ছেড়ে উঠতে পারলাম না পর্যন্ত।ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিলো।মনে হচ্ছিলো আমার আয়ু বোধহয় এবারই শেষ।
রাতে দোলনার দোলার শব্দে ঘুম ভাঙলো।
ঘুম ভেঙে শুনতে পেলাম কেউ একজন করূণ সুরে কান্না করছে।
ততক্ষণে রিতুও ঘুম থেকে উঠে পড়েছে।আমি বিছানা থেকে উঠতে গেলে মাথায় প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করি।তাই আর বিছানা থেকে উঠিনা।
কান্নার পরিমাণ আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে।এবার শুধু একজন কান্না করছে না।তিনটা ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলাম।
বাইরের দিক থেকে আওয়াজ আসছে।
-আমাকে বাঁচাও আম্মু।আমাকে বাঁচাও আব্বু।আমাকে ওরা মেরে ফেললো।তোমরা কোথায়?আমি মরে গেলাম।
এতটা করুণ সুরে আর্তনাদ করছিলো যে মনে হচ্ছিলো সত্যি সত্যি ওপাশের রুমে ও বাইরে কাউকে হত্যা করা হচ্ছে।
এসব বলার পরের সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।বুঝতে বাকি রইলো না এটা সেই শয়তানদের কাজ!
রিতু ভয়ে অস্থির হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।কিছু সময় পরে মনে হলো কে যেন কাঁথার মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করতেছে।দুজনের কাছেই এমন মনে হওয়ার সাথে সাথে লাইট জ্বালালাম, কিন্তু কিছুই দেখলাম না।আমার নিজের সাথে এমন হবে, আমি দোলনায় বসার আগে কোনোদিন ভাবতে পারিনি।
লাইট অফ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।লাইট জ্বালানো থাকলে আমার ঘুম হয়না।আধা ঘণ্টা পরে রিতুর চিৎকারে মাথার ব্যথা নিয়েই বিছানায় বসে পড়লাম।
-রাশেদ, কে যেন আমার পা ধরে টান দিয়েছে!
-কই,আমার তো মনে হলো না।
-টান আমাকে দিয়েছে।আমার পা জ্বলছে।
লাইট অন করে দেখি রিতুর পায়ে কারো আঁচরের দাগ।সত্যি সত্যিই বিছানার তলা থেকে কে যেন তার পা ধরে টান দিয়েছে।এবার মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে খাটের তলায় দেখার জন্য রিতুকে বললাম।সে দেখতে গিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো।খাটের তলায় সে বীভৎস কিছু একটা দেখেছে।পরক্ষণেই আমি দেখতে গিয়ে কিছুই পেলাম না।
সে রাতে আর ঘুম হলো না।একটা ট্যাবলেট খেলাম যাতে ব্যথা কমে।
ব্যথা কমতে কমতে দুপুরের পরে গিয়ে কমলো।সেদিন সকালের দিকে টিভিতে একটা নিউজ দেখলাম যেখানে পার্কের মালিকের ম্যানেজারে এমন মৃত্যুর জন্য তার কাছে রিপোর্ট করার জন্য সাংবাদিকরা গিয়েছে।তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন, সেই জায়গাটাতে একটা সাইনবোর্ড দেখলাম।শোমসপুর,খোকসা।
তারমানে তিনি খোকসাতেই থাকেন।হয়তোবা ওখানে গেলে তাকে পাওয়া যাবে।
বিকেলের শেষ দিকে শোমসপুর বাজারে চলে গেলাম।টিভিতে তার নাম দেখেছিলাম।সেই নাম বলতেই একজন তার বাড়ি দেখিয়ে দিল।
দারোয়ানের সাথে কথা বলে সেই বাড়িতে ঢুকলাম।সুনসান বাড়ি,তিনি সোফায় বসে নিউজপেপারে চোখ বুলাচ্ছে।আমাকে দেখে বললেন,
-কে আপনি?কিছু দরকার?
-হ্যাঁ, দরকার।সোজা ভাবেই আপনাকে বলছি।
দোলনায় বসার কারণে মানুষের মৃত্যু হয়,তবু সেই দোলনা আপনি কেন পার্ক থেকে সরান নি?
-আপনাকে আমি জবাব দিতে বাধ্য নই।
-আপনি বাধ্য।এর সাথে মানুষের জীবন -মৃত্যু জড়িত!
-সেটা আমার দেখার বিষয় না।
-প্লিজ বলেন,আমি আপনার কাছে হাতজোড় করছি।ভুল করে দোলনাতে বসে আজ আমি যতরকমের সমস্যা আছে, সবকিছুর মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
-সেটা আপনার বিষয়!
প্রচন্ড রকমের রাগ উঠে গেলো।পাশে থাকা টব টা তার মাথার সোজা ধরে বললাম,
-আপনি বলবেন কি না?
-বলছি,বলছি।
আসলে আমি জানতাম এই দোলনায় বসলে মানুষের মৃত্যু হয়।তবুও রেখেছিলাম কারণ এটা রুপার তৈরি হওয়ার অনেক দূর থেকেও মানুষ দেখতে আসতো।
কিন্তু আমি তো সাইনবোর্ড দিয়ে রেখেছিলাম না বসার অনুরোধ করে।
-কিন্তু সেটা একটা অফ সাইডে।যেখানে কারো নজর যায় না।
আমি আজ দোলনাটা ধবংস করে দিবো।পারলে ঠেকায়েন।
তাকে আর বেশিকিছু বললাম, লোকটা যে মারাত্মক লোভী। সেটা তার কথাতেই বুঝতে পারলাম।এদের শাস্তি এরা নিজেরাই পাবে।
শাকিলকে ফোন করে পার্কে ডেকে আনলাম। সাথে এক বোতল কেরোসিন তেল।ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে।চারিদিকে অন্ধকার অন্ধকার ভাব।পার্কে ঢুকে দোলনাটার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিলাম।
ম্যাচে ঠুকা দিয়ে আগুন ধরালেই সেই আগুন সাথে সাথে নিভে যেতে থাকলো।বারবার এমন হওয়ায় আমি আল্লাহর নাম নিয়ে আগুন ধরিয়ে সেটাকে দোলনায় নিক্ষেপ করলাম।ভালোমতো যাতে আগুন ধরে সেজন্য দোলনার উপরে কিছু কাগজ দিলাম।
একদিকে আগুন জ্বলছে,অন্যদিকে মনে হচ্ছে কেউ যেন পার্কটাকে উল্টাপাল্টা করে দিচ্ছে।আমরা দুজন সেদিকে খেয়াল না করে পার্ক থেকে বের হয়ে আসলাম।
মাথার যন্ত্রণা তখনো একটু একটু আছে।আমি শাকিলকে বাড়িতে চলে যেতে বললাম।রিতু বাড়িতে একা ভয় পাবে।
একা একা সেই বিক্রম ভিলার পথে রওনা দিলাম।একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে ছোট মা কে উদ্দেশ্য করে দু বার ডাক দিলাম।
-ছোট মা!ছোট মা!
*
-হ্যাঁ, রাশেদ!
আমি আছি।
-ছোট মা,আমার যেতে ভয় লাগছে।
-তুই ভয় পাস না!আমি আছি,তোর কিছু হবেনা।পথে অনেক কিছু তোর সামনে আসবে, ভয় পাবি না।নির্ভয়ে এগিয়ে যাবি।শুধু মনে রাখবি ওগুলো তোর চোখের ভুল।
মনে সাহস নিয়ে আমি হাঁটা দিলাম।সত্যি সত্যিই আমার সামনে বড় বড় সাপ এবং অদ্ভুত কিছু প্রাণী আসতে লাগলো।মনে হচ্ছিলো আমাকে খেয়ে ফেলবে।কিন্তু সেগুলো আমার কিছুই করতে পারছিলো না।
একটা সময় আমি বিক্রম ভিলাতে পৌঁছে গেলাম।আমি গেট দিয়ে ঢোকার সাথে সাথে মনে হলো তিনজন আমাকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে।কেমন যেন ভার ভার মনে হচ্ছিলো।
সেসময় কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কেউ বলে উঠলো,
-দোলনা শেষ করেছিস তো কি হয়েছে!এখানে তুই কিছুই করতে পারবি না।
আমার মা বাবাও আমার সাথে আছে এখন।
ওর এই কথা শুনেই আমি আয়তুল কুরসী পড়ে নিজের বুকে ও চারপাশে ফুঁ দিয়ে নিলাম।এবার হালকা হালকা মনে হচ্ছে।
আমি সাথে থাকা লাইটার বের করে বিক্রম ভিলাতে আগুন লাগিয়ে দিলাম।সাথে সাথে দাউদাউ করে আগুন ধরে গেলো।চারিদিক পুড়ে ছারখার হয়ে গেলো।তিনজনের আর্তনাদ স্পষ্ট আমার কানে ভেসে আসছিলো।এভাবে কিছুসময় চলার পরে আর্তনাদ থেমে গেল।
হয়তো তাদের জীবনচক্র ওখানেই আগুনের সাথে থেমে গেলো।
সেদিন বাড়িতে চলে আসলাম।সে রাতে কোনো সমস্যা হয় নি আর।ছোট মা শুধু একবার বলে গেলো,
নতুন জীবনে শুভকামনা।আমিও আসি।
সকালে ঘুম থেকে উঠে টিভিতে সংবাদ দেখতে গিয়ে দেখলাম,
ইভানা পার্কের মালিকের অদ্ভুতুড়ে মৃত্যু।কিভাবে মৃত্যু হয়েছে,কেউ জানেনা!