সকালটা ঝিমধরা। কলকাতার এই বসন্তের সকালগুলোতে একটা অদ্ভুত ধোঁয়াশা থাকে—হালকা রোদ, হালকা বাতাস, আর রাস্তাঘাটে চলা নীরব ব্যস্ততা। নিশু তখনো ঘুমের ঘোরে, হঠাৎ দরজার বেল টনটন করে বেজে উঠলো।
“কে এত সকালে?” বিছানা থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা খুলতেই অভিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিশু চমকে উঠলো।
হাতে কফির মগ, চোখে অল্প ঘুমের ছাপ, মুখে হালকা হাসি।
“গুড মর্নিং, ঘুম ভাঙানো হয়েছে বুঝি?” অভি হেসে বলল।
“তুমি কী ঘড়ি ধরে আসো?” নিশু একটু বিরক্ত, একটু কৌতূহলী।
“না, কিন্তু এই শহরে নতুন আসা কেউ যদি সকালে কফির ঘ্রাণ না পায়, তাহলে সেটা অন্যায় হবে না?” বলেই ও একটা মগ এগিয়ে দিল।
নিশু নিতে নিতে বললো, “আজ শনিবার। ছুটির দিন। একটু ঘুমাতে দিলেও পারতে।”
“ঘুমিয়ে জীবন কেটে যাবে, কলকাতা চিনবি কখন?” অভি চোখ টিপে বলল।
শেষমেশ, ছাদে গিয়ে তারা দুজন একসাথে বসলো। ছাদে কুয়াশা আর রোদ মিশে একটা সোনালি পর্দা তৈরি করেছে।
“তুমি এখানে কতদিন?” নিশু জিজ্ঞেস করলো।
“দেড় বছর হতে চললো। পিসিমার ফ্ল্যাটে উঠেছিলাম চাকরির জন্য। এখন চাকরি আছে, কিন্তু থেকে গেছি। শহরটা ভালোবেসে ফেলেছি,” অভির চোখে তখন দূরের কিছু।
“তুমি আর্কিটেক্ট, তাই তো?” নিশু কৌতূহলে জিজ্ঞেস করলো।
“হ্যাঁ। পুরনো বাড়ি নিয়ে কাজ করতে ভালো লাগে। সেই কারণেই কলকাতা। এখানে অতীত টিকে আছে, নতুনত্বের সঙ্গে মিশে।”
“তুমি অনেক গভীর কথা বলো,” নিশু একটু মৃদু হেসে বলে।
“আর তুমি অনেক সরলভাবে শোনো। তাই বলি।”
একটা নিঃশব্দতা নেমে এলো। তারপরে অভি বললো, “চল, আজ কলকাতাকে একটু চিনে নিই। শহরটা নিজের হাতে ছুঁয়ে দেখলে বুঝতে পারবি, এর ভেতর কত গল্প লুকিয়ে আছে।”
নিশু একটু দ্বিধা করলেও রাজি হলো। নতুন শহর, আর একটুখানি সাহস নিয়ে তৈরি হওয়া নতুন সম্পর্কের ডাকে সাড়া না দিয়ে উপায় কোথায়?
—
কলেজ স্ট্রিট, দুপুর ১২টা
বইয়ের গন্ধে ভরা সরু গলিগুলো। অভি আর নিশু হাঁটছে পাশাপাশি। অভি দোকানের পুরনো বইগুলো ঘাঁটছে, নিশু তাকিয়ে আছে তার হাতের গতির দিকে।
“এই জায়গাটা আমার প্রিয়,” অভি বললো, “শুধু বইয়ের জন্য না, এখানে এসে সময় থেমে যায়।”
“তুমি কি সব জায়গাকে এত রোমান্টিক করে দেখো?” নিশুর কণ্ঠে খুনসুটি।
“না, শুধু যেগুলো ভালোবাসি। যেমন এই জায়গাটা, কিংবা…” অভির চোখ একবার থেমে যায় নিশুর মুখের উপর।
নিশু হঠাৎ একটু অস্বস্তিতে চোখ নামিয়ে ফেলে।
—
বিকেল — রবীন্দ্র সরোবর
পানির ধারে বসে অভি বললো, “জানিস, আমি একসময় খুব রাগী ছিলাম। সম্পর্ক মানে আমার কাছে ছিল নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু একটা মেয়ে আমাকে শেখালো—ভালোবাসা মানে শুধু পাওয়া নয়, কিছু না পেয়েও শান্ত থাকা।”
নিশু চুপ করে শুনছে।
“সে এখন নেই,” অভি ধীরে বললো, “একটা ভুল বোঝাবুঝিতে হারিয়ে গেলো। হয়তো আর কোনোদিন ফিরে আসবে না।”
নিশুর বুকটা একটু ভারি হয়ে উঠলো। এমন গল্প তো তারও আছে—তাকে ছেড়ে যাওয়া, কিংবা কাউকে ছেড়ে আসা। সেই একই শূন্যতা, অন্য কারো মুখে শুনলে কেন যেন আরও বেশি বাস্তব লাগে।
—
রাত — নিশুর ফ্ল্যাট
নিশু ডায়েরি খুলে লিখছে:
“অভির চোখে একটা ছায়া আছে। সেই ছায়ায় কি আমি নিজেরই ছায়া দেখতে পাচ্ছি? নাকি সে কাউকে খুঁজছে, যার বদলে আমি কেবল ছায়াস্বরূপ হয়ে উঠছি?”
খুলে রাখা জানালায় বৃষ্টির জল ছিটকে পড়ছে। নিশু জানে না, তার ঠিক পাশের ঘরে অভি বসে আছে এক পুরনো ফটো অ্যালবামের সামনে। ছবির মেয়েটা অনেকটা নিশুর মতো।
অভি ফিসফিস করে বলে, “তুই কি সত্যিই ফিরে এসেছিস, নাকি শুধু ছায়া হয়ে ফিরে এলি?”