আমার মামাতো বোন যেদিন কান্নাভেজা কণ্ঠে বাড়ির সবার সামনে বলেছিলো,আমি নাকি তাঁর বুকে হাত দিতে চেয়েছিলাম,তাঁর গায়ে হাত দিয়েছি,তাঁর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে নষ্ট করতে চেয়েছিলাম সেদিন আমার মামা আমাকে নানু বাড়ির সবার সামনেই কষে একটা থাপ্পড় মেরে তাদের বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। আমি সেদিন খুব নিরুপায় হয়ে সবার দিকে নিরীহ চোখে তাকিয়েছিলাম। সেদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার এই বাড়িতে থাকাটা কারো কখনো পছন্দ ছিলো না,সবাই আমার প্রতি অনেক বিরক্ত ছিলো। করুণা করে এতোটা দিন তারা আমাকে থাকতে দিয়েছিলেন। আমি সবার কাছে বোঝা হয়েছিলাম এতোদিন। তাই তারা আমার চলে যাওয়াতে দুঃখী না বরং সুখী।
আমার যখন বারো বছর বয়স তখন আমার মা কঠিন এক রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমার মা অসুস্থ থাকা অবস্থায় আমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। মাও বাবার বিয়েতে কিছু বলেননি কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর আর বেশি দিন এই সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকা হবে না। মা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন বাবার কাছে আমি সুখী থাকবো না তাই মৃত্যুর আগে মামাদের কাছে আমাকে রেখে গিয়েছিলেন,সেখান থেকেই আমার মামার বাড়িতে থাকা শুরু। মামার বাড়িতে থেকেই আমি ইন্টার পাশ করে অনার্সে পড়ছি। আমার কয়েকটা মামাতো বোন ছিলো তাঁর মধ্যে একজন ছিলো আনিতা। যে মেয়েটার সাথে প্রথম থেকেই আমার জমতো না। শহরের মেয়েরা যেমন সে তাদের থেকে একটু বেশিই স্মার্ট তাই হয়তো আমার মতো সহজ সরল অানস্মার্ট মানুষকে সবসময় এড়িয়ে চলতো। আমি বুঝতে পারতাম আমার তাদের বাড়িতে থাকাটা তাঁর পছন্দ নয়। কিন্তু তাঁর বাবা চায় আমি যেনো তাদের বাসায় থেকেই মানুষের মতো মানুষ হই তাই সে এটা নিয়ে কিছু বলতে পারে না। কারণ মৃত্যুসম্ভাবনা আমার মাকে তাঁর বাবা কথা দিয়েছিলেন আমাকে তিনি তাঁর কাছে রাখবেন।
কিন্তু আজ সেই কথাটা তিনি রাখার প্রয়োজন মনে করছেন না। কারণ আমি যে তাঁর মেয়ের ইজ্জত নিতে চেয়েছিলাম। আর পৃৃথিবীর কোনো বাবা চাইবেন না তাঁর ঘরে কোনো ধর্ষক থাকুক। তাই আমি আমার মামাকে কোনো দোষ দেই না। কারণ তাঁর জায়গা আমি থাকলেও হয়তো এমনই করতাম। তবে মানুষ যে নিজের প্রয়োজনে পৃৃথিবীর সবচাইতে জঘন্যতম কাজটাও করতেও একবারও ভেবে দেখবে না সেটা আজ খুব করেই বুঝতে পারছি। আর সেটা যদি অপছন্দের মানুষ হয় তাহলে তো কোনো কথায় নেই।
আমার মামাতো বোন আনিতাকে যখন একটা ছেলের সাথে দিনের বেলায় আবাসিক হোটেল থেকে বের হতে দেখলাম তখন আমি তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করি ছেলেটা কে? যদিও বুঝতে পেরেছিলাম ছেলেটা তাঁর বয়ফ্রেন্ড তবুও জিগ্যেস করার পর সে বলল জাস্ট ফ্রেন্ড। তারপর ছেলেটা চলে গেলো। আমি যখন তাকে বললাম কাজটা তুমি ঠিক করোনি। প্রেম করছো ভালো কথা তাই বলে কি নিজের বয়ফ্রেন্ডের অন্যায় নোংরা চাহিদা গুলোও পূরণ করতে হবে? এটা ভালোবাসা নয়। আমি মামার কাছে সব বলে দিবো। তারপরেই আমি বাসায় চলে আসি। বাসায় এসে দেখি কেউ নেই। আনিতা আমার রুমে এসে আমাকে বুঝাতে শুরু করলো,আমি যা দেখেছি তা যেনো কাউকে না বলি কিন্তু আমি তাঁর কথায় কোনো গুরুত্ব দিলাম না। আর সেটার ফল সবাই বাসায় আসার পরেই পেলাম। আমি কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি একটা মেয়ের মনে এমন কিছু থাকতে পারে। আমার কথাটা এখন কেউ বিশ্বাস করবে না। আর আমি কাউকে বলতেও চাই না। যারা আমাকে বিশ্বাস করে না,ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে তাদের ভালো মন্দ সম্পর্কে ভাববার কোনো প্রয়োজন মনে করলাম না।
দশ বছর পর আমি আমার বাবার কাছে ফিরে যাই। আমাকে দেখে কেনো জানি আমার বাবা মা খুব একটা খুশি হতে পারেননি। তবে আমার বোনটা অনেক খুশি হয়েছিলো যখন সে জানতে পেরেছিলো তাঁর ভাই এসেছে। যদিও সৎ ভাই আমি। তবে সে সেটা বোঝে না। শহরে একজন মানুষকে আমি কোনো কিছু না বলেই চলে এসেছি। তাঁর কথা খুব মনে পড়ছে। মেয়েটার নাম মেঘলা। শহরে পড়ালেখা করলেও সেও আমার মতোই খুব সহজ সরল। মেয়েটাকে জানানো উচিত ছিলো কিন্তু আমি পারিনি।
দুইদিন পর বাবা হঠাৎ করে ডেকে নিয়ে বললেন,
“তোর মা চাচ্ছে না তুই এখানে থাক। তোর মা যেনো কার কাছ থেকে সব শুনেছে। তোকে কি জন্য তোর মামারা মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে সেটা সে জানে। তাঁর কথা তাঁরও একটা মেয়ে আছে। এখন অনেক ছোট। তুইতো ওর আপন ভাই না। তাই তোকে নিয়ে ভয় হচ্ছে। ধর্ষকদের তো কোনো মা বোন নেই। তুই বরং অন্য কোথাও চলে যা আমি তোকে সব খরচ দিবো।”
সেদিন আমি পৃৃথিবীর প্রথম কোনো সন্তান হিসেবে নিজের বাবার গালে থাপ্পড় মেরেছিলাম। হ্যাঁ আমি আমার বাবার গালে থাপ্পড় মেরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম,
” তুই আমাকে ধর্ষক বলছিস? আমার কথা না ভেবে তুই নিজের কথা ভাব। তুইতো সেক্স পাগল একজন মানুষ। আমার মা মারা যাওয়ার আগেই আরেকটা বিয়ে করেছিলি। তোকে আমার বাবা বলে কোনোদিন পরিচয় দিতে ইচ্ছে করেনি। আজ তুই আমার মন থেকে উঠে গেছিস। একজন বাবা কখনো তাঁর ছেলেকে এভাবে ধর্ষক বলতে পারে না। আর একজন সন্তানও কখনো তাঁর বাবার গায়ে হাত তুলতে পারে না। কাজেই আজ থেকে আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই। তুই আমার বাবা না। মা মারা যাওয়ার পর এই পৃথিবীতে আমার কখনো কেউ ছিলো না,আজও নেই। সবাই শুধু আমাকে করুণা দেখিয়েছে।”
সেই রাতে বাবা লজ্জায় আমার রুম থেকে চলে যায়। পরের দিন আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করে বাড়ি থেকে চিরদিনের জন্য বের করে দেয়। আমিও থাকার জন্য জোর করিনি। কারণ আমি জানতাম এমন কিছু হবে। তাই রাতে কিছু টাকা চুরি করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলাম। আমার সৎ মায়ের যতো গয়নাগাটি ছিলো সবকিছু আমার ব্যাগের ভিতরে রেখে দিয়েছিলাম রাতেই। কারণ এগুলো এক সময় আমার মায়ের ছিলো। এগুলোর দাবিদার আমি। আমার মাকে যারা মুত্যুর কয়েকদিন আগেও সুখে থাকতে দেয়নি আমি তাদের কাছে আমার মায়ের কোনো কিছু রেখে যেতে পারি না।
আমি আমার বাবার বাড়ি থেকে চলে আসি। আমি বুঝতে পারি এতো বড় দুনিয়াতে এতো এতো মানুষ থাকলেও আমার কোনো আপন মানুষ নেই। এতো বড় দুনিয়াতে আমার থাকার কোনো জায়গা নেই। একজন মানুষ আছে যাকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি,হয়তো বা ভালোও বাসি। সেও আমাকে ভালোবাসে। এখন সেই মেয়েটার জন্যই বেঁচে আছি। না হলে অনেক আগেই অবহেলার এই সস্তা জীবনটা শেষ করে দিয়ে না ফেরার দেশে চলে যেতাম।
সাতদিন পরে হঠাৎ করেই মেঘলা ফোন করে দেখা করতে বলে। আমি যখন তাকে বললাম এই কয়েকটা দিন কি একবারও ফোন করার প্রয়োজন মনে করোনি?
তখন সে বলল,দেখা করার পর সব বলবে। আমিও কিছু না বলে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য চলে গেলাম।
কি হয়েছে যে এভাবে দেখা করতে বললে? বিপরীত পাশের মানুষের অবস্থাটাও তো দেখবে।
– বাসা থেকে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। কিন্তু আমি এই বিয়েটা করতে চাই না। কেনো করতে চাই না সেটা তুমি জানো।
– আমার কথা শুনো। তারপর না হয় সিদ্ধান্ত নিও কি করবে।
– আমি তোমার কোনো কথা শোনার জন্য এখানে আসিনি। তুমি কি করবে না করবে সেটা তোমার ব্যাপার। দশদিন পর আমার বিয়ে। তুমি আমাকে নিয়ে পালাবে নাকি নিজের প্রেমিকাকে অন্য কারো হাতে তুলে দিবে ভেব দেখো। আমি কবুল বলার আগ পর্যন্ত তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। কিন্তু কবুল বলার পর আমি তোমাকে ঘৃণা করা শুরু করবো। এতোটাই যে এর আগে কেউ কখনো কাউকে এতোটা ঘৃণা করেনি।
– আমার অবস্থাটা তো তুমি বুঝবে। আমার কথাটা শুনবে।
আমার কোনো কথা না শুনেই মেঘলা চলে যায়। আমাার নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃণা হতে লাগলো। কেমন মানুষ আমি যে আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে বুঝতে পারলো না। এতো কষ্ট,অশান্তি নিয়ে কখনো বেঁচে থাকা যায় না। আমার একটু শান্তি দরকার। কোথায় পাবো? মৃত্যুই কি মানুষের একমাত্র শান্তির পথ?