গভীর রাতে ঘুম ভাঙলে কখনো কি আপনার মনে হয়েছে, কারো পায়ে হাঁটার শব্দ পাচ্ছেন ঘরে, অথচ আপনি বাসায় একা?
আমার একবার এমন হয়েছিলো। আমি তখন বেশ ছোট, ক্লাস ফোর কি ফাইভে পড়ি। ২০০৬ কি ২০০৭ সালের ঘটনা। সেদিন আমাদের বাসায় একটা বাজে ঘটনা ঘটেছিলো। আমাদের বিল্ডিংয়ের নিচের তলার এক আপু সুই*সাইড করেছিলেন।
এখন, তার সুই*সাইডের আসল কারণ কেউ বুঝতে পারছিলো না। আপুটা তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। পরদিন পরীক্ষা। উনার বাবা মা উনাকে বাসায় একা রেখে তার ছোটভাইকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছে। উনি বাসায় পড়ছিলেন। বাবা মা যখন ফিরে এসেছেন, তখন বাসার দরজা ভিতর থেকে লক করা। উনারা ডাকাডাকি করেন, দরজা ধাক্কান। দরজা কেউ খোলে না।উনাদের দরজা ধাক্কানোর শব্দে আমাদের পাঁচতলা বাসার সবগুলো মানুষ উনাদের ফ্লোরে চলে গেছেন। এতোক্ষণ দরজা ধাক্কানোর পরও যখন দরজা খোলা হচ্ছে না, তখন নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। সেটা যে কি, তা কেউ বুঝতে পারছে না।
আমাদের বিল্ডিংয়ের পাশাপাশি আরেকটা বিল্ডিং আছে। কার যেন মাথায় এলো, ঐ বিল্ডিংয়ের তিনতলায় গিয়ে আপুদের বাড়ির ভেতরটা দেখা যেতে পারে, আপুদের বাড়িও তো তিনতলায়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ঐ বিল্ডিংয়ের তিনতলায় তিনচারজন চলে গেলেন। কিন্তু কিছু দেখা গেলো না।
ঘরের দরজা জানালা ভালোভাবে আটকানো ভেতর থেকে। বাইরে থেকে কারো দেখার সুযোগ নেই। আপু যে তার নিজের ঘরেই আছে সেটা বোঝা যাচ্ছে, ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতর জ্বলতে থাকা লাইট দেখা যাচ্ছে। ঐ বিল্ডিং থেকেও চিৎকার করে আপুকে ডাকা হলো। কিন্তু তিনি দরজা খুললেন না।
আমাদের বাড়ির একটু দূরেই থানা। এরমধ্যেই কেউ পুলিশকে খবর দিয়ে ফেলেছিলো, পুলিশও চলে এসেছিলেন। পুলিশ দরজা ভাঙলেন। প্রথমে পুলিশের লোকজন আপুর বাবা মাকে নিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকলেন, এরপর আস্তে আস্তে বাড়ির মুরব্বিরা ঢুকলেন। আমরা যারা ছোট ছিলাম, তাদের কাউকে ঢুকতে দেয়া হলো না, আপুর সেই ছোট ভাইটাকেও না। ছোট ভাইটা আমার বয়সী ছিলো।
যারা যারা ভেতর থেকে ফিরে আসছিলেন, তাদের সবার মুখেই আমি ভয় আর আতঙ্কের ছাপ দেখছিলাম। অথচ সবাই বয়সে বড়। ভেতরে কি ভয়ংকর জিনিসই না দেখে এসেছিলেন তারা, ভাবতেই আমার শরীরটা ভয়ে জমে আসছিলো। পুলিশ একটু পরেই সবাইকে বের করে দিয়ে সুরতহাল প্রতিবেদন লেখা শুরু করলো। আমাদের বিল্ডিংয়ের সমস্ত লোক তখন গিয়ে জড়ো হলো উপরতলায় আমাদের ঘরে।
আপুর বাবা মা হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। তাদেরকে সবাই সান্ত্বনা দিচ্ছিলো। এরমধ্যেই একদল এই সুই*সাইডের কারণ উদঘাটনে গোলটেবিল আলোচনা বসিয়ে দিলেন। কেন মেয়েটা এমন করলো, বাসা থেকে কোন প্রেশার দেয়া হচ্ছিলো কিনা, কোন ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিলো কিনা এসব আরকি। এরমধ্যেই মা আমাকে আমার ঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘বাইরে বড়রা কথা বলছে, এরমধ্যে তোমার থাকতে হবে না। কালকে তোমার স্কুল আছে না? এখন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো চুপচাপ।’ বলেই আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে লাইট অফ করে দিয়ে চলে গেলেন।
লাইট অফ করলেও, দরজার পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে ড্রয়িংরুমের আলো ঠিকই ঘরে ঢুকছিলো। আর বাইরে অনেক মানুষের কথা বলার শব্দ তো আছেই। আমার মনে হচ্ছিলো, এর মাঝে আমি ঘুমাতে পারবো না। আজকে আমার সারারাত জেগে থাকতে হবে। জন্মের পর এবারই প্রথম সারারাত আমি জেগে থাকতে পারবো। এর আগে কখনোই আমার সারারাত জাগা হয়নি।
এটা ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমিয়ে গেছি, টের পাইনি।
ঘুমটা কখন ভেঙেছিলো বলতে পারি না। ঘুম ভেঙেই বুঝলাম পুরো ঘর অন্ধকার। বাইরে ড্রয়িংরুমে আলো জ্বলছে না। মানুষজনের বকবক করার শব্দ নেই। আসলে কোনো শব্দই নেই। পুরো পৃথিবী যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। পুরো বাড়িতে আমি যেন একা।
পরে জেনেছিলাম, সে সময়টাতে আপুর লাশ নিচে নামানো হচ্ছিলো। তাই বাড়ির সব মানুষ চলে গিয়েছিলো দেখতে। আমি ঘুমিয়ে গেছি ভেবে আম্মুও আর ঘরে থাকেননি, বাইরে থেকে দরজা আটকিয়ে নিচে চলে গিয়েছিলেন। পুরো বাড়িতে আসলেই আমি একাই ছিলাম। কিন্তু সেটা তো আমি তখন জানি না।
আমি চুপচাপ শুয়ে আছি। বোঝার চেষ্টা করছি কি হয়েছে, সবাই কোথায় গেছে। চারদিক শুনশান। এরমধ্যে আমি পায়ে হাঁটার শব্দ পেলাম।
কে যেন হাঁটছে। হাঁটার শব্দটা আসছে পাশের ঘর থেকে। আব্বু- আম্মুর ঘর। আমি ভাবলাম আব্বু বা আম্মুই হয়তো হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে আমার ঘরের দিকে আসছে। শব্দটা স্পষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে।
আব্বুদের ঘর আর আমাদের ঘরে মাঝে ডাইনিংরুম।শব্দটা ডাইনিংরুম পার হচ্ছে।আম্মু হয়তো দেখতে আসছে আমাকে। আমার তখন ভয় লাগেনি। একবারও মনে হয়নি, সেটা অন্যকিছু হতে পারে।
ডাইনিংরুম পার হলেই আমার ঘর। ঘরের সামনে দরজা।দরজায় পর্দা লাগানো। কাউকে ঘরের ভেতর দেখতে হলে পর্দা ফাঁক করে উঁকি দিতে হবে। পর্দা ফাঁক হলো আস্তে আস্তে। পর্দার ওপাশে অন্ধকার।পুরো বাড়িই অন্ধকার। সেই অন্ধকারে কিছুটা চোখ সয়ে এসেছিলো আমার। দেখতে পারছিলাম একটু একটু।
সেই গভীর অন্ধকারে পর্দা ফাঁক করে যে মুখটা উঁকি দিয়েছিলো, তাকে আমি দেখেছিলাম।
আপনাদের এটা বলতে পারলে আমি খুশি হতাম, যে সেদিন পর্দার ওপাশে আমি সেই আপুকে দেখেছিলাম। আপু ভয়ংকর মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাহলে আমার ঘটনাটার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেত। আমি ধরে নিতাম আপুর কারিন জ্বীন অথবা অন্য কোনো কিছু আপুর রুপ ধরে আমাকে দেখা দিয়েছে। অথবা আপুর ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটার পর আমি হ্যালুসিনেট করেছি।
কিন্তু না, তেমন কিছুই হয়নি। যে মুখটা আমি দেখেছিলাম, সেটা একটা ছেলের মুখ। ঐ ছেলেটাকে আমি চিনি না, কখনো দেখিনি। আজ পর্যন্ত আমি জানতে পারিনি ছেলেটা কে ছিলো। মুখটা ভয়ংকর ছিলো না, শুধু কেমন একটু ফ্যাকাশে, সাদাটে ছিলো মুখটা। আর তার চোখগুলো অদ্ভুত ছিলো। কেমন যেন মরা মানুষের মতো, স্থির, শীতল চোখ।
এরপর আর ছেলেটিকে কখনো দেখিনি। এমন ঘটনা আর আমার সাথে হয়নি কখনো। ছেলেটা কি মানুষ, নাকি অন্যকিছু ছিলো, কেন সে আমাকে দেখা দিয়েছিলো, তার কোনো ব্যাখ্যাও আমি পাইনি।
তবে আপনাদের একটা অদ্ভুত ব্যাপার জানিয়ে রাখি। আমার এই জীবনে আমি তিনজন মানুষের দেখা পেয়েছি, যাদের জীবনেও আমার মতো ঘটনা ঘটেছে। তারাও বাসায় একা ছিলেন। ঠিক আমার মতো তারাও রাতের অন্ধকারে ঘরের ভেতর একটা ছেলেকে দেখতে পান, যাকে তারা চেনেন না। আমার দেখা ছেলেটার মতো ঐ ছেলেটার মুখও ছিলো ফ্যাকাশে, আর চোখ মরা মানুষের মতো শীতল।
যখনি বাসায় একা থাকবেন, সাবধানে থাকবেন। দরজা জানালা ভালো মতো লাগিয়ে রাখবেন। পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই ঘটে, স্বাভাবিক বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা দেয়া চলে না। হয়তো আমাদের মতো অভিজ্ঞতা আপনাদেরও হতে পারে। ঘরে এমন একজনকে দেখতে পাবেন, যাকে আপনারা চেনেন না, দেখেননি কখনো।