— এইটা কেমন কথা বাবা? তোমার খাওয়ার কষ্ট হয়েছে এটা আমাকে বললেই হয়। এত চিন্তা করা লাগে? আজ থেকে তুমি তিনবেলা আমাদের সাথেই খাবা। শুধু শুধু মেসে গিয়ে মেসভাড়া দিয়ে বুয়ার হাতের জঘন্য খাবার খাওয়ার কী দরকার বলো?
— না আসলে সমস্যাটা শুধু খাওয়ার না। আসলে মেসে থাকলে আমার পড়াশোনাটাও একটু ভালো হতো আরকি। আর সামনেই পরীক্ষা। রান্নাবান্না করে সময় নষ্ট করতে চাইনা।
— এখানেই থাকো সমস্যা তো নাই।
— না আঙ্কেল গেলেই বেশি ভালো হতো।
— তুমি যখন এতো করে চাইছো তখন আমি আর কি বলবো। তবে কখনও আসতে মন চাইলে আসিও। তোমার জন্য সব সময় আমার চিলেকোঠা বরাদ্ধ থাকবে।
— একদিন হুট করেই আসবো আঙ্কেল।
— তা চলে যাচ্ছো কবে?
— মাসের আর পাঁচদিন বাকি আছে। আমি ওই মাসের শুরুতেই উঠবো মেসে।
— একটা আবদার করি বাবা?
— করেন।
— অন্তত এই কয়টা দিন তুমি আমাদের সাথেই খাওয়াদাওয়াটা করিও কেমন। আমি কিন্তু না শুনতে চাই না।
— আচ্ছা খাবো। তবে খাওয়ারটা একটু কষ্ট করে পাঠিয়ে দিলে ভালো হতো।
— আচ্ছা আমি মৃন্ময়কে দিয়ে পাঠিয়ে দিতে বলবো।
— আচ্ছা আঙ্কেল উঠি আমি। আসসালামু আলাইকুম।
— ওয়ালাইকুম আসসালাম। আচ্ছা বাবা যাও।
. আঙ্কেলের কথা মতো রাতে মৃন্ময় এসে খাবার দিয়ে গেছিলো। খেয়ে শুয়ে শুয়ে অনেক কিছুই ভাবছি। মানুষের এই একটা সমস্যা। একটু বিশ্রামে থাকলেও অবুঝ মনটা একাই বকবক করে। এই বকবকের কোনো শেষ নেই।
ইদানিং রাতে একদম ঘুম হয়না। দু’দিন হলো ঘুমানোর জন্য স্লিপিং পিল খাই তবুও ঘুম আসেনা। অথচ এই আমি রাত এগারোটা বারোটার বেশি জেগে থাকতেই পারতাম না। বুঝছি না। দিনদিন আমি মানব থেকে মহামানব টানব হচ্ছি কী না কে জানে!
আমি আকাশ দেখে নির্দিধায় একটা রাত পার করে দিতে পারি। তবে এই বদ্ধ ঘরে বসে আকাশ দেখতে দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই জানলা দিকেই একটু চোখ বুলিয়ে ডায়েরি লিখতে বসে গেলাম। আজকাল এই ডায়েরি লিখতেও আলসে লাগে। অথচ এই ডায়েরির সাদা পৃষ্ঠায় আমার জীবনের উত্থান-পতনের সব ঘটনাই লিপিবদ্ধ আছে।
. সকাল থেকেই দারুণ দৌড়ের উপর ছিলাম। নয়ন একটা টিউশনির কথা বললো সেই বাসাতে গিয়েছিলাম। ক্লাস ফোরের এক বাচ্চাকে পড়াতে হবে। সব ঠিক করে এলাম। তারা আমাকে টিউটর হিসেবে সহজেই গ্রহন করছে ভেবেই খুশি লাগলো। যদিও বেতনটা একটু কম তবে এই বেহাল জীবনে সামান্য টাকাটাও আমার কাছে হীরের মতো মূল্যবান এখন।
.রাত হয়েছে অনেক। এদিকে খাবারও দিয়ে যায়নি এখনও। শরীরটার অবনতিও ইদানিং আমিও লক্ষ্য করছি খুব তবে মনটা ভালো আছে। তাই ডায়েরি লিখছিলাম। হঠাৎই মনে হলো আব্বু-আম্মু আর ভাইয়াদের সাথে একটু কথা বলি। উঠে চলে এলাম সাবিত ভাইয়ের দোকানে।
ভাইয়াকে ফোন দিতেই সাথেসাথে রিসিভ হয়ে গেলো। বুঝলাম না। তারা কি আমার ফোনের জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকে?
— কেমন আছো ভাইয়া?
— এভাবে কেউ ভালো থাকে? আমরা একটুও ভালো নেই। তুই ফিরে আয় ভাই, আমি বড় হয়ে তোর পায় ধরে বলছি ফিরে আয়।
— আম্মুকে দাও তো।
— কেমন আছিস আব্বু?
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আম্মু। তুমি, আব্বু কেমন আছো?
— ছেলে কাছে না থাকলে কী মা-বাবা ভালো থাকে? তুই আসবি কবে বাবা?
— আসবো আম্মু, হুট করেই একদিন চলে আসবো।
— খেয়েছিস?
— না আম্মু খাবো বাসায় ফিরে। আব্বাকে একটু দিবা?
— তোর আব্বা খুব অভিমান করছে রে। কথা বলবে না।
— আমি রাখি তাহলে আম্মা।
— আবার কবে ফোন দিবি?
— হুট করেই একদিন দেবো আম্মা। এত টেনশন করিও না তো। আমি খুব ভালো আছি। রাখি? আসসালামু আলাইকুম।
চোখটা জ্বলছে খুব। হয়তো পানি আসতে বাঁধা পাচ্ছে তাই। দোকান থেকে চলে আসার সময় সাবিত ভাইও বললো,
— আসিফ, তোর শরীরটা দিনদিন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে কোনো সমস্যা হলে ডাক্তার দেখা।
বুঝলাম না। সবার চোখেই আমি পড়ছি এখন! এটাতো মহামানব হওয়ারই লক্ষণ। হি হি হি।
.অপরদিকে মৃন্ময় ঘুমিয়ে যাওয়ায় নিলার মা নিলাকে আসিফের খাবার দিয়ে আসার জন্য বলেছেন। নিলা রাজি না হলেও মায়ের কথায় বাধ্য হয়ে রাজ্যের সব বিরক্তি নিয়ে খাবার নিয়ে এসে দেখে দরজা খোলা তবে ঘরে কেউ নেই। মিনিট কয়েক এদিকে ওদিকে খুঁজেও না পেয়ে আরও বিরক্ত হয়ে রুমে ঢুকে খাবার বিছানায় রেখে চলে আসবে তখনই চোখ যায় বিছানায় খুলে রাখা ডায়েরিতে। নিলার কেন জানি কৌতূহল জাগে। ছোটবেলা থেকেই নিষিদ্ধ সব কাজে নিলার খুব বেশি আগ্রহ। নিজের কৌতূহলকে দমাতে না পেরে কী মনে করে যেন ডায়েরিটা পড়বে বলে নিয়ে চুপিচুপি চলে আসে নিলা। আর ভাবে,
দেখবো কী লেখা আছে এখানে।
.খিদে লেগেছিলো খুব। ঘরে আসতেই দেখলাম বিছানায় খাবার রাখা। খুব খিদে লাগায় গপগপ করে খেয়ে নিলাম। খাওয়া শেষে শুয়ে শুয়ে ভাবছি কাল কী কী করবো। কালও যে অনেক কাজ। অথচ আমার ঘুম আসছেই না। একটু ঘুমের যে খুব দরকার আমার!
.রাত প্রায় একটা বাজে। কৌতুহলী নিলা ডায়েরিটা পড়বে বলে খোলে। প্রথমের দিকটা ফাঁকা। পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে।
কয়েক পৃষ্ঠা পর থেকেই লেখা। নিলা পড়তে শুরু করে,
ইদানিং মোটেও ঘুম হয়না আমার। শরীরটাও দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই বাসায় এসেছিলাম আম্মুর কথা মতো। ডাক্তার দেখালাম। অনেকগুলা টেস্ট দিলো। এই অবধি তো সব ঠিকই ছিলো। তবে কে জানতো আমার জন্য বিশাল বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। ডাক্তার টেস্ট দেখে জানালো আমার ব্লাড ক্যানসার! আর সেটা অনেক আগে থেকেই। এখন রোগটা ভয়ানক হয়ে গেছে তাই শরীরের রক্ত নষ্ট হওয়ায়ই আমার শরীর ভেঙে আসে। শুকিয়ে যাচ্ছি। কত স্বাভাবিক ভাবেই না ডাক্তার বললো,
আমি নাকি ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত!
আমি জানতাম ক্যানসারের চিকিৎসা অনেক ব্যায়বহুল। আর গরিব হলেতো মৃত্যু অবধারিত। তবুও আমার বাবা-মা আমাকে ভালো করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিলেন।
তিন ভাই আর বাবা মা মিলে আমাদের সুখের সংসার। কখনও এই সংসারে দুঃখ আসেনি। আসলো সেটা আমার কাঁধে চড়েই । আমাকে যে আমার মা-বাবা, ভাইয়া – ভাবিরা এতটা ভালোবাসে তা এই অসুখ না হলে জীবনেও জানতাম না। তিন-চার মাসের ভেতরই আমার জন্য প্রায় তিন-চার লাখ টাকা ফুরিয়ে ফেললেন আব্বু। সেদিন গভীর রাতে শুনতে পেলাম তার কথা। আমি যে না ঘুমিয়ে জেগে ছিলাম তারা বুঝেনি।
বাবা ভাইয়াকে বলছিলো,
— দরকার হলে ঘরবাড়ি সব বিক্রি করে দেবো তবুও আমার ছেলের আমি কিচ্ছু হতে দেবো না। আমার তো এই বাড়ি ছাড়া এখন আর কিছু ই নাই। তাই বলে কি ছেলেটা ঠিক হবেনা?
কথাটা শুনে নিরবে খুব কেঁদেছিলাম। কতটা স্বার্থপর আমি! এই সুখের পরিবারে অসুখ হয়ে এসেছি। আবার বাবার শেষ সম্বল বাড়িটুকুও শেষ করবো? আমার বড় দুইটা ভাই দু’জনই বিবাহিত। ছেলেমেয়েও আছে। আমার জন্য বাড়ি বেঁচলে তারা সবাই থাকবে কোথায়? খাবে কী? আমার ভাইয়া ভাবি তবুও একবারও বলেনি যে আমাদের জায়গা বেঁচবো না। আমরা থাকবো কোথায়! এতটা ভালোবাসে আমাকে সবাই। তবে আমি যে পারবো না এতটাও স্বার্থপর হতে। এক আমার জন্য সাত আটটা মানুষ না খেয়ে ঘরছাড়া হয়ে মরবে এটা আমি কী করে মানবো। তাই খুব দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবো । একমাত্র এই রাস্তাটাই আমার জন্য খোলা। হয়তো কষ্ট হবে আমার, সবারও। তবে আমি পারবো না বাবার শেষ সম্বল আর ভাইয়া ভাবিদের গৃহহারা করতে।