১। সালটা ২০১০। বিয়ে করি আমি। আমরা দুইজনেই মধ্যবিত্ত পরিবারের। আমি একটি রংয়ের ফ্যাক্টরিতে কাজ করি। বিয়েটা হুট করেই করে ফেলেছি। বাবা-মা ছাড়া এতিমখানায় বড় হয়েছি। শুনেছি আমার মা-বাবা দু’জনেই বেঁচে আছেন। আমার যখন ৭ মাস বয়স, তখন মা-ই আমাকে এতিমখানায় রেখে যায়! এর চেয়ে বেশি কিছু কখনো জানতে পারিনি। আসলে জানার ইচ্ছেই হয়নি। মোটকথা, পরিবার পরিচয়হীনভাবেই বেড়ে উঠেছি, তাই বুঝ হওয়ার পর থেকেই সবসময় একটা সুখী পরিবার পাওয়ার স্বপ্ন ছিল আমার।
বিবাহিত জীবন খুব সুন্দর কাটছিল। বছর ঘুরতেই বাবা হওয়ার সংবাদ পেলাম। মানে, স্ত্রী আমার গর্ভবতী। কিন্তু আমার স্ত্রীর যখন গর্ভের ৫ মাস হলো, তখন বাচ্চাটি নষ্ট হয়ে গেল। প্রচণ্ড ভেঙে পড়লাম আমরা। এভাবে পরপর মিসক্যারেজ হলো ৪ বার। শারীরিক কোনো জটিলতা না থাকার পরেও একই ঘটনা বারবার ঘটছে এবং গর্ভের ৫ মাস হতেই সেটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! ব্যাপারটা আমার কাছে স্বাভাবিক লাগলো না।
আমি এবং আমার স্ত্রী গেলাম একজন মাওলানার কাছে। তিনি জানালেন জ্বীনের আছর রয়েছে আমার স্ত্রীর উপর। তিনি পানি পড়া এবং কিছু আমল বলে দিলেন। এরপর কেটে গেল কয়েক মাস। আমরা আবার সন্তান নেওয়ার কথা ভাবতে লাগলাম এবং আবারও খুশির সংবাদ পেলাম। এইবার খুব সাবধানে ছিলাম আমরা। হুজুরের দেওয়া আমলগুলো নিয়মিত করছিল আমার স্ত্রী।
৮ মাসের গর্ভবতী তখন আমার স্ত্রী। এক সন্ধ্যায় এক বৃদ্ধ মহিলা এলো আমার স্ত্রীর কাছে। আমি তখন বাসায় ছিলাম না। মহিলার সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করতে করতে আমার স্ত্রী ভুলে গিয়েছিল আমল করার কথা। মহিলা চলে যাওয়ার পর, হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হলো ওর এবং সাথে ব্যথা উঠে গেল! ভাগ্যক্রমে আমি তখন বাসায় যাই। এই অবস্থা দেখে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বের হই।
গ্রামের রাস্তাঘাট সন্ধ্যার পরেই নিরব হয়ে যায়। রিকশা-গাড়ি পাওয়াও খুব কঠিন। আমি আমার স্ত্রীকে পাঁজাকোলা করে হাঁটতে লাগলাম। ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে বড় হিজল গাছটার সামনে পৌঁছালাম। দেখলাম একজন বয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। আসলে তখন এতই চিন্তিত ছিলাম, আতঙ্কে ছিলাম যে, মাঝ সন্ধ্যায় একজন মহিলা গাছের নিচে কেন থাকবে সেটা চিন্তা করলাম না। আমি দূরে রাস্তার দিকে হাঁটতে লাগলাম। কিছু টং দোকানের আবছা আলো দেখা যাচ্ছে! আমি হাঁটছি তো হাঁটছি, কিন্তু একপর্যায়ে খেয়াল করলাম রাস্তা টা শেষ হচ্ছে না। ঘুরে ফিরে হিজল গাছের নিচেই আসছি আমি! তখন স্ত্রী অবস্থা মারাত্মক খারাপ। এই মুহূর্তে কিছু একটা না করলে খুব খারাপ কিছু হয়ে যাবে।
আমি স্ত্রীকে নিয়ে ওই বৃদ্ধ মহিলার কাছে গেলাম। আমাদের দিকে দৌড়ে আসলো মহিলাটি। মহিলাকে বললাম, “চাচি, আমার বউয়ের ব্যথা উঠছে। কিছু একটা করেন!” সে আমাকে বললো, “আইচ্ছা, আমি দেখতাসি। তুই একটু আড়ালে যা।” আমিও কথামতো একটু দূরে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে রইলাম। সব কেমন ঘোরের মতো লাগছিল। একসময় স্ত্রীর প্রসবের চিৎকার শুনতে লাগলাম। মিনিট দশেক পর বাচ্চার কান্না শুনলাম। পরক্ষণেই সব শান্ত হয়ে গেলো। কোনো শব্দ না পেয়ে পিছন ঘুরে যা তা দেখার জন্য কখনোই প্রস্তুত ছিলাম না। দেখলাম, ঘাড় মটকানো অবস্থায় পড়ে আছে আমার স্ত্রী। তার কিছু দূরে আমার মাথাহীন নবজাত সন্তানের নিথর দেহটাও পড়ে আছে।
হঠাৎ ভয়ংকর এক হাসি শুনলাম গাছের উপর থেকে। উপরে তাকিয়ে দেখলাম ওই বৃদ্ধ মহিলার মতো দেখতে কী যেন একটা গাছে পা দুলিয়ে বসে আছে। কী ভয়ংকর চেহারা। চোখে আগুন জ্বলছে যেন!!! আমি এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারাই। সকালে জ্ঞান ফেরার পর আমার স্ত্রী সন্তানের মৃতদেহটা আর খুঁজে পাইনি।
২। ঘটনাটা আমার নানার। আমি আমার মায়ের মুখে শুনেছি। আমার নানার বাড়ির পিছনে বিশাল এক বাঁশঝাড়ের জংলা ছিল। সেখানে কিছু বদজ্বীন ছিল। জংলার ভেতর একটা ছোট পুকুরও ছিল। সেই পুকুরে কেউ স্বর্ণের অলংকার পরে নামলে সেটা আর গায়ে থাকতো না। কেউ ডুব দিয়ে খুঁজতে চাইলে, এক ধরনের শিকল এসে পেঁচিয়ে ফেলতো। এসব নানা ঘটনার জন্য কেউ আর ওই পুকুরে নামতো না।
তো যাইহোক মূল ঘটনায় আসি। একদিন নানার বাড়ির সবাই পাশের গ্রামে একজনের বিয়েতে যায়। তখন নানা ঘরে একাই ছিল। সন্ধ্যায় নানা বিছানায় শুয়ে তসবী পড়ছিলো। এমন সময় পেছনের দরজায় কেউ একজন টোকাতে টোকাতে বলল, “চাচা, গ্রামে ডাকাত ঢুকছে।” নানা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখে, কেউ নেই সেখানে!! লাইট নিয়ে বের হয়ে গেলো ঘর থেকে এবং খুঁজতে লাগল আশপাশ। নানা টর্চ মারছিলো আর বলছিলো, “এই, আমার সাথে মজা করিস না। কে আছিস? সামনে আয়।”
হঠাৎ ঝড়ো বাতাস শুরু হলো। বাঁশঝাড়ের বাঁশগুলো মাটিতে নুইয়ে পড়ছিলো! বাঁশে-বাঁশে বাড়ি লেগে বিকট শব্দ হতে লাগলো। নানা খেয়াল করলো কিছুটা দূরে লম্বা কালো কাপড় পরা একজন দাঁড়িয়ে আছে (জ্বীন)। আস্তে আস্তে তারা সংখ্যায় বাড়তে লাগলো এবং সামনে এগোতে লাগলো। নানা ভালো জ্বীন পালতো। তারা নাকি বদজ্বীনদের একজনকে মেরে ফেলেছিল। তাই এর প্রতিশোধ নিতেই তারা নানার উপর চড়াও হচ্ছে। একপর্যায়ে বদজ্বীনগুলো নানার অনেক কাছে চলে আসে এবং নানা মাটিতে পড়ে যায়। তখন নানার পালিত জ্বীনগুলো এসে নানার সামনে দাঁড়ায় নানাকে বাঁচানোর জন্য। আল্লাহর রহমতে তখন কয়েকজন লোক ওদিক দিয়ে যাচ্ছিল। তারা নানাকে জংলায় পড়ে থাকতে দেখে ধরে ঘরে নিয়ে যায়। এবং লোকগুলো বুঝতে পারে নানার সাথে খারাপ কিছু ঘটেছে। তাই তারা নানাকে ঘরে ফিরার আগ পর্যন্ত তার পাশে থাকে।
এই ঘটনার পর নানা প্রায় মৃত্যুশয্যাশায়ী হয়ে যায়। মৃত্যুর আগে নানা ঘটনাটি খুলে বলে। এর বেশ কিছুদিন পরই মারা যায় আমার নানা।