দরজার_ওপাশে পর্ব০২ এবং শেষ পর্ব

গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসছে কারো কান্নার আওয়াজ।
দু’বছর আগে দরজার ওপাশের রুমটাতে লাবনীর সাথে আমার বাসর রাত হয়েছিলো। আজও আমার শ্বশুর বাড়ীর লোকেরা ফুল দিয়ে আমাদের জন্য বাসর ঘর সাজিয়েছেন। শুধুমাত্র রুমটা আলাদা। লোপা আর লাবনীর রুমটা পাশাপাশি।
আচ্ছা আমি কি লাবনীর সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি। এগুলো কি ভাবছি আমি..??
আমি যা করেছি ঠিকি করেছি লাবনীর মত আনসোশ্যাল মেয়ের সাথে সংসার করা যায় না। লোপাই আমার জন্য পারফেক্ট। ঘুমন্ত অবস্থায় আমার লোপাকে অপ্সরীর মত লাগে। আর এ মুখ দেখে হাজার বছর কাটাতে পারবো।
লোপাদের বাড়িতে এক সপ্তাহ ছিলাম। এই সাতদিনে লাবনীর সাথে একবারো দেখা হয়নি। আমার শ্বাশুরির সাথে দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু উনি আমার সাথে কোন কথা বলেননি হয়তো এখনো রেগে আছেন। সাতদিন ঘুরে বেরিয়ে, ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। লোপা তার পছন্দের সব জায়গায় নিয়ে গিয়েছে।
সকালের ট্রেনে ঢাকা চলে যাবো। রেডি হয়ে নাস্তা শেষ করে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। তারপর রওনা দিলাম নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। কাল থেকে শুরু হবে আবার ব্যস্ত জীবন ।
লোপাদের বাসার গেইটের সামনে আসার পরে মনে হল কেউ এক পলক দেখার জন্য পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে ফিরে তাকালাম দেখলাম লাবনী ওর রুমের সামনে বারান্দায় এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। নিজের অজান্তে চোখের কোণে জল এসে গেছে। আমি আর দেরি না করে দ্রুত ওখান থেকে চলে এলাম।
আজ আমাদের বিয়ের তেরোতম বিবাহ বার্ষিকী দেখতে দেখতে কিভাবে একযুগ কেটে গেলো। সামনে কেক নিয়ে বসে আছি। পুরো রুম অন্ধকার শুধু চারটা মোমবাতি জ্বালানো। কেকটা একাই কাটতে হবে লোপা এখনো বাসায় ফেরেনি। ইদানীং ও অনেক ব্যস্ত। অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে। হয়তো এই বিশেষ দিনটার কথা ভুলে গেছে। লোপা আর আগের মত নেই অনেক বদলে গেছে।
বিয়ের প্রথম চার বছর আমরা খুব সুখেই ছিলাম। পৃথিবীর সব থেকে সুখি মানুষ ছিলাম আমরা দু’জন।
যেদিন শুনতে পেলাম লাবনী প্রেগন্যান্ট ওই দিন থেকে আমার সুখের ঘরে আস্তে আস্তে করে আগুন লাগতে শুরু করলো।
লোপাও মা হতে চায় বেবি নেবার জন্য সেও উঠে পরে লেগেছে। জন্মমৃত্যু আল্লাহর ইচ্ছাতে হয়। আল্লাহ যদি না দেয় কারো ক্ষমতা আছে বাচ্চা দেবার।
কত চেষ্টা করলাম,, ডাক্তার দেখাল, বিদেশেও ট্রিটমেন্ট করালাম কোন কিছুই হলো না বাচ্চার মুখ আর দেখতে পারলাম না।
আমার আর লোপার কারো কোন সমস্যা নেই দু’জনে সন্তান জন্মদিতে সক্ষম। তার পরেও আমাদের কোলজুড়ে কোন সন্তান আসেনি।
বাচ্চা বাচ্চা করে প্রথম প্রথম কথা কাটাকাটি,মন মালিন্য হত, এর পর ঝগড়া ঝাটি । প্রতিদিনি ঝগড়া লাগত এমনও হত সহ্য না করতে পেরে গায়ে হাত তুলে ফেলতাম। চার/ পাঁচ দিনেও কেউ কারো সাথে কথা বলতাম না।
এখন মাসেও একদিন লোপার সাথে কথা হয় না। একি ছাদের নিচে থাকি ঠিকি কিন্তু আলাদা আলাদা রুমে। আমরা এখন নামে মাত্র স্বামী -স্ত্রী। গত তিন বছর ধরে আলাদা থাকি।
লাবনীর সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি আমি। এইজন্য আল্লাহ তালাহ তার শাস্তি আমাকে প্রতিনিয়ত দিয়ে যাচ্ছে।
লাবনী স্বামী সংসার নিয়ে অনেক সুখে আছে। দুইটা ছেলে আছে ওদের ঘরে । নিজে এখন প্রতিষ্ঠিত। কলেজের সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে আছে। আমি ডিভোর্স দেবার তিন বছর পরে নিজের পছন্দ মত ডাক্তার ছেলেকে বিয়ে করেছে। শুনেছি ওর স্বামী খুব ভালো মানুষ লাবনীকে অনেক ভালবাসে।
অনুসূচনায় শেষ হয়ে যাচ্ছি আজ। যদি লবনীকে ডিভোর্স না দিতাম..? যদি ওর সাথে সংসার থাকতো..? তাহলে হয়তো আমিও সুখে থাকতাম। আমিও সন্তানের বাবা হতাম, বাবা ডাক শুনতে পেতাম।
ভুল করেছি অনেক বড় ভুল। আমি লাবনীর মত মানুষকে বিশ্বাস করে ভুল করেছি।
লোপাকে বুঝানোর জন্য,সংসারের ঝামেলা ঠিক করার জন্য বন্ধু রাশেদকে বাসায় থাকতে দিয়েছিলাম।
এখন দেখি বন্ধু আমার লোপাকে বুঝাতে বুঝাতে নিজের করে নিয়েছে। আমাকে কিক মেরে দূরে ফেলে দিয়েছে। রাশেদ আর লোপা এক বছর ধরে রিলেশনে আছে। ছুটির দিন বাসায় থাকে না রাশেদের সাথে লং ড্রাইভে চলে যায়। প্রায় সময় রাত করে বাসায় ফেরে।
লোপাকে পড়াশুনা করিয়ে বিসিএস ক্যাডার বানিয়েছি। আর এখন সে বলে আমি নাকি আনসোশ্যাল ওর যোগ্য না।
এই কথা শোনার জন্যই তো লোক ধরে ঘুষ দিয়ে তোমারে ক্যাডার বানিয়েছি। সবি আমার কপাল।
আমিও সব নিরবে মেনে নিয়েছি। সমাজের মানুষের কথার ভয়ে, সম্মান বাঁচানোর জন্য।
লোপা আমার কাছ থেকে মুক্তি চায়। খুব তাড়াতাড়ি রাশেদকে বিয়ে করবে। আমাকে উকিলের সাথে কথা বলে কাগজপত্র ঠিক করতে বলেছে।
আমিও এখন গভীর রাতে দরজার ওপাশে লোপা আর রাশেদের হাসি ঠাট্টার আওয়াজ পাই। শুনতে পাই ওদের ভালোবাসার খুনসুটি…
কিন্তু লোপা তুমি তো শুনতে পাওনা দরজার এপাশের নিঃশব্দের কান্নার আওয়াজ।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প