জোড়া তালগাছ

রাত যত গভীর হতে থাকে, পরিবেশ ততই ভারী হয়ে ওঠে। বাতাসের বয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, আশপাশের সব শব্দ যেন হঠাৎ করেই স্তব্ধ হয়ে যায়। কৃষক রহিম মাঠে পানি সেচ দিতে গিয়েছিলেন। শুষ্ক মৌসুম, সারাদিন পানি না পাওয়ায় তিনি রাতেই বেরিয়ে পড়েন। মাথায় টুপি, কাঁধে গামছা জড়ানো, হাতে কোদাল নিয়ে জমিতে ছোট ছোট ড্রেন তৈরি করছিলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ করেই চারপাশের পরিবেশ বদলে যেতে থাকে।
ঝমঝম ঝমঝম শব্দ আসতে থাকে দূর থেকে। প্রথমে তিনি পাত্তা দেননি, ভেবেছেন হয়তো বাতাসের সঙ্গে বাঁশের ডগা ঠোকা খাচ্ছে। কিন্তু আশেপাশের গাছগুলো তো একদম স্থির! আর কোনো বাতাসও তো বইছে না!
কিছুক্ষণ পরই কানে আসে বিড়ালের কর্কশ ডাক। গভীর রাতে বিড়ালের ডাক সাধারণ ব্যাপার নয়, কিন্তু রহিম এটাকে উড়িয়ে দেন। এমন সময় তার নাকে প্রচণ্ড পচা পাঠার গন্ধ আসে। তার ধানের জমি যেন সেই গন্ধে একাকার হয়ে ওঠে। গন্ধের উৎস খুঁজতে আশেপাশে তাকান তিনি, কিন্তু কোথাও কোনো পাঠা নেই। এত রাতে গ্রামের কেউ কি পাঠা ছেড়ে দিতে পারে? মনে মনে প্রশ্ন জাগে, কিন্তু উত্তর পান না।
বিস্ময় কাটাতে তিনি একটি বিড়ি বের করেন। আগুন ধরাতেই চারপাশ আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। যেন কিছুই হয়নি। রহিম খানিকটা স্বস্তি পান এবং আবার কাজে মনোযোগী হন। কিন্তু হঠাৎই কানে আসে কান্নার শব্দ। গভীর রাতের কৃষিজমির মাঝে কার কান্না আসতে পারে? তিনি খেয়াল করেন, জোড়া তালগাছের নিচে কেউ একজন বসে কাঁদছে।
তিনি একটু এগিয়ে যান। ধীরে ধীরে কান্নার শব্দ বাড়তে থাকে, সাথে এক অজানা ভয়ের শীতল স্রোত তার শরীর বেয়ে নামে। গলা শুকিয়ে আসে, কিন্তু সাহস করে ডাক দেন, “কে ওখানে?”
কোনো সাড়া নেই।
আবারও ডাক দেন, “কে বসে আছিস? এত রাতে এখানে কী করছিস?”
তবুও কোনো উত্তর নেই।
তিনি আরও কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে ভালো করে দেখতে চেষ্টা করেন। কেউ একজন বসে আছে, মাথা নিচু করে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। দেখতে যেন কোনো নারী।
তিনি এবার একটু জোরেই বলেন, “এই শুনছ? কে তুমি?”
কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
তার শরীর কাঁপতে শুরু করে, কিন্তু কৌতূহল তাকে আরও কাছে টেনে নিয়ে যায়। তৃতীয়বার ডাক দিতেই সেই বসে থাকা মানুষটি হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু কী আশ্চর্য! সে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তার ছায়াটা এক লাফে তালগাছের ডগা পর্যন্ত উঠে যায়! আর এক মুহূর্তের মধ্যেই সে তালগাছের গোড়ায় গিয়ে মিলিয়ে যায়!
রহিমের শরীরের রক্ত হিম হয়ে যায়। গা ছমছম করতে থাকে। দ্রুত পকেট থেকে আরেকটি বিড়ি বের করে কাঁপা হাতে ধরান। কিছুক্ষণ পর যেন চারপাশ স্বাভাবিক হয়ে আসে। কোনো শব্দ নেই, বাতাসের গুঞ্জন পর্যন্ত নেই। তিনি আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াননি। ছুটতে ছুটতে বাড়ির দিকে রওনা হন।
বাড়িতে পৌঁছানোর পর শরীরটা বেশ অসুস্থ বোধ করতে থাকেন। গা প্রচণ্ড ঠান্ডা হয়ে যায়, অথচ গরম আবহাওয়া! তিনি বিছানায় শুয়ে পড়েন, কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই সেই ছায়ার ভয়ঙ্কর দৃশ্য মনে পড়ে যায়।
হঠাৎ করে ঘরের জানালার বাইরে অদ্ভুত এক ছায়া দেখতে পান। মনে হয় কেউ দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু পরক্ষণেই মিলিয়ে যায়। তার কানে আসতে থাকে ফিসফিস করা কণ্ঠস্বর—
“আমি আসছি…”
রহিম প্রচণ্ড ভয়ে উঠে বসেন। কপাল বেয়ে ঠান্ডা ঘাম গড়িয়ে পড়ে। দরজার দিকে তাকাতেই দেখেন, ঘরের কোণে কেউ একজন দাঁড়িয়ে! মুখ দেখা যায় না, শুধু অস্পষ্ট কালো অবয়ব!
তিনি চিৎকার করতে যান, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হয় না। শরীরটাও যেন অবশ হয়ে আসে। সেই ছায়াটি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে…।
সেই রাতে কী ঘটেছিল, রহিম নিজেও জানেন না। সকালে পরিবারের লোকজন তাকে জ্ঞানহীন অবস্থায় খুঁজে পান। শরীর প্রচণ্ড ঠান্ডা, জ্বরজ্বর অনুভূতি। এরপর থেকে তার জীবনে একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে থাকে। রাতে দরজা-জানালা বন্ধ করেও তিনি অনুভব করেন, কেউ যেন তার আশেপাশে হাঁটছে। দরজার বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে।
গ্রামের মানুষজন বলাবলি করতে থাকে—“ওই জোড়া তালগাছ ভালো কিছু নয়, রাতের বেলা ওখানে গেলে কেউ আর আগের মতো থাকে না…”

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প