সাতটা বিড়াল, হ্যা গুনে গুনে সাতটা বিড়ালের মৃ*তদেহ। কিন্তু ঠিক স্বাভাবিক না মৃ*তদেহগুলো।কেউ যেনো বিড়ালগুলোর দেহ থেকে মস্তক আর লেজ ছিঁড়ে র*ক্ত সবটুকু শুষে নিয়েছে। একদম ফ্যাকাশে হয়ে আছে মৃতদেহগুলো। কে করতে পারে এই অমানবিক নিষ্ঠুর কাজ? সে কি কোনো মানুষ নাকি পি’শাচ? আমি ঘুরে তাকালাম বাহাদুর আর রাণীর দিকে। এটা ওদের কাজ না নিশ্চিত। এর দুইটা কারণ আছে, প্রথম কারণ ওরা এমন হিংস্র নয়, বরং ওরা সবকিছু ভয় পায়। খুবই নিরীহ ধরণের ওরা। আর দ্বিতীয় কারণ, বিড়ালগুলোকে দেখলে বোঝাই যাচ্ছে ওদের অনেক আগেই মারা হয়েছে। সদ্য মৃত্যু মনেই হচ্ছে না। বাহাদুর আর রাণী তো এসেছে গতকাল মাত্র। আর রাতে ওরা আমার ঘরেই শুয়ে ছিলো ওদের বিছানায়। রাণীর শরীর বেশ খারাপ থাকে ইদানীং, ওরা এই কাজ করতেই পারে না।
বসার ঘরে বসে আছি আমরা সবাই। আমি বেশ শক্ত মনের মেয়ে। সহজে সবকিছুতে ভয় পাইনা। কিন্তু আজকের ওই দৃশ্য আমাকে এতোটাই মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছে, আমি স্বাভাবিক থাকতে পারছি না। আম্মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। রাফি আর নাফিও বেশ ভয় পেয়েছে। দরজার পাশেই বাহাদুর আর রাণী বসে কাঁপছে। আব্বা সারাঘর পায়চারি করছেন। ডায়বেটিসের জন্য প্রতিদিন ভোরবেলা আব্বা হাঁটতে বের হন। এটা আমার মাথাতেই ছিলো না। আব্বা আজকে ভুলবশত দরজা লাগাতে ভুলে গিয়েছেন বাইরে যাওয়ার সময়। এতে বড় কোনো দুর্ঘটনাও ঘটতে পারতো। যদিও যেটা ঘটেছে সেটা সামান্য নয়। দরজা খোলা পেয়ে বাহাদুর আর রাণী বাইরে চলে গেছে এবং ওই দৃশ্য দেখে ভয় পেয়েছে।
আম্মা শক্ত গলায় বললেন,”বয়স হচ্ছে আর ভীমরতি হচ্ছে নাকি আপনার? অপরিচিত এলাকা, ধারেকাছে মানুষজনও নেই। বাড়িতে এতো বড় মেয়ে। আর আপনি দরজা খোলা রেখেই বের হয়ে চলে গেলেন কোন আক্কেলে? আর আপনি যে বললেন নতুন কোয়ার্টারের কাজ নাকি শেষের পথে? কবে যাবেন সেখানে? এমনিতেই আমাদের এই মফস্বলে এনে ফেলেছেন তার উপর দুইদিন যেতে পারলো না এমন একটা দুর্ঘটনা চোখের সামনে। ধারেকাছে মানুষজনও তেমন নেই। দিনে যা-ও একটু মানুষের মুখ দেখা যায়, সন্ধ্যা হতে না হতে সব একদম নিস্তব্ধ পুরী। এখানে আমার আর একটা দিনও থাকতে ইচ্ছা করছে না।
আব্বা কাচুমাচু হয়ে বললেন,”ভুল হয়েছে আমার। আর কখনো এমন ভুল হবে না। কিন্তু আমি ভাবছি এতোগুলা বিড়াল বাড়ির মধ্যে এলো কোথা থেকে? আমি তো এ কয়দিনের মধ্যে কোনো বিড়াল দেখিনি। রাফি নাফি তোরা দেখেছিস?”
ওরা মাথা নাড়লো, দেখেনি। আব্বা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,”বাহাদুর আর রাণী কি এমন কাজ করতে পারে? কি মনে হয় তোর?”
আমি ভ্রু কুঁচকে আব্বার দিকে তাকিয়ে বলি,”আব্বা আপনি কি ওদের নতুন দেখছেন? ওরা এমন করতে পারে আদৌ? বিড়াল মেরে ফেলা দূরের কথা, ওরা তো উলটে ভয় পায় সবকিছু।”
“না মানে বলছিলাম, রাণী তো সন্তানসম্ভবা। হয়তো এমন কিছু ইচ্ছা হয়েছে তার।”
আমি কোনো কথা বললাম না। আব্বা নিজেও জানেন এটা কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়। শুধু শুধু এগুলো বলছেন। আমি চোখ বন্ধ করে সোফার উপরেই শুয়ে পড়লাম। যতবার চোখ বন্ধ করছি ওই দৃশ্যটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কে করতে পারে এই কাজ? আচ্ছা, আবু মিয়া কি জানতে পারে? এই বিড়াল গুলো কোথা থেকে বাড়ির মধ্যে এলো? আর কীভাবেই বা এদের মৃ*ত্যু হলো? তিনি তো সারারাত গেটে পাহাড়া দেন, কিছুই কি তার চোখে পড়েনি? আমি ঠিক করলাম, আজ উনি আসলেই এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করবো উনাকে। নিশ্চয়ই উত্তর পাবো। ভিতর ভিতর অস্থির হয়ে উঠলাম আমি রহস্যটা জানার জন্য। আস্তে আস্তে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকলাম আমি। আম্মার মৃদু গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তিনি আব্বাকে বলছেন,”যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব নতুন কোয়ার্টারে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এখানে আমার একদম ভালো লাগছে না।” আব্বাও উত্তরে কিছু বললেন, আমি শুনতে পেলাম না। মনে হচ্ছে কতো কাল ঘুমাই না আমি। গভীর ঘুমে ঢলে পড়লাম আমি।
যখন ঘুম ভাঙে তখন প্রায় সন্ধ্যা। এতো ঘুমিয়েছি আমি? কেউ ডাকেনি আমাকে? সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমার মাথা ঝিম ঝিম করছে তখন। সোফার হাতল ধরে উঠে বসলাম। ঘুমের আগের সবকিছু মনে করতে লাগলাম। সকালে উঠে বাহাদুর আর রাণীকে দেখতে না পাওয়া, খোলা দরজা, তারপর ওদের কান্নার আওয়াজ আর তারপর ওই দৃশ্য। আমি শিউরে উঠে হালকা গোঙানি দিয়ে উঠলাম। শব্দ শুনে আম্মা হন্তদন্ত হয়ে কাছে আসলেন আমার। রাফি নাফিও মায়ের পিছু পিছু এলো।
“কি হয়েছে মা? স্বপ্ন দেখেছিস কোনো?”
আম্মার চোখে ভয়।
“আম্মা, এতো সময় আমি ঘুমিয়েছি আমাকে ডাকোনি কেনো? সকাল থেকে ঘুমাচ্ছি। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বেজে গেছে তাও ডাকোনি কেনো আমাকে?”
আম্মা চোখ গোল গোল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বিস্ময় তার মুখে। হতবাক হয়ে বললেন,”কি বলছিস কি তুই? তুই তো দুপুরে উঠলি। খাওয়া দাওয়া করলি আমাদের সাথে। তারপর বললি, তোর খুব ঘুম পাচ্ছে। তোকে যেনো না ডাকা হয় একদম। এরপর সোফায় এসে শুয়ে পড়লি। আমি এতো করে বললাম ঘরে যেয়ে ঘুমাতে, তুই কোনো কথাই শুনলি না। কি হয়েছে মা তোর? শরীর ভালো আছে তো?”
আম্মার কথা শুনে ছিটকে সরে এলাম আমি। কি বলছে আম্মা এসব? আমি কখন উঠলাম? কি হচ্ছে আমার সাথে এগুলো? ঘুমের ঘোরে এতোকিছু করলাম আর টেরও পেলাম না? এতো গভীর ঘুম তো আমার কখনো হয়না।
আমি বিড়বিড় করে বললাম,”আম্মা বাহাদুর আর রাণী কোথায়? কেমন আছে ওরা এখন? খাওয়া দাওয়া করছে?”
“হ্যা ওরা ভালো আছে। তুই চিন্তা করিস না। আমাকে বল তোর কোথায় খারাপ লাগছে? তোর আব্বাকে ফোন দিবো? তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে?”
“না আম্মা, আমি ঠিক আছি। হয়তো সকালের ঘটনায় নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারছি না এখনো। একটু সময় লাগবে। আর একটা কথা, আবু চাচা কি এসেছে আম্মা?”
আম্মা ভ্রু কুঁচকে বললেন,”আবু মিয়াকে দিয়ে কি কাজ তোর? সে আসলো কিনা তা দিয়ে তোর কি?”
“একটু দরকার আছে উনার সাথে।”
“একটা কথা ভালো করে শুনে রাখ তিথি। সবকিছুতে নিজেকে জড়াস না। খুব তাড়াতাড়ি এই পোড়োবাড়ি ছাড়বো আমরা। ততদিনে পড়াশোনা বাদে আর কোনো দিকে মাথা ঘামাবি না তুই। এই বলে রাখলাম।”
আমি আম্মাকে আশ্বস্ত করলাম নিজের কোনো ক্ষতি করে কিছু করবো না আমি। কিন্তু আজ আমার আবু মিয়ার সাথে কথা বলতেই হবে। আম্মা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে চলে গেলেন।
আবু চাচার ঘরের সামনে এসে দরজায় টোকা দিলাম আমি। কেমন যেনো অস্বস্তি হচ্ছে। এর আগে উনার ঘরের সামনে আসিনি আমি। প্রয়োজনও হয়নি। আজও ইচ্ছা করছে না। কিন্তু রহস্যের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমার অস্বস্তি থেকেই যাবে।
খট করে দরজা খোলার আওয়াজে আড়ষ্ট হয় দাঁড়াই আমি। ঘরের মধ্যে কি ঘুটঘুটে অন্ধকার রে বাবা। ছোট্ট একটা মোমবাতি টিমটিম করে জ্বলছে শুধু। ইলেক্ট্রিসিটি তো আছে, উনি এমন ঘর অন্ধকার করে বসে আছেন কেনো? কি অদ্ভুত কাণ্ড।
“এ কি মা জননী আপনি এখানে?”
আবু চাচা বেশ চমকে গেছে। এতোটা চমকানোর কি আছে?
“একটু কথা বলতাম চাচা আপনার সাথে।”
“ভিতরে এসে বসেন।”
আমি শিউরে উঠে কিছুটা পিছিয়ে গেলাম।
” না না চাচা বাইরেই থাকি আমি। আপনার ঘর অন্ধকার কেনো এমন?”
নাক দিয়ে ঘোৎ করে একটা শব্দ করলেন উনি। কেমন যেনো ভয়ংকর উনার কাজকর্ম গুলো।
“আমার আলো সহ্য হয়না। তাই। কি বলতে এসেছেন বলে চলে যান।”
আমি মনে মনে বিরক্ত হলাম। বলে চলে যাবো না তো কি থাকবো এখানে?
“চাচা বলছিলাম গতকাল কি আপনি বিড়াল দেখেছেন বাড়ির মধ্যে কোনো? সাতটা বিড়াল?”
চোখ লাল করে আমার দিকে তাকালেন আবু চাচা। হালকা অন্ধকারে ওই চোখ দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে যাই আমি। আমি সহজে ভয় পাইনা। কিন্তু আজ যেনো অল্পতেই বড্ড ভয় ভয় করছে আমার।
“আমি কোনো বিড়াল দেখিনি। কুত্তা বিলাই পালা নিষেধ এই বাড়ির মধ্যে। আপনার কুত্তা দুইটারে এখনো রাখছেন এখানে আপনি?”
এবার বেশ রাগ হলো আমার। সামান্য কেয়ারটেকারের এতো মেজাজ হবে কেনো? নিজেকে যেনো এই কোয়ার্টারের মালিক ভেবে বসে আছে। আমি কিছুটা ঝাঁঝের সাথে বললাম,”ওদের ছেড়ে আমি বেশিদিন থাকতে পারিনা। ওদের মধ্যে একজন অসুস্থ। আমি ওদের কোথায় রাখবো এখন? ওরা তো আপনার কোনো ক্ষতি করেনা। নিজেদের মতো থাকে। আর তাছাড়া বেশিদিন তো নাই আমরা এখানে, চলে যাবো খুব তাড়াতাড়ি। ওরা সে কয়দিন আমার সাথেই এখানে থাকবে। এতে কার কি সমস্যা হবে না হবে আমার দেখার দরকার নেই।”
আমি উনাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ধুপধাপ করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে আসলাম। পিছনে তাকাই নি, তবে আমার মন হচ্ছে একজোড়া লাল রাগী চোখ আমার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে।
মেজাজটা বড্ড কড়া হয়ে আছে। তুই এই কোয়ার্টারের কেয়ারটেকার, তোর কাজ পাহাড়া দেওয়া। তুই এতো কথা বলবি কেনো? তেমন যদি কোনো বিধিনিষেধ থাকতো আব্বার অফিস থেকেই মানা করে দিতো। যেহেতু আমরা অফিস থেকেই কোয়ার্টার পেয়েছি। রাগে শরীর জ্বলছে আমার। আর কীভাবে বললো উনি যে বিড়াল দেখেননি কাল। সাতটা বিড়াল বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলো আর উনি দেখেননি? তবে কি উনি পাহাড়া না দিয়ে নিজের ঘরে বসে ঘুমান? এমন যদি হয় আব্বাকে বলে কমপ্লেইন করতে হবে উনার নামে। আমাকে হুমকি দেওয়া? ভালোমতো বুঝিয়ে দিবো উনাকে আমি কে। এসব ভাবছিলাম আর বারান্দায় পায়চারি করছিলাম। আজ সারাটাদিন বাহাদুর আর রাণীর সাথে আমার সময় কাটানো হয়নি। ওরা কেমন যেনো ভয়ে মিইয়ে আছে সকাল থেকে। বড্ড খারাপ লাগছে ওদের জন্য আমার।
সবে নিজের ঘরে এসে বসেছি। বাহাদুর আর রাণীর ঘুমিয়ে গেছে। ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম খানিকক্ষণ। এরপর উঠে একটু পড়তে বসলাম। পরীক্ষার সময় এগিয়ে এসেছে, অথচ কিছুই তেমন পড়া হচ্ছে না। আজ সারাদিন এতো ঘুমিয়েছি চাইলে দুইদিন না ঘুমালেও চলবে। তাই ভাবলাম সময়টা কাজে লাগাই।
কতোক্ষণ পড়েছি জানিনা, বইয়ের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম প্রায়। ঠিক এমন সময় হঠাৎ একটা বিশ্রী গন্ধে আমার নাড়িভুড়ি উল্টে আসার উপক্রম হলো। এমন বাজে গন্ধ কোথা থেকে আসছে? দুর্ঘন্ধযুক্ত ময়লা আবর্জনা পোড়ালে যেমন গন্ধ হয় অনেকটা তেমন কিন্তু আরো বেশি তীব্র। আমি ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম। ঘড়িতে সময় দেখলাম, রাত দুইটা পঁয়ত্রিশ বাজে। এই অসময়ে এমন বাজে গন্ধ কোথা থেকে আসতে পারে? এসব আকাশপাতাল ভাবছিলাম। কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। ঠিক এমন সময় আমাদের মেইন গেটের ক্যাচক্যাচ আওয়াজ শুনে কেঁপে উঠলাম আমি। এতোরাতে গেট খুলছে কে? আবু মিয়া? নাকি আর কেউ? ঠিক করলাম সব লাইট অফ করে বারান্দায় যেয়ে দাঁড়াবো। আস্তে আস্তে পা ফেলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম আমি। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, আজ কি অমাবস্যা? এতো অন্ধকার কেনো? আমি বারান্দার রেলিঙ ধরে নিচতলাটা দেখার চেষ্টা করলাম। অন্ধকারটা কিছুটা চোখ সয়ে এলে আমি অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখলাম। আমার হাত পা কাঁপছে থরথর করে। আবু চাচা মানুষটা আসলে কে? এদের সাথে কি সম্পর্ক তার?