— আপনাকে না ছাদে আসতে মানা করেছিলাম তারপরও আজ আবার আসলেন?
— আসলে এই ছাদ ছাড়া আর কোথায়ই বা যাবো বলুন? ছাদের চিলেকোঠায় থাকি। আমার তো আর বেলকনি নাই যে সেখানে একটু আসবো।
— আপনাকে শুধুমাত্র ওই চিলেকোঠাই ভাড়া দেয়া হয়েছে ছাদ না।
— কিন্তু আমার যে আকাশ না দেখলে একটা রাতও যে কাটে না।
— রুমে বসে দেখা গেলে দেখবেন না হলে নাই। তবুও আপনাকে যেন আমি আর ছাদে না দেখি। বিশেষ করে আমি থাকা সময় তো না-ই।
আমি আর প্রতি উত্তরে কিছু বলতে পারলাম না। তার আগেই নিলা হাঁটা শুরু করলো। আর যেতে যেতে আস্তে আস্তে বললো,
— আব্বু কেন যে এসব ব্যাচেলর ভাড়া দেয় সেটাই বুঝিনা, ধুর!
আমি ঠায় দাঁড়িয়ে নির্লজ্জের মতো সন্ধ্যার আকাশ দেখতে লাগলাম। কি করবো। এই আকাশই যে আমার সব!
কিছু সময় খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে রুমে চলে এলাম। এখন আবার রাতের রান্নাবান্নাও করতে হবে। ব্যাচেলর মানুষের আবার এই একটা সমস্যা মন চাক বা না চাক রান্না করতেই হবে। তবে ইদানীং নিজের রান্না আর মোটেও খাইতে ইচ্ছে করেই না। মন চায় বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতের খুব ঝাল দিয়ে চচ্চড়ি করা ছোট মাছ দিয়ে গোগ্রাসে কয়েক প্লেট ভাত খেতে। তবে তাও যে পারি না। তাইতো গিলতে না পারলেও জীবন বাঁচাতে হলেও আমাকে খেতেই হচ্ছে।
.বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি প্রায় মাস চারেক হবে। এসে উঠেছি মনোয়ার আঙ্কেলের বাসায়। উনি মানুষ হিসেবে অমায়িক। এর আগে আমি একটা মেসে থাকতাম। বছর তিনেকের মতো ওনার ছোট ছেলে মৃন্ময় কে পড়াচ্ছি। উনি বারবারই বলতেন,
— বাবা, তোমার কোনো সমস্যা না হলে আমাদের বাসার ছাদে একটা ছোট্ট রুম আছে সেখানে এসেই থাকিও।
আমি থাকিনি তখন। তবে মাস চারেক আগে না এসে আর পারলামও না। যদিও আঙ্কেল আমার থেকে ভাড়া নেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন শুধু বিনিময় হিসেবে মৃন্ময় কে ভালো করে পড়াতে হবে আর সবার সাথে টুকটাক সময় দিতে এই তার চাওয়া। আমিও মেনে নিয়েছি। সব মিলিয়ে ভালোই চলছে। আর ছাদে যে মেয়েটা রাগ দেখিয়ে চলে গেলো সে মনোয়ার আঙ্কেলেরই বড় মেয়ে। এবার অনার্সে পড়ছে। খুব ভালো ছাত্রী সে। শুনেছি ব্যবহারও তার বাবার মতোই অমায়িক। শুধু আমার সাথেই আজ অবধি কখনোই ভালো ব্যবহার করেনি। তার সাথে আমার যতবারই কথা হয়েছে আমি লক্ষ্য করেছি তার মুখে তখন বিরক্তি চরমে ছিল। জানিনা, কেন জানি মেয়েটা আমাকে সহ্যই করতে পারেনা। অথচ আমি তার সাথে এমন কিছু করিনি যার জন্য সে এমন করবে। তবে একটা অপরাধ ধরা যায় সেটা হলো ওইযে ছাদে যাওয়া। কিন্তু আমিও যে নিরুপায়। বদ্ধ ঘরে বসে বসে কী আর আকাশ দেখার স্বাদ মেলে?
.রান্না শেষ করে খানিক সময় রেস্ট নিলাম। দিনদিন কেমন যেন ভারসাম্যহীন হয়ে যাচ্ছি। যদিও হওয়াটা স্বাভাবিক। আগের মতো নিয়ম করে আর কিছু করতে পারি না। ইদানিং ডায়েরি লেখার নেশাটাও একদম মরে গেছে। কি মনে করে যেন তাই ডায়েরিটা নিয়েই বসলাম। বিন্দু বিন্দু স্মৃতিগুলোকে বন্দী করে রাখাটায় আলাদা একটা স্বাদ।
.রাত প্রায় একটা বাজে। খাওয়া শেষ। অভ্যাস মতো ছাদে যাবো ভাবছি। তবে মনে পড়ে গেলো নিলার কথা। তার কথার যুক্তি আছে। আমাকে শুধু রুম ভাড়া দেয়া হয়েছে ছাদ না। তাই যা করার রুমেই করতে হবে। তবে মেয়েটা যদি জানতো যে তার বাবা আমাকে রুম ভাড়া দিয়েছে ঠিকই কিন্তু ভাড়া কখনোই নেয় না তবে মেয়েটা নিশ্চয় আমাকে সেই কবেই রুম থেকে তাড়িয়ে দিতো। এমনিতেই তো দেখতে পারে না। তাই উপায় না পেয়ে রুমে বসেই আকাশের কিছু অংশ দেখতে থাকলাম। আর গুনগুন করে ইচ্ছে মতো গান গাচ্ছি,
” মেঘ তুমি উড়ে চলো আকাশে, নেবে কি মোরে ভর করে বাতাসে, তোমার সাথে? আমিও হারাতে চাই সেখানে, যেখানে সুখ গুলোও ডানা মেলে বাতাসে। আর কষ্ট গুলো খুঁজে পায় রাতের জোছনা”।
.বিকেল চারটা ছুঁইছুঁই। মৃন্ময়কে পড়ানো শেষ করে বাইরে এসেছি। উদ্দেশ্য বাড়িতে একটা ফোন করা। প্রায় দেড়মাস হলো কারও সাথে কথা হয়নি। বাবা-মা, ভাইয়া -ভাবি আর পিচ্চি গুলারে বড্ড মনে পড়ছে। সাবিত ভাইয়ের দোকানে গিয়ে ফোন দিলাম। বুকটা খুব কাঁপছে। আমাকে শক্ত হতে হবে না হলে সমস্যা।
— আসসালামু আলাইকুম।
— ওয়ালাইকুম আসসালামু। কে?
— ভাইয়া আমি আসিফ।
— আসিফ! ভাই তুই কোথায়? কেমন আছিস? বাড়ি আয় ভাই। আম্মু -আব্বু তোরে খুব মিস করে। প্রতিদিন কাঁদে তোর জন্য। তুই বাড়ি আয় ভাই।
— আম্মু আছে?
— হ্যাঁ।
— আম্মুকে দাও তো।
— দিচ্ছি লাইনে থাক।
গলাটা ধরে আসছে খুব। নাহ, আরও পাষাণ হতে হবে। চোখকে ভিজতে দিলেই সব শেষ।
— আব্বুরে তুই কই? তাড়াতাড়ি বাড়ি আয় আব্বু। আমরা কি এতটাই অক্ষম যে আমাদের না বলে তুই চলে গেলি?
ফুঁপিয়ে কেঁদে দিয়ে আম্মু বলতে লাগলো।
— তোমরা অক্ষম নও আম্মু। আমার আর এসব সহ্য হচ্ছিল না তাই চলে এসেছি।
— কেমন আছিস বাবা? কী খেয়েছিস? তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি আয় বাবা আমি তোকে তোর পছন্দের সব কিছু খাওয়াবো তবুও বাড়ি আয়। তোকে খুব দেখতে মন চাচ্ছে!
— যাবো আম্মু। হুট করেই একদিন যাবো। আম্মু, আব্বুকে ফোনটা দাও তো।
— তোর বাপ তোর উপর রাগ করে আছে। কথা বলবে না। আব্বা তোর ভাবি কথা বলবে নে ধর,
— বাবু তুমি এভাবে বাড়ি ছেড়ে গেলে? আমাদের কথা একটা বারও ভাবলে না? তোমার বাবা-মা ভাই আমরা কি এতটাই খারাপ?
— না ভাবি এসব কিছু না। তুমি কেমন আছো? আমার চাচ্চু তরী কেমন আছে?
— কেউ ভালো নেই। তুমি চলে আসো। আমরা যেভাবে পারি তোমাকে দেখবো। তবুও তুমি চলে আসো।
— আসবো ভাবি। হুট করেই একদিন চলে আসবো।
— কবে আসবা?
— আসবো একদিন। আচ্ছা ভাবি রাখি তাহলে এখন।
— তুমি তো নিজের নাম্বার ও বন্ধ করেছো তো আবার কবে ফোন দিবা?
— জানি না ভাবি।
বলেই ফোনটা কেটে দিলাম। দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। আর একটু কথা বললেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারতাম না। শেষমেশ সব ধূসর হয়ে যেত।
.একটা টিউশনিতে কোনো ভাবেই আর চলতে পারছি না। এদিকে শরীরটাও আজকাল বড্ড বেঈমানী করছে। শুধু ঘুম পায়। অসার হয়ে আসে। নড়তে পারি না। দেখতেও ফ্যাকাশে হয়ে গেছি। কয়েকদিন ধরেই বন্ধু নয়নকে বললাম একটা টিউশনি খুঁজে দিতে। দিয়েছিল খুঁজে তবে অনেক দূর। প্রতিদিন গাড়িতে যাওয়া আসায় আমার পোষাবে না। গুনীজনরা আসলেই সত্যি বলেন। টাকা ছাড়া দুনিয়ার সবই অচল সব!
.সিঁড়ি বেঁয়ে ছাদে যাচ্ছি তখনই মনোয়ার আঙ্কেলের সাথে দেখা। আমাকে দেখতেই একগাল হেসে বললেন,
— যাক, তোমাকে ডাকতেই যাচ্ছিলাম।
— কেমন আছেন আঙ্কেল?
— আলহামদুলিল্লাহ। তা রাতের রান্না করেছো?
— না আঙ্কেল করিনি। একটা টিউশনির খোঁজে বাইরে গেছিলাম। এখন গিয়েই রান্না করবো।
— তাহলে ভালোই হলো। বলছি আজ আর রান্না করা লাগবে না। তোমার আন্টি আজ রাতে তোমাকে আমাদের সাথে খেতে বলেছে।