হানাবাড়ি(পর্ব ১)

আব্বার বদলির সুবাদে এই মফস্বল শহরটায় আমরা এসেছি দিন তিনেক হলো। জায়গাটা খারাপ না। তিনদিনে যা মনে হয়েছে এলাকার লোকগুলোও বেশ ভালো। আমি অবশ্য এখানে বেশিদিন থাকবো না। অ্যাডমিশন প্রিপারেশন নিচ্ছি, যেখানেই চান্স হবে চলে যাবো। আব্বা আম্মার সাথে থাকবে আমার ছোট দুই জমজ ভাই রাফি আর নাফি। দুইজন ক্লাস এইটে পড়ে। ওদেরকে এখানের একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়েছে গতকালই। প্রথমেই আমরা যে কোয়ার্টারে এসে উঠেছি তার একটু বর্ণনা দিই। এটাকে ঠিক কোয়ার্টার বলা যায় কিনা তাও জানিনা। গাছপালা ঘেরা তিনতলা একটা বাড়ি। বেশ পুরোনো বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়। বহুদিন হয় মেরামত করা হয়নি। বাইরের দেয়ালগুলোতে শেওলা জমেছে। চারপাশে আম, কাঁঠাল সহ আরো অনেকরকম গাছ। দিনের বেলাতেও রাতের অন্ধকার যেনো। আমরা দোতলায় এসে উঠেছি। তবে আব্বার অফিস থেকে বলা হয়েছে অল্প কিছুদিনই এই কোয়ার্টারে থাকতে হবে আমাদের। নতুন কোয়ার্টার বানানোর কাজ চলছে। হয়ে গেলেই আমরা সেখানে উঠতে পারবো। আমাদের এই কোয়ার্টারটার পাশেই আরো একটি একই কায়দার কোয়ার্টার। ওই জায়গাটাও বেশ নির্জন। এই তিন দিনে ওই বাড়ি থেকে কারো সাড়াশব্দ বা দেখা পাইনি। আমাদের কোয়ার্টারটায় অবশ্য আরো দুইটা পরিবার নাকি আছে। কেয়ারটেকার আবু মিয়ার কাছ থেকে শুনলাম তারা ছুটিতে বেড়াতে গেছে। তাড়াতাড়িই চলে আসবে। তাই বলা যায় পুরো বাড়িটাতেই শুধু আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। আবু মিয়া দিনের বেলা থাকে না। তার বক্তব্য সারারাত জেগে সে বাড়ি পাহাড়া দেয়,তাই দিনের বেলা তার ঘুম দরকার। তার নিজের বাড়ি যেয়ে সে সারাদিন ঘুমায়,ঠিক সন্ধ্যার সময় এসে হাজির হয়। প্রায় ছয় ফুট লম্বা, বিশাল কালো দাঁড়িওয়ালা আবু মিয়াকে একটু ভয় ভয়ই লাগে আমাদের। যদিও দিনের বেলা তাকে আমাদের প্রয়োজনও হয়না। সাধারণ একজন কর্মকর্তা আমার আব্বা। ঘরে না আছে দামী আসবাবপত্র না আছে আম্মার ভারী গহনা। এতো পাহাড়ার দরকারও হয়না আমাদের।
“আম্মা আজ একটু শহরে যাবো।”
আম্মা সকালের এই সময়টায় বড্ড ব্যস্ত থাকেন। আব্বা খেয়ে অফিসে চলে যাবেন, আবার দুপুরের খাবার নিয়েও যাবেন। রাফি নাফি স্কুলে যাবে। নতুন জায়গায় এসে আম্মা কোনো সাহায্যকারীও পান নি। আবু মিয়াকে বলা হয়েছে, সে বলেছে খুব তাড়াতাড়িই একটা মেয়ে খুঁজে দিবে সে আম্মাকে সাহায্য করার জন্য। সামনে আমার পরীক্ষা তাই আমাকে কোনো কাজও করতে দেন না আম্মা। কোনোরকমে সকালটা রুটি আলুভাজি দিয়েই চালিয়ে নিই আমরা। খেতে খেতেই আম্মাকে বললাম।
আম্মা রাফি আর নাফির টিফিন রেডি করছিলেন। আমার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,”শহরে যাবি কেনো আবার?”
“বাহ রে, ভুলে গেলে আম্মা? আমার বাহাদুর আর রাণীকে যে রুমকিদের বাড়ি রেখে এসেছি। ওদের আনতে হবে না?”
“ও হ্যা তাইতো!”
বাহাদুর আর রাণী আমার পোষা দুইটা কুকুর। ওদেরকে সাথে আনিনি কারণ ভাবলাম এখানে এসে আগে থাকার জায়গাটা ঠিকমতো গুছিয়ে নিয়ে ওদেরকে আনবো। রুমকি আমার বান্ধবী, ওর নিজেরও বেশ কিছু পোষা কুকুর আছে। তাই ওর কাছেই ওদের রেখে এসেছিলাম। কিন্তু ওদের ছেড়ে থাকতে পারছিলাম না তাই নিয়ে চলে আসবো ভাবলাম।
সকাল সকালই রওনা দিলাম ওদের আনার জন্য। শহরে আরো কিছু কাজ আছে। ওগুলো সেরে ওদেরকে নিয়ে আসবো।
সব কাজ সেরে ওদের আনতে আনতে প্রায় বিকাল হয়ে যায় আমার। ওদেরকে নিয়ে যখন কোয়ার্টারের গেট দিয়ে প্রবেশ করবো তখন প্রায় মাগরীবের আজান দেওয়ার সময় হয়ে গেছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার! আমাকে এতোদিন পর দেখে ওরা এতো খুশি হয়েছিলো, সারা রাস্তায় ওদের প্রফুল্লতা চোখে পড়ার মতো ছিলো। কিন্তু বাড়িতে ঢোকার আগে ওদের চোখে স্পষ্ট ভয় দেখতে পেলাম আমি। কোনোভাবেই ওদের গেটের ভিতরে ঢোকানো যাচ্ছে না। না বাহাদুরকে না রাণীকে। খুব করুণ সুরে ওরা ডাকা শুরু করেছে। ওরা একবার আমার দিকে তাকায় আর একবার বাড়ির দিকে তাকায়। সারাদিন বাড়ির বাইরে, বেশ ক্লান্ত লাগছে আমার নিজেরই। তার উপর ওদের এই আচরণ বেশ বিরক্ত লাগছে আমার। জোর করে ওদেরকে গেটের মধ্যে ঢুকালাম। ওদের চিৎকারে কান পাতা দায়। আমার বড্ড অস্বস্তি লাগছে। আশেপাশের মানুষরা আবার কিছু না বলে। যদিও এ তল্লাটে খুব বেশি মানুষ আমার চোখেও পড়েনি এই কয়দিনে। তবুও আমার জন্য কারো সমস্যা হোক তা আমার ভালো লাগে না।
রাফি নাফি তো বাহাদুর আর রাণীকে পেয়ে ভীষণ খুশি। রাণী আবার সন্তানসম্ভবা। ওর জন্য এক্সট্রা যত্ন করতে হয় আমাদের। ওদেরকে ওদের প্রিয় খাবার দিলাম। কিন্তু ওরা কেনো জানি খাবার খেতেও চাচ্ছে না। শুধু ভয়ে ভয়ে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। আম্মা বললো,”নতুন জায়গায় এসে ভয় পাচ্ছে ওরা। কয়দিন যাক, এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না।”
ঠিক সন্ধ্যার পর গেট খোলার ক্যাচক্যাচ আওয়াজ পাওয়া গেলো। নিশ্চয়ই আবু মিয়া এসেছে। পুরোনো গেট, খুলতে গেলে এমন বিশ্রী শব্দ হয়। সবে বাহাদুর আর রাণী খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রাম নিচ্ছিলো। হঠাৎ দেখলাম ওরা তারস্বরে চিৎকার করা শুরু করলো। এমন একটা অবস্থা যে ওদের থামানোই দায় হচ্ছে আমাদের। ওদের চিৎকারটা যেনো মনে হচ্ছে ওদের কেউ শক্ত কিছু দিয়ে আ’ঘাত করছে। আমি, আম্মা, রাফি নাফি সবাই ব্যস্ত হয়ে গেলাম ওদের থামাতে। কিন্তু ওদের থামার কোনো লক্ষণ নেই, বার বার দরজার দিকে তাকাচ্ছে আর চিৎকার করছে।
“কুত্তা ডাকে কোথায়? কোন জায়গায় কুত্তা কান্দে?”
বিরক্ত হয়ে তাকালাম আমরা। নিচতলা থেকে আবু মিয়ার গলা পাওয়া যাচ্ছে। বাহাদুর আর রাণী আমার খুব প্রিয় বন্ধু। ওদের কেউ কুত্তা বলে ডাকলে আমার ভয়াবহ রাগ হয়। আমি দোতলার বারান্দায় এসে নিচে তাকালাম।
“কি হয়েছে আবু চাচা? চিৎকার করছেন কেনো?”
“মা জননী, কুত্তা ডাকে কোন জায়গায় সেটাই জিজ্ঞেস করছিলাম।”
আমি রাগ চেপে বললাম,”চাচা ওরা আমার পোষা কুকুর। শহর থেকে নিয়ে আসলাম আজকেই। নতুন জায়গায় এসেছে তো। তাই ভয় পেয়ে একটু চিৎকার করছে। ঠিক হয়ে যাবে।”
গলা খাঁকারি দিয়ে আবু মিয়া বললেন,”কোয়ার্টারে কুত্তা পালা নিষেধ।”
আমি তো অবাকের শীর্ষে। এর আগেও কোয়ার্টারে থেকেছি। কোথাও তো এমন শুনিনি। আর বাহাদুর বা রাণী ওরা কেউ কারো ক্ষতি করে না। বরং যেখানেই যায় সবাই ওদের পছন্দ করে।
“এমন কোনো নিষেধ তো শুনিনি চাচা।”
“শোনো মা জননী, এই কোয়ার্টারের কেয়ারটেকার আমি। গত ত্রিশ বছর যাবৎ এইখানে কাজ করি আমি। আমি এখানে যা বলি সেটাই এখানের নিয়ম। আশা করি বুঝতে পারছেন। খুব তাড়াতাড়ি আপনারা নতুন কোয়ার্টারে উঠে যাবেন। সেখানে কুত্তা বিলাই যা মন চায় রাখবেন। কিন্তু এখানে যতদিন আছেন ততদিন এখানে মানুষ বাদে আর কোনো প্রাণী রাখা যাবে না।”
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি আবু মিয়ার দিকে। উনি কথা কম বলেন। এই কয়দিনে উনাকে খুব বেশি কথা বলতে আমি শুনিনি। কিন্তু লোকটা যে এতো বড় ঘাড়ত্যাড়া তা তো আগে বুঝিনি আমি।
“কিন্তু চাচা, এ কয়দিন ওদের কোথায় রাখবো আমি?”
“সে আমি জানিনা মা। আজ রাতটা তোমাদের সময় দিলাম। কাল সকাল হতেই ওদের কোয়ার্টার থেকে বাইরে নিয়ে যেতে হবে। চললাম আমি, কিছু লাগলে ডাক দিয়েন।”
সামান্য একটা কেয়ারটেকারের এমন ব্যবহারে আমি যতটা না অবাক হচ্ছি তারচেয়েও রাগ হচ্ছি বেশি। এমন একটা মফস্বলে এমন পোড়োবাড়ির মতো একটা কোয়ার্টার। তার আবার এমন একজন কেয়ারটেকারের কতো মাতব্বরি। নিশ্চয়ই লোকটা নিজের এমন চেহারা দেখিয়ে সবাইকে দাবিয়ে রাখে। কিন্তু আমি তো সেই দলের না। আমি ঠিক করলাম বাহাদুর আর রাণীকে এখানেই রাখবো। দেখি আবু মিয়া কি করতে পারে। এতো বড় সাহস। আমাকে বলে এখানে সে যা বলবে তাই নিয়ম। আব্বা ফিরুক আজ বাড়ি, এর একটা বিহিত আজ করেই ছাড়বো। শেষ দেখে ছাড়বো আমি আজ।
ভোরের আলো ফোটার আগেই আবু মিয়া চলে যায়। সকালে আমাদের একটু দেরি হয় ঘুম থেকে উঠতে। কিন্তু কেনো জানি আজ খুব তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙ্গে গেলো আমার। ঘড়িতে সময় দেখলাম মাত্র সকাল সাড়ে পাঁচটা বাজে। হঠাৎ পাশে তাকিয়ে দেখি বাহাদুর আর রাণীকে যে বিছানা করে দেওয়া হয়েছে সেখানে ওরা নেই। একটু চমকে উঠি আমি। ওরা তো এমন করে না। যত বেলাই হোক না কেনো, আমি বা আম্মা না ডাকলে ওরা বিছানাই ছাড়ে না। আমি লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম। ঘুম ছুটে গেলো আমার। সারাঘরে খোঁজা শুরু করলাম ওদের। কোথাও নেই। ভয়ে আমার হৃৎপিণ্ড ধকধক করা শুরু করলো। এদিকের কিছুই ওরা চিনে না। কোথায় গেলো ওরা। আমি মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লাম। বাকিরা কেউ এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। ওদেরকে বড্ড ভালোবাসি আমি।
হঠাৎ নিচতলা থেকে রাণীর কান্নার আওয়াজ পেয়ে আমার ঘোর কাটে। আমি আবারও অবাক হই। এতো সকালে ওরা নিচে যাবে কীভাবে?আমাদের দরজা তো বন্ধ ভিতর থেকে। যদিও এখন এসব ভাবার সময় নেই। আমি এলোপাতাড়ি ছুটে নিচে নেমে গেলাম। ওর কান্নার আওয়াজ শুনে শুনে এগোচ্ছিলাম আমি। এ কয়দিনে নিচতলাটা সেভাবে দেখিও নি ভালো করে। এমন একটা জায়গা দিনের বেলাও অন্ধকার লাগে, এখন তো আলো কেবল ফোটা শুরু করেছে।
হঠাৎ দেখলাম একটা জামগাছের নিচে বাহাদুর আর রাণী দাঁড়িয়ে আছে। রাণী কাঁদছে আর বাহাদুরও ভয় ভয়ে একদিকে তাকিয়ে আছে। আমার জানে যেনো পানি এলো ওদের দেখে। আমি ছুটে গেলাম ওদের দেখে। আমাকে দেখে ওরাও এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। আমি রাণীকে কোলে তুলে নিলাম। দেখলাম কোথাও কোনো ক্ষত আছে কিনা বা ব্যথা পেয়েছে কিনা। এভাবে কেনো কাঁদছে ও? কয়দিন পরেই ওর বাচ্চা হবে, সব দিকেই তো খেয়াল রাখা দরকার আমার।
এতোক্ষণে আমার মাথাতেও ছিলো না ওরা কেনো এখানে এসেছে? কীভাবেই বা এসেছে? আর কেনোই বা রাণী এভাবে কাঁদছিলো। হঠাৎ সামনের দিকে তাকাতেই আমি দুই পা ছিটকে পিছে চলে গেলাম। ওড়না দিয়ে নাক চাপা দিলাম, তারপরেও পারলাম না। ওখানে দাঁড়িয়েই হড়হড় করে বমি করে দিলাম। এ কি দৃশ্য? এ কি দেখলাম আমি? থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ওদের দুইজনকে শক্ত করে চেপে তাকিয়ে থাকলাম আমি সামনের দিকে। নড়াচড়া করার শক্তিও যেনো হারিয়ে ফেলেছি আমি।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প