বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। না, ঝুম নয়, টুপটাপ মাটিতে, পাতায়, টিনের চালায় নেমে আসছিলো এক ধরনের শান্তি হয়ে। চারদিক মেঘলা, হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইছে গ্রামের পুরনো সেই বাড়িটার বারান্দায়। আরিফ বারান্দার বেঞ্চে বসে আছে। সামনে ছোট্ট টেবিল। তাতে দু’কাপ ধোঁয়া ওঠা চা। একটা নিজের, আরেকটা প্রিয়তমা স্ত্রী মেহরীনের।
চা বানাতে বানাতে সে নিজেই হেসেছিল একটু। মনে মনেই বলেছিল,
“তুমি নেই, তবু তোমাকে ছাড়া এক কাপ চা বানানো আজও কষ্টের।”
আজকাল আশেপাশের কেউ আর জিজ্ঞেস করে না,
“দুই কাপ চা কেন?”
গ্রামের মানুষ বুঝে গেছে, এই চা শুধু পান করার জন্য না, এটা আরিফের ‘অপেক্ষা’।
বারান্দার পাশে একটা জবা গাছ। মেহরীন খুব যত্ন করত ওটার।
বৃষ্টির ফোঁটা জবা ফুলের লাল পাপড়িতে পড়ে ঠিক যেমন মিশে যায়, মেহরীনও ঠিক তেমন করে মিশে আছে এই বাড়ির প্রতিটা কোণে।
আরিফ ধীরে ধীরে চায়ের কাপে চুমুক দিল। চায়ের ধোঁয়া গালের পাশে এসে ছুঁয়ে গেল, ঠিক যেমন করে একসময় মেহরীনের চুল এসে ছুঁয়ে দিত তার গাল।
সে চোখ বন্ধ করল।
“তুমি জানো, আজও আমি তোমার চুলের ঘ্রাণ পাই এই বৃষ্টিতে?
তুমি বৃষ্টির দিনেই তো প্রথম এসেছিলে আমার জীবনে। ভেজা চুলে, ভেজা চোখে…
তখন কি ভেবেছিলে, এই চায়ের কাপে ভেসে যাবে পুরো একটা জীবন?”
হঠাৎ হাওয়ার এক ঝাপটা এসে পর্দা উড়িয়ে দিল।
আরিফ চমকে উঠল, মনে হলো যেন কেউ পাশের চেয়ারে এসে বসেছে।
সে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইল, তারপর নিঃশব্দে একটা কথা বলল,
“আজ চায়ে চিনি একটু বেশি হয়ে গেছে, না?”
আবার নিজেই উত্তর দিল,
“তুমি তো ঠিক এটাই বলতে…”
বৃষ্টি থেমে গেছে ততক্ষণে।
কিন্তু বারান্দার কোণায় রেখে যাওয়া সেই চায়ের কাপটায় এখনো গরম ধোঁয়া উঠছে।
আর চোখের কোণে নামছে এক ফোঁটা বৃষ্টি, নাকি জল, সেটা আলাদা করা যাচ্ছে না।