চিঠি আসেনি আজও পর্ব ২

পোস্ট অফিসটা দুপুরে ঝিমিয়ে পড়ে, যেমনটা প্রতিদিন হয়। কাঠের দরজায় টোকা পড়তেই সবাই চমকে তাকায়।
দরজার ফ্রেমে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণ — মাথায় ছাতি নেই, গায়ে হালকা বাদামি শার্ট, কাঁধে একটা ময়লা রঙের ঝোলা ব্যাগ, আর মুখে কৌতূহলের ছাপ।
— “এই পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার কে?”
মনোহর কাকু উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এলেন।
— “আমি এখনো দায়িত্বে আছি, তবে আগামীকাল অবসর। আপনি বুঝি নতুন পোস্টমাস্টার?”
তরুণ মাথা ঝাঁকায়।
— “হ্যাঁ, আমি অভীক চৌধুরী। ট্রেন থেকে সোজা এখানেই এলাম।”
মনোহর কাকু হাসলেন,
— “আপনি বুঝি শহরের বাইরে থেকে এসেছেন?”
— “হুগলি থেকে। ছোট শহর, কিন্তু পোস্ট অফিসের গন্ধটা সবার এক।”
অভীকের চোখ ঘুরে দেখে নেয় পুরো পোস্ট অফিসটা। দেয়ালের ফাটল, কাঠের মেঝে, পুরনো রেকর্ড বুকের গন্ধ — সব যেন তার চেনা।
কিন্তু হঠাৎ তার চোখ পড়ে পাশের বেঞ্চে বসা মেয়েটির দিকে —
হলুদ চুড়িদার, সাদা ব্যাগ, চুলটা বাঁধা, আর চোখে এক অদ্ভুত নীরবতা।
মেয়েটি তখন জানালার বাইরে তাকিয়ে, যেন বাইরের বাতাসে কোনো বার্তা খুঁজছে।
মনোহর কাকু ধীরে বলে,
— “ও মেঘলা। প্রতিদিন আসে একটার খোঁজে।”
অভীক জিজ্ঞেস করে,
— “কোনটা?”
কাকু বলে,
— “একটা চিঠি… যা কখনো আসে না।”

রাত গড়িয়ে যায়। পরদিন সকাল থেকে অভীক অফিস সামলাতে শুরু করে।
ফাইল গোছানো, খাম গণনা, স্ট্যাম্প বুক চেক — তার হাতে সময় নেই।
তবু দুপুর ঠিক ১২টা বাজলে সে খেয়াল করে, দরজায় চুপচাপ এসে দাঁড়ায় সেই মেয়ে — মেঘলা।
অভীক তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
মেঘলা মনোহর কাকুর দিকে এগিয়ে বলে,
— “আজ কোনো খাম আছে আমার নামে?”
কাকু মাথা নাড়েন,
— “না মা, আজও না।”
মেঘলা নীরবে বেঞ্চে গিয়ে বসে।
অভীক কৌতূহল লুকোতে পারে না।
সে চুপিচুপি কাকুকে জিজ্ঞেস করে,
— “সে ঠিক কতদিন ধরে এভাবে আসে?”
মনোহর কাকু চোখের চশমা নামিয়ে বলেন,
— “প্রায় চার বছর। তার প্রেমিক রুদ্র ছিল আর্মিতে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চিঠি লিখত। হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে সে রোজ আসে… বিশ্বাস করে একদিন চিঠি আসবেই।”
অভীক চুপ করে।
তার পেশার জীবনে অনেক মানুষ এসেছে, গেছে।
কিন্তু এমন অপেক্ষার দৃশ্য — চোখে লেগে থাকে।

পরদিন থেকে অভীক লক্ষ্য করে —
মেঘলা প্রতিদিন এক সময়েই আসে, একইভাবে বসে, কিছু না বলে চলে যায়।
একদিন সে সাহস করে এগিয়ে যায়।
— “আপনার জন্য যদি কখনো চিঠি আসে, আমি নিজেই হাতে তুলে দেবো।”
মেঘলা তাকায় তার দিকে — ধীর, অবাক চোখে।
— “আপনি নতুন পোস্টমাস্টার?”
— “হ্যাঁ, আমি অভীক। হুগলি থেকে এসেছি।”
মেঘলা হালকা হেসে বলে,
— “আমার চিঠির ঠিকানাটা খুঁজে পেলে আমায় জানাবেন।”
অভীক কিছু বলার আগেই সে ফিরে যায়।

সেই রাতে পোস্ট অফিসের পুরনো কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে অভীক পায় একটা পুরনো রেজিস্টার।
তার পাতা উল্টাতে উল্টাতে চোখে পড়ে —
“Rudra S. Chatterjee → Meghla Dey”
শেষ তারিখ: ৪ বছর ২ মাস আগে।
তারপর, আর কিছু নেই।
অভীক সেই নামটা মনে রেখে পরদিন খোঁজ করে সামরিক ডাকঘরের ফোল্ডারে।
কিন্তু তেমন কিছু মেলে না।
তবু কেন জানি তার মনে হয় — এই মেয়ের গল্প এখন কেবল অতীত নয়, হয়তো তার ভবিষ্যতের অংশও হতে চলেছে।

পরদিন দুপুরে, মেঘলা আসে।
অভীক তাকে দেখে বলে,
— “আপনার গল্পটা আমি শুনেছি। যদি আপনি চান… আমি একটু খুঁজে দেখব, কোথাও হারিয়ে যাওয়া চিঠির খোঁজ মেলে কিনা।”
মেঘলা ধীরে মাথা নাড়ে।
— “চিঠির খোঁজ যদি মন দিয়ে কেউ করে… সে একদিন ঠিক আসবে।”
এই কথার ভেতরে অভীক যেন নিজের মনের দরজায় একটা ধাক্কা পায়।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প