অভিশপ্ত দোলনা(২য় পর্ব)

মোবাইলে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে জানালার বাইরে অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করেও দোলনা ও মেয়েটাকে পেলাম না।মনের ভুল ভেবে শুয়ে পড়লাম।অন্ধকার রুমে আমি স্পষ্ট টের পেলাম অন্য কারো উপস্থিতি এ রুমে বিদ্যমান।আমি সেটা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ঘুমের দেশে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।
সেম স্বপ্ন,কিন্তু স্বপ্নের মাঝে মেয়েটি চিৎকার করে আমাকে বলছে।তোকে আগেই মেরে ফেলতাম,কিন্তু তোর সাথে কে যেন আছে।যে আমাকে বারবার তোকে হত্যা করতে ও পজেস্ট করতে বাঁধা দিচ্ছে।
কথাটা শুনেই আমার ঘুম ভেঙে গেল।আমি বিছানার উপরে বসে পড়লাম।রিতু এখনো বিভোরে ঘুমোচ্ছে।
সে রাতে আর ঘুম হলো না।ফজরের নামাজের অপেক্ষায় বসে থাকলাম।
আমার কোনোকিছুতেই মন বসছিলো না।গার্ডের কথা সত্য হলে দোলনার সাথে আমার জীবন মৃত্যুর সম্পর্ক জড়িয়ে রয়েছে।এর পিছনের রহস্য আমাকে বের করে জানতেই হবে। কিন্তু কিভাবে জানবো?
মাথায় বুদ্ধি আসলো,পার্কের মালিকের সাথে দেখা করলে মন্দ হয় না।
অফিসে দরখাস্ত পাঠালাম আমি অসুস্থ।ছুটি নিলাম যতদিন সুস্থ না হই।এবার অন্তত ভালোভাবে ঘটনার সূত্রপাত বের করা যাবে।
সকাল সকাল পার্কে গেলাম।যথারীতি গার্ড দোলনার আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে।আমাকে দেখে নিজে থেকেই এগিয়ে আসলো।
-স্যার,কোনো সমস্যা?
-আপনি কি জানেন,এই দোলনাটা কোথা থেকে আনা হয়েছিল?
-তা তো জানিনা স্যার,,,আমাকে চাকরি দেয়াই হয়েছে পার্কটা কম্পলিট করার পর!আমি এসে দেখেছি পার্কের এই সাইডে দোলনা।
-কেউ জানে,এই বিষয়ে কিছু?
-স্যার,একটা লোক জানতে পারে।আমাদের বড় স্যারের ম্যানেজার।তিনিই সব কেনাকাটা করেছিল!
-ম্যানেজারের নাম্বার বা বাসার ঠিকানা দিতে পারবেন?
নাম্বার তো নাই, স্যার সপ্তাহে দু একদিন আসে।ওই অফিসে যোগাযোগ করলে পাওয়া যেতে পারে।
আমাকে একটা অফিস রুমে নিয়ে গেল গার্ড।তার পিছু পিছু গিয়ে পার্কের ম্যানেজারের কাছ থেকে পার্কের মালিকের ম্যানেজারের নাম্বার নিলাম।
পার্ক থেকে বের হয়ে কিছুটা পথ চলে এসেছি,গার্ড পিছন থেকে আমাকে ডাক দিয়ে বললো
-স্যার আপনার নাম্বারটা দেন তো।
-আমার নাম্বার কি করবা?
-কিছু জানলে আমাকে জানাবেন!আমি এই বাযে দোলনার কাছে আর থাকতে চাই না।পেটের দায়ে চাকরি করি।নাই কবে এখান থেকে চলে যেতাম!
-কেন চাচা?
-আর বলবেন না,,প্রায় রাতেই দোলনা থেকে একটা হাসির আওয়াজ আসে,আবার মুহুর্তের মধ্যে কান্নার আওয়াজ শোনা যায়।আমি তখন ওই দিকটাতে চলে যাই।আমার ভয় লাগে মাঝে মাঝে।আমি একটা মেয়ে নিয়মিত রাতে এখানে এসে দোলনায় বসে থাকে।প্রথমে মনে করেছিলাম অবৈধভাবে কেউ হয়তোবা ভিতরে প্রবেশ করে।তাকে বারণ করে দিয়ে আসি।কিন্তু মেয়েটা চোখের পলকে উধাও হয়ে যায়।
-আপনি একদিন ও ধরতে পারেন নি তাকে?
-না, বললাম না। চোখের পলক পড়তে যে সময় লাগে তার উধাও হতেও সে সময় লাগে না।
-আমিও একটা মেয়েকে দেখি চাচা!সাদা একটা সালোয়ার পড়া থাকে,চুলগুলো সামনের দিকে দিয়ে সেও হাসে।সে এক ভয়ংকর হাসি চাচা।
-হ্যাঁ, স্যার।সাদা সালোয়ার পড়া থাকে।
-চাচা,আজ আসি।ভুল করে দোলনায় বসার কারণে আমার জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে গেছে।এর সমাধান আমাকে করতেই হবে।
-ঠিক আছে স্যার, সাবধানে থাকবেন।
একটা কথা স্যার,আপনার ভেতরে কোনো ভালো শক্তি আছে মনে হয়,নাইলে এতদিন বেঁচে থাকলেন কিভাবে?
-কি জানি চাচা!
চাচাকে বিদায় দিয়ে একটা নিরিবিলি পুকুরের ধারে গিয়ে বসলাম।উপজেলার পুকুর,অনেক বড়।চারিদিকে বসার জন্য বেঞ্চ সিস্টেম করা।আমি একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম।বসে ম্যানেজার নাম্বারে ফোন দিলাম।কিন্তু ভাগ্য খারাপ থাকলে যা হয় আর কি!
নাম্বার বন্ধ।
অনেক আশা নিয়ে একটা নাম্বার বের করলাম, তাও বন্ধ।তাহলে ম্যানেজারের সাথে দেখা করবো কিভাবে?
বাড়ি থেকে রিতু ফোন দিলো। তার নাকি বাড়িতে আনইজি লাগছে।
আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে যেতে বললো।বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে।
আমি বাড়িতে গিয়ে দেখি রিতু রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।ওর সারা শরীর ঘেমে নেয়ে আছে।আমাকে দেখে দৌঁড়ে এসে বললো,
-রুমের ভেতর কারা যেন হাঁটাচলা করছে।আমি ছাড়া রুমে আরো কেউ আছে।
-কি বলো।
-ঠিকই বলি,তুমি চলো রুমে!
রুমে গিয়ে দুজনের চোখ কপালে উঠে গেল।এ কি অবস্থা রুমের।সারা রুমের অবস্থা শোচনীয়।বিছানা বালিশ সব ফ্লোরে।
-এগুলো কিভাবে হলো রিতু?
-আমি তো ভয়ে বাইরে চলে গেছিলাম। কিভাবে হয়েছে জানিনা।
-কিছু একটা সমস্যা তো হয়েছেই আমাদের সাথে।যা আস্তে আস্তে ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে।
রিতু কিছু না বলে শুধু কান্না করতে থাকলো।
সিদ্ধান্ত নিলাম ওকে ওর বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিবো।কিন্তু সে যাবে না।পতি ভক্ত কোনো নারী স্বামীর বিপদে ঘর থেকে বের হয় না।তার জীবন চলে গেলেও না।সেও আমাকে ছেড়ে গেলো না।
দিন শেষে রাতের আধারে রিতু আমাকে নিয়ে বাইরে বসে থাকলো।সে ভয়ে রুমে যেতে চাচ্ছিলো না।
কেমন যেন একটা গুমোট পরিবেশ।মনে হচ্ছিলো প্রকৃতি একটা শোকে পড়ে গেছে।
রাত ১০টার দিকে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন ঘরের পিছনের বাগানের দিক থেকে একটা শব্দ আসতে লাগলো।হ্যাঁ, ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ।এটা দোলনা দোলার শব্দ।আমি উঠতে গেলে রিতু আমাকে ধরে রাখে, যেতে দিবে না।কিন্তু শব্দের মাত্রা ক্রমেই বাড়তে লাগলো।
যত দোয়া পারতাম, ভালো করে পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে রিতুকে সাথে নিয়েই বাগানের দিকে গেলাম।বাগান থেকে রজনীগন্ধার তীব্র একটা গন্ধ নাকে আসছে।নতুন ফুলের সুবাস সেটা।সাথে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ পরিবেশটাকে আরো ভারী করে তুলেছে।
আরেকটু সামনে যেতেই সেই পরিচিত দৃশ্য।যেটা মাত্র কয়েকদিনে আমার চোখের সামনের দৃশ্য হয়ে গেছে।কিন্তু এবার মেয়েটা দোলনা থেকে উঠে দাঁড়ালো।আমাদের দুজনের দিকে ঘুরে তাকাতেই কোথা থেকে যেন একটা ছায়া এসে মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো।সাথে সাথে ছায়াটা অদৃশ্য হয়ে গেলো।বাতাস থেকে একটা শব্দ আমার কানে ভেসে আসলো,
সেটা হলো।
-আমি থাকতে তোর কিছুই হবে না। আমি তোর পাশেই আছি।
রিতু এসব দেখে সেন্সলেস হয়ে গেল।ফোন করে শাকিলকে ডেকে আনলাম।এত রাতে ওই পারে আমাকে সাহায্য করতে।
সেই রাতটা কোনোমতে পার করলাম।রাতে ঘুম হয়নি।কানে শুধু একটা আওয়াজ বেঁজেছে।সেটা হলো,
-আমি থাকতে তোর কিছুই হবে না।আমি তোর পাশেই আছি।
কে এই অদৃশ্য শব্দের কথক?
একটা স্যালাইন দেয়ার ব্যবস্থা করলাম রিতুর জন্য।তার শরীর যথেষ্ঠ খারাপের দিকে।তাকে স্যালাইন দিয়ে আমি পাশের রুমে গিয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।
হঠাৎ শাকিলের ধাক্কায় আমার ঘুম ভাঙলো।
-কিরে রাশেদ,কার সাথে এভাবে কথা বলছিলি?
-কই,না তো!
-আমি স্পষ্ট শুনেছি, তুই ঘুমের মধ্যে কারো সাথে কথা বলেছিস।
-না, হয়তোবা টেনশন বেশি হচ্ছে তাই।
-আচ্ছা,ফ্রেশ হয়ে নে।তোর ফোনে কে যেন ফোন দিচ্ছে,ধর কথা বল।
ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে অসংখ্য কল এসেছে।ফোন ব্যাক করতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
-স্যার,আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়া আলাইকুম আসসালাম।কে?
-স্যার,আমি পার্কের গার্ড।
-ও কি হয়েছে?
-স্যার,আপনার মতোই ভুল করে একজন দোলনায় ভুল করে বসেছিল।আমি তাকে সাবধান করে দিয়েছি।কিন্তু তবুও আমি আজ তাকে ফলো করে দেখতে চাই সে কি করে।
-আচ্ছা,আমি আসছি।
বাড়িতে কোনোমতে ম্যানেজ করে গার্ডের সাথে দেখা করতে গেলাম।গার্ডকে সাথে নিয়ে অপরিচিত লোকটার বাসার দিকে হাঁটা দিলাম।
-আপনি লোকটাকে চিনলেন কি করে?
-স্যার, আমাদের পার্কে তো সিসিটিভি ক্যামেরা আছে।ওখান থেকে ছবি নিয়েছি একটা।আর লোকটাকে সতর্ক করার সময় ঠিকানা শুনে নিয়েছি।২ ঘন্টার পথ,যেতে রাত হতে পারে।
-কিন্তু, রিতু বাড়িতে একা।আচ্ছা,চলেন।
গার্ডকে সাথে করে নিয়ে চলে গেলাম উক্ত ঠিকানায়।
রাত তখন ৯ টা।একটা লোককে ছবি দেখাতেই ঠিকানা দেখিয়ে দিল।
আমরা সেই বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতেই দুজনে যা দেখলাম,সেটা দেখার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না।
তাদের বাড়ির পাশের আম গাছটাই একটা লাশ ঝুলছে।
-ওহ মাই গড গার্ড চাচা।ইনি সেই লোকটা না?
-হ্যাঁ,,,
গার্ড চাচা চেঁচিয়ে উঠলো।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প