কিন্তু আঙ্কেল এসবের কি দরকার ছিলো?
— আরে তাতে কী। তুমি তো আমার ছেলের মতোই তাই না?
— জ্বি আঙ্কেল।
— আচ্ছা শুনো, আমি মৃন্ময়কে পরে পাঠিয়ে দিলে তুমি তখন যেও কেমন?
— আচ্ছা ঠিক আছে যাবো।
— আচ্ছা আমি তাহলে নীচে গেলাম কেমন?
— আচ্ছা, আসসালামু আলাইকুম।
— ওয়ালাইকুম আসসালাম।
মনোয়ার আঙ্কেল যে আসলেই অমায়িক তার প্রমান এটাই। অনেকদিন নিজের রান্না খেয়ে একদম জিভটাও বিষাদ হয়ে গেছে। আহ! কতদিন পর যে একটু ভালো রান্না খাবো! এসব ভাবতে ভাবতেই ছাদে উঠে আকাশ দেখায় মনোযোগ দিলাম। আজ আকাশে বিশাল বড় চাঁদ। তবে মেঘের কারণে একটু বেশিই ভালো লাগছে। মাঝেমাঝেই কোথা থেকে যেন একফালি মেঘ এসে চাঁদটাকে ঢেকে দিচ্ছে। ঠিক যেন লুকোচুরি খেলা। হুটহাট মন ভালো হওয়ার জন্য এটাই তো যথেষ্ট।
একটু পরই মৃন্ময় এসে খাওয়ার জন্য ডাক দিলো। আমিও ওর সাথে চলে গেলাম। খাওয়ার টেবিলে বসে তো অবাক! এত রকমের খাবার!
তাও বেশির ভাগই আমার পছন্দের। ছোট মাছ, লালশাক ভাজি, করলা ভাজি আর কবুতরের মাংস।
আঙ্কেল খেতে খেতে গল্প জুড়ে দিলেন। আন্টিও আমার আসাতে খুব খুশি। শুধু দেখলাম নিলার চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ।
খেতে খেতে আন্টি বললেন,
— আসিফ তোমার কী শরীর খারাপ?
— না আন্টি শরীর তো ঠিকই আছে।
— না মানে অনেক দিন ধরেই দেখছি তুমি অনেক শুকিয়ে গেছো।
— আসলে আন্টি পড়াশোনার খুব চাপ তো। তার উপর একা রান্না করে খাওয়া। ওসব খেয়ে আর কতো মোটা হবো বলেন? তবে আজ যা খাওয়ালেন না তার জন্য আমি মোটা হলেও হতে পারি। হাহাহা।
আমার কথা শুনে সবাই হেসে দিলো তবে নিলা বাদে। খাওয়া শেষে কিছু সময় গল্প করে আমি আবার ছাদে চলে এলাম। আজ দিনটা খুবই ভালো। মাঝে মাঝে এমন খাওয়া পেলে আসলেই মন্দ হয় না। আর আন্টির রান্নার হাতও যথেষ্ট ভালো।
— আপনাকে না মানা করেছিলাম ছাদে আসতে।
আকাশ দেখছি আর সাতপাঁচ ভাবছি তখনই পেছন থেকে কথাটি শুনে থমকে গেলাম। আমার মনেই ছিলোনা যে ছাদে থাকা মানা। তবে এত ভালোভালো খেয়ে মনটা এতই উতলা ছিলো যে এটা ভুলেই গেছিলাম।
— কেন এসেছেন? লজ্জা নাই না কি?
— দুঃখিত। আসলে আপনার মায়ের হাতের রান্না খেয়ে সব একদম ভুলে গেছিলাম।
— আমার বাবার মাথাটাও তো খেয়েছেন।
— মানে?
— মানে আর কী? রুম ভাড়া তো বাবা মাফই করে দিয়েছেন। তবুও আপনি একটা কথাও শুনেন না, কেন? লজ্জা নাই না কি?
আমি মাথাটা নিচু করে নিলাম। জেনে গেছে তাহলে? আর না জানারই বা কি আছে। মিথ্যাও তো বলেনি। আমিতো ফ্রি থাকি।
সত্যি কথাটাই বলছে মেয়েটা। তবুও কেমন যেন লাগলো। কেমন?
— দেখেন আমি আপনাতে বিরক্ত হচ্ছি খুব। আপনার জন্য একটু শান্তিতে ছাদে আসতেও পারি না। আপনি দয়া করে এই বাসা থেকে অন্য কোথাও চলে যান প্লিজ। মেসেও তো থাকতে পারেন। আমি সহ্য করতে পারছি না আপনাকে। আপনি ভাবতেও পারেন যে সামান্য কারণে এমন করছি। তবে সত্যি বলছি কেন জানিনা আপনাকে আমার সহ্য ই হয়না মোটেও। আপনি যদি চলে যান তো আমি খুব খুশি হবো। দয়া করে আমার কথাটা রাখবেন প্লিজ।
মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়েই আছি। নিলা পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। বুঝলাম না কিছুই। সামান্য ছাদে আসাটাই মেয়েটার এতটা বিরক্তির কারণ! হতেও পারে। হয়তো সে চায় না। বা আমাকে ভালো চোখে দেখে না। অপরিচিত হিসেবে বিষয়টা স্বাভাবিক। আকাশটাও মেঘলা। চাঁদটাও আর দেখাই যাচ্ছে না। নাহ, রুমেই বরং যাই। ছাদে থাকাটা আর ঠিক হবে না।
.
বিকেলে মৃন্ময়কে পড়াচ্ছি আর সাতপাঁচ ভাবছি। তবে কাল রাতেও অনেক ভেবেছি। ভেবে দেখলাম এখানে থাকাটা আর ঠিক হবেনা। কারণ হিসেবে দুইটা বিষয় দাঁড় করিয়েছি । এক হলো আমি আকাশ না দেখে, খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস না নিয়ে একটা দিনও বাঁচতে পারবো না আর একটা হলো এখানে থাকলে নিলার মেজাজটা আরও খারাপ হবে। যদিও চলে গেলে আমার খুবই কষ্ট হবে। কারণ সামান্য একটা টিউশনি দিয়ে তো আর পুরো মাস চলা সম্ভব না। এখানে থাকাকালীন তাও ভাড়াটা বাঁচতো কিন্তু চলে গেলে! তবুও আমাকে যেতেই হবে। আমি কারও বিরক্তির কারণ হতে চাইনা।
— ভাইয়া একটা কথা বলি?
ভাবনায় ছেদ ফেলে মৃন্ময় জিজ্ঞেস করলো।
— হ্যাঁ বলো।
— অনেকদিন ধরেই দেখছি আপনি শুধু শুকিয়ে যাচ্ছেন। চোখমুখ কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ভাইয়া, আপনার কী কিছু হয়েছে?
মৃন্ময়ের কথা শুনে বুকটা ধক করে উঠলো। তাহলে সেও আমার শরীরের অবনতি ধরে ফেলেছে! যদিও ধরতে পারাটা স্বাভাবিক। তবুও ওকে বুঝানোর জন্য বললাম,
— পড়াশোনার অনেক চাপ বুঝলা তো তাই শরীরের যত্ন নিতে পারি না। সমস্যা নেই ঠিক হয়ে যাবে। তুমি এখন পড়ায় মনোযোগ দাও।
মৃন্ময় আর কিছু বললো না। তবে ওর যে উত্তর টা পছন্দ হয়নি সেটা বুঝে নিলাম। এখন মনোয়ার আঙ্কেলের সাথে দেখা করাটা খুব জরুরি। তাই আন্টিকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করতেই বললেন,
— তোমার আঙ্কেল তো এখন বাসায় নেই তবে রাতে আসিও।
.পড়ানো শেষ করে রুমে চলে এলাম। এমাসের আর পাঁচদিন বাকি আছে। আমাকে খুব তাড়াতাড়ি মেস ঠিক করতে হবে আর মাসের শুরুতেই চলে যেতে হবে। সাথে যেভাবেই হোক একটা টিউশনি যোগাড় করতেই হবে। আর এই কয়দিনে ভুল করেও ছাদে একটা সেকেণ্ডও থাকা যাবে না। আমি দ্বিতীয়বার আর নিলার বিরক্তিমাখা মুখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না। সন্ধ্যায় সাবিত ভাইয়ের দোকানে নয়নের সাথে বসে আমার মেসে ওঠার কথাটা ঠিক করে নিলাম। সাথে যেখানেই হোক দু’একটা টিউশনিরও খোঁজ দিতে বললাম। এবার যতই দূর হোকনা কেন আমাকে টিউশনি করাতেই হবে।
নয়নের সাথে কিছু সময় আড্ডা দিয়ে ফিরে এলাম। সিঁড়ি বেঁয়ে উঠছি তখনই মনে পড়লো মনোয়ার আঙ্কেলের সাথে কথা বলা দরকার। রুমে না গিয়ে তাই কলিং বেল বাজালাম। দরজা খুললেন আন্টি। আমাকে দেখেই একগাল হেসে বললেন,
— আরে আসিফ যে! এসো ভিতরে এসো।
— আন্টি আঙ্কেল আছে?
— হ্যাঁ রুমেই আছে তুমি ভেতরে এসে বসো আমি ডেকে দিচ্ছি।
— আচ্ছা দেন।
আমি ভেতরে এসে বসলাম আর আন্টি ডাকতে চলে গেলো। সংক্ষিপ্ত সময়ে আমি চাচ্ছি কোনোভাবেই যেন নিলার সামনাসামনি না হই। আর আঙ্কেলকে চলে যাওয়ার কথাটা কেমন করে বলবো সেটাও ভাবছি। যেভাবেই হোক বাসাটায় আর থাকা যাবে না।
— কি খবর বাবা আসিফ?
— আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল কেমন আছেন?
— আলহামদুলিল্লাহ বেশ ভালো। তা হঠাৎ কি মনে করে?
— না মানে একটু জরুরি কথা ছিলো আরকি।
— তা বলো শুনি কি এমন জরুরি কথা তোমার।
— আসলে আঙ্কেল, আপনি তো জানেনই আমি একা থাকি। একাই রান্না করে খেয়ে ক্লাস করি, টিউশনি করি সবই করি। নিজের ওই বিশ্রী রান্না খেতেখেতে জিভটা একদম বিষাদ হয়ে গেছে। তাই আমি চাচ্ছিকি যে আমি বরং মেসে গিয়ে উঠি। ওখানে তাও বুয়া রান্না করে দেবে আমিও কিছুটা সময় পাবো আর নিজের বিষাদও কাটবে।