আঙ্গুল(পর্ব ১)

রানু গভীর রাতে একা একা বাড়ির পেছনের গোরস্থানে এসে দাঁড়ায়। আজ যদি একটু ভয় পাওয়া যায়, এই আশা নিয়ে সে গোরস্থানে এসেছে। রানু ভুত বিশ্বাস করে না। এতটুকুও না। সে অনেক বার চেষ্টা করেছে ভুত বিশ্বাস করার। ভয় পাওয়ার চেষ্টাও করেছে সে।শহর থেকে দূরে হওয়াতে ওদের বাড়ির চারপাশটা এমনিতেই ভিষণ থমথমে। বাসার পেছনেই বাশ বাগান। রানু গভীর রাতে ছাদের দেয়ালে বসে রেডিওতে ভুতের গল্প শুনেছে। নির্জন রাস্তায় শেষ রাতের দিকে হেটেছে একা একা। ভোর রাতে নদীর পাড়ে ঘুরা হয়েছে। হলিউডের টপ লিস্টেড হরর ফিল্ম গুলো দেখেছে রুম অন্ধকার করে। লাভ হয়নি। ভয় পায় নি সে। বরং হাসি পেয়েছে বার বার। মুখে রঙ মেখে এভাবে ভুত সাজার কোন মানে হয় !
আজও ভয় পেল না রানু। দীর্ঘ সময় নিয়ে গোরস্থানে হেটে বেড়ালো। পুরাতন কবর গুলো খুব কাছ থেকে দেখলো। কোন কোন কবরের ভেতর গর্ত। শেয়াল বাসা করেছে নিশ্চয়ই। ভয় পাওয়ার বদলে রানুর মন খারাপ হয়ে যায়। সবাইকে একদিন মরে যেতে হবে। গোরস্থানে এলে এই সত্যটা মনে পড়ে যায়। রানু মন খারাপ করে বাসায় ফেরে। আজও ভয় পাওয়া হলো না।
রুমে এসে দেখলো সাজ্জাদ আগের মতোই ঘুমাচ্ছে।ওর ক্লান্ত মুখটা দেখে মায়া লাগে রানুর। ঘুমন্ত সাজ্জাদের চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় ও। এই মানুষটাকে সে অনেক বেশি ভালবাসে।
পরদিন নাশতার টেবিলে সাজ্জাদ বলল-“ তুমি নাকি রাত বিরাতে গোরস্তানে যাও। কাল শ্যামল দা, দেখেছে তোমাকে। এসব পাগলামো কেন করছো?”
শ্যামল পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে এ বাড়ির কেয়ারটেকার।বয়স চল্লিশের একটু উপরে হবে।শহর থেকে নতুন অফিসার এলে এই বাংলোতেই ওঠে। বছর দুয়েক থাকতে হয় এখানে। এদের দেখাশোনার কাজটা শ্যামলই করে। সে খুব আগ্রহ নিয়েই করে। মানুষের সাথে দ্রুত মিশে যাওয়ার ক্ষমতা আছে এই লোকটির। আরও একটা গুন আছে তার। সে খুব সুন্দর বাঁশি বাজায়।প্রায়ই গভীর রাতে তার বাঁশির সূর ভেসে আসে।
রানু শ্যামলের দিকে তাকিয়ে বলল-“ এটা কিন্তু ঠিক না শ্যামল দা। আপনি আমার পিছু পিছু গোরস্থানে গেলেন। আমাকে একবার ডাকও দেননি। এখন আবার আপনার স্যারের কাছে আমার নামে নালিশ করে বসে আছেন।” শ্যামল কিছু বলে না। লাজুক ভঙ্গিতে হাসে।যেই হাসির অর্থ সে দুঃখিত।
নাশতা শেষ করে সাজ্জাদ অফিসে চলে যায়। যাওয়ার সময় রানুকে বলল-“ সাবধানে থেকো। এলাকাটা খুবই নিরিবিলি।কোন সমস্যা হলেই আমাকে ফোন দেবে। শ্যামল দা কে ডেকে আনবে।”
রানু হাসিমুখে ওকে বিদায় দিল।সাজ্জাদ বাসা থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই রানুর মন খারাপ হতে শুরু করে। পুরোটা দিন তাকে একা কাটাতে হবে। সময় কাটানোর মতো কোন ব্যাবস্থা নেই। করার মতো কাজ নেই বললেই চলে। তবুও রানু সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ব্যাস্ত থাকার। সে ধুয়া কাপড় চোপড় আবার ধুয়ে দিল। তার পুরো ঘর গোছানোই ছিল। তবু আবার নতুন করে সব ঠিকঠাক করে নিল। ওয়্যারড্রপ থেকে গুছানো কাপড় গুলো বের করে আবার গুছিয়ে ফেললো। কিন্তু রোজ রোজ একই কাজ করতে তার ভাল লাগে না। বিরক্তি নিয়ে কাজগুলো করতে হচ্ছে শুধুমাত্র সময় কাটানোর জন্য।
রান্না করতে ভালো বেশ খানিকটা সময় চলে যায়।ওরা মানুষ মাত্র দুইজন তবু রানু বেশ কয়েক পদ রান্না করল। দুপুরে খেয়ে একটা উপন্যাস হাতে নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল রানু। এই উপন্যাসটাও তার আগে কয়েকবার পড়া। তবু নতুন করে চোখ বুলাতে থাকে ও।
রানু কখন ঘুমিয়ে পরেছে বলতে পারবে না। ওর ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যার ঠিক আগে। ঘুম ভাঙল সাজ্জাদের ফোনে। সাজ্জাদ ফোন দিয়ে বলল-“ শোন, একটা কাজে আটকে গেলাম। এমপি সাহেবের বাসায় যেতে হবে রাতে। আজ ফিরতে পারবো কিনা জানি না। ফিরলেও অনেক রাত হবে। তুমি তো এমনিতেই ভয় পাও না। সমস্যা হওয়ার কথা না। আর ভয় পেলে শ্যামল দার মেয়েকে এনে আজকের রাতটা তোমার সাথে রেখে দাও।” রানুর বলতে ইচ্ছা করলো-, ‘আমি ভয় পাই না সত্যি কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমার রাতে ঘুম আসবে না।’ লজ্জায় রানু একথা বলতে পারলো না। ফ্রেশ হয়ে এক কাপ চা নিয়ে বসলো বারান্দায়।ও যখন দুপুরে বই পড়ছিল তখন আকাশ পরিস্কার ছিল।অথচ এখন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। সেই সাথে ঠান্ডা বাতাস।সন্ধ্যে বেলাতেই কেমন যেন মধ্য রাতের মত অন্ধকার চারদিকে। রানু বারান্দায় বসে আরাম করে ধোঁয়া ওঠা চা খাচ্ছে এমন সময় দেখলো হাতে একটা বড় চার্জার লাইট নিয়ে শ্যামল দা আসছে। তার গায়ে কালো একটা চাদর। শ্যামলের চুল বড় বড়। সে পেছনে চুলের ঝুটি বেধে রাখে।সেই সাথে গাল ভর্তি ঘন দাড়ির কারণে তার চেহারায় একটা ঋষি ঋষি ভাব চলে এসেছে।
কাছে এসে শ্যামল বলল-“ দিদি, আসমানের অবস্থা আইজ সুবিধার না। তুফান হইতে পারে।” তার কথা যে সত্য এটা প্রমাণ করার জন্যই বুঝি সাথে সাথেই বিদ্যুৎ চমকে ওঠে। মেঘের ডাকে কেপে উঠলো চারদিক। ফ্ল্যাশ লাইটের মতো আলোতে চারদিক আলো ঝলমলে হয়ে উঠে মুহূর্তেই আবার ঢেকে গেল কালো অন্ধকারে।
রানু বলল-“ হ্যা, ঝড় আসবে মনে হচ্ছে।আপনি এই বৃষ্টির মধ্যে এখন আসলেন কেন? সাজ্জাদ আপনাকে ফোন দিয়েছে?”
-“ নাহ স্যার ফোন করে নাই। নিজে থেইক্যাই আসলাম। তুফান হইলে এই এলাকায় কারেন্ট চইল্যা যায়। এই লাইটটা নিয়া আসলাম আপনার জন্য। একা একা আছেন আপনি।”
-“ ওহ লাইট লাগবে না। আমার কাছে ভালো মোম আছে। তবু লাইট আনার জন্য আপনাকে থ্যাংক শ্যামল দা।”
লাইট সাথে নিয়েই শ্যামল দ্রুত গতিতে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলো। সে যত দ্রুত সম্ভব বাসায় ফিরতে চায়। আকাশের অবস্থা আসলেই ভালো না। বৃষ্টির বেগ একটু একটু করে বেড়েই চলেছে। রানু শ্যামলের চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে রইলো। একবার ও এটা ভাবল না, সে যে বাসায় আজ একা এটা শ্যামলের জানার কথা না। সে কীভাবে জানলো এবং নিজে থেকেই চার্জার লাইট নিয়ে এলো!
রাতের খাবার খেয়ে রানু খাতা কলম নিয়ে বসলো।কিছু একটা লিখতে ইচ্ছে করছে। তখনো বৃষ্টি হচ্ছে ।অবস্থা যা দাড়িয়েছে এই বৃষ্টি আজ রাতে থামবে বলে মনে হচ্ছে না।বৃষ্টির বেগ আরও বাড়লো। সাথে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে। আকাশ যেন চিৎকার করে কান্না করছে। বাতাসের গতি বাড়তেই লোডশেডিং হয়ে গেল। চারদিক নিকষ কালো অন্ধকার। আকাশের বিজলি চমকানোর আলো ছাড়া আর কোন আলো নেই। রানু কিছুক্ষণ অন্ধকারেই বসে রইলো। তারপর মোম জ্বেলে আবার লিখতে বসলো।রানু বুঝতে পারছে না কী লিখবে এমন সময় হঠাৎ করে বাইরে কিসের যেন শব্দ হলো। রানু তেমন গুরুত্ব দিলো না। হয়তো ঝড়ে গাছের কোন ডাল ভেঙে পরেছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার শব্দটা শুনতে পেল ও। শব্দটা আসছে বারান্দা থেকে।মনে হলো কেউ মেঝেতে জুতা ঘসে পরিস্কার করছে।রানু এবার কান খাড়া করে শব্দটা শোনার চেষ্টা করে। এবারে শব্দটা অন্যরকম মনে হল। রানু ভুত বিশ্বাস করে না,ভয়ও পায় না। কিন্তু ওর মনে অন্য একটা ভয় ঢুকে গেল। সে বাসায় আজ একা। এই খবর পেয়ে কোন চোর-ডাকাত আসে নি তো! রানু আগেই দরজার কাছে গেল না। সাজ্জাদের নাম্বারে ফোন দিল। নাম্বার বন্ধ ওর।এরপর রানু শ্যামলকে ফোন করল। কয়েক বার রিং হলেও কেউ ফোন ধরল না। শ্যামল কাজের মানুষ। সারাদিন খাটাখাটনি করে এখন ঘুমাচ্ছে। এই ঝড় বৃষ্টির রাতে ফোন ধরবে না এটাই স্বাভাবিক।
রানু মোম হাতে উঠে আসে। দরজার খুলে বাইরে যেতে সাহস পায় না।গলা উচু করে বলে-“ কে? কে বাইরে শব্দ করছে? কে?” কেউ জবাব দেয় না। কিন্তু অসস্তিকর সেই শব্দটা এখনো আছে। রানু বোঝার শব্দ করে কিসের শব্দ হতে পারে এটা। কেউ কিছু খাচ্ছে? নাকি কেউ ইনিয়ে বিনিয়ে কান্না করছে ?রানু বুঝতে পারে না। দরজার ওপাশে কেউ আছে এটা বুঝতে পারে। ও আরও কয়েকবার ডাকলো। কেউ সাড়া দিলো না। অথচ বাইরের শব্দ শুনে কারও অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে সহজেই।
রানু মনে ভয় নিয়েই দরজার ছিটকিনিতে হাত দিল।দরজা পুরোপুরি খুলল না। একটুখানি ফাঁক করে বাইরে উকি দিল। মোমের আলোয় কেমন যেন ভুতুরে দেখাচ্ছে চারদিক। বাইরে কেউ নেই। রানু সাহস পেল মনে।পুরো বারান্দাটা একবার সে দেখে নেবে তারপর ঘরে ফিরে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে যাবে। ভয়ের কিছু নেই। রানু দরজা খুলে বারান্দায় চলে এল। ওর হাতের মোমের আগুনটা দ্রুত উঠা নামা করছে। বাইরে বাতাস আছে। যে কোন সময় মোম নিভে যাবে। বারান্দায় এসেই চমকে গেল ও। বারান্দার শেষ মাথায় কে যেন গুটিসুটি মেরে বসে আছে।লোকটি দুই হাত কোলের মধ্যে রেখে বারান্দাকে পেছন করে বসে আছে।রানু লোকটার পেছন দিক দেখতে পাচ্ছে। তার অবয়বটি স্পষ্ট নয়।রানুর বা হাতে একটা মোম এখনো জ্বলছে। মোমের আলোয় এত দূরের মানুষকে দেখা সম্ভব না। রানুর হাত পা কাপছিল। কথা বলতে গিয়ে দেখল গলায় কথা আটকে যাচ্ছে। তবুও কাপা কাপা গলায় বলল-“ কে ওখানে? কে?” কোন জবাব পাওয়া গেল না। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকালো। সেই আলোতে রানু দেখলো লোকটার গায়ে কালো চাদর জড়ানো। পেছনে চুল ঝুটি করে বাধা। রানু অবাক হল।এতো শ্যামল দা।কিন্তু সে এত রাতে এখানে বসে কী করছে। রানু আরও একটু এগিয়ে গেল। একটু দূরে দাড়িয়ে বলল-
“শ্যামল দা? কথা বলছেন না কেন?”
শ্যামল জবাব দিল না। সে মাথা নিচু করে কিছু একটা করছে। রানু আরও একটু কাছে এগিয়ে যায়। এবারে কিছুটা রাগের কন্ঠে বলল-“ শ্যামল দা, আপনি কথা বলছেন না কেন?উল্টোদিকে মুখ করে বসে আছেন কেন? আমার দিকে তাকান। এখানে কী করছেন আপনি?
এবারে শ্যামল জবাব দিল। জড়ানো গলায় বলল-“ আমি খাইতাছি দিদি মনি।”
শ্যামলের কন্ঠ শুনে রানু হঠাৎ ভয় পাওয়া শুরু করলো। কারণ কন্ঠটা শ্যামলের ছিল না।কেমন যেন নির্জীব একটা গলার স্বর। রানু শ্যামলকে ভালো করেই চেনে। এই কন্ঠ শ্যামলের হতে পারে না। এমন সময় আচমকা বাতাসের দমকায় রানুর হাতের মোমটা নিভে যায়। ওর ভয়টা আরও তীব্র হয়ে গেল।রানুর শরীর জমে গেল ভয়ে। যতটা সম্ভব ভয়টাকে আড়াল করার চেষ্টা করে রানু বলল-“ কী খাচ্ছেন আপনি?”
শ্যামল ওর দিকে ঘুরে তাকালো।শ্যামলের চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকমের লাল। সেই চোখের দিকে লক্ষ্য করার সময় পেল না রানু।বিজলির আলোতে রানু শ্যামলের রক্তাক্ত মুখটা দেখলো। ঠোঁট দিয়ে তাজা রক্তের ফোটা গড়িয়ে পরছে। রানু ভয়ে দু কদম পিছিয়ে গেল। ওর মনে হল ও মাথা ঘুরে পরে যাবে। রানু যথেষ্ট সা্হস এনে আবারও বলল-“ রক্ত কেন? কী খাচ্ছেন আপনি?”
শ্যামল সেই নির্জীব কন্ঠে বলল-“ আঙুল খাই গো দিদি মনি। আমার বড় খিদা….. ”
শ্যামল হাত উচু করে দেখালো। রানু অবাক হয়ে দেখলো সে ওর নিজের আঙুলগুলোই খাচ্ছে।ওর রক্ত মাখা হাতের দুটো আঙুল অর্ধেক নেই। সেখান থেকে গলগল করে রক্ত ঝরছে। শ্যামলের মুখে বিভৎস একটা হাসি ঝুলে আছে।….

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প