দরজার ওপাশে (পর্ব ৬-শেষ পর্ব)

রুমটার বের হওয়ার দরজার সামনে দেখি লোহার একটা কেঁচি গেট দিয়ে একেবারে বের হওয়ার রাস্তা বন্ধ করা। আর সেই কেঁচি গেটের সামনেই একটা মেয়ে আলুথালু অবস্থায় পড়ে আছে। তার হাত-পা শিকল দিয়ে বাঁধা। আর রুমের অন্য একপাশে তুষার! সেও শিকল দিয়ে বাঁধা!
সজীব মেয়েটিকে দেখে হঠাৎ ‘রিনি’ বলে চিৎকার করে ছুটে গেল। আমি এদিকে এদিক ওদিক তাকিয়ে সুইচবোর্ড খুঁজে বের করে লাইট জ্বালালাম। আলোতে চোখ সয়ে আসতে কিছুক্ষণ সময় লাগল!
সজীব মেয়েটিকে ধরে বলতে থাকে- এই রিনি! তুমি এখানে কেন? কিভাবে? তুমি না পালিয়ে গিয়েছিলে?
মেয়েটিকে আমার স্বাভাবিক মনে হল না। সে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। মাঝেমধ্যে তার হাতের বাঁধা শিকল দিয়ে গেটটায় বাড়ি মারছে। আর তাতে সেই বহুল আলোচিত ‘নূপুরের শব্দের’ উৎস উন্মোচিত হল!
মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে না যে সে সজীবকে চিনেছে! মেয়েটির হাতে পায়ে আঘাত আর ক্ষতের চিহ্ন!
আমি এদিকে তুষারের কাছে তাড়াতাড়ি গেলাম। তুষারের মাথায় ব্যান্ডেজ। হাতে পায়ে মারের দাগ। তুষারকে ধরে ঝাঁকুনি দিতেই সে ঘোলাটে চোখে তাকাল!
আমাকে দেখে খুব ধীরে ধীরে বলল- রূপ! ত..তুমি? আমি..আ..মি কি সত্যি দেখছি?
তার এই অবস্থা দেখে আমার চোখ ফেটে কান্না আসল।
আমি কাঁদতে কাঁদতেই বললাম – তোমার এই অবস্থা কে করেছে তুষার? এখানে কি করে এলে তুমি?
তুষার কোনমতে ফিসফিস করে বলল- গ..গিন..গিন্নীম..গিন্নীমা!
এরপরেই সে জ্ঞান হারাল। আমি হাউমাউ কাঁদতে কাঁদতে টের পেলাম কেউ আমার কাঁধে হাত দিয়েছে। আমি পেছনে ফিরতেই সজীব আমাকে ধরে রাখে!
আমি মরিয়া হয়ে বললাম – ওদের খোলার ব্যবস্থা করতে হবে।
সজীব বলল- একটা কুড়াল জাতীয় কিছু লাগবে। এমনি এমনি কি করে খুলব? আর ওদের এভাবে রেখে কি করে বাইরে গিয়ে সেটা নিয়ে আসব?
আমি বললাম – তুমি নিয়ে এসো। আমি ওদের কাছে দাঁড়াই।
সজীব প্রায় চিৎকার করে বলে- অসম্ভব! আমি তোমাকে রেখে যাব না। একজনকে হারিয়ে ফেলেছি। তোমাকে ছাড়া আর বাঁচতে পারব না!
– সজীব বোঝার চেষ্টা কর! ওদের অবস্থা ভাল না! ওদের খুলতে হবে..
আমি এটুক বলতেই পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর বলে ওঠে – এই যে! এই চাবি দিয়ে খোল!
ঘুরে দেখি গিন্নীমা!!!
গিন্নীমা সুন্দর করে হেসে বললেন – খামোখা ভাঙাভাঙি করার থেকে চাবি দিয়ে খোল। আমার কাছে চাবি আছে।
গিন্নীমা সজীবের দিকে দুইটা চাবি বাড়িয়ে দিলেন। সজীব চাবি দুইটা হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে!
আর আমি এদিকে বিকট চিৎকার করে জিজ্ঞেস করি- ওদের সাথে কি করেছেন? কেন ওদের এখানে আটকে রেখেছেন?
আমার চিৎকারে সবাই ওপরে উঠে আসে। এই গুপ্ত দরজা দেখে সবাই অবাক হল! আমি লক্ষ করলাম শুধুমাত্র ভাইয়া আর তৈয়ব চাচা খুব স্বাভাবিকভাবে নিলেন!
মা বললেন – এইখানে এই দরজা কোথা থেকে এল? আগে তো দেখিনি!
অনামিকাকে দেখে ভাবী জিজ্ঞেস করলেন- তুই এলি কেন? তোর না পেট ব্যথা?
অনামিকা কাঁচুমাচু মুখে বলে- আমার কিছু হয়নি! আমি আসলে এতক্ষণ নাটক করছিলাম!
গিন্নী মা ভয়ানক গলায় চোখ রাঙিয়ে উঠলেন – কি?
মা বললেন – এখানে কি হচ্ছে? ওরা কে? আরে! এটা তো রিনি! আর এই ছেলেটা কে? রিনি এখানে কেন? কিছুই তো বুঝতে পারছি না!
গিন্নীমা হিসহিস করে বললেন – আমি এইখানে এই পরিবারের কলঙ্কদের লুকিয়ে রেখেছি! ওদের জন্য পরিবারের মানসম্মান ধুলোয় মিশে যাচ্ছিল!
আমি জিজ্ঞেস করলাম- তার মানে?
গিন্নীমা বললেন – তোমার সাথে বিয়ের আগে সজীবের এই মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল!
আমি চমকে সজীবের দিকে তাকালাম! সে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল!
গিন্নীমা বললেন – কিন্তু ও একটা চাষার মেয়ে! এই মেয়ের বাবা আমাদের জমিতে কাজ করেছে। এখন তার মেয়ে দুই কলম বেশি পড়েছে বলে নিজেরা জাতে উঠে গেছে বলে মনে করছিল! আমরা জমিদার! আমাদের বাড়িতে বৌয়েরা আসে বনেদী বাড়ি থেকে। সেখানে এই চাষার মেয়ে এই বাড়ির বউ হবে? কখনোই না। আমি সজীবকে নিষেধ করলাম। কিন্তু সজীব বলেছিল এই মেয়ের সাথে বিয়ে না দিলে ও এই বাসা ছেড়ে, এই পরিবার ছেড়ে, সবকিছু ছেড়ে চলে যাবে! আমি তা হতে দেব না। আমি জমিদার বাড়ির মেয়ে, জমিদার বাড়ির বৌ হয়ে এই চাষীর মেয়েকে জিতে যেতে দিতে পারি না। আমি ওকে আমাদেরই বাড়ির ছেলেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে দিতে পারি না! আমি সজীবকে একটা কাজে সদরে পাঠিয়ে দিলাম। বলেছিলাম ও ফিরে আসলে সিদ্ধান্ত নিব।
এটুক বলে গিন্নীমা থামলেন।
মা বললেন – এটুকু আমি জানি। আমি, শিহাব আর তৈয়ব ভাই এটুকু জানি। কিন্তু এরপর কি? ও এখানে কেন? ও তো চিঠি রেখে পালিয়ে গিয়েছিল।
গিন্নীমা আবার হিসহিসিয়ে বললেন – এরপরের অনেককিছু তুমি জানো না। কিন্তু তোমার বড় ছেলে আর তৈয়ব জানে!
মা চমকে ভাইয়ার দিকে তাকালেন!
গিন্নীমা বললেন – আমি এরপর তৈয়বকে দিয়ে মেয়েটিকে ধরে নিয়ে আসি। ওকে বাধ্য করি একটা চিঠি লিখতে। আমি ওকে বলেছিলাম চিঠি না লিখলে ওর পরিবারকে আমি মেরে ফেলব। ওর বাবা-মা আর একটা ছোটবোন আছে। বাধ্য হয়ে ও একটা চিঠি লিখেছিল!
সজীব এবার ধীরে ধীরে বলে- চিঠিতে লেখা ছিল- সজীব আমি তোমার টাকা দেখে তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম। আমি আসলে অন্য একজনকে ভালবাসি! গিন্নীমা আমাকে অনেক টাকা অফার করেছেন। সেটা নিয়ে আমি আমার প্রেমিকের সাথে চলে যাচ্ছি। আমাকে ক্ষমা করে দিও। ভাল থেক!
গিন্নীমা বললেন – হ্যাঁ। আমি ওকে এটাই লিখতে বলেছিলাম। ও ভেবেছিল ও এটা লিখলেই আমি ওকে ছেড়ে দেব। বেচারি জানত না ওর জন্য আরো ভয়াবহ কিছু অপেক্ষা করছে! শিহাব আর তৈয়বকে দিয়ে আমার রুমেই একটা দরজা তৈরি করলাম। বাকি সবাইকে সেদিন আমি অনামিকার নানুবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এরপরে আমি এই মেয়েটিকে এখানে বেঁধে রেখেছি। এটা ছয় বছর আগের ঘটনা। অন্য কোথায়ও রাখতে পারতাম কিন্তু আমি আমার চোখের সামনে রাখতে চেয়েছিলাম। আর ওর পরিবার জানত না সজীবের সঙ্গে রিনির সম্পর্ক আছে। ওরা রিনিকে খুঁজেছিল। আমি বলেছি আমি জানি না। এরপর আমি টাকাপয়সা দিয়ে ওদের অন্য গ্রামে পাঠিয়ে দেই। সজীব ফিরে এলে ওকে আমি চিঠি দেখাই। ইচ্ছামত বকাবকি করেছি। সজীবও আমাকে বিশ্বাস করেছিল!
সজীব বলল- আমি ভাবিনি আপনি এত নিচে নামতে পারেন গিন্নীমা!
গিন্নীমা পাত্তা না দিয়ে বলতে থাকেন- এই মেয়ে কম জ্বালায়নি আমাকে। চিৎকার চেঁচামেচি করার চেষ্টা করত! অ্যাটাক করতে চাইত। ওকে তখন মারধোর করতাম। আর ড্রাগস দিতাম। ড্রাগস দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতাম। আমাকে এসব কাজে তৈয়ব সাহায্য করেছে। আর শিহাবও সব জানত।
মা বললেন – ছি শিহাব! ছি! এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোকে? তুই আমার ছেলে?
গিন্নীমা বললেন – এরপর আমি এখানে কেঁচি গেট বসালাম। এই মেয়েটা তখন কেঁচি গেটে শিকল বাড়ি দিয়ে শব্দ করত! আমার মাথায় আরেকটা পরিকল্পনা এল। ওর এই শব্দ করার জন্য আমার উপকারই হল। আমি এই রুমে ভূত আছে সেই গল্প ফাঁদলাম! আমি নিজেই দাবি করলাম আমি এখানে ভূত দেখেছি। ও যতই শব্দ করত সবাই ভাবত এখানে ভূত আছে। সে নূপুরের শব্দ করে। আমি এরসাথে ডালপালা লাগালাম। বললাম এই বাড়িতে অনেক আগে জলসাঘরে নাচত একজনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছিল। তার আত্মাই হয়তো কোন কারণে ফিরে এসেছে। এসব কথা অনামিকা জানত না। ও শুধু জানত এই রুমে ভূত আছে! আর পাশের রুমে কিছু নেই। ওটা আমি বানিয়ে বলেছিলাম।
আমি এবার ঝাঁঝিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করলাম- আর তুষারের এই হাল কেন করেছেন? ও আপনার কি ক্ষতি করেছিল?
গিন্নীমা বললেন – তুমি সেদিন ওর সাথে পালিয়ে যাচ্ছিলে!
ভাবী বলল- সত্যি নতুন বৌ?
আমি কিছু বলার আগেই সজীব বলল- আমি সব জানি। ও আমাকে বলেই যাচ্ছিল।
গিন্নীমা জিজ্ঞেস করলেন – তোমাকে এই বাড়ির বউ কেন করেছি জানো রূপরেখা? আমি ভেবেছিলাম তুমিও তোমার বাবার মত আমার ওপরে কোন কথা বলবে না।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম!
গিন্নীমা বললেন – তোমার বাবার এই যে এত ধনসম্পদ, এত বিলাসিতায় তুমি বড় হয়েছ, সবকিছু আমাদের অবদান। তোমার বাবা এই গ্রামেরই ছেলে। তোমার দাদা আর সজীবের দাদা বন্ধু ছিল। বন্ধু না বলে ভাই বললেও ভুল হবে না এত খাতির ছিল। কিন্তু তোমার দাদী তোমার ফুপুর জন্মের সময় বাচ্চাসহ মারা গেলেন। কিছুদিন পর তোমার দাদাও মারা গেল। তোমার বাবা এরপরে আমাদের দয়ায় বড় হয়েছে। তার পড়ার টাকা, থাকা খাওয়ার টাকা আমরা দিয়েছি। এমনকি প্রথম চাকরিতে আমরাই ঢুকিয়ে দিয়েছি। এরপর সে এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে, ভাল কাজ করে এত বড় হয়েছে। সজীবের দাদা মারা যাওয়ার পর তোমার বাবাকে বলেছিলাম এত কিছু যখন করছি তাই আমরা পরে যা চাইব তাই দিতে হবে। তোমার বাবা তখন নতুন চাকরি পাওয়ার আনন্দে আটখানা! রাজি হয়েছিল। এর ত্রিশ বছর পরে আমি তোমাকে চাইলাম সজীবের বৌ করে। নুন খেয়েছে, অস্বীকার করবে কি করে? সজীবের যেহেতু একটা পাস্ট ছিল আমি ভেবেছিলাম তুমিও তোমার বাবার মতই আমার হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলাবে। কিন্তু এটা আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। তুমি যে পাতায় পাতায় চলবে সেটা আমি বুঝিনি। তুমি প্রথম যেদিন আমার ঘরে আসো আমি তখন এখানে এই রুমে ছিলাম। তুমি যে আমাকে ডেকেছ আমি শুনেছি। তাড়াতাড়ি বের হয়ে দেখি তুমি বেরিয়ে যাচ্ছ। তখন আমি তোমাকে ডাক দিয়েছিলাম। তখন থেকেই আমি বুঝেছি তুমি বড্ড সেয়ানা! তাই তৈয়বকে বলেছিলাম তোমাকে বাড়ির বাইরে বের না হতে দিতে। কিন্তু সজীব একটা কাজে তৈয়বকে বাইরে পাঠিয়েছিল। সেই ফাঁকে তুমি বেরিয়ে গেলে। তুমি সেদিন কেন যাওনি আমি জানি না তবে তুমি যখন তোমার প্রেমিকের সাথে কথা বলছিলে তখনই তৈয়ব ফিরে আসে। সে তোমাদের একসাথে দেখে ফেলেছিল। ও আমাকে বলায় আমি বলেছি ওকে ধরে আনতে। তুমি বাসায় ঢোকার পর তৈয়ব পেছন থেকে তুষারের মাথায় বাড়ি মেরে ধরে আনে। এটা শুধু আমি আর তৈয়বই জানি। এরপর ওকেও ড্রাগস দেই, ওকেও ঘুম পাড়িয়ে রাখি!
মা বললেন – ছি মা! আপনি এরকম! এত খারাপ!
সজীব বলল- গিন্নীমা আপনার এত অহংকার! পরিবারের মানসম্মানের এত চিন্তা! এখন মানসম্মান ধুলায় মিশল না?
আমার কাছে তখন সাহিরের ফোন আসে। আমি তাকে আসতে বললাম। সাহির এসে তুষারকে দেখে অবাক হয়ে গেল!
কিন্তু সে হঠাৎই বলে – এই বাসায় কিছু আছে!
সজীব জিজ্ঞেস করে – কি আছে?
– ভাল কিছু। কোন আত্মা! আমি টের পাচ্ছি। আমি এসব নিয়ে প্রচুর কাজ করেছি! সে হঠাৎই একটা ভাঙা আলমারির দিকে দেখায়!
জিজ্ঞেস করে – ওটার পেছনে কি কিছু আছে?
আমি দেখলাম ওইটার দিকে দেখানোর সাথে সাথে গিন্নীমা কেমন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন!
– ওখানে ধরবে না। ওইটা কিছু না- তিনি কড়া গলায় বলে ওঠেন।
আমি এবার বললাম – আপনার কথা আর কেউ শুনবে না।
এটা বলে আমি আলমারিটা সরানোর চেষ্টা করলাম। আমাকে সরিয়ে দিয়ে সজীব আর সাহির সেটা সরাল। আবার অবাক হবার পালা! আলমারির পেছনে নিচে নামার সিঁড়ি।
সজীব গিন্নীমাকে জিজ্ঞেস করল- এটা আবার কি তামাশা?
শিহাব ভাইও অবাক হয়ে বললেন – এখানে কি?
গিন্নীমার চোখগুলো যেন জ্বলে ওঠে!
– ওদিকে যাবে না। খবরদার!
তার খবরদারি না শুনে সবাই সেদিকে এগিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে একটা মাটির ঘরের মত পেলাম। সেখানে গিয়ে সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকি! ছোট ছোট দুইটা কবরের মতো!
মা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন- এটা কি?
গিন্নীমা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন!
ভাবীও হঠাৎ করে ভীত গলায় বলল – এখানে কি গিন্নীমা?
গিন্নীমা তবুও নিশ্চুপ!
আমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করে ফেললাম – অণু আর ইমরানের কবর?
সবাই আমার দিকে চমকে তাকাল!
গিন্নীমা হঠাৎ হুহু করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন- হ্যাঁ! আমি মারতে চাইনি। বিশ্বাস কর! আমি ওদের মারতে চাইনি!
গিন্নীমার কথা শুনে ভাবী মাথা ঘুরে পড়ে যেতে যেতে কোনমতে দেওয়াল ধরে সামলালেন!
শিহাব ভাই চিৎকার করে বললেন – আমি আপনাকে সাহায্য করেছি আর আপনি আমার ছেলেমেয়েকে মেরে ফেলেছেন? কেন গিন্নীমা ওরা তো আপনারও কিছু হত! ওরা কি করেছিল?
গিন্নীমা কাঁদতেই থাকলেন।
খুব ধীরে ধীরে বললেন- একদিন আমি খেয়াল করিনি। আমার ঘরের দরজা খোলা ছিল। আমি এই ভেতরে ছিলাম। ওরা দুইজন খেলতে খেলতে এখানে এসে সব দেখে ফেলেছিল! ওরা চিৎকার করতে চেয়েছিল। আমি তাই একজনের মুখ চেপে ধরেছিলাম। আর তৈয়ব অন্যজনের। ইমরান আমার হাতে ছিল। ওর নাকও যে চেপে রেখেছিলাম আমি বুঝিনি। ও নিশ্বাস নিতে না পেরে, বাতাসের অভাবে..মরে..আমি..আমি ইচ্ছা করে করিনি। আমি বুঝিনি সত্যি! অণু সেটাও দেখেছিল। ও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। এরপর.. এরপর আমরা ওদের মাটিচাপা দেই। অণুকে জীবন্তই দিয়েছিলাম। আর কোন উপায় ছিল না! আমি তখন আর কিছুই ভাবতে পারিনি! এই বাসার নিচে অনেক মাটির ঘর আছে। ওই ঘর দিয়ে এই মাটির ঘরে আসা যায়। আলমারি ছিল তাই তোমরা জানতে না। তাই আমি ওই রুমটাতেই রিনিকে বন্দী করেছিলাম। কারণ প্রয়োজনে তৈয়ব এই মাটির ঘর দিয়ে ওপরে আসত যাতে কেউ বুঝতে না পারে। রাতে প্রয়োজন হলে ও সিঁড়ি দিয়েই স্বাভাবিকভাবে আসত। সেই পায়ের শব্দই তোমরা পেতে।
গিন্নীমা আবার হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। সবাই বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। যেন বোবা হয়ে গেছে।
গিন্নীমা বললেন – ওদের মেরে ফেলে ওদের স্যান্ডেল ওই দরজার সামনে রেখে বলেছিলাম ওদের ভূত ধরে নিয়ে গেছে। তখনই গেটটা বাইরে থেকে একেবারে বন্ধ করে দেই। এরপর থেকে সবাই আরও ভয় পায়!
ভাইয়া হঠাৎই ধপ করে ভাবীর পায়ের সামনে বসে পড়েন।
এরপর ভাবীর পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন- আমাকে ক্ষমা করে দিও জোহরা! আমি ভাবতেই পারিনি এই ডাইনী মহিলা আমার বাচ্চাদের মেরে ফেলবে। আমাকে ক্ষমা করে দিও!
ভাবী হঠাৎই ছ্যাৎ করে সরে গেলেন।
সজীবকে বললেন – পুলিশ ডাকো। এই সবাইকে ফাঁসি দিক।
সাহির বলল- আমি আসার সময় পুলিশকে ইনফর্ম করে এসেছি। ওরা নিচেই আছে।
আমরা অবাক হয়ে তাকাতে সে বলল- আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি এসব পুরনো বাড়ি জাতীয় কেসগুলোতে ভূতপ্রেতের চেয়ে পারিবারিক জটিলতাই বেশি থাকে। তাই। আর এতক্ষণ যা যা কথা হয়েছে আমি রেকর্ড করেছি। আসলে কোন কেসে গেলে শুরু থেকেই রেকর্ড করি। অভ্যাস হয়ে গেছে। পরে কাজে দেয় অনেকসময়।
পুলিশ এল। গিন্নীমাকে হ্যান্ডকাফ পরানো হল। উনি যেন পাথর হয়ে গেছেন।
আমি গিন্নীমাকে বললাম – এখন কোথায় গেল মানসম্মান? সবার সামনে এভাবে যেতে ভাল লাগবে তো আপনার?
গিন্নীমা জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বললেন – তোমার জন্য আমার এত বড় সর্বনাশ হল। ছ’বছর ধরে সব লুকিয়ে রেখেছি। কেউ কিচ্ছুই টের পেল না! তার তুমি সব উল্টে দিলে। আজ অনামিকার পেট ব্যথার সময় তোমাদের না দেখেই আমি সন্দেহ করেছিলাম। আমার রুম লক দেখে সব বুঝে গিয়েছি। আমার অনেক বড় ভুল হয়েছে। অনেক বড়। আমি অপেক্ষা করছিলাম সজীব কবে সদরে যাবে। তখন আমি তুষারকে ড্রাগস দিয়ে তোমার ঘরে শুইয়ে রাখতাম। এরপর সজীবকে ডেকে দেখাতাম। এই পরিকল্পনাই করেছিলাম!
আমি আর সজীব হতবাক হয়ে গেলাম! কি ডেঞ্জারাস মহিলা উনি! গিন্নীমা, ভাইয়া আর তৈয়ব চাচাকে নিয়ে যাওয়া হল।
যাওয়ার সময় গিন্নীমা আমার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে বললেন – তুমি আমার সব শেষ করে দিলে নতুন বৌ। আমি তোমাকে ছাড়ব না। মরে গেলেও আমি ভূত হয়ে ফিরে এসে তোমার সর্বনাশ করব!
তার কথা শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল!
তুষারকে হসপিটালে নেওয়া হল। রিনিকে মেন্টাল হসপিটালে পাঠানো হল। কিন্তু রিনি তার দুইদিন পরই মারা গেল।
সব মোটামুটি ঠিক হলে সাহির একদিন এল।
সে বলল- কাজ করতে করতে এক্সপেরিয়েন্স হয়ে গেছে। কোথাও কিছু থাকলে বুঝতে পারি। এখানে এসেও বুঝতে পারছিলাম। অণু আর ইমরানের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। তাই তাদের আত্মা মুক্তি পায়নি। ওরা ভাল আত্মা ছিল। কিন্তু ওদের শক্তি কম ছিল। তাই ওরা রূপরেখার কাছে সাহায্য চেয়েছিল। আগেই অন্য কারো কাছে চাইতে পারত। কিন্তু চায়নি কারণ এই বাড়ির সবাই তো গিন্নীমার হাতের পুতুল ছিল! উনার ওপরে কেউ কথা বলত না।
– এখন কি মুক্তি পেয়েছে ওরা?
– হ্যাঁ। এখন যেহেতু জানাযা পরে সঠিকভাবে ওদের কবর দেওয়া হয়েছে, ওরা মুক্তি পেয়েছে।
সাহির আবার বলে- আর নূপুরের শব্দ যে না সেটা তো আগেই জেনেছেন। কিসের শব্দ তা নিজের চোখেই দেখেছেন। আর গিন্নীমা একটা প্লেটে নিজের খাবার নিতেন, একটায় রিনির। তুষারকে আটকে রাখার পর একটায় তুষারের। এই হল প্লেটের রহস্য।
সজীব আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করে – রূপরেখা তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?
আমি হঠাৎই তাকে প্রশ্ন করলাম- বিয়ের পরদিন তুমি আমাকে শাড়ি পরিয়ে দেয়ার অপশন দিয়েছিলে। তুমি কি কোনদিন রিনিকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছিলে?
সজীব চমকে উঠে জিহ্বা কামড় দিয়ে বলে- না না! ছি ছি! কি বলছ এসব? ও আমাকে বলেছিল বিয়ের পর শাড়ি পরিয়ে দিতে হবে। তাই ইউটিউব দেখে শিখতাম। সেখান থেকেই শিখেছি! রূপরেখা ও আমার পাস্ট। ও বেঁচে থাকলেও আমি তোমাকেই ভালবাসতাম। কারণ আমি এখন তোমাকেই ভালবাসি! কিন্তু তুমি তো বললে না! আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?
আমি উত্তর দিলাম- এই জমিদার বাড়িতে থাকতে থাকতে আমিও একটা ভুল করে ফেলেছি!
সজীব শঙ্কিত গলায় বলল – কি ভুল?
– জমিদার সাহেবকে ভালবেসে ফেলেছি!
আমি হেসে ফেললাম। সজীবও হেসে দিল।
তুষার সুস্থ হয়ে একদিন এসে সজীবের হাতে আমার হাত দিয়ে বলে- রূপরেখা, সজীব সাহেব তোমাকে আমার চেয়েও বেশি ভালবাসে। তুমি তাকে অনেক ভাল রেখ! আর আপনি সজীব সাহেব হাতটা শক্ত করে ধরুন। ছেড়ে দিলে কিন্তু আমি আর দ্বিতীয়বার চান্স দেব না!
সজীব হেসে বলে- ছাড়ার প্রশ্নই আসে না!
আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলাম- যদি কামড়ে দেই?
সজীব বলল- তাহলে আরও শক্ত করে ধরব।
গিন্নীমা আর তৈয়ব চাচার ফাঁসির আদেশ হল। ভাইয়ার চোদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। দুইমাস পরে খবর পেলাম গিন্নীমা মারা গেছেন। আরো কয়েক মাস পরে তৈয়ব চাচার ফাঁসি কার্যকর করা হল।
দশ বছর পর…
এই দশ বছর আমাদের খুব ভাল কেটেছে। সাত বছর আগে আমাদের ঘর আলো করে আমাদের জীবনে ছোট্ট এক পরী এসেছে। সজীব মেয়ের নাম রেখেছে মেঘমালা।
আমাদের বাড়ির প্রধান এখন মা। উনি এখনো আগের মতই আছেন। হাসিখুশি, শান্তশিষ্ট। ভাবী ওই ঘটনার পর কয়েকদিন খুব আপসেট ছিলেন। ধীরে ধীরে ঠিক হয়েছেন। অনামিকার বিয়ের কথা চলছে। সজীব এখন ভীষণ ব্যস্ত। সব তার একা সামলাতে হয়। এই ব্যস্ততার মাঝেও সে আমাকে আর আমাদের মেয়েকে সময় দিতে ভোলে না। গিন্নীমা মারা যাওয়ার পর তার ঘরটা বন্ধ করে রাখি। মাঝেমধ্যে খুলে পরিষ্কার করে আবার বন্ধ করে রাখা হয়।
একদিন ছুটির দিন সকালে আমি আর সজীব ড্রয়িংরুমে বসে চা খাচ্ছি। আর মেঘমালা দৌড়াদৌড়ি করছে। ড্রয়িংরুমে পূর্বপুরুষদের পেইন্টিং আছে। সেখানে গিন্নীমারও পেইন্টিং আছে।
মেঘ হঠাৎই সেই ছবির দিকে তাকিয়ে বলে- ওমা! দাদুটা একদম ছবির মত দেখতে!
আমি বিষম খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কি বললে মা?
– এই যে দাদুটা সামনাসামনিও একইরকম সুন্দর!
সজীব আতঙ্কিত গলায় বলে- আম্মু তুমি কোথায় দেখেছ দাদুকে?
– ওই যে যেই রুম বন্ধ থাকে। রানু খালা রুমটা পরিষ্কার করার জন্য খুলেছিল। আমি ওখানে খেলছিলাম। রানু খালা ঝাড়ু আনতে গিয়েছিল। তখন দেখেছি।
তার মানে মেঘ গিন্নীমার ঘরের কথা বলছে!
সজীব জিজ্ঞেস করল- দাদু কি করছিল?
– কিছু না। বিছানায় বসে ছিল। আর আমাকে হাত দিয়ে ডাকছিল।
– কি?!
– হ্যাঁ। হাসছিল আর ডাকছিল হাত দিয়ে। কিন্তু আমি যাইনি। কারণ তোমরা তো অপরিচিত মানুষের কাছে যেতে মানা করেছ। তাই না?
আমি আর সজীব ভীত, আতঙ্কিত চোখে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
গিন্নীমার বলে যাওয়া শেষ কথাগুলো বারবার কানে বাজতে লাগল- “মরে গেলেও আমি ভূত হয়ে ফিরে এসে তোমার সর্বনাশ করব!”

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প