‘আমি একবার এক জঘন্য পাপ কাজ করেছিলাম।‘ গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে সুজিত বলল।
আমি সহ উপস্থিত বাকি তিনজন কৌতুক বোধ করলাম। সোবহান সাহেব তো গলা খাঁকারি দিয়ে নড়েচড়েই বসলেন।
আড্ডা জমে গেছে। ভেতর ঘর থেকে ঘনঘন চা আসছে। আমরা বসে আছি সোবহান সাহেবের বসার ঘরে। ভদ্রলোক আমাদের অফিসের ক্যাশিয়ার। সারাক্ষণ হৈ-হুল্লোড় করা লোক। স্ত্রী এবং দুই কন্যা নিয়ে মগবাজার ওয়্যারলেসে একটা দুই বেডরুমের বাসায় থাকেন। আড্ডা দিতে খুব পছন্দ করেন। গত কয়েক বছর ধরে প্রতি মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার সোবহান সাহেবের বসার ঘরে আমাদের চারজনের আড্ডা বসে। তার বড় মেয়ে ইশিতা বিষয়টা একেবারে পছন্দ করে না। মেয়েটা কলেজে পড়ে। আমাদের সামনে তেমন আসে টাসে না। ছোট মেয়েটা অবশ্য আসে। মেয়েটার নাম ইতি। ইতি মাঝেমাঝেই আমাদেরকে দু-চারটা ছড়া শুনিয়ে দিয়ে যায়।
আমি আর সোবহান সাহেব ছাড়া বাকি দুজন রশিদ আর সুমন। এরা দুজন মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট এ বিভিন্ন পোস্টে কাজ করে। রশিদ বিয়ে করে নি। ব্যাচেলর মেসে থাকে। ফার্মগেট মোড়ের কাছাকাছি কোন এক ঘুপচি গলিতে মেস। যত রাতই হোক রশিদ কোনমতেই আড্ডা ছেড়ে উঠতে চায় না। সুমন বিয়ে করেছে মাস দুয়েক হলো। ঘরে তার নতুন বউ একা। রাত বাড়লেই তার বাসা থেকে ফোন আসতে থাকে। বেচারা উঠে যাওয়ার তোড়জোড় করে। আমরা উঠতে দেই না। নানান রকম ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা বলা হয়। নবদম্পতিদের নিয়ে রসালো কৌতুক করা হয়। সুমন চোখমুখ লাল করে বসে থাকে। আমার বাসা থেকে অবশ্য তেমন ফোন-টোন কোনদিন আসে না। আমার স্ত্রী শাহানা ঘুম কাতুরে মেয়ে। সারাদিন ঘরের কাজ করে আর তিন বছর বয়েসি দুষ্টু ছেলেকে সামলে সুমলে রেখে সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও আর জেগে থাকতে পারে না। আমার কোনদিন ফিরতে দেরি হলে আমার জন্য না খেয়ে খাবার সাজিয়ে বসে থাকা মানুষ শাহানা নয়।
আমাদের আড্ডায় নতুন মুখ সুজিত। এই ছেলে মাত্রই বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে জয়েন করেছে। বয়স কম, আমাদের অনেকের প্রায় হাঁটুর বয়েসি। মোটা কাঁচের চশমায় ছেলেটার চোখ দেখা যায় না। বড় চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। সারাক্ষণ হাসছে, কথা বলছে। কিন্তু এই ছেলেকে আমাদের এই আড্ডায় আনতে বেগ পেতে হল। সে নাকি রাতে ঘরের বাইরে কোথাও বেশিক্ষণ থাকে না!
রাতে আমাদের খুব ভালো খাওয়া দাওয়া হল। প্রতি আড্ডাতেই হয়। সোবহান সাহেবের স্ত্রীর রান্না বরাবরই অসাধারণ। আজ চিংড়ির দোপেয়াজা ধরণের একটা বিশেষ পদ ছিল। রশিদ মোটামুটি নির্লজ্জের মতো বাটি খালি করে ফেলেছে। খাওয়া দাওয়ার পর বসার ঘরে সবাই আয়েশ করে বসেছি। সুজিতকে নিয়ে কিছুক্ষণ খুব হাসাহাসি হলো। ভেতর থেকে দফায় দফায় চা আসতে থাকলো। আজকের আড্ডায় ভূতের গল্প জমে উঠেছে। প্রথম গল্পটা বলল রশিদ। তার নানার নিজের জীবনের গল্প। এক শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা রাতের ঘটনা। তখন রমজান মাস। তারাবি পড়তে বাড়ি থেকে মসজিদে যাওয়ার সময় নির্জন গ্রাম্য রাস্তায় ভদ্রলোক দেখলেন এক ইয়া লম্বা মানুষের অবয়ব বাঁশঝাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। মুরুব্বীদের কাছে তিনি শুনেছেন রাতে একা একা এদের মুখোমুখি হলে কোনভাবেই ভয় পাওয়া যাবে না। এরা বদ জ্বীন। আয়াতুল কুরসি এদের বিরুদ্ধে মোক্ষম অস্ত্র। রশিদের নানা মনে মনে আয়াতুল কুরসি পড়তে পড়তে ভীত পায়ে সামনে এগুলেন। যতই কাছে যাচ্ছেন অবয়বটি ততোই লম্বা হচ্ছে। একসময় দেখা গেল মানুষটির বাম পা বাঁশঝাড়ের কাছে, ডান পা রাস্তার অন্য পাশে। তাকে যেতে হলে যেতে হবে দুই পায়ের মাঝে দিয়ে। তিনি যখন নিচ দিয়ে যাচ্ছেন তখন উপর থেকে ঝরঝর করে পানি পড়লো মাথায়, তীব্র প্রস্রাবের গন্ধ…। গা ছমছমে গল্প, কিন্তু গল্পের এই পর্যায়ে কাহিনীর মোড় ঘুরে যাবার জন্যই হোক বা রশিদের বলার ভঙ্গির জন্যই হোক একটা হাসাহাসি শুরু হয়ে গেল। ভয় কেটে গেল।
এরকম সময় সুজিত নিজে থেকে তার নিজস্ব এক অভিজ্ঞতার গল্প বলতে চাইলো। ভূতের গল্প সাধারণত কারো নিজের অভিজ্ঞতা হয় না। সবই শোনা বা খুব কাছের মানুষের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা। এই ছেলে বলতে চাচ্ছে নিজের জীবনের ঘটনা। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের আগ্রহ বেড়ে গেল। সাথে কিছুটা কৌতুকও বোধ করলাম। এই ছেলে নাকি রাতে বাসার বাইরে বেশিক্ষণ থাকে না। অথচ রাত দশটা বাজতে চলল সে এখন তার জীবনের এক অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতার গল্প ফেঁদে বসেছে।
গরম চায়ের ধোঁয়ায় সুজিতের চশমার ভারী ঘোলা কাঁচ আরো বেশি ঘোলা হয়ে আছে। আমরা সবাই অপেক্ষা করে আছি সুজিত কি পাপ করেছিল শোনার আশায়।
সুজিতের ভুতুড়ে অভিজ্ঞতার গল্পটা তার নিজের ভাষায় এরকমঃ
“আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। প্রায় শেষের দিকে। দুটা মাত্র কোর্স বাকি। থাকি কাকলিতে এক মেসে। মেসটা এক গলির শেষ মাথায়। গলির মাথায় সোডিয়াম ল্যাম্প সারাবছর নষ্ট থাকে। জায়গাটা ছিনতাইকারীদের খুব প্রিয়।
মেস থেকে কিছু দূরে রিকশার গ্যারেজ। গ্যারেজের সামনে চায়ের দোকান। অনেক রাত পর্যন্ত এই দোকান খোলা থাকে। রাত দুপুরে সিগারেট খেতে ইচ্ছে হলে আমি আর শাওন এই দোকানে আসি।
আমাদের ফ্ল্যাটে আমরা তিনজন থাকি। আমি, শাওন আর নুরুল। শাওন আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। ইউনিভার্সিটির শুরু থেকেই আমরা দুজন এই মেসে আছি। নুরুল ছেলেটা এসেছে মাত্র কয়েক মাস হয়েছে। মফস্বল থেকে এসেছে। নতুন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। মাথামোটা ধরণের ছেলে। আমাকে আর শাওনকে মাঝেমাঝেই হাস্যকর সব প্রশ্ন করে। আড়ালে আমরা নুরুলকে নিয়ে হাসাহাসি করি।
আমরা থাকি তিনতলায়। বাড়ির ডিজাইন বেশ পুরনো। তিনতলা বিল্ডিং হলেও দোতলার ছাদ বলে একটা ব্যাপার আছে। ব্যাপারটা এমন, নিচতলা আর দোতলায় যেকয়টা ঘর আছে তিনতলায় তারচেয়ে একটা ঘর কম। এই ঘরের জায়গাটাকে বলা হচ্ছে দোতলার ছাদ। এই ছাদে বাড়িওয়ালার পরিবারের লোকজন বিকেলে হাওয়া খেতে ওঠে। ছাদটা নুরুলের ঘরের জানালা দিয়ে সরাসরি দেখা যায়।
আমাদের সেমিস্টার প্রায় শেষের দিকে। পরীক্ষা হয়ে গেছে, রেজাল্ট বাকি। দুজনেই চাকরি খুঁজছি। এমন সময় ঘটনাটা ঘটালাম।
এক রাতে আমার চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। আমি শাওনকে নিয়ে নিচে নামলাম। রাত তখন একটা কি দেড়টা। হাতে কাজ কর্ম তেমন নেই। এরকম অবস্থায় যা হয়, আমার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি এলো। শাওনকে বললাম, চল আজকে রাতে নুরুলকে ভয় দেখাই।
ছেলেমানুষি চিন্তা। কিন্তু শাওন এক কথায় রাজি। কলেজ জীবন থেকে আমার সব বদ মতলবের সঙ্গী শাওন।
আমাদের সলিড প্ল্যান। দোতলার ছাদে রাতে কখনোই আলো থাকে না। নুরুলের জানালা দিয়ে অন্ধকার ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকলে এমনিতেই গা ছমছম করে। আমরা এই ছাদে উঠে নুরুলকে ভয় দেখাবো। জায়গাটা অন্ধকার হওয়ায় আমাদের কাজ তেমন কঠিন না। শাওনের একটা ছোট টর্চ আছে। সে থুতনির কাছ থেকে টর্চের আলো মুখের উপর ফেলে আমাকে দেখাল। বেশ ভয়ঙ্কর দেখায়। আইডিয়া মন্দ না। কোন এক ইংলিশ সিনেমা থেকে এই আইডিয়া ধার করা। অন্ধকারে হঠাৎ তাকে দেখলে যে কারো পিলে চমকে যাবে। আমি এসব কোন ঝামেলায় গেলাম না। এমনি রওয়ানা দিলাম। অন্ধকার ছাদ থেকে নুরুলের নাম ধরে ডাকলেই বেচারা ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলবে বলে আমার ধারণা।
রাত তখন তিনটার মতো হবে। নুরুল অনেকরাত জেগে পড়ে। কিছুক্ষণ হলো তার রুমের বাতি নিভেছে। আমরা ধীরে সুস্থে সিঁড়ি দিয়ে নেমে দোতলার ছাদে উঠলাম। আকাশে অর্ধেক চাঁদ। কিন্তু চারদিকে পূর্ণিমার মতো থইথই আলো। আমি শাওনকে ফিসফিস করে বললাম এতো চাঁদের আলো থাকবে জানলে আজকে আসতাম না। শালা হয়তো কোন ভয়ই পাবে না।
শাওন আমাকে থামিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেল। নুরুলের জানালায় দুবার খটখট শব্দ করে সে নিচে বসে পড়লো। তার দেখাদেখি আমিও নিচে বসলাম। নুরুল হয়তো ভয় পেয়ে উঠে বসেছিল। সে চেঁচিয়ে বলল, কে? বাইরে কে? ছেলেটা কয়েকবার আমাদের দুইজনকেও ডাকলো, শাওন ভাই। সুজিত ভাই।
আমরা কোন কথা বললাম না। শাওন মাটিতে টর্চ ঠুকে ঠুকে একটা গানের সুরের মতো কিছু তৈরি করার চেষ্টা করলো। আমরা দেখলাম জানালা দিয়ে নুরুলের ভয়ার্ত মুখ বাইরে উঁকি দিলো। শাওন সেই মুহূর্তে নিজের মুখে টর্চ না ধরে নুরুলের দিকে তাক করে সুইচ টিপে দিলো।
তারপর ধপ করে একটা শব্দ হলো। নুরুলের আর কোন সাড়াশব্দ পেলাম না।
আমরা তখন হেসে কুল পাই না। গাধাটা কি সত্যিই অজ্ঞান হয়ে গেল? তিনতলায় উঠে গিয়ে আমরা অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কাধাক্কি করলাম। নুরুল দরজা খুলল না। পরদিন দেখলাম নুরুলের চোখের নিচে কালি। রান্নাঘরে নুরুলের খাবার পড়ে রইলো। সে কিছু খেল না। আমরাও নুরুলকে কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। দূরে দূরেই থাকলাম সারাদিন।
আসল ঘটনা শুরু হলো সেদিন রাত থেকে।
রাত প্রায় দুইটা বাজে তখন। আমি রুমের বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছি। সকালে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ইন্টার্ভিউ। সারাদিন প্রস্তুতি নিয়ে ক্লান্ত। রাতে ভালো ঘুম দরকার। এমন সময় দরজায় ধুমধুম শব্দ হলো। বাইরে নুরুলের ভয়ার্ত গলা। খুলবো না খুলবো না করেও উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। দেখি ছেলেটা থরথর করে কাঁপছে। মুখে কথা আটকে যাচ্ছে।
শাওনও সিগারেট হাতে রুম থেকে বের হয়ে এসেছে। কাঁপতে কাঁপতে নুরুল যেটা বলল সেটা হলো তার প্রচণ্ড ভয় লাগছে। তার জানালার বাইরে ছাদে দুজন মানুষ বা ‘অন্যকিছু’ প্রতিদিন বসে থাকে। তাকে ডাকাডাকি করে।
আমরা হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারলাম না। বেচারা সত্যিই কঠিন ভয় পেয়েছে। বারবার একই ভয় পাচ্ছে।
আমরা নুরুলকে ব্যাপারটা বলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বললাম গতকাল রাতে আমরাই তাকে ভয় দেখিয়েছি। কিন্তু কোন কারণে নুরুলকে কোনভাবেই কথাটা বিশ্বাস করানো গেল না। তার সেই এক কথা, এইমাত্র সে দুজন মানুষ বা ‘অন্যকিছু’কে দেখে এসেছে। অথচ আমরা দুজন আমাদের ঘরেই বসে আছি।
আমি আর সময় নষ্ট করলাম না। সকালে ইন্টার্ভিউ। নুরুলকে শাওনের রুমে রেখে নিজের রুমে চলে আসলাম।
অবাক ব্যাপার নুরুলের এই ভয় গেল না। প্রায় প্রতিদিন রাতে সে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকলো। যত দিন যায় নুরুলের অবস্থা আরও খারাপ হয়। এদিকে আমাদের রেজাল্ট হলো। শাওন চাকরি নিয়ে নারায়ণগঞ্জ চলে গেল। মেসে থাকি শুধু আমি আর নুরুল। শাওনের রুমের জন্য নতুন ভাড়াটিয়া খোঁজা হচ্ছে।
একদিন রাতে খাবার পরে নুরুল আমার ঘরে এলো। অনেকক্ষণ একথা ওকথা বলে বলে একসময় ইতস্তত করে বলল, সুজিত ভাই আজকে আমি আপনার রুমে ফ্লোরে ঘুমাই?
জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? তোর রুমের কি হয়েছে?
সে কিছু বলল না, মাথা নিচু করে রইলো। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। নিতান্ত মাথামোটা গাধা ধরণের ছেলে। একে ধমক ধামক দিলেও তেমন কাজ হবে বলে মনে হলো না। আমি মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে বললাম, নুরুল এসব তোর মনের ভয়। তোকে যে ভয় দেখিয়েছিল সে এখন নারায়ণগঞ্জ থাকে। অথচ তুই প্রতিদিন সেই একই ভয় পেয়ে যাচ্ছিস।
নুরুল এবারও কিছুই বলল না। নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার একটু মায়া হলো। ছেলেটার এই ভয়ের জন্য তো আমিই দায়ী। তার ভয়টা ভাঙ্গাতে হবে। আবার বললাম, দেখ নুরুল আমার রুমে ঘুমানো তো সমাধান না। তারচেয়ে চল আজকে আমি তোর রুমে থাকবো। দেখি তোর ভুত আজকে আমাকে ডাকে কিনা।
নুরুল যেন অনেকদিন পর একটু হাসলো। আমি বালিশ নিয়ে চলে গেলাম তার রুমে। ছেলেটা গোছানো। ফ্লোর ঝকঝকে পরিষ্কার। আমি মোটা একটা কাঁথা ফ্লোরে পেতে শুয়ে পড়লাম। অনেকরাত পর্যন্ত আমার মোবাইল টেপাটিপি করা অভ্যাস। আজকেও তাই করছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে নুরুলের নাক ডাকার শব্দ শুনতে পেলাম। নাক ডাকাডাকি আমি দুচোখে দেখতে পারি না। এই শব্দের মধ্যে আজ আর ঘুম হবে না। ঠিক এমন সময় আমি একটা প্রচণ্ড ভয় পেলাম। কোন কারণ ছাড়াই সমস্ত ইন্দ্রিয় সচেতন হয়ে গেল। আমি লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। এক মুহূর্তে গলা শুকিয়ে গেছে। জানালায় দুবার খটখট শব্দ হলো স্পষ্ট শুনতে পেলাম।
নুরুল উঠে বসেছে। আমাকে বসে থাকতে দেখে হয়তো বুঝে গেছে আমিও শব্দটা শুনেছি। সে ফিসফিস করে আমাকে ডাকলো, সুজিত ভাই জানালার কাছে আসেন।
ভয়ে আমার পা কাঁপছে। আমি কোনমতে নুরুলের খাটে উঠে গেলাম। জানি না জানালার বাইরে কি আছে বা আদৌ কিছু আছে কিনা। হতে পারে নুরুলের মতো পুরো ব্যাপারটা আমার উত্তপ্ত মস্তিস্কও কল্পনা করে নিচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হলো কোনভাবেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকানো উচিৎ হবে না।
বুঝতে পারলাম নুরুল আমার পাশে বসে থরথর করে কাঁপছে। আমি মনের সকল শক্তি এক করে জানালার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন স্পষ্ট শুনলাম ধাতব কিছু একটা কেউ একজন মাটিতে ঠুকে ঠুকে একটা তাল তোলার চেষ্টা করছে। আমি ততোক্ষণে জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিয়েছি। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। হঠাৎ তাল থেমে গিয়ে তীব্র আলোর ঝলকে চোখ ধাধিয়ে গেল। কিন্তু তার আগের মুহূর্তে আমি দেখলাম ছাদে বসে আছি আমি আর শাওন!”
গল্পের এই পর্যায়ে অনেকেই আপত্তি তুলল। এ কেমন ভূতের গল্প হলো? মৃত মানুষের আত্মা বা জীনের গল্প সবাই শুনেছি। কিন্তু এ তো জীবন্ত মানুষের ভুত! তাও আবার মানুষটা আমাদের সামনে বসে।
ভেতর থেকে আরেক দফা চা আসলো। সুজিত সিরিয়াস মুখে বলল, গল্পের শেষটা কিন্তু এখনো বাকি।
আমরা তখন জানি গল্পটা বানানো। বানানো গল্পের ক্লাইম্যাক্স আরো জমজমাট হবে সেটাই স্বাভাবিক। কাজেই গল্প এখানেই শেষ হবার কথা না।
সুজিত নতুন এক কাপ চা হাতে নিতে নিতে বলল, “কোথায় যেন ছিলাম? ওহ, আমার চোখে তীব্র আলো এসে পড়লো। আমি ঝটকা দিয়ে সরে আসতে গিয়ে নুরুলের গায়ের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। সাথেসাথে এতক্ষণের রক্ত হিম করা ভয় উধাও হয়ে গেল। হঠাৎ করেই একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। ভয় কেটে যাওয়ার পর আবার জানালার কাছে গেলাম। কাউকে দেখলাম না। একা একা টর্চ নিয়ে দোতলার ছাদে গেলাম। কোথাও কেউ নেই।
এই ঘটনার পর আস্তেআস্তে নুরুলের মাথা খারাপ হয়ে গেল। গ্রাম থেকে বাবা-মা এসে ছেলেটাকে নিয়ে গেল। আমি প্রচণ্ড এক অপরাধবোধে ভুগতে থাকলাম। কিন্তু সেদিনের ঐ ঘটনা শাওনকেও কখনো বলা হয় নি।
মেসে তখন আমি একা থাকি। এই চাকরিটার ইন্টার্ভিউ দিলাম, হয়ে গেল। বেতন ভালো, সুযোগ সুবিধা আছে। জয়েন করে ফেললাম। তার আগে আদাবরে বোনের বাসায় গেলাম তাদের সাথে এক সপ্তাহ থেকে আসতে। বোনের দুটো ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে। একজনের বয়স আট, অন্যজনের পাঁচ। দুজনই আমাকে খুব পছন্দ করে। বড়জনের নাম সামির, ছোটটা কায়েস। সারাদিন আমার খুব আনন্দে কাটলো। বাচ্চা দুটোকে নিয়ে নানান জায়গায় ঘুরলাম। রাতে খাওয়া হলে আপা দুজনকে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেও চলে গেলেন। আমি দুলাভাইয়ের সাথে বসে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললাম। দুলাভাই প্রচণ্ড ব্যাস্ত মানুষ। নিজের কয়েক রকমের বিজনেস আছে। কিছুক্ষণ তার সাথে ব্যাবসা বাণিজ্যের আলাপ করে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। আমার হাই তোলা দেখে দুলাভাই উঠে পড়লেন। আমি ঘুমাতে চলে গেলাম।
অনেক রাতে আমার ঘুম ভাঙ্গল চাপা গোঙানির শব্দে। শব্দ আসছে আপা দুলাভাইয়ের রুম থেকে। আপা ভয়ার্ত গলায় আমার নাম ধরে ডাকছেন। আমি ছুটে গিয়ে দেখলাম দুলাভাই জানালার পাশে বসে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে আছেন। দুলাভাইয়ের ভীত মুখ দেখে আমার মুহূর্তেই নুরুলের কথা মনে পড়ে গেল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে দুলাভাই? শরীর খারাপ করেছে?
দুলাভাই কিছু বললেন না। তাঁর হাত পা কাঁপছে। লোকটা কোন কারণে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। আমি এক গ্লাস পানি এনে দিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলাম।
পরদিন ভোরে নাস্তার টেবিলে বসে কোনভাবেই দুলাভাইয়ের মুখ থেকে কিছু উদ্ধার করা গেল না। আমি সেদিনই হোস্টেলে ফিরে চলে এলাম।
হোস্টেলে ফিরে দেখলাম নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। শওকত নাম।
ইউনিভার্সিটি ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। চটপটে ছেলে। আমাকে দেখেই ছুটে এলো গল্প গুজব করবে বলে। আমি সময় দিলাম না। মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। রাতে খেয়ে কোনমতে নিজের রুমে ঢুকে পড়লাম। শওকত ছেলেটা উঠেছে নুরুলের রুমে। রাত বাড়তে থাকলো। আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম অশুভ একটা কিছুর জন্য। মন বলছে আজকে রাতে শওকত ছেলেটাও নুরুলের মতো কিছু একটা দেখে ভয় পাবে। কিছুই হলো না।
পরের কয়দিন শওকতের পরীক্ষা ছিল। তেমন কথা হলো না। কথা হলো বৃহস্পতিবার রাতে। পরেরদিন শুক্রবার, ছুটির দিন। শওকত এলো আমার রুমে। অনেকরাত পর্যন্ত আমরা গল্প করলাম। বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা ছিল। রাত জেগে খেলা দেখলাম। ছেলেটার সাথে ভালোই জমলো আমার। অনেকরাতে শওকত তার রুমে গেল। আমি কম্পিউটার বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়বো ঠিক তখন শওকত ধুমধাম শব্দ করে তার রুম থেকে বের হয়ে এলো। প্রচণ্ড ভয়ে তার মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে। আমাকে বলল, সুজিত ভাই। বাইরে…ছাদে…ছাদে দুটা ভয়ঙ্কর কিছু বসে আছে……”
এইটুকু বলে সুজিত উঠে দাঁড়ালো। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বলল, অনেক রাত হলো। এবার উঠতে হয় সোবহান ভাই।
আমরা হইহই করে উঠলাম। সুমন বলল, গল্পের মানে তাহলে কি দাঁড়ালো? গল্প শেষ না করে কোন ওঠাউঠি নেই সুজিত।
সুজিত নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, এখন আমি একা একটা ফ্ল্যাটে থাকি। সন্ধ্যার পর বাসার বাইরে কোথাও থাকি না। সন্ধ্যার পর যারাই আমার আশেপাশে থাকে তারাই সেদিন রাতে প্রচণ্ড ভয় পায়।
সবাইকে চমকে দিয়ে সোবহান ভাই প্রথমে হো হো করে হেসে উঠলেন। একসময় আমরাও হাসিতে যোগ দিলাম। কিন্তু সবাই মেনে নিলাম গল্পটা বেশ ভালো। মোটামুটি ভয়ের একটা গল্প।
আড্ডার আসর সেদিনের মতো ভেঙ্গে গেল। রাত প্রায় বারোটা। আমরা যার যার বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম। ঢাকা শহরে বারোটা কোন রাতই না। আমি বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে সোজা বাসায় চলে গেলাম। খেয়াল করলাম কোন কারণে ভয় ভয় লাগছে। রাস্তায় দুয়েক জায়গায় সোডিয়াম বাতি নষ্ট। মনে হলো অন্ধকারে কি কেউ বসে আছে? বিরক্ত চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে?
বাসায় পৌঁছে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে হলো। শাহানা বাচ্চাদের সাথে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে। আমি কাপড় ছেড়ে গোসল করলাম। অন্য বেডরুমে ঢুকে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন দেখলাম টেবিলের উপর মোবাইল ভাইব্রেট করছে। রশিদের ফোন। ফোন ধরলাম। রশিদ চুপ করে রইলো। কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করতে ইতস্তত করে রশিদ বলল সে এইমাত্র জানালার বাইরে দুটি লোমশ ভয়ঙ্কর প্রাণীকে বসে থাকতে দেখেছে। আমি না চাইতেও শব্দ করে হেসে উঠলাম। আমি নিশ্চিত রশিদ ইচ্ছা করে আমাকে ভয় দেখানোর জন্য কাজটা করেছে। হয়তো সুমন আর সোবহান ভাইকেও একটু আগে ফোন করে এই কথাগুলাই বলেছে। আমি পাত্তা দিলাম না। রশিদের চালাকি যে আমি ধরে ফেলেছি এটা তাকে জানিয়ে দিলাম। রশিদ চুপ করে রইলো। আমি লাইন কেটে দিলাম।
ঠাণ্ডা পড়ছে। মশারির ভিতরে ঢুকে পড়েছি। ফ্যান জোরে চলছে। কমানো দরকার। এমন সময় আরেকবার ফোন বেজে উঠলো। এবার সুমন। মনে হলো সেও প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। কেন যেন এবারে ব্যাপারটা আর মজা মনে হলো না। এমনসময় প্রায় রজনীগন্ধার মতো কিন্তু তারচেয়ে অনেক বেশি তীব্র একটা গন্ধ আমার নাকে এসে লাগলো। জানালার বাইরে খুব হালকা করে দুবার টোকা দেয়ার শব্দ হল। আমার এই বেডরুম আটতলার উপরে। জানালা থেকে কোন ছাদ দেখা যায় না। পাশে খোলা মাঠ। জানালায় হয়তো কোন শব্দ হয় নি। সবটাই আমার কল্পনা। আমি তবুও কাছে গিয়ে বাইরে তাকালাম। দেখলাম দুটো কম বয়েসি ছেলে মাটিতে বসার মতো করে বসে আছে! একবারও মনে হল না জায়গাটা খালি মাঠ। আমি আছি আটতলার উপরে। বসে থাকার জন্য এতো উপরে মাটি কোথায়? চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখলাম ডানের ছেলেটা সুজিত। তবে আমার পরিচিত মোটাসোটা সুজিত না। এই ছেলেটা শুকনো পাতলা, বয়েস অনেক কম। প্রচণ্ড একটা জান্তব ভয় আমাকে গ্রাস করে ফেলল। তখনো আমার হাতে ফোন ধরা, ফোনের ওইপাশে সুমন। আমাকে চমকে দিয়ে আরেকটা ফোন আমার কাছে এলো। আমি না দেখেই বুঝলাম ফোন করেছেন সোবহান ভাই।