অপেক্ষা পর্ব – ৪ এবং শেষ পর্ব

সকাল হওয়ার আগেই ব্যাগ গুছিয়ে ঘরে একটা চিঠি লিখে রেখে চলে এলাম ঢাকার পথে। চিঠিতে লেখা ছিলো তারা যেন আমার জন্য বেশি চিন্তা না করে। হুট করেই আমি আবার ফিরে আসবো।
.ডাক্তার বলেছে চিকিৎসা করালে হয়তো বেশিদিন বাঁচবো। তবে মরবোই। আমিতো এমনিতেই মরবো। হয়তো একটু আগেই মরলাম। এতে অন্তত আর সাত আটটা জীবন বেঁচে থাকলো। আমি জানি আমার জন্য আমার পরিবার নিজেদের জীবন দিয়ে দিতেও একটা বারও ভাববে না। কিন্তু আমি যে এতটাও স্বার্থপর হতে পারি নি।
শেষ ধাপ! উহু, ক্যানসারের শেষ ধাপ! হয়তো হুট করেই একদিন চলে যাবো। হি হি হি। তবুও শেষ নিঃশ্বাস অবধি হাসতে চাই। আকাশ দেখতে চাই। কষ্ট গুলোকে হজম করতে শিখতে চাই।
আমিও যে বাঁচতে চাই। হি হি হি।
টুপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো নিলার চোখ বেঁয়ে। এইতো ডায়েরিটা ধরার সময়ও ছেলেটার প্রতি বিরক্তি ছিলো তার। অথচ এখন!
নিলা ভাবে,
ছেলেটা এমন কেন? এতবড় একটা অসুখ, সে জানেও যে মারা যাবে তারপরও মুখে এতটুকুও কষ্টের ছাপ নেই! শুধুমাত্র বাবা – মা, ভাইয়াদের কথা ভেবে নিজেকে সরিয়ে নিলো? সবার কাছেই নিজের জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছুই নেই। আর ছেলেটা!
কত বাজে ব্যবহার করেছি তার সাথে অথচ একটা বারও আমাকে মাথা তুলে জোর গলায় কিচ্ছু বলেনি। এতটা কষ্ট বুকে রেখে ছেলেটা কি সুন্দর ভালো থাকার অভিনয় করছে। আমরা কেউ বুঝছি না। কেউই না! খুব কষ্ট হচ্ছে নিলার। অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। এতটা খারাপ ব্যবহার করা আসলেই ঠিক হয়নি। মানুষের কারও উপর রাগ করতে যেমন সময় লাগেনা তেমনি মায়া লাগাতেও সময় লাগে না। এই মুহূর্তে নিলারও তেমনি মায়া কাজ করছে। মনে হচ্ছে সে যদি পারতো ছেলেটাকে ভালো করতে! একটু সাহায্য যদি পারতো! অঝরে কাঁদছে নিলা। এতটা কষ্ট কখনোই হয়নি ওর।
. সকাল থেকেই শরীরটা একটু বেশিই খারাপ লাগছিলো আমার। তাই হাসপাতালে এসেছি। ওদিকে কাল রাতে ডায়েরিটা না পেয়ে টেনশনে ছিলাম। পরে মনে হলো মৃন্ময় হয়তো দুষ্টামি করে নিয়েছে। কিন্তু ভয় হচ্ছে ডায়েরিটা না পড়ে। যদিও এতবড় ডায়েরির আসল কথাগুলো পড়তে হলে অনেক সময় লাগবে। এতটা ধৈর্য ওর নেই। তাই একটু টেনশন কম হচ্ছে।
এদিকে ডাক্তার বললো আমার শরীরের রক্ত একদম কমে গেছে। প্রায় ছয় পয়েন্ট রক্ত আছে মাত্র। অথচ স্বাভাবিক একজন মানুষের জন্য দশ পয়েন্ট রক্ত প্রয়োজন। ডাক্তার বললো তাড়াতাড়ি রক্ত না নিলে যেকোনো সময় আমার স্ট্রোক হতে পারে। তাই নয়নকে ফোন দিয়ে বললাম। ঘন্টা খানেক পর ডোনার নিয়ে চলে এলো ও। রক্ত নিতে নিতে অনেক সময় লাগবে। নয়নকে তাই চলে যেতে বললাম। প্রতিবার যদিও একাই আসি। সমস্যা হয়না এখন।
.রাত আটটা বাজে প্রায়। সারাদিন কিছুই খাইনি। মাথাটাও ভারি ভারি লাগছে। তাই ঘরে এসেই শুয়ে পড়লাম। মৃন্ময় এসেছিলো সারাদিন কোথায় ছিলাম জানতে আর খাবার দিতে। বলে দিলাম কাজ ছিলো। ও চলে যেতেই টেবিলে দেখলাম ডায়েরিটা রাখা। বুঝলাম বেচারা পড়েইনি। হা হা হা। এসব গল্প না পড়াই ভালো। জীবনের গল্প গুলো খুবই কষ্টের হয়। বিশ্রী হয়!
.দুইটা টিউশনি যোগাড় হয়ে গেছে। দুদিন খুব ব্যস্ততার মাঝে ছিলাম। কাল সকাল সকাল মেসে উঠবো তাই আঙ্কেল আন্টির থেকে বিদায় নিতে তাদের রুমে যেতেই আন্টি বললো,
— থেকে গেলেই কী ভালো হতো না?
— না আন্টি। আসলে একটু সময় দরকার আমার। তাই যাওয়া আরকি।
— শরীরের অবস্থা দেখেছো তোমার? মেসের খাবার খেয়ে তো বাঁচতেই পারবে না।
— সমস্যা নেই আন্টি অভ্যাস আছে আমার।
— এখন গেলে তো আর জোর করা যায়না। তা বের হবে কখন?
— গাড়ি বলেছি। সামান্য কিছু জিনিস আছে সেগুলো নিতে আসবে একটু পর। নেয়া হলেই কাল সকালের মাঝে বের হবো ইনশাআল্লাহ।
— রাতে তাহলে খেয়ে যেও কেমন?
— আচ্ছা আন্টি খাবো।
আরও কিছু সময় কথা বলে ছাদে আসতেই পেছন থেকে নিলা বললো,
— আমি সেদিন চলে চলে যেতে বলাতেই কী চলে যাচ্ছেন?
— আরে না না তা কেন হবে। আসলে এখানে আর ভালো লাগেনা। সত্যি বলতে আকাশ না দেখলে আমার ভালো লাগেনা। আর ওই মেসে বিশাল ছাদ। সারাদিন রাত আকাশ দেখলেও কেউ বিরক্ত হবে না।
— না গেলে হয়না?
— উহু। এখানে থাকলে আপনিই বেশি বিরক্ত হবেন। আমি চাইনা আমার জন্য কেউ বিরক্ত হোক।
— আমি কিন্তু আপনার ডায়েরিটা পড়েছি!
নিলার কথায় বুকটা ধক করে উঠলো। তারমানে সেদিন ও এসেছিলো। তবুও স্বাভাবিক হয়ে বললাম,
— সমস্যা নেই।
— আমি আর কখনোই আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করবো না। ছাদে আপনি সব সময় থাকলেও কিচ্ছু বলবো না। আপনি চলে যাইয়েন না প্লিজ ।
— যাত্রাগামী মানুষকে না আটকে বরং শুভকামনা জানাতে হয়।
— আমাকে মাফ করা যায়না?
— আপনি তো কিছু করেন নি। আর যদি করেও থাকেন তো মাফ করে দিলাম।
— থেকে গেলে হয়না?
— একদিন হুট করেই চলে আসবো সমস্যা নেই।
নিলা আর কিছু না বলে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো। আমিও রুমে এসে সব গুছিয়ে যাওয়ার আয়োজন করতে থাকলাম।
.রাত প্রায় একটা বাজে। বসে আছি স্টেশনের ওয়েটিং বেঞ্চে। বসে থাকতে ভালো লাগছে। দূরের আরেকটা বেঞ্চে একজন মানুষ বসে আছে। সাথে কয়েকটা ব্যাগ। ঘড়িতে তাকিয়ে বারবারই সময় দেখছেন উনি। আজ রাতের শেষ ট্রেন আসবে। লোকটা ট্রেনটার অপেক্ষাই করছে। তার যে আজ বাড়ি ফিরতেই হবে। বাসায় সবাই হয়তো অপেক্ষা করছে।
.বাসার সবার সাথে খুব কথা বলতে মন চাচ্ছে। তবে বলবো না। একদিন হুট করে গিয়ে সারপ্রাইজ দিলে মন্দ হয়না।
আমি জানি সবাই আমার জন্য খুব টেনশন করে। আমাকে তারা বাঁচাতে চায়। আমার বাবা-মা, ভাইয়া ভাবি আর পিচ্চি গুলাও খুব করে চায় আমি সুস্থ হয়ে যাই।
আমি জানি আমার পরিবার আমার বাড়ি ফেরার জন্য প্রতিটা ন্যানো সেকেণ্ড অপেক্ষা করে। আমি জানি আমার মা পথের পাণে চেয়ে অপেক্ষা করে আর ভাবে,
আব্বু আমার ঠিক আসবে।
তবে মা-বাবার চোখের সামনে ছেলের মৃত্যু কোনো বাবা-মা’ই সহ্য করতে পারবে না। তাইতো আমি সরে এসেছি। আমি চাইনা তাদের এতটা কষ্ট দিতে।
আমি জানি আমি খুব বড় স্বার্থপর।
আমি এটাও জানি আরও একটা মানুষ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। নিলা মেয়েটার না জানলেই ভালো হতো। হয়তো একটা অপেক্ষার প্রহর কমতো। মেয়েটা এখন আমাকে ভালোবাসে এটাও জানি আমি। তবে যাত্রাগামী পথিকের যে পিছু ফিরে তাকাতে নেই। তাকালেই মায়া বাড়ে। আর মায়া জিনিসটা বড্ড খারাপ।
ঝাপসা চোখে দেখলাম ট্রেন আসছে। অপেক্ষা করা মানুষটার মুখে সে কী হাসি! এ যেন শত অপেক্ষার অবসান। লোকটা ব্যাগ নিয়ে তৈরি হচ্ছে বাড়ি ফিরবে বলে।
একটু পরই ট্রেনটা আবার আঁধারের মাঝে মিলিয়ে গেলো। ঝাপসা হয়ে আসা চোখটা শার্টের হাতা দিয়ে মুছে নিয়ে একগাল হাসলাম।
সবাই অপেক্ষা করে। আমিও অপেক্ষা করি। একদিন হুট করেই আমিও ট্রেনে করে বাড়ি ফিরবো। হয়তো সে ট্রেন আমাকে ভুল করে আর বাড়ির পথে নেবেই না। ডাক্তার বলেছে আমার রক্ত পনেরো দিনের বেশি টিকছে না। আমার আয়ু সর্বোচ্চ একমাস!
হি হি হি।
আমিও অপেক্ষায় আছি! একদিন হুট করেই আমার অপেক্ষারও অবসান হবে! হি হি হি!
হাসতে হাসতে চোখটা আবার ঝাপসা হয়ে এলো!

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প