চাতক চোখেরা (তৃতীয় এবং শেষ পর্ব)

১১.
সম্ভবত গভীর রাত, আমার হাত পা সবই বাঁধা একটা শক্ত চেয়ারের সাথে। চোখ দুটোও মোটা কাপড়ে বাঁধা। দুই রকম শব্দ পাচ্ছি, কিন্তু খুব মৃদু ভাবে। চারদিক এত শান্ত, নিরব যে ওই সামান্য খসখস বা মৃদু নিঃশ্বাসের শব্দ আমার কানে হাতুড়ি পেটার মত ধরা পড়ছে। বুঝতে পারছি আমার ডানদিকে ফিট সাত আটেক দুরে কেউ বসে আছে। এবং সম্ভবত তাকেও বেঁধে রাখা আছে অথবা মানুষটার চেয়ার থেকে ওঠার মত অবস্থা নেই। আর আমার বামদিকে কেউ একজন সেই আদি আমলের ঘোরানো ডায়ালওয়ালা ফোন ঘুরিয়ে একটা ফোন কল করার চেষ্টা করছে।
তিনবারের চেষ্টায় সম্ভবত লাইনটা পেয়ে গেলো সে।
“স্যার, একটা ঝামেলা হয়া গ্যাছে। একটা মাইয়া আসছিলো সেই সইন্ধ্যাকালে। ঢুকবার চাইছিলো, আমি দেইনাই। কিন্তু আইন্ধার রাইতে লুকায়া বাড়িত ঢুকছে।”
তারমানে আমার বামদিকে চৌকিদার কথা বলছে। তাকে যতটা দুর্বল বয়োবৃদ্ধ ভেবেছিলাম সন্ধ্যার সময়, সে আসলে ততটা দুর্বল নয়। আমার মাথার পিছনে এখনো দপদপ করছে ব্যাথার চোটে।
ফোনের ওই পাশ থেকে সম্ভবত কিছু প্রশ্ন আসলো।
“স্যার, জামশেদ স্যারে তারে এই বাড়ির ঠিকানা দিয়া পাঠাইছে, এমন কথা কইছিলো।” উত্তরে বললো চৌকিদার। ওপাশের কথা শুনতে পাচ্ছিনা, তবে উত্তর গুলো শুনে বুঝতে পারছি কথোপকথনের বিষয়বস্তু।
“জ্বী স্যার, শহইরা মাইয়া। প্যান্ট পড়া। কান্ধে একটা ব্যাগ আছিলো। আমি সরায়ে রাখছি এখন।”
“স্যার, নীচতলার তালা লাগানো রুমটাতে ঢুকছিলো। সব দেইখা ফালাইছে। আর দোতলার রুমে ঢুকতে গেছিলো, পারেনাই। কিন্তু ভিতর থেইকা স্যার নিজেও অনেক চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করছিলো।”
“হ স্যার, আমি এখন দুইজনরে হলরুমে চেয়ারে বাইন্ধা রাখছি। মাইয়ার হাত পা চউখ সবই বান্ধা। আর স্যারের শুধু হাত পা বাইন্ধা রাখছি। চউক্ষে চশমা আছে।”
“আইচ্ছা স্যার। আপনি তাইলে রওনা দ্যান। এই মাইয়ারে এইখান থেইকা বাইর হইতে দেওন যাইবোনা।”
আমি আৎকে উঠলাম, চিৎকার দিয়ে উঠলাম। এবং আবার মাথার পিছনে আঘাতে নেতিয়ে পড়লাম।
কতক্ষণ পেরিয়েছে জানিনা। তবে মোটা কাপড়ের ফাঁক ফোকর দিয়ে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে তাতে সকাল হয়ে গিয়েছে। ঘরের মাঝে আলো। জ্ঞান পুরোপুরি ফেরা মাত্র বুঝতে পারলাম ঘরে চতুর্থ ব্যাক্তি আছে একজন।
“অরুনিমা, তোমাকে পরীক্ষায় না পারলেও এই এখানে সর্বকালের সর্বোচ্চ নাম্বার দিলাম।” বলতে বলতে মানুষটা কাছে এগিয়ে এসে আমার চোখের বাঁধন খুলে দিলো। সালাম স্যার দাঁড়িয়ে আছেন সামনে। অত্যুজ্জ্বল আলো চোখ সইয়ে নিতে যতটুকু সময় লাগলো, আমি ব্যাগ্রভাবে চারদিক তাকালাম। সামনে যদি সালাম স্যার হয় তবে আমার ডানদিকে কে?
জামশেদ স্যারের ছবি দেখেছিলাম উনার ডায়েরিতে। কিন্তু এখন সেই চেহারার খুব সামান্য অবশিষ্ট। বুড়িয়ে গেছেন সময়ের চেয়েও বেশী। আমার চোখে অজস্র প্রশ্ন নিশ্চয়ই ঝিকমিক করে উঠেছিলো। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সামনে বসে পড়লেন সালাম স্যার।
“তোমার মনে যত প্রশ্ন আছে অরুনিমা, তুমি করতে পারো। আমি সবগুলোর উত্তর দিব। আজ আমার ভাইবা নিবে তুমি।”
বলতে বলতে তার সবচেয়ে পবিত্র হাসিটা হাসলেন। আমি আমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম বিনা বাক্যব্যয়ে। জামশেদ স্যারের ডায়েরীর ভিতরে লুকিয়ে রাখা ছবিটায় যে মানুষটা এই বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়েছিলো তিনি আর কেউ নয়, সম্ভবত সালাম স্যারের বাবা। বড় চৌধুরী সাহেব। বাবা ছেলের চোখের নির্দৃষ্ট সময়ের চাহনি আর হাসিতে বড্ড মিল। এইজন্যেই প্রথম দেখা থেকেই ছবির মানুষের আদলটা খুব চেনা চেনা ঠেকছিলো। ইসস্ আর একটু আগে ধরে ফেলতে পারলে রহস্যের সমাধান ওখানেই হয়ে যেতো!
“জামশেদ স্যারকে কেন স্যার? উনাকে এই এতোটা বছর এখানে আটকে রেখেছেন!”
“আমরা তখন মাত্র এসিস্টেন্ট প্রফেসর হয়েছি। হরিহর আত্মা। ওকে বাবার কেনা জমিদারবাড়ি দেখাতে এনেছিলাম। কিন্তু একরাতে ও তোমার মতই ওই ঘরটায় ঢুকে পড়ে। তারও আগে ঘরের দেয়ালে থাকা প্রানীগুলোর চোখের যে অস্বাভাবিকতা, সেটাও সম্ভবত আবিস্কার করে ফেলে। এবং ওই কদিনের মাঝেই সে তার ডায়েরী ভর্তি করে ছবি এঁকে ফেলে।”
“স্যারের চোখে কালো চশমা কেন?”
“ও অনেক কিছু দেখে ফেলেছিলো, জেনে গিয়েছিলো। তাই আর সবার চোখ যেভাবে তোলা হয়েছে, ঠিক ওভাবেই ওর চোখও তুলে ফেলেছিলাম আমি নিজ হাতে। চিন্তা করোনা, তোমার চোখও তোলা হবে একটু পরেই।”
আমার পরিনতি যে খুব ভালো কিছু হবেনা, তা বুঝতে পারছি। তাই সালাম স্যারের হুমকি গায়ে মাখলাম না।
“জামশেদ স্যারের চোখ জোড়াটাই কি আপনি আলাদা করে রেখেছেন ওই ঘরে? কিন্তু স্যার নিজের দৃষ্টি ছাড়া কিভাবে তার ডায়েরীতে নিজ চোখের ছবি আঁকলেন?”
“প্রিয় এবং গুণী বন্ধুর চোখকে ওইটুকু মর্যাদা দিতে কার্পন্য করবো, এমন কৃপন আমি না। আর ও যখন আমাকে সন্দেহ করা শুরু করলো তখন আমিও ওকে সন্দেহ করতে শুরু করেছি। তাই সে ডায়েরীতে নিজের চোখের বিভিন্ন ভঙ্গিমার ছবি এঁকেছে। বুঝতে পেরে গিয়েছিলো, সে তার চোখ হারাতে যাচ্ছে।”
“শুধু ওই ঘরে থাকা অসংখ্য বয়ামে রাখা চোখের জন্যে আপনি স্যারকে গত প্রায় এক যুগ ধরে এখানে আটকে রেখেছেন? সাথে চোখ তুলে ফেলার মত নিষ্ঠুরতা!”
“নাহ্, কাজগুলো আমিই করেছি এমন প্রমান ওর কাছে ছিলোনা। খুব বড় কোনো বিপদে আমাকে ও ফেলতে পারতোনা কিন্তু ও সবসময়ই আমার চেয়ে মেধাবী এবং প্রতিযোগিতায় এগিয়ে ছিলো। মেধা মনন আর বুদ্ধির দিপ্তীতে ওর পাশে আমি ছিলাম কিছুটা ম্রিয়মান।। তাই সহজ হিসেবে ও ডিপার্টমেন্টে থাকলে আমি কখনোই ডীন হতে পারতাম না। তাই এমন ব্যবস্থা করলাম, যাতে সব কুলই আমার দিকে আসে।”
“তারচেয়ে উনাকে মেরে ফেললেন না কেন? এতটা কাল উনাকে বাঁচিয়ে রাখাটা আপনার জন্যে যথেষ্ঠই ঝামেলা জনক ছিলো নিশ্চয়ই?”
“অরুনিমা, আমাকে প্রশ্ন করে হতাশ করোনা প্লীজ। তুমি কি আমাকে সিরিয়াল কিলার ভাবছো নাকি? জামশেদ ছিলো আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওর বাবা মা সহ তিন কুলে কোনো আত্মীয়স্বজন বেঁচে ছিলোনা। সেই ভার্সিটি লাইফের শুরু থেকে আমরা বন্ধু। আজীবন চিরকুমার থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। তাই আমিই ওর বন্ধু বলো কিংবা স্বজন। এতটা কাছের মানুষ হয়ে কিভাবে ওকে মেরে ফেলবো?”
সালাম স্যারের হাস্যকর যুক্তি শুনে বুঝতে পারলাম, সাইকোলজির শিক্ষক হতে হতে তিনি নিজেই কঠিন মনোরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে এটার শুরুটা কবে থেকে সেটা জানতে হবে।
“কিন্তু স্যার আপনার এই চোখ প্রীতি কেন? কোনো উদ্দেশ্য বা রাগ, ক্ষোভ?”
“প্রথম কার চোখ সংগ্রহ করেছিলাম জানো? আন্দাজ করতে পারবে?”
“পারবো স্যার, আপনি অসংখ্য চোখের মাঝেও একটি চোখকে আলাদা করে রেখেছেন সবসময়। জামশেদ স্যারও তার নিজের ডায়েরীতে এই চোখটা এঁকেছেন অনেকবার। আপনার বাবার চোখ। আমার ধারনা আপনার রোগের শুরুটা হয়েছিলো আপনার বাবার চোখ তুলে ফেলার মাধ্যমে।”
“তুমি সত্যিই আমার শ্রেষ্ঠ ছাত্রী। তোমাকে সর্বোচ্চ নম্বর দিতে পারলে, সহকর্মী শিক্ষক হিসেবে ডিপার্টমেন্টে পেলে আমিই সবচেয়ে বেশী খুশী হতাম। কিন্তু তুমিও জামশেদের মত অনেক জেনে ফেলেছো। তাই ওর ভাগ্য তোমাকেও বরণ আরে নিতে হবে। কথা দিচ্ছি ওর চোখের পাশেই তোমার চোখ জোড়া রাখব।”
আমি কেঁপে উঠছি বারেবার, সালাম স্যারের অকপটে সব স্বীকার করা দেখেই আমি আমার ভবিতব্য বুঝতে পারছি। কিন্তু আমিতো জামশেদ স্যারের মত তিনকুলে বাপ মা ছাড়া না। আমাকে এত সহজে হজম করতে পারবেনা সালাম স্যার।
আমার চোখের দৃষ্টি পড়ে ফেলতে পারলো সামনে দাঁড়ানো বিভীষিকা ছড়ানো কিন্তু মেধাবী মানুষটা।
“অরুনিমা, তুমি শুভ্রের কথা ভুলে গিয়েছো? ও তোমার মতই রহস্যের অনেক কাছে চলে এসেছিলো। এখানে আসার পথেই ওর দুর্ঘটনা ঘটে যায়। বলা ভালো ঘটানো হয়।”
“স্যার আপনি সব জেনেশুনেই জামশেদ স্যারের ডায়েরী আপনার প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দিতেন কেন? সবকিছু প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার সামান্য হলেও সম্ভাবনা বা আশঙ্কা তো ছিলো?”
“এটাকে তুমি আমার সামান্য অহংকার বা তোমাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে পারো। সত্যিই যদি এত বুদ্ধি কারও থাকে তবে আবিস্কার করুক আমার রহস্য”
অবাক ভাবটাকে গলার নীচে নামিয়ে পরের প্রশ্নটা করলাম,
“স্যার আপনার বাবার চোখ তুললেন কেন?”
“উনি আমার এমন কিছু কর্মকান্ড দেখে ফেলেছিলেন যা উনার দেখা উচিৎ হয়নি।”
“কিন্তু এই যে হলরুমে প্রানীদের চোখ কিংবা ওই তালাবদ্ধ ঘরে থাকা এত এত চোখ, এরা সবাই আপনার বাবার বা জামশেদ স্যারের মত কোনো কিছু দেখে ফেলেছিলো?”
“না না, ওদের ব্যপারটা সম্পূর্ণই আলাদা। বাবার চোখটা ফেলতে মায়া লাগলো, সাজিয়ে রেখে দিলাম। উনি মারা গেলেন কিন্তু তার চোখ দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন সবসময়। আমার কেমন একটা নেশার মত হয়ে গেলো। কেউ আমাকে সারাক্ষণ দেখছে। নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। তারপর থেকে সময়ে সুযোগে চোখ সংগ্রহের নেশা বাড়তেই থাকলো আর আমার কাঁচের বয়াম যোগ হতে থাকলো।”
“আমি বা আমরা যারাই ওই ডায়েরী হাতে পেয়েছি, তাদের সারাক্ষন ওই বিশ্রী অনুভূতিটা কেন হয়? অসংখ্য দৃষ্টি শরীরে বিধছে এমন কেন মনে হয়!”
“তোমরা সাইকোলজির সেরা ছাত্র, কল্পনা শক্তি ভালো, সেই সাথে সারা দিনমান অজস্র চোখের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তোমাদের অনুভুতি বাঁধা পড়ে যেত। অন্তত আমার এমনটাই ধারনা। সাথে আমার মতই নেশায় জড়িয়ে যেতে হয়তোবা।”
আমি আর কোনো প্রশ্ন খুজে পেলাম না, আমার আবার বমি পেতে লাগলো। কিংবদন্তি তুল্য প্রিয় এই শিক্ষকের এমন চেহারা সুদুরতম কল্পনারও বাইরে যে।
“অরুনিমা, আমি খুব দুঃখিত। তবে তোমাকে কোনো ব্যাথা দিবোনা। আমার কেয়ারটেকারটাও এখন এই ব্যপারে খুব অভিজ্ঞ। তোমার চোখ দুটোকেও আমি বিশেষ মর্যাদা দিয়ে রাখবো, আগেই বলেছি।”
এতোক্ষন খেয়ালই করিনি, সামান্য দুরে একটা ছোট্ট ট্রলি নিয়ে এসেছে চৌকিদারটা। আমি বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছি। এভাবে সব স্বপ্নের শেষ হবে আমার?
দুজন মানুষ আমার কাছে এগিয়ে আসছে। আমি চারদিক দেখছি। সাহায্যের আশায় নাকি পৃথিবীর আলো শেষবারের মত, নিজেও জানিনা। পুরোটা সময় জামশেদ স্যার মরার মত পড়ে আছেন, জ্ঞানহীন নাকি ঘুমের ঘোরে আছেন আমি জানিনা। উনার কাছ থেকে সাহায্য পাবোনা। পা দুটো শক্ত করে রেখেছি। খোলা মাত্র লাথি মেরে যদি ছিটকে ফেলতে পারি। চৌকিদার আমার পায়ের বাঁধন খোলা শুরু করেছে।
প্রবল শব্দে ঘরের সদর দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পড়লো তিন চারজন মানুষ। ইউনিফর্ম পরনে, পুলিশ দেখে এত খুশী আজ পর্যন্ত হইনি। অন্য সব কাহিনীর মত সব শেষ হয়ে যাওয়ার পরে তারা আসেনি বরং একেবারে ঠিক সময়ে এসেছে। তাদের পিছনে কৌশিকের মায়া ভরা মুখটা দেখে আমি এক মুহূর্তের জন্যে অবাক হলাম, তারপর কোথা থেকে যে আবেগ উথলে উঠলো আমার!
পুলিশরা দুজনকেই এরেস্ট করলো। সালাম স্যারকে নিয়ে যাওয়ার আগে কৌশিক, স্যারের প্রশ্নমাখা চোখের দিকে তাকিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“ল্যান্ড লাইনের যুগে পড়ে থাকা চৌকিদারের মাথায় আসেনি তোমার মোবাইল ফোন বন্ধ করার কথা। সাইলেন্ট ছিলো বলে তুমি বা সালাম স্যারও সম্ভবত ভুলেই গিয়েছিলে ওটার কথা। গতকাল ভোরে তোমার সাথে ফোনে কথা বলার সময়ই আমার সামান্য সন্দেহ হয়েছিলো তুমি আসলে বাড়ি যাওনি। তাই পরে তোমার বাড়িতে ফোন করে নিশ্চিত হয়ে নিয়েই আমি রওনা দিয়ে দেই। আর ফোন ট্রেসিং করতে না পারলেও সমস্যা হতোনা। তোমার কাছ থেকে তো জেলার নাম পেয়েই গিয়েছিলাম। হয়তো সামান্য দেরী হতো তখন। তাতে মনে হয় একটা বড় ক্ষতি হয়ে যেতো, তাই না!”
১২.
ঠিক পনেরো বছর পরের কথা,
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিন্যাল সাইকোলজী ডিপার্টমেন্টের বিভাগীয় প্রধানের ঘরের সামনে ছেলেমেয়েরা উঁকি ঝুকি দিচ্ছে। আজ সেমিস্টার ফাইনালের ভাইবা পরীক্ষা নিবেন ম্যাডাম, কিন্তু দরজা ভিতর থেকে বন্ধ।
দরজার ঠিক পাশেই নেমপ্লেটে বড় করে লেখা আছে, অরুনিমা শবনম।
প্রত্যেক ব্যাচের খুব প্রিয় ম্যাডাম, পড়ান খুব ভালো, সবচেয়ে অমনোযোগী ছাত্রটাও মন্ত্রমুগ্ধের মত তার লেকচার শোনে। গল্পচ্ছলে পড়াতে পছন্দ করেন। কিন্তু মাঝেমধ্যে ম্যাডামের যেন কি হয়। গুম হয়ে থাকেন। খুব অস্বাভাবিক আচরন করেন।
আমি আমার কামরায় বসে আছি। জানি আমাকে নিয়ে আমার ডিপার্টমেন্টে এমন সব কথাই প্রচলিত। কিন্তু কিভাবে ওদের সব সত্যি কথা বলি? আসলেই মাঝে মাঝে আমার খুব নেশার মত ওঠে। অনেকদিন হয়ে গেলো এই নেশার বয়স, তা প্রায় পনেরো বছর তো হবেই, আমার তখন শুধু ইচ্ছে করে, কেউ যেন আমার দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকে। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ কেউ ভাবতে, ভাবাতে ইচ্ছে করে। তখন আমি আমার ডান আর বাম দিকে থাকা যে কাঠের আলমিরা দুটো, তাদের কবাটখানা খুলে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকি।
কেন জানেন?
আচ্ছা তার আগে বলে নেই,
সালাম স্যারের অল্প কদিনের জেল হয়। তারপর তিনি ছাড়া পেয়ে যান। কারণ তার চৌকিদার সমস্ত দায় নিয়ে নেয় কোর্টে। সব নাকি সেই করেছে। জামশেদ স্যারও খুব শক্ত বিরোধিতা করেনি। হয়তো বয়স হয়ে গিয়েছিলো বলেই বন্ধুর প্রতি কঠোর হননি। জানিনা আসল কারণ কি ছিলো। বছর তিনেক পরে জামশেদ স্যার মারা যান। সালাম স্যারও কোথায় আছে কেউ জানেনা। কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে দুটো মানুষই।
কিন্তু একেবারে হারাতে দেইনি আমি।
জামশেদ স্যারের চোখ জোড়া আমি আমার ডানদিকের কাবার্ডে রেখেছি, আর বাম দিকের পাল্লায় রেখেছি সালাম স্যারের চোখ জোড়া। হ্যাঁ, সালাম স্যারের ওই দুটো চোখ আমি স্যারের জীবদ্দশায় নিজের হাতে তার শরীর থেকেই সংগ্রহ করেছি! এটুকু বিভৎস আচরন স্যারের পাওনা হয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি। তারপর সালাম স্যারের কি হয়েছে সেটা এই গল্পের জন্যে জরুরী না।
স্যারের নেশাটা আমি টের পাই অনেকদিন ধরেই। নেশা বেড়ে গেলে আমি আমার কামরার দরজা বন্ধ করে দুইজোড়া চোখের সামনে নিজেকে মেলে ধরি, আমার খুব শান্তি শান্তি লাগতে থাকে।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প