সতীনের ঘর পর্ব ০৫

অনেকদিন পর বিজয়ের সাথে ছাদে আসা।রাতের আকাশে চাঁদটা কেমন ঝলমল করে জ্বলছে। বিজয় ছাদের এক পাশে দাড়িয়ে,আমি অন্য পাশে।খুব কাছাকাছি না,আবার বেশি দূরেও না। বিজয় একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আমাকে বললো
– কি বলতে চাও,বলো।
– আমি জব করতে চাই।(ভয়ে ভয়ে‌ বললাম)
– কোথায়?
– এখনো ঠিক করিনি তবে কুইন বলেছে যদি জব করি তাহলে খুজে দিবে।
– আচ্ছা।
– কি আচ্ছা?
– কুইন কে বলো জব খুজতে।
– তুমি না এক সময় আমার জব করা পছন্দ করতে না,এখন এত সহজে রাজি হয়ে গেলে?
– কেনো রাজি না হলে কি খুশি হতে?
– নাহ্,তবে এত সহজেই রাজি হবে ভাবিনি।
– পৃথিবীতে অনেক কিছুই মানুষের ভাবনার বাইরে থাকে।
– হুম,যেমন তোমার আমার সম্পর্কটা সব ভাবনার বাইরে ।
– আচ্ছা বলতে পারো,আমাদের জিবন টা এমন কেনো হলো?অন্যরকম ও তো হতে পারতো।
– আমিযে মা হতে অক্ষম তাই হয়তো!
– আমরা চাইলেই একটা বাচ্চা দত্তক নিতে পারতাম।
– তাতে তুমি খুশি হলেও,তোমার পরিবার খুশি হতো না।
বিজয় আমার আরেকটু কাছে এসে বললো
– একটা সত্যি কথা বলবে?
– কি কথা?
– এখনও কি ভালোবাসো আমায়?
– অনেক রাত হয়েছে‌ ঘুমাতে গেলাম।
– এড়িয়ে যাচ্ছো?
– হুম,যেমন তুমিও এড়িয়ে যাও আমার প্রশ্ন গুলো।
– আকাশের চাঁদ টা কত সুন্দর দেখাচ্ছে,তাইনা?
– হ্যা,তবে সেটা আমাদের জন্য না,একসাথে চাঁদ দেখার অধিকার আমরা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছি।
– ভুলে যেওনা,তুমি এখনও আমার স্ত্রী।
– সেটাতো শুধু কাগজে।
– এভাবে কেনো নিজেকে আড়াল করে রাখো?
– তুমি নিজেকেই প্রশ্ন করো,উত্তর পেলেও পেতে পারো।
– তোমার সাথে তর্ক করে পারবোনা,তাই তর্কে যেতে চাইনা।
– তাহলে ঘুমাতে যাও।
– আর তুমি?
– আর কিছুক্ষন না হয় থাকি,চাঁদ দেখি।
– আমি তোমার পাশে থাকলে কি খুব ক্ষতি হবে?
– ক্ষতি হবে কিনা জানিনা তবে তোমার বউ জলবে।
– তুমিও তো আমার বৌ।
– তাতে কি!
– তোমার জলে না?
– জল্লেও,মলম লাগেনা।
– এভাবে কেনো সব অধিকার ছেরে দিলে?
– তুমিতো তাই চেয়েছিলে।
– সত্যিই কি বুঝো আমি কি চাই?
– বুঝিনা বলেই তো,আর বুঝতে চাইনা।
– তোমার হাত টা একটু ধরতে দিবে,অনেক দিন এই হাতের স্পর্শ পাইনা।
– এই হাতের স্পর্শ হয়তো তোমার আর প্রয়োজন হয় না।
– আজ প্রয়োজন।
– এটা তোমার ক্ষণিকের আবেগ।
– এটা আবেগ না,ভালোবাসা।
বিজয় ক্রমে ক্রমেই আমার আরো কাছে আসতে লাগলো।আমি চলে আসতে চাইলাম ও আমার হাত ধরে থামিয়ে দিলো।
কাছে এসে কপালে, গালে চুমু খেতে লাগলো।আমি নিজেকে ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না,ওর শক্তির কাছে,ওর স্পর্শের কাছে হেরে যাচ্ছিলাম।ও আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো,যেনো পালাতে না পারি।আমিও যেনো কোথায় হারিয়ে যাচ্ছি,নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিনা।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বললাম,অনেক রাত হয়েছে ঘুমাবো।
বিজয় বললো আচ্ছা চলো একসাথেই যাই।আমি শাশুরির ঘরে থাকার জন্য গেলাম কিন্তুু দরজাটা ভেতর থেকে লাগানো ছিলো।উনি তো দরজা লাগান না,তাহলে কি উনি কোনো ভাবে বুঝে গেছেন আমি আর বিজয় এক সাথে আছি।আজ তাহলে ঐ খালি ঘরটায় থাকতে হবে।
ওই রুম পর্যন্ত বিজয় আমাকে এগিয়ে দিয়ে ঠায় দাড়িয়েই আছে।আমি বললাম
– কি হলো ঘুমাতে যাও।
– তোমার পাশে একটু জায়গা দিবে?
– কিন্তু…
– কোনো কিন্তু না,প্লিজ ফিরিয়ে দিয়োনা আমাকে।
– কি লাভ মিথ্যে মায়া বাড়িয়ে?
– লাভ ক্ষতির হিসাব তো অনেক আগেই ভুলে গেছি।প্লিজ আজকে একটু সময় দাওনা আমাকে।কথা দিলাম তুমি না চাইলে আর কখনো এমন দাবি করবো না।
ওর এমন ভাবে অনুরোধ করাতে,মানা করতে পারলাম না।সেই রাত টা দুজনে একসাথেই কাটালাম।এতদিনের রাগ,অভিমান সব যেনো কোথায় হারিয়ে গেছে।সব অভিমান গুড়িয়ে,নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুজনে মিশে একাকার হয়ে গেছি।
সকালে ছোটোর চিল্লাচিল্লিতে ঘুম ভাঙ্গলো।
কাজের মেয়ের সাথে কি নিয়ে যেনো রাগারাগি করছে।ঠিক কি নিয়ে এমন করছে জানিনা তবে বেশ বুঝতে পারছি ও রেগে আছে।রাতে স্বামী ঘরে যাইনি বলে কথা।
আমারও রাতে বিজয় কে জায়গা দেওয়া টা ঠিক হয় নি।আমি কি করে ভুলে যেতে পারি ওর স্বার্থপরতার কথা!ওতো আমাকে কম কষ্ট দেয়নি বরং কষ্ট দিতে কোনো ফাঁকফোকর বাকি রাখেনি।মেয়েদের এই একটা সমস্যা,প্রিয় মানুষ যতই কষ্ট দিকনা কেনো,একটু ভালোবেসে কাছে টানলে সব ভুলে যায়। কিন্তুু আমার তো ভুলে গেলে চলবেনা,নিজেকে শক্ত হতে হবে,এগিয়ে যেতে হবে।আমি আর বিজয়ের কাছাকাছি যাবো না,আমি যে ওর কাছে গেলে দুর্বল হয়ে পরি,আর এই দুর্বলতাই আমার কষ্টের কারন।যদি ভালো থাকতে হয় নিজেকে ওর কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে।
কুইনের সাথে কথা বলে একটা জবের ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। অফিসের ম্যানেজার সাজ্জাত কুইনের খুব ভালো ফ্রেন্ড।তবে আমার চাকরিটা কোনো সুপারিশে হয়নি,নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেই পেয়েছি।
শুরু হলো আমার নতুন জিবন।সকালে অফিসে চলে যাই, বাসায় আসি সন্ধ্যায়।মাঝে মাঝে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হয়ে গেলে ,কুইন আমি একসাথে আড্ডা দেই।
বাইরে কিছু খাই,শাশুড়ি চটপটি খুব পছন্দ করেন,ওনার জন্যও নিয়ে নেই।
মার্কেটে যাই নিজের জন্য কিছু কিনি,পরীর জন্যও কিনি। কিন্তুু আমি কিছু দিলে ছোটো সেটা পরী কে নিতে দেয়না,পরী তো ওর কথা শুনেনা,নিতে না দিলেও জোর করেই কান্নাকাটি করে নেয়।পরী এখন অনেক টাই বড়ো হয়ে গেছে,ভাঙ্গা ভাঙ্গা কথা বলে।আমাকে মামনি বলে ডাকে।ছোটো আগের মতোই প্রায় আমায় কথার মারপ্যাঁচে অপমান করে,অফিস থেকে বাসায় আসলেই আমাকে দেখে মুখ গোমড়া করে রাখে,আমি ওর এই মুখ গোমড়া করে রাখার কারনটা ঠিক খুজে পাইনা। খুজার প্রয়োজন ও মনে করিনা। ও অপমান করলেও,এখন আর ওইসব বিষয় গায়ে মাখিনা।
বিজয়ের সাথেও যথেষ্ট দুরত্ব বজায় রাখি।
ওর সাথে শুক্রবার ছাড়া দেখা হয় না,দেখা হলেও তেমন কথা হয়না।
কুইন ঠিক ই বলেছিলো,কাজে ব্যাস্ত থাকলে অনেক কিছু ভুলে থাকা যায়।এখন আর আমার আগের মত একা অনুভব হয় না,আগের মত রাত ও জাগি না।সারাদিন কাজ শেষে ক্লান্ত শরীর যখন বিছানা পায়,নিজের অজান্তেই ঘুমের দেশে হারিয়ে যাই।অফিস,কাজ,ঘুম,বান্ধবীর সাথে আড্ডা,সব মিলিয়ে ভালই আছি।
এভাবেই কেটে গেলো দুই বছর।
আমি এখন অফিসে মোটামুটি সুনাম অর্জন করেছি।আমার কাজে বস অনেক খুশি।সাজ্জাত কুইনের বন্ধু,এখন আমারও ভালো বন্ধু হয়ে গেছে।সাজ্জাত আমাকে অফিসের কাজে অনেক হেল্প করে,ওর জন্যই এতটা এগোতে পেরেছি।
একদিন সাজ্জাত বললো,অফিস থেকে নাকি দেশের বাইরে বিজনেস করার পরিকল্পনা চলছে,কয়েকজন‌ কর্মী নেওয়া হবে। যারা দেশের বাইরে কোম্পানির প্রোডাক্ট গুলো তুলে ধরবে,এতে কোম্পানির বিজনেস অনেক টা এগিয়ে যাবে।এইটা করতে গেলে কয়েকজন দায়িত্ববান কর্মী লাগবে,আর বস নাকি সেখানে আমাকেও নির্বাচন করেছে বাট প্রবলেম একটাই যেই যাবে জুটি নিয়ে যেতে হবে, যারা যাবে তারা স্বামী স্ত্রী এক সাথেই এই কোম্পানিতে জব করতে পারবে,আপাতত দশ বছরের জন্য নেওয়া হবে,পরে চাইলে তারা আরো মেয়াদ বাড়িয়ে সেখানে একবারে সেটেল ও হয়ে যেতে পারবে।আমার জুটি নেই বলে তেমন একটা মাথা ঘামাইনি ব্যাপারটা নিয়ে, অফিসের কেউ তো আর জানেনা আমার ব্যাপারটা,যেহেতু আমার বায়ো তে বিবাহিত দেওয়া তাই তারা আমাকে নির্বাচন করেছে,জানলে হয়তো‌ করতো না।
এর মাঝে ছোট আবার মা হতে চলেছে।‌বিজয়ের‌ ছোটোর প্রতি অন্য সময়ের তুলনায় যত্ন,ভালোবাসা একটু বেড়েই গেলো,এটাই স্বাভাবিক।প্রতিটি দায়িত্ববান স্বামীর উচিৎ,এই সময়টায় স্ত্রীর পাশে থাকা।বিজয় ও দায়িত্ব পালনে অটুট।কিন্তু আমাকে আবারো একবুক হতাশা ঘিরে ধরলো,মা না হতে পারার কষ্টটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।ওদের এই প্রেম প্রেম ভাবটা আমার ঠিক সহ্য হয় না।কেনো জানি বুকের ভিতরটা জলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।আমি নিজের মনকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেও পারিনা।আমি চাইনা আমার মনে এমন ভাবনা গুলো আসুক,তবুও এমন ভাবনা এসেই যায়, না চাইতেও। সতীন বলেই হয়তো এমনটা হয়,স্বামীর ভাগ দেওয়া যে কতটা কষ্টের যে দেয় একমাত্র সেই জানে।
অফিসে কাজ করছিলাম এমন সময় ফোন আসলো, বিজয় ফোন দিয়েছে।মোবাইলটা হাতে নিয়ে একটু চমকে গেলাম কি হলো, বিজয় তো আমাকে ফোন দেয়না‌, হটাৎ ফোন!বেশি না ভেবে কল টা ধরলাম
– হ্যালো
– তুমি কি একটু অ্যাপোলো হসপিটালে আসতে পারবে?
– কেনো কি হয়েছে???
– আগে এসো,পরে বলছি।
– এখন তো অফিসে কাজ করছি।
– ছুটি নিয়ে এসো।
– আচ্ছা দেখছি।
হসপিটালে এসে দেখি,ছোটো চিৎকার করছে,আমি বিজয়ের কাছে জানতে চাইলে বললো
– বাথরুমে পরে গিয়ে ব্লাড যাওয়া শুরু হইছে,ডাক্তার বলছে এখনই সিজার করতে হবে,না হলে বাচ্চা বা মা কাউকেই বাচানো যাবেনা।আর অপারেশনের জন্য রক্তের প্রয়োজন,তুমি কি দিতে পারবে?
– হ্যা পারবো।তারপর রক্ত দিলাম,ডাক্তার অপারেশন করলো,২টা যমজ ছেলের জন্ম দিলো ছোটো। কিন্তুু বাচ্চা গুলো সময়ের আগেই ডেলিভারি হওয়াতে একটু অপুষ্ট।তবে ডাক্তার বলেছে ঠিক মত যত্ন নিলে,মায়ের দুধ ঠিক মত পেলে ওরা তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
আমি শুধু পাশে বসে ভাবছিলাম,বিধাতা যাকে দেয় কোল ভরে দেয় আর যাকে না দেয় একেবারেই দেয় না।আমাকে এমন একটা বাচ্চা দিলে কি এমন ক্ষতি হতো!
যমজ বাচ্চাদের সামলাতে গিয়ে ছোটো পরীর ঠিক মত যত্ন নিতে পারেনা।তাই পরী এখন রাতে আমার সাথেই থাকে।দিনের বেলা শাশুড়ি ওর খেয়াল রাখে।এভাবেই দিন গুলো যাচ্ছিলো। ছেলে বাচ্চা গুলোও আস্তে আস্তে বড়ো হতে লাগলো, কিন্তূ বাচ্চা গুলো প্রায় অসুস্থ থাকে।আমি সময় পেলে ওদের কে কোলে নেই।সময় ই তো নেই হাতে,কাজের চাপ এখন অনেক বেশি।রাতে ফিরতে ফিরতে বারোটা বেজে যায়।বেশি রাত হয়ে গেলে বিজয় আমাকে গাড়ি নিয়ে অফিস থেকে নিয়ে আসে।আমি নিষেধ করলেও শুনেনা,বলে এত রাতে মেয়ে মানুষ একা একা যাওয়া ঠিক না,রাস্তা ঘাটের পরিস্থিতি তো ভালোনা।আমার ও এত রাতে একা একা রাস্তা দিয়ে আসতে ভয় লাগে, বাসে উঠলে মনে হয়,যদি বাস অন্য রাস্তা দিয়ে নিয়ে চলে যায়,আজকাল তো কত কিছুই হয়, ক্রাইম পেট্রোলে এমন অনেক কিছুই দেখি।তবে এই ভয়ের কথা আমি ও কে বলিনি,বিজয় নিজের থেকেই আমাকে নিতে আসে। বিজয় নিতে আসলে একটু স্বস্তি অনুভব করি,ওর সাথে নিশ্চিন্তে বাসায় চলে আসি।বাসায় এসে ছোটোর রাগে লাল হওয়া মুখটা দেখে আমি না হেসে পারিনা।
একদিন বিজয় আর ছোটোর খুব ঝগড়া হলো….

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প