বাস্তব জীবনে নিজ চোখে ভুত-প্রেত বা জ্বীন দেখা একজন মানুষের সাথে দেখা করার ইচ্ছা আমার দীর্ঘদিনের। আজ হঠাৎ এমন একজন মানুষ, যে কিনা ৬টা জ্বীন পোষে তার সাক্ষাৎ পেয়ে তাই মনটা আমার উত্তেজনায় ভরে উঠলো। আমি কণ্ঠে প্রচণ্ড আগ্রহ ফুটিয়ে তোলে সামনে বসা মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার জ্বীন গুলো কী আপনার সঙ্গে থাকে?’
মহিলাটি শুধু মুচকি হাসলো, কোনো উত্তর দিল না। এমন সময় তার অদূরে একটা পাখির খাঁচার দিকে আমার চোখ পড়লো। খাঁচায় অদ্ভুত দেখতে ৬টি একদম দবদবে সাদা পাখি। একটা আরেকটার সঙ্গে গা লাগিয়ে বৃত্ত করে ঘুমাচ্ছে। আমার সমস্ত শরীর জুড়ে একটা অদ্ভুত পুলক বয়ে গেল। আমি খাঁচার দিকে একটু এগিয়ে গেলাম। আমার উপস্থিতিতেই যেন পাখিগুলো একটু নড়ে উঠলো। এরপর ৬টি পাখিই একসঙ্গে মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো। তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কী ছিল আমি জানি না। আমি যেন একটা ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে এলাম। উঃ বলে আর্তনাদ বেরিয়ে এলো গলা দিয়ে। মহিলাটির দিকে তাকাতেই দেখলাম তার মুখে এখনো চাপা হাসি লেগে রয়েছে। মলিন শাড়ি কাপড় পড়া কোঁকড়া চুলো এই মহিলাটিকে দেখে এই প্রথম আমার সামান্য ভয় করতে লাগলো। বিকেল আর সন্ধার সন্ধিক্ষণে লঞ্চের ভেতর এবং বাহিরের পরিবেশটা কেমন অদ্ভুত লাগলো। আমি ব্যাগটা কাঁধে তুলে মুচকি হেসে বললাম, ‘আমি একটু ছাদে যাচ্ছি। আপনার কিছু লাগবে?’ মহিলাটি বললো, ‘না, বাবা।’
জুতো হাতে করে ১০-১২জন ঘুমন্ত মানুষের পাশ কাটিয়ে ছাদের সিঁড়ির কাছে পৌঁছুলাম। লঞ্চ ভর্তি মানুষ। ঢাকায় পৌঁছুতে আরো ৬ ঘণ্টা লাগবে সম্ভবত। ছাদে ইঞ্জিনের ভয়ানক বাজে শব্দ বাদে আর সবকিছুই সুন্দর। ঢাকা গামী এই লঞ্চে উঠেছি দুই ঘন্টা হবে। এরমধ্যে একমাত্র সেই মহিলাটি ছাড়া আর কারো সঙ্গে পরিচিতি ঘটেনি। আমি সাতার না জানলেও নদী ভালোবাসি। তাই লঞ্চে উঠেই গন্তব্য স্থানে পৌঁছুন পর্যন্ত ছুটোছুটির ভেতর থাকি। একবার এমাথা থেকে ওমাথা, ছাদ, লঞ্চের সামনের খোলা অংশ। লঞ্চে উঠার পর সেই ঘুরতে ঘুরতেই দূতলার একটা অংশ হেটে যাচ্ছিলাম। পেছনের দিকে চাদর,পাটি বিছিয়ে প্রায় পুরো জায়গাটা ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। এমন সময় চোখ গেল সেই মহিলার দিকে। একটা চাদরে একা চুপচাপ বসে আছে। আমাকে দেখে হয়তো ভেবেছিল আমি বসার জন্য জায়গা খুচ্ছি। তাই আমাকে আহ্বান করে নিঃসংকোচে বসতে বলল। আমিও বসে পড়ে তার সাথে আলাপ জমালাম। ব্যাগ রাখার জন্য একটি জায়গাত হবে। তাছাড়া সন্ধ্যার পর শীত বাড়লেও আরাম করে বসার জায়গা পাওয়া যাবে। যদি না তার সাথে অন্য কোনো মানুষ থাকে।
টুকটাক আমার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করলেন তিনি। কোথা থেকে এসেছি, কী কাজ করি, বাড়ি কোথায় ইত্যাদি। কিন্তু সেই পর্যন্ত সত্যিই আমার চোখে কোনো পাখির খাঁচা চোখে পড়েনি। মহিলাটি সম্পর্কে যখন জানতে চাইলাম তখনই তিনি অদ্ভুত কথাবার্তা শুরু করলেন। তিনি বললেন, তার আপন কেউই বেঁচে নেই। তবে জ্বীন তাড়ানোর তার অদ্ভুত অলৌকিক ক্ষমতা আছে। এক হুজুর গ্রামে এসে তার সেই অদ্ভুত শক্তির পরিচয় পেয়ে তাকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ করেন। সেখানে তার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। তারপর তার জ্বীন তাড়ানোর নানান ঘটনা গ্রামে তার কত প্রভাব ইত্যাদি আমাকে শুনাতে লাগলেন। অবাস্তব আর অবিশ্বাস্য লাগলেও আগ্রহ ভরে আমি তার সমস্ত কথা শুনে গেলাম। এক পর্যায়ে আমার ধারণা হলো তিনি অপ্রকৃতিস্থ। নাহলে এত বিশ্বাসের সাথে এইসব কথা আজ পর্যন্ত কারো কাছে শুনিনি আমি। কিছুটা কৌতূহলী অবশ্যই হলাম তার কথা শুনে। এবং শেষে তিনি গর্বের সাথেই বললেন, তিনি নিজে ৬টা জ্বীন পালেন। ঠিক পরের মুহূর্তেই হঠাৎ অদূরে খাঁচা বন্ধি ৬টি অদ্ভুত পাখি দেখে তাই আমার মন একটু আতঙ্কিত হলো এবং এক প্রকার পালিয়েই চলে এলাম তার কাছ থেকে।
ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ হবে। হঠাৎ একটু ঝুকে নীচে তাকাতেই দেখলাম কতগুলো পাখি যেন নিচ থেকে বেরিয়ে উপরে উঠে আসছে। আশ্চর্য্যই! তাদের গতি তেমন দ্রুত না হওয়ায় স্পষ্ট গুনতে পারলাম ৬টি সাদা পাখি। মহিলাটির পাশে খাঁচার ভেতর যেগুলো দেখেছিলাম এগুলো ওগুলোই চিনতে পারলাম। এরপরেই আরেকটা কমলা রঙের পাখি নিচ থেকে উঠে এলো। ৭টি অদ্ভূত পাখি কিছুক্ষণ লঞ্চের উপর চক্কর কেটে দূরে কোথাও চলে গেল। ভেতরে এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করলাম। কিছু যেন একটা ঘটে গেছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম আমার মতো আরো অনেক মানুষ অবাক হয়ে উপরে তাকিয়ে পাখিগুলো দেখছে। আমি দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলাম। এতক্ষণে লঞ্চের সমস্ত বাতি জ্বলছে। মহিলাটি যেখানে বসেছিল ওখানে তাকিয়েই দেখতে পারলাম মহিলাটি নেই। খাঁচার ভেতরে পাখিগুলোও নেই। শুধু একটা শূন্য খাঁচা আর শূন্য চাদর পড়ে আছে। আবার মানুষজন ডিঙিয়ে সেখানে পৌঁছুলাম। কৌতূহল চোখ দিয়ে চারপাশে সেই কোঁকড়া চুলো , মাঝবয়সী শীর্ণ বস্ত্রের মহিলাটিকে খুঁজতে লাগলাম। না দেখতে পেয়ে উত্তেজনায় আমার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো। আমি হতভম্ব হয়ে পুরো লঞ্চ ছুটে বেড়ালাম। নিশ্চিত সেই মহিলাটিকে আর খুঁজে পাবো না জেনেও পাগলের মতো পুরো লঞ্চ জুড়ে তাকে খুঁজে বেড়ালাম। লঞ্চে অবস্থানরত খুব কম মানুষই হয়তো ছিল যাদের মুখের উপর আমি একবার অন্তত তাকাইনি।
শেষে আবার সেই চাদর আর খাঁচার কাছে ফিরে এলাম। মাথা কিছুটা ঠাণ্ডা হতেই পাশে চাদর পেতে বসা এক লোককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই যে আঙ্কেল, এখানে যে একটি মহিলা বসে ছিল সে কোথায় গেছে বলতে পারেন?’ লোকটা ঘুম জড়ানো চোখ একটু স্বাভাবিক করে উত্তর দিলেন, ‘কি জানি! একটু আগেও তো এইখানে দেখছিলাম, এরপর চোখ লাইগা গেছিল। আপনার কিছু নিয়া ভাগছে নাকি?’ আমি উদ্ভ্রান্ত ভাবে , না বললাম। সেই চাদরেই ঝিম মেরে বসে রইলাম কতক্ষণ কে জানে। তারপর একটা লোক ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমার অনুমতি ছাড়াই পাশে বসলো। তারপর কণ্ঠ কিছুটা জোরালো করে বলল, ‘আমি আগেই সন্দেহ করছিলাম, মহিলাটা জ্বীন।’ আমি বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকালাম। আমার পাশের লোকটাও লোকটার দিকে মনোযোগ দিল। জ্বীন শব্দটা শুনেই যেন উৎসুক দৃষ্টিতে চারপাশের অনেকগুলো চোখ লোকটার মুখের দিকে স্থির হলো।
লোকটা বলল, ‘আমি লঞ্চে উঠার পরেই এইদিকে ফাঁকা জায়গা দেইখা চলে আসছিলাম। আমি স্পষ্ট দেখলাম এই জায়গাটা ফাঁকা। খালি একটু অন্য দিকে ঘুইরা ব্যাগ থিকা চাদর বের করে এইদিকে তাকাইলাম। আর দেখি চাদর পাইতা ইনি বসে আছেন। আমার দিকে তাকাইয়াই সালাম দিল। এক সেকেণ্ডে কই থিকা আইলো কিছুই মাথায় ঢুকলো না। এরপরে ঐখানে চাদর পাতলাম, সারাক্ষণই মহিলাটার উপর নজর রাখলাম। মনে হইলো পাগলী নাকি। একলা একলা কথা কয় ফাঁকা খাঁচার দিকে তাকাইয়া। এরপর হঠাৎ কইরাই ঘুমে চোখ বন্ধ হইয়া গেল। চোখ খুইলাই দেখি এইখানে কেউ নাই। শূন্য থিকা আইসা শূন্যে মিলাইয়া গেল।’ এতটুকু বলেই লোকটা কেমন যেন কেঁপে উঠলো।
আমার উত্তেজনা আরো বেড়ে গেল। আমিও সমস্ত ঘটনা শুরু থেকে এই পর্যন্ত গলা কিছুটা চওড়া করে বলে গেলাম। লোকটা সব সময়েই ফাঁকা খাঁচা দেখলেও আমি সেখানে ৬টা অদ্ভুত পাখি দেখেছিলাম। এবং শেষে ছাদ থেকে ৭টি পাখি উড়ে যেতে দেখি। এবার সবাই যেন দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে লাগলো। অনেকেই দোয়া দরুদ পড়া শুরু করলো। নিশ্চিত হয়ে কয়েকজন ঘোষণা করলো, ওটা জ্বীন না হয়ে যায় ইনা। এক বয়স্ক লোক বলতে শুরু করলো, ‘এটা নাকি অসম্ভব কিছু না। এইসব লঞ্চের অনেক লোহার অংশ পুরাতন জাহাজ থেকে লাগানো হয়। জাহাজে এমন লোহাও আছে যা কিনা কয়েকশ বছরের পুরনো। ওইসব জাহাজে আগেকার দিনে সমুদ্রে চলতো। ঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছাস নানান বিপদের আশঙ্কা থাকতো জাহাজের। তাই অনেক নাবিকই নাকি জ্বীন পুষতো জাহাজে, যাতে তারা এইসবের সঙ্গে লড়াই করে জাহাজকে রক্ষা করতে পারে। একটা সময় পর সেইসব জাহাজ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেলে তা ভেঙে অন্য জাহাজে ব্যবহার করা হতো এবং এইভাবে জ্বীন স্থান্তরিত হতো। এখনো কিছু লঞ্চে তাই হঠাৎই কিছু অদ্ভুত জ্বীন দেখা যায়। যদিও তারা কারো কোনো ক্ষতি করে না। অনেকেই বলে আগত অনেক বিপদ থেকেই নাকি মানুষের অজান্তেই লঞ্চের যাত্রীদের তারা রক্ষা করে।’
সত্যিকারের গা ছমছমে পরিবেশ বোধ হয় এটাকেই বলে। সবাই বিস্মিত হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার দু কান দিয়ে যেন গরম ভাপ বের হতে লাগলো। ঢাকার প্রায় কাছেই চলে এসেছে লঞ্চটি। সেই বৃদ্ধ লোকটা এগিয়ে এসে এবার আমাদের উঠতে বললেন। চাদরটা আর ফাঁকা খাঁচাটা স্পর্শ করে কয়েকটা সূরা আর দোয়া পড়লেন। এরপর বললেন, এগুলো পানিতেই ফেলে দেয়া ভালো। যদি সত্যিই ওটা জ্বীন হয়ে থাকে।আশেপাশের কেউই আপত্তি তুললো না। আমার কেমন খারাপ লাগছিল, মনে হচ্ছিল এই জিনিস দুটোর ভেতর অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে। এইগুলো নিজের সাথে করে নিয়ে যাওয়ার এক অদ্ভুত ইচ্ছা হঠাৎই মনে উদয় হলো। কিন্তু সাহসে তেমন এগোতে পারলাম না। এগুলো যদি এখন আমার সাথে থাকে তাহলে এক অজানার আতংকেই হয়তো আমার সমস্ত বোধ লোপ পেয়ে যাবে। তাদের কথামতো ফেলে দেওয়াই ভালো। বৃদ্ধ লোকটা চাদর আর খাঁচা আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি ধীরে ধীরে লঞ্চের কিনারে চলে এলাম। উত্তেজনায় আমার হাত পা কাঁপছে। প্রচণ্ড ভাবে পানি আমায় টানছে। ইচ্ছা করছে এগুলোর সাথে নিজেকেও ফেলে দেই এই অজানা, অপরিচিত পানির জগতে। মুহূর্ত ভেবেই খাঁচা আর চাদর পানিতে ছুড়ে ফেলে দিলাম। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম, আরো কিনারে। পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার অদ্ভুত এক ইচ্ছা আমার শরীরটাকে সামনে ঝুকিয়ে দিল। পেছনের কয়েকজন হয়তো আমার উদ্ভ্রান্ত পদক্ষেপ অনুমান করতে পেরেছিল। দ্রুত একজন ছুটে এসে আমার হাত খপ করে ধরে একটানে লঞ্চের ভেতরের দিকে নিয়ে এলো। আমার মাথা ঘুরছিল। প্রচণ্ড ক্লান্তিতে চোখ বুঝে ফেললাম, হয়তো সাথে সাথেই জ্ঞান হারালাম। লোকগুলোই আমার জ্ঞান ফেরালো।
ভালোয় ভালোয় সেবার বাড়ি ফিরতে পেরেছিলাম। এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। তবুও সেই সন্ধ্যার কথা মনে হলেই মনটা এক অজানা রোমাঞ্চে আজো ভরে ওঠে। কোনো অদ্ভুত রঙের পাখি দেখলেই সমস্ত শরীর ছুটে পালানোর প্রেরণা কিলবিল করতে থাকে। সেই সন্ধ্যার পরের স্মৃতির অনেকটা অংশ যদিও এখনো ঝাপসা রয়ে গেছে আমার কাছে।