হানাবাড়ি (পর্ব ৫)

সারাঘরে সুনসান নীরবতা। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম। কতোক্ষণ পর আমার জ্ঞান ফেরে আমি জানিনা। কিন্তু যখন আমি জেগে উঠি আমি নিজেকে একটা অন্ধকার ঘরে হাত বাঁধা অবস্থায় পাই। ধাতস্থ হতে আমার মিনিট দুই সময় লাগে। সেই পাশের কোয়ার্টার থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ এ কোয়ার্টারে আসা, তাদের উপর নজর রাখতে নিচতলায় আবু মিয়ার ঘরের সামনে আসা আর তারপর আমাকে ধরে এই ঘরে নিয়ে আসা। সব মনে পড়ে যায় আমার। হালকা গোঙানি দিয়ে উঠি আমি। মা কে দেখতে ইচ্ছা করছে খুব।
আমার গোঙানি শুনে পাশ থেকে একটা মেয়ের গলা কথা বলে উঠলো,”বোন তোমার জ্ঞান ফিরেছে? আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
আমি তাকিয়ে দেখলাম ওই মেয়েটা যাকে বলি দেওয়ার উদ্দেশ্যে ওরা এখানে এনেছিলো। আমি কোনোরকমে চোখ মেলে ওর দিকে তাকালাম। এই ঘরে আমরা দুইজন ছাড়া আর কেউ নেই। বাকিরা কোথায় গেলো তাহলে?
“কেনো নিজের বিপদ এভাবে নিজে ডেকে আনলে বোন? মেরে তো আমাকে ফেলবেই। আজ হোক কাল হোক। কিন্তু তুমি কেনো এসবের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে নিজের জীবনটাও শেষ করে দিলে? এখন তো ওরা তোমাকেও মেরে ফেলবে।”
আমি স্মিত হেসে বললাম,”ওরা আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। আমার বাবা সকাল হলেই আমার খোঁজ করা শুরু করবে। এরপর পুলিশে খবর দিবে। এদের সবাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। সব ভণ্ডামি এদের।”
অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো মেয়েটা। এরপর ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আমার হাতে নিজের হাত রেখে বললো,”তোমাকে আমি এখন এমন কিছু কথা শুনাবো যা হয়তো তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না।”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,”কি কথা?”
“যারা আমাদের এখানে ধরে এনেছে তারা কেউ মানুষ নয়।”
“তোমাকে দেখে তো শিক্ষিতই মনে হয়। তোমাকে ওরা বললো ওরা মানুষ নয়। আর তুমিও সেইটা বিশ্বাস করলে? ওরা আমাদের ভয় দেখানোর জন্য এসব বলছে। আর কিছুই না।”
“তবে শোনো সেই কথা। আজ থেকে প্রায় একশত বছর আগের কাহিনি। হঠাৎ করেই পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রাম থেকে মাঝে মাঝেই মেয়েরা নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছিলো। তাদের হদিস পাওয়া যাচ্ছিলো না। বেশ কিছুদিন পরে তাদের মৃ*তদেহ পাওয়া যেতো নদীর পাশে বা ধানের ক্ষেতে। তাদের শরীরে একবিন্দু র*ক্তও থাকতো না। গলা থাকতো কাটা। একটুকরো কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকতো তাদের শরীর। দিনের পর দিন এমন হতে থাকলে এই ঘটনা গ্রামগুলোর মধ্যে একটা ত্রাস সৃষ্টি করতে লাগলো। আর বলে রাখা ভালো মেয়েগুলোর মধ্যে কেউ বিবাহিত ছিলো না। সব কয়টা মেয়ে ছিলো কুমারী। এজন্য মেয়ের বাবারা সবাই পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলো মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্য। তারা মনে করেছিলো বিয়ে দিলেই বুঝি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ঠিকই একই দলে ছিলো আমার দাদীর নানা। দাদীর মা কে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগেন তিনি। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে বিয়ে ঠিক করে ফেলেন। ঠিক গায়ে হলুদের রাতে হঠাৎ করে দাদীর মা নিখোঁজ। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না সে রাতে।”
মেয়েটা একটু থামে, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে শুনছি সব।
“তারপর কি হলো?”
“দাদীর মা কে পাওয়া যায় ঠিক দুইদিন পরে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তিনি ছিলেন জীবিত। হঠাৎ একদিন সকালে চুল উষ্কোখুস্ক অবস্থায় চিৎকার করতে করতে তিনি তার বাড়িতে আসেন। এসেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। গ্রামের মানুষেরা তখন অন্যকিছু ভেবেছিলো। মেয়ে হয়তো অন্য কোথাও পালিয়ে গিয়েছিলো। সেখান থেকেই এ অবস্থায় ফিরেছে সে। তাদের একঘরে করে দেওয়ার আলোচনাও শুরু হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু দাদীর মায়ের জ্ঞান ফেরার পরে সে এমন কিছু ঘটনা সবাইকে শুনায় যা মুহুর্তেই তোলপাড় করে দিয়েছিলো গ্রামের মানুষগুলোকে।”
“কি ঘটনার কথা বলেছিলেন তিনি?”
“সেদিন গায়ে হলুদের রাতে দাদীর মা পুকুরে হাতমুখ ধুতে গিয়েছিলো। যদিও সে একা ছিলো না। তার বোনরাও সাথে ছিলো। বোনদের মধ্যে সবাই ছিলো বিবাহিত। একা তিনিই ছিলেন অবিবাহিত। হঠাৎ পুকুর পাড় থেকে উঠে আসার পরেই তার মনে হলো তার বোনরা কেউ নেই তার পাশে। পুরো জায়গাটায় সে একা। সে ভেবেছিলো তার বোনরা বোধহয় তার সাথে মজা করার জন্য তাকে একা রেখেই চলে গেছে।
কিন্তু সে যখন পুকুরপাড় থেকে উঠে আসতে লাগলেন ঠিক তখনই তার মনে হলো তার চারপাশে কিছু প্রাণীর অস্তিত্ব। তিনি কিছুটা ঘাবড়ে যান। দ্রুত পুকুরপাড় থেকে উঠে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু ততক্ষণে তার চারপাশ কিছু কুকুর সদৃশ কালো জন্তুতে ভরে গেছে। কুকুরের চেয়ে তারা ছিলো আকৃতিতে অনেক বড়। দাদীর মা ভীষণ ভয় পেয়ে যান ওই দৃশ্য দেখে। সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে যান তিনি। যখন জ্ঞান ফেরে তখন তিনি এই মানুষের মতো দেখতে জানোয়ারদের ডেরায়।”
আমি চোখ বড় বড় করে সব শুনছি। বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি আমি। কোনটা বিশ্বাস করবো? এই বিজ্ঞানের যুগে এসব অতিপ্রাকৃত জিনিস নাকি কোনটা অবিশ্বাস করবো যা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি? আমার মাথা কাজ করছে না। ফিসফিস করে বললাম,”উনি কীভাবে ছাড়া পেয়েছিলেন এদের ডেরা থেকে?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েটা বললো,”সে কথা আমি জানিনা। আমাদের কখনো জানানো হয়নি। এসব কথা আমার দাদীর মুখে শোনা। তবে একটা ব্যাপার আমি জানি। এই রাঘানিয়া জাতি আসলে শয়তানের উপাসনা করে। শয়তানকে খুশি করতে পারলেই তারা সর্বোচ্চ শক্তির ধারক হবে। শতশত বছর ধরে এরা লোকচক্ষুর আড়ালে এসব করে আসছে। তবে কোনো একটা কারণে শয়তান এদের উপর ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিলো। তখন তারা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা গুণে গুণে নয়শো নিরানব্বইটা মেয়ে শয়তানের উদ্দেশ্য বলি দিবে। তাহলেই নাকি শয়তান তাদের উপর খুশি হয়ে সেই সর্বোচ্চ শক্তি তাদের দান করবে। তখন থেকে তারা একের পর এক কুমারী মেয়েদের ধরে নিয়ে যেতে থাকে আর শয়তানের উদ্দেশ্যে বলি দিতে থাকে। হয়তো সেই সংখ্যা পূরণ হতে আর বেশি দেরী নেই। হতে পারে আমি আর তুমিই সেই শেষ কুমারী মেয়ে যাদের বলি দিয়ে এই জানোয়ারগুলো শয়তানের থেকে অবিনশ্বর শক্তি পাবে।”
এই বলে মেয়েটা হাঁটুতে মুখ গুজে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। আমি চাচ্ছি মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে কিন্তু আমার দুই হাতই শক্ত রশি দিয়ে বাঁধা। নিজের জন্য তো দুশ্চিন্তা হচ্ছেই সাথে মেয়েটার জন্যও খারাপ লাগছে। নিশ্চয়ই তার মায়ের কথা মনে পড়ছে। আমি নরম গলায় বললাম,”কান্না করো না। কোনোভাবেই এদের উদ্দেশ্য আমরা সফল করতে দিবো না। নিজেকে শক্ত করো।”
আস্তে আস্তে করে মেয়েটা মাথা তুললো। চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে। আমার দিকে অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,”তুমি জানো না এরপর আমাদের সাথে কি হতে চলেছে। ঠিক রাত তিনটায় এরা কুমারী মেয়েদের শয়তানের উদ্দেশ্যে বলি দেয়। সেখানে আজ তোমার জন্য ওদের সব শেষ হয়ে গেলো। তুমি বুঝতে পারছো না কতো ভয়ংকর কিছু আজ হতে পারে। ওরা কতোটা হিংস্র এটা আমি শুনেছি আমার দাদীর কাছ থেকে। আমার দাদীর মা এদের চোখে ধূলো দিয়ে পালিয়ে আসার পর থেকে তার উত্তরসূরীদের উপর নজর পড়ে এই রাঘানিয়াদের। আমার ফুপুকেও এরা উঠিয়ে নিয়ে এসেছিলো। তার মৃতদেহ পাওয়া যায় ঠিক দুইদিন পর। আর আজ আমাকে। আজ তুমি তখন না আসলে এতোক্ষণ বোধহয় আমাকে…..”
কথা শেষ না করেই মেয়েটা দুই হাতে মুখ ঢেকে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। বড্ড মায়া হয় আমার ওর জন্য। আমি ওকে বললাম,”আমার হাতের বাঁধনটা খুলে দাও। তোমার হাত তো খোলাই আছে।”
“তুমি কি ভেবেছো আমি চেষ্টা করিনি? তোমার জ্ঞান ফেরার আগেই অনেকবার চেষ্টা করেছি আমি। কিন্তু এদের এই শক্ত বাঁধন খোলার ক্ষমতা আমাদের মনুষ্য জাতির কারো নেই। একমাত্র মৃত্যুই হবে এখান থেকে বের হওয়ার পথ। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। এরপর চোখ সরু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে বললাম,”ওদের উদ্দেশ্য কোনোভাবেই সফল করা যাবে না। তুমি কি কোনো উপায়ই জানো না এদের ধ্বংস করার? তোমার দাদী কিছুই বলেননি? যে কোনো উপায়? জানা আছে?”
আমতা আমতা করে মেয়েটা বললো,”কিন্তু সেটা তো আমাদের দ্বারা কোনোদিন সম্ভব নয়।”
আমি ঝট করে মেয়েটার দিকে তাকালাম। অসহিষ্ণু হয়ে বললাম,”সে যেমনই হোক বলো আমাকে।”
মেয়েটা কিছু বলতে যাবে তার আগেই দরজায় খুট করে একটা শব্দ হলো। মেয়েটা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আমার কাছে সরে এলো। আমি জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলাম। কি হতে যাচ্ছে আমি জানিনা। শুধু জানি এদের উদ্দেশ্য কোনোদিন সফল হতে দেওয়া যাবে না। আমি হাত মুষ্টিবদ্ধ করলাম। দরজায় একটা নেকড়ে সদৃশ জন্তুর কালো ছায়া পড়লো।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প