মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দীপ্তি আর রিসাদ। এতোবছর পর দীপ্তি রিসাদকে দেখে মুহূর্তে নিজের সব রাগ অভিমান ভুলে জরিয়ে ধরে। ওর যে বয়স হয়েছে, চুলে পাক ধরেছে, পাশে মেয়ে দাড়িয়ে আছে তা যেন ভুলেই গেছে। রিসাদেরও চুল পেকে গেছে, মুখে আর শরীরের চামড়ায় ভাজ পরেছে।
প্রথম যেদিন দীপ্তি রিসাদকে জরিয়ে ধরেছিল সেদিন রিসাদ পাথরের মতো দাড়িয়ে ছিল, দীপ্তি নিজের বাহুডোরে আটকাবে কিনা তা ভাবতে ভাবতেই দীপ্তি সরে গেছিল। আজও ঠিক তেমনটাই হয়েছে। দীপ্তি মাথা তুলে চোখ মুছে নেয়। চোখ-মুখ শক্ত করে জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি এখানে কিভাবে?’
‘আমাকে তো দৃষ্টি এনেছে, বলল ওর মায়ের সাথে দেখা করাবে।’
‘দৃষ্টি! ‘
‘হ্যাঁ মা,বাবাকে আমি এনেছি।’
দৃষ্টির কথাতে দীপ্তি রিসাদ দুজনেই অবাক। দৃষ্টি দীপ্তিকে মা আর রিসাদকে বাবা বলে ডাকায় রিসাদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দৃষ্টি আর দীপ্তির দিকে তাকায়। দৃষ্টি দুজনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলতে শুরু করে,
‘ছোটবেলা থেকে আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ আমার মা। আমার বন্ধুরা যখন তাদের বাবার সাথে স্কুলে আসত তখন মাকে বাবার কথা জিজ্ঞেস করতাম, আর মা শুধু একটাই কথা বলত, তোর বাবা আমাদের সাথে থাকে না অনেক দূরে থাকে। ব্যাস! আমি এতটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতাম। যখনই বাবার বিষয়ে কিছু জানতে চাইতাম মা সবসময় পজিটিভ কিছু বলত। বাস্তব বোধ হবার পর খেয়াল করলাম, মা আড়ালে কাঁদে।
একদিন রিতাকে আন্টিকে বাবার ব্যাপারে কথা বলতে শুনলাম, এগিয়ে গেলাম তাদের দিকে। সেদিন মা আমার জোড়াজুড়িতে সবটা বলতে বাধ্য হয়। সবটা বলার শেষে মা বলেছিল, তোর বাবা সত্যিই ভালো মানুষ, ওকে তুই ভুল বুঝিস না। সেদিন বুঝতে পারলাম মা বাবাকে কতটা ভালোবাসে। সেদিন রিতা আন্টি বলেছিল, বাবা নাকি মাকে খুঁজতে আন্টির কাছে গেছিল আর মায়ের সাথে ডিভোর্স হবার পর যাকে বিয়ে করেছিল সে নাকি বাবাকে ধোঁকা দিয়েছে।
জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এ তিনটি উপর থেকেই ঠিক হয়ে আসে। ভাগ্য যাদের এক করতে চায় তাদেরকে কে আলাদা করতে পারে।
একদিন বাবাকে একটা রেস্ট্রুরেন্ট এ দেখি। মায়ের কাছে বাবার ছবি দেখি। অনেক আগের হলেও চিনতে অসুবিধা হয় নি। কিন্তু বাবা আমাকে চিনত না, চেনবেই বা কি করে? আমি যে বেচে আছি তাই তো সে জানত না। অজুহাত দেখিয়ে কথা বললাম, জানতে পারি শহরে নতুন। আমাদের স্কুলের পাশে যে অফিসটা আছে সেখানে ট্রান্সফার হয়ে এসেছে। এর পর প্রায়ই দেখা হত, ইচ্ছে করত বাবা বলে ডাকি। কিন্তু পারিনি। কথায় কথায় তার পরিবারের কথা জানতে চাইলাম, তোমার কথা বলল মা। আর তার ভুলের কথা বলল, তোমাকে খুঁজছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য। তখন বুঝলাম, বাবা তোমাকে এখনও ভালোবাসে, নিজের ভুল বা পাপের জন্য সে অনুতপ্ত। ‘
দৃষ্টির কথা গুলো মন দিয়ে শুনছিল দীপ্তি আর রিসাদ। রিসাদ মাথা নিচু করে ছিল আর দীপ্তির চোখ থেকে পানি পরছিল। দৃষ্টি ওর মায়ের কাছে গিয়ে পায়ের কাছে বসে পরে আর বলতে শুরু করে,
‘মা, বাবা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে, আজ সে নিজের কাজের জন্য অনুতপ্ত।
বাবাকে ক্ষমা করে দাও মা। তুমিও তো আজও বাবাকে ভালোবাস। নতুন করে তুমি আমি আর বাবা আমাদের জীবন শুরু করি।’
আচমকা দীপ্তি দৃষ্টির গালে পরপর কয়েকটা চড় বসিয়ে দেয়ে, রিসাদ উঠে দীপ্তিকে আটকায়।
‘তুমি পাগল হয়ে গেছ দীপ্তি? আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি তাও প্লিজ তুমি দৃষ্টির সাথে এমন কর না। তুমি ছাড়া কে অাছে ওর বল।’
‘মা তুমিই তো বলেছিলে, কেউ যদি ভুল করে ক্ষমা চায় তাহলে তাকে ক্ষমা করা উচিত আর ক্ষমা মানুষের মহৎ গুন। তাহলে তুমি কেন বাবাকে ক্ষমা করতে পারছ না?’
‘সব প্রশ্নের উত্তর হয় না দৃষ্টি। তুই এখনও অনেকটা ছোট। এসবের মধ্যে নিজেকে আনিস না।’
‘মা আমি অনেক বড় হয়েছি। সবটা বুঝি। বাবা যখন তোমার কাছে ক্ষমা চাইছে, তখন প্লিজ তুমি…’
‘তুই যে মানুষটাকে ক্ষমা করতে বলছিস সে মানুষটা অামার জীবনের কত গুলো বছর নষ্ট করেছে তা কি সে জানে? ৪ বছর সম্পর্ককে পরিনতি দেয়ায় অনেক বাঁধা পেয়েছি, তাও ওর বলাতে ওর হাত ধরে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। ২ বছরের বিবাহিত সম্পর্কে ও অন্য একটা মেয়ে নিয়ে আসে।আমাদের ৬ বছরের ভালোবাসার কোনো ভ্যালুই ছিল না ওর কাছে। তার আগে ওকে বহু বার বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়েছি যে ও যা করছে সব ভুল কিন্তু ও কিছু বুঝতেই চায় নি। আমার সামনে সেই মেয়েকে নিয়ে এসে বলে আমি তোমাকে ডিভোর্স দেব। ডিভোর্স পেপার হাতে দিয়ে বলে সাইন করে দিও আর আমি যেন এসে তোমাকে বাড়িতে না দেখি। কেন? ও কি জানত না আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। সেই রাতে আমি কোথায় যাব তা একবারও ভাবে নি। তাহলে তুইই বল এ মানুষটাকে কি করে ক্ষমা করা যায়?
নিজের হার স্বীকার করতে পারবে না বলে তোকে আমার থেকে আলাদা করার প্লান করে।’
মায়ের কথা শুনে দৃষ্টি চুপ হয়ে আছে। এখানে ওর কি বলার আছে ও সেটাই বুঝতে পারছে না। দীপ্তি আবার বলা শুরু করে,
‘এই যে মানুষটাকে দেখছিস, এ প্রচুর ইগো। ওর সাথে পরিচয় হবার ৩ বছরের মধ্যে আমি চাকরি পেয়ে যাই কিন্তু এ তখনও বেকার। আমাকে অনেক বুঝিয়েছে আমি যেন চাকরি না করি।
আরো বলেছে, মেয়েদের চাকরি করে কি হবে? ওদের তো স্বামী, সন্তান আর সংসার সামলানোই একমাত্র কাজ।
আমি ভেবেছিলাম, এমন একটা মানুষের সাথে কি করে থাকব? কিন্তু পরে ভেবেছি একে ছাড়া কি করে থাকব? নিজের ভালোবাসার উপর বিশ্বাস আর ভরষা রেখে এগিয়ে যাই।
বিশ্বাস কর দৃষ্টি, আমার জীবনের সবচেয়ে ভুল স্বীদ্ধান্ত ছিল এটা। বিয়ের পরও ওর এমন মানুষিকতা বদলায় নি। কিন্তু আমি আমার লক্ষ্য স্থির ছিলাম, আজও আছি।
এই মানুষটাকে আমি অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু এর সাথে নতুন করে জীবন শুরু করা আর মৃত্যু আমার কাছে একই মানে রাখে।’
‘মা..!’
‘আমার যা বলার আমি তা বলে দিয়েছি দৃষ্টি। তুই যদি তোর বাবার সাথে যেতে চাস আমি তোকে আটকাবো না।’
‘মা প্লিজ তুমি এমন করো না। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। আমারও তো ইচ্ছে করে তোমার আর বাবার সাথে থাকতে।’
‘একটু আগে বললি না, আমি তোকে শিখিয়েছি ক্ষমা মহৎ গুন। মনে কর, আমি তোকে এটাও শিখিয়েছি, আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে সুখ পাওয়া যায় না।
যেটা আমি তোকে শিখিয়েছি সেটা আমি কি করে অস্বীকার করি!’
‘ আমার তুমি ছাড়া আর কাউকে চাই না, কাউকে না।
বাবা তুমি চলে যাও। আমি আমার মায়ের চোখে পানি দেখতে পারব না। তুমি নিজে আমার আর মায়ের জীবন এলোমেলো করে দিয়েছ। অামার মা’কে অনেক আঘাত দিয়েছ, আমি তোমাকে নতুন করে সে সুযোগ দিতে পারব না,
সরি।’
পুরোটা সময় রিসাদ মাথা নিচু করে ছিল। কিছু বলার নেই ওর। আজ ওর মেয়েও ওকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
‘তোমার স্বীদ্ধান্ত সব সময়ই ঠিক ছিল দীপ্তি, ভুল আমি ছিলাম। নিজের ইগোকে সবসময় বড় করতে গিয়ে নিজের আপন মানুষদের হারিয়ে ফেলেছি। তোমাকে কোনোদিন দেখতে পাব বা আমার সন্তান বেঁচে আছে এটা কোনোদিন ভাবিই নি। জীবনদশায় তোমাদের দেখে যেতে পারছি এটাই আমার জন্য অনেক।
তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ, দৃষ্টি আমাকে বাবা বলে ডেকেছে, এটাই আমার জন্য অনেক। ভালো থেকো তোমরা। আমাকে ক্ষমা করেছিস দৃষ্টি? ‘
‘বাবা..’
‘হ্যাঁ রে, ক্ষমা করে দিস। আসছি।’
দীপ্তির দিকে তাকিয়ে দৃষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায় রিসাদ। মা মেয়ে দুজনেই তাকিয়ে আছে রিসাদের যাওয়ার দিকে।
মানুষ যখন নিজের পাওনার থেকেও বেশি সুখ পায় তখন সে তা মূল্য দিতে পারে না। হাতে কাচা টাকা এলে মানুষ যেমন তা দু’হাতে উড়ায়, ঠিক তেমনি বেশি সুখ পেলে তা হেলায় হারায়।
ক্ষনিকের সুখের জন্য আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়া বোকামী।
বাঁচতে হলে আত্মসম্মান এর সাথে সুখে বাঁচুন, নাহলে….