মেঘলা নিশ্চিত মনে চলে যায়,একবারও পিছু ফিরে তাকায় না আমার দিকে। আমি অনেক দূর পর্যন্ত তাঁর উপস্থিতি অনুভব করি। একসময় সে অদৃশ্য হয়ে যায়। মেসে এসে অন্ধকার রুমে শুয়ে শুয়ে ভাবতি থাকি মেঘলার কথা কিন্তু আমি কোনো সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারি না। আমি যদি তাকে আমার কাছে নিয়ে আসি তাহলে তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনটা কি হবে? তাকে কি সুখ দিতে পারবো আমি? অনার্সে পড়ুয়া একটা বেকার যুবককে কেউ কি এতো সহজেই চাকরি দিবে? যাকে মন থেকে ভালোবাসা যায় তাঁর সুখ চাওয়াটাই নাকি প্রকৃত ভালোবাসা। আবেগে পড়ে তো মেয়েরা অনেক কিছুই বলে,অনেক কিছুই করতে চায়। মেঘলারও তো এখন আবেগের সময়। কেবল মাত্র সতেরো বছর,ইন্টারে পড়ে। এই সময়টাতে মেয়েদের মনে অনেক আবেগ কাজ করে। তাঁর মধ্যেও হয়তো করছে তাই সে এমন বলছে। কিন্তু আমি তো সব বুঝি। বাস্তবতা কি আমি জানি। দুবেলা খাবারের জন্য কতো কি করতে হয়। বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়। আমি তো সবকিছু বুঝে মেঘলার মতো করতে পারি না। তাঁর আবেগকে কাজে লাগিয়ে তাঁর ভবিষ্যতটা নষ্ট করতে পারি না,যেখানে নিজের ভবিষ্যৎটাই অন্ধকার।
যেখানে নিজের থাকার কোনো জায়গা নাই,সেখানে অন্য একজনকে বিয়ে করে সুখী হওয়ার স্বপ্ন দেখাটা হয়তো বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়। মায়ের গয়নাগাটি বিক্রি করলে আর কতোই বা পাওয়া যাবে? এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে দশটা দিন পাড় হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না। আজ মেঘলার বিয়ে, সে নিশ্চয় খুব সুন্দর করে সেজেছে। সাজবেই তো। বিয়ের দিন মেয়েরা সাজবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে আজ অন্য কারো জন্য সাজবে। আমি তাঁর কথা রাখলাম না। তাঁর কাছে সারাজীবন ঘৃণার পাত্র হয়েই বেঁচে থাকবো আমি। তবুও আমার ভালোবাসার মানুষটা সুখী হোক। আমার কষ্টের জীবনের সাথে আর কাউকে জড়াতে চাই না। হয়তো সে কিছুদিন আমাকে ঘৃণা করবে কিন্তু একসময় আমাকে ভুলে যাবে। স্বামীর ভালোবাসা পেলে এমনিতেই আমাকে মনে রাখবে না। এরকম অনেক শুনেছি খুব গভীর প্রেম ছিলো একসময় সেই প্রেমটা আর থাকে না। সময়ের সাথে ভালোবাসার মানুষটাও বদলে যায়। পরিস্থিতি বাঁধ্য করে বদলে যেতে।
মেঘলার বিয়ে হয়ে যায়। আমি সেদিন কেনো জানি তাঁর কাছে যাওয়ার সাহস পাইনি। আমার মনে হয়েছিলো তাঁর ভবিষ্যৎ সুখের জীবন নষ্ট করার কোনো অধিকার আমার নেই। কারণ আমি জানতাম একসময় সে আমাকে ভুলে গিয়ে তাঁর হাসবেন্ডকে নিয়ে সুখী হবে । মেঘলার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে আমার ওপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গিয়েছে। কোনোদিন খেয়েছি আবার কোনোদিন খাইনি। নিজের পড়ালেখাটা চালানোর জন্য অনেক কিছু করেছি জীবনে। সেগুলো বলে কারো চোখের জল ফেলাতে চাই না। আমি সবসময় ভাবতাম যাদের কেউ নেই তারা কিভাবে বেঁচে থাকে? কিন্তু আমিই যখন কাউকে ছাড়া বেঁচে থাকা শুরু করলাম তখন বুঝলাম বেঁচে থাকার জন্য কাউকে দরকার হয় না। দরকার হয় টাকার। দরকার হয় বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার।
আমার মনে আছে,একসময় আমি বেঁচে থাকতে ভয় পেতাম। যখন আমার মায়ের গয়না বিক্রি করা টাকা ফুরিয়ে গেলো তখন আমার থাকা খাওয়া নিয়ে মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেলো। আমার কাছে যা ছিলো সব তো শেষ,এখন আমি কি করবো। কে আমাকে খাবার দিবে,কে আমাকে থাকতে দিবে। এসব নিয়ে ভাবতে খুব ভয় হতো। নিজেকে খুব অসহায় মনে হতো। তখন একদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় দেখলাম একটা ছেলে চা বিক্রি করছে। ছেলেটার বয়স খুব বেশি হলেও সাত কিংবা আট বছর হবে। আমি সেদিন ছেলেটার দিকে তাকাতেই চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়তে লাগলো। যেই বয়সে ছেলেটার স্কুলে পড়ার কথা ছিলো, বাবা মায়ের আদর ভালোবাসা পাওয়ার কথা ছিলো। সেই বয়সে ছেলেটা ফুটপাতে চা বিক্রি করছে শুধুমাত্র নিজের জীবিকা নির্বাহের জন্য। কিংবা কে জানে এই সাত বছরের মানুষটাই হয়তো কারো না কারো ভরণপোষণের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। হায়রে জীবন! এমন জীবনের প্রতি কেনো জানি আমার ঘৃণা হতে লাগলো। তবে ছেলেটাকে দেখে মনের মধ্যে কিছুটা হলেও সাহস হলো। আমার বারবার তখন একটা কথায় শুধু মনে হলো। সাত বছররের ছেলেটা যদি বেঁচে থাকার জন্য জীবন যুদ্ধে নেমে পড়তে পারে,বেঁচে থাকার জন্য ভয় না পায় তাহলে আমি কেনো ভয় পাচ্ছি।
সেদিন থেকেই আমার জীবনে নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়। আমি দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য অনেক লজ্জাজনক কাজও করেছি যেটা কাউকে বলার নয়। এভাবেই মেঘলার বিয়ের পর আমার জীবনের একটা বছর কেটে যায়। এই এক বছরে তাঁর সাথে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি। সেও কোনোদিন ফোন দেয়নি আমিও তাকে ফোন দেওয়ার সাহস পাইনি। তবে আজ একবছর পরেও আমার সিদ্ধান্তটাকেই বেস্ট মনে হচ্ছে। আমি এখনো আগের মতোই আছি। নিজের জীবন যাপনের কোনো গতি করতে পারিনি। মেঘলা আমার সাথে থাকলে তাকেও এসব সহ্য করতে হতো। কিন্তু এখন সে হয়তো অনেক ভালো আছে। নাটক সিনেমায় যতো সহজে নিজের অভাব অনটন এর জীবনকে পরিবর্তন করে সুখময় করা যায় বাস্তবে ততোটা সহজ না। বাস্তব বড় কঠিন। নাটক সিনেমায় কষ্টের জীবন ক্ষণস্থায়ী কিন্তু বাস্তবে কষ্টের জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়।
আমার অনার্স শেষ হয়ে গেলেও আমি কোনো চাকরির ব্যবস্থা করতে পারি না। একটা চাকরির জন্য কতো কিই না করেছি কতো জায়গায় ঘুরেছি। কিন্তু সবশেষে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কেউ টাকা চেয়েছে,কেউ দিতে চেয়েও পরে আর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। লোক ছাড়া ছাড়া চাকরি হয় না। আমার তেমন কেউ ছিলোও না যে চাকরি দিবে। অনেক জায়গায় ভাইবা দিয়েছি কিন্তু রেজাল্ট খারাপ থাকার কারণে ভাইবা অনেক ভালো দেওয়ার পরেও চাকরি হয়নি। একসময় মনে হলো আমার জীবনটা এমনই থাকবে,কোনো পরিবর্তন হবে না। কতো চেষ্টা করলাম নিজের ভাগ্যটা বদলানোর জন্য কিন্তু পারলাম না। হয়তো সৃষ্টিকর্তা চাননা আমার ভাগ্যটা পরিবর্তন হোক। সবশেষে যখন হাল ছেড়ে দিলাম। যেভাবে চলছে চলুক না। এই দুই টাকার সস্তা জীবন নিয়ে আর চিন্তা করবো না। যার জীবনের কোনো মূল্য নেই,যে মারা গেলে চোখের জল ফেলার কেউ নেই। সেই জীবনটা বাঁচলেই কি আর না বাঁচলেই কি।
তিনবছর পর,
ঢাকা শহরে খুব সাধারণ ভাবে বেঁচে থাকার মতো একটা চাকরি পেয়েছি। দিনশেষে রাতে মাথার নিচে কিছুটা হলেও জায়গা হয়েছে। মাস শেষে পনেরো হাজার টাকা বেতন পাই। এটা দিয়েই চলে যায় আমার। এখন আর বেঁচে থাকার জন্য ভয় হয় না,বরং চো মনে হয় মৃত্যুই ভালো। এই পৃথিবীটা থাকার জায়গা না,এখানে যতো কম থাকা যায় ততোই ভালো।
আনিতা তাঁর ভুলের জন্য নিজেকে অনেক বড় অপরাধী ভাবে,সে এখন অনুতপ্ত। মামারাও আমার কাছে ফোন করে ক্ষমা চায়। তাদের কাছে যেতে বলে। সেদিন তারা না জেনে আমার প্রতি অনেক অন্যায় করেছিলো। আমার কোনে দোষ ছিলো না। বাবা মাও এখন ফোন দেয়। তারাও চায় তাদের ছেলেটা যেনো আবার ফিরে আসে। নিজের বাপ দাদার ভিটেমাটি দেখাশোনা করে। আমি হয়তো চাইলে তাদের কাছে ফিরে যেতে পারবো কিন্তু তাদের প্রতি আমার মনে যে একটা ক্ষত সৃষ্টি হয়েছি সেটা কোনোদিন ভালো হবে না। তাদের প্রতি যে শ্রদ্ধাটা ছিলো সেটা এখন নেই। আমি চাইলেও তাদেরকে আর কখনো ভালোবাসতে পারবো না,আপন ভাবতে পারবো না। কারণ তারা যদি আমাকে সাপোর্ট করতো তাহলে আজ আমি এই অবস্থায় থাকতাম না। কিন্তু তারা করেনি। আমার খারাপ সময়ে আমাকে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিয়েছিলো। আজও হয়তো আমি ভালো নেই কিন্তু বেঁচে তো আছি? এটাই বা কম কিসে?
এই পৃৃথিবীর সবাই তো বেঁচে থাকে। কজনই বা সুখে থাকতে পারে,ভালো থাকতে পারে? আমি না হয় খারাপই থাকলাম।
মেঘলা সেদিন ফোন দিয়েছিল। আমার সাথে কথা বলার সময় অনেক কাঁদলো। তবে সে সুখে আছে সেটা জেনে খুব ভালো লাগলো। আমার এভাবে বেঁচে থাকাটা সে মেনে নিতে পারেনি। আমি যেমন তাকে সুখে দেখতে চেয়েছি সেও চায় আমি যেনো সুখে থাকি। তাই সে চায় আমি যেনো বিয়ে করে নিজের জীবনে নতুন কাউকে নিয়ে নতুন ভাবে শুরু করি। কিন্তু মেঘলা হয়তো একটা চিরন্তন সত্য জানে না। পৃৃথিবীর কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের কপালে কখনো সুখ লেখা থাকে না। শত চেষ্টার পরেও তারা সুখের দেখা পায় না। হয়তো বা ক্ষণিকের জন্য একটু ভালো থাকতে পারে তবে সুখ তাদের জীবনে কখনো আসে না। আমার জীবনেও আসবে না আমি জানি। তাই আর সুখ নামক মরীচিকার পেছনে কখনো দৌড়াইনি কিংবা ভালো থাকার চেষ্টা করিনি।
উদ্যেশ্যহীন ভাবে যাযাবরের মতো ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখলাম একটা বাচ্চা মেয়ে ফুল বিক্রি করছে। মেয়েটাকে দেখে প্রচন্ড মায়া লাগলো। মনে হলো আমার থেকেও অসহায় মানুষ পৃথিবীতে আছে।
আমার মনে হলো আমি চাইলে কিছুটা সময়ের জন্য ভালো থাকতে পারি,শান্তি খুঁজে নিতে পারি। এই ফুল বিক্রি করা ফুলের মতো নিষ্পাপ বাচ্চাটার সাথে কিছুটা সময় কাঁটানো যায়।
ফুল কতো করে বিক্রী করোস?
-দশ টাকা।
-সবগুলোর দাম কতো নিবি?
-অনেক।
-অনেক কতো?
মেয়েটা কথা বলে না। বুঝলাম সে আমার কথা কোনো কিছু বুঝতে পারছে না। পকেট থেকে পাঁচশত টাকার একটা নোট বের করে দিয়ে বললাম,
“তোর সবগুলো ফুল আমি কিনলাম। এখন সবচেয়ে দামি ফুলটার সাথে আমি গল্প করবো। আমার কাছে তুই হচ্ছিস সেই দামি ফুল।”
মেয়েটার সাথে গল্প করতে করতে একসময় কল্পনার জগতে চলে যাই।
ওইতো মেঘলা আসছে আমার দিকে। তাঁর সাথে তাঁর স্বামীও আসছে,মেঘলার কোলে ফুটফুটে একটা বাচ্চা। খুব সুন্দর লাগছে তাদের। আমি জানি এটা আমার কল্পনা। তবুও ভালো লাগছে সে আমার দিকে আসছে,আমার সাথে কথা বলবে। হোক না কল্পনায় তবুও তো অনেকদিন পর নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে খুব কাছ থেকে দেখতে পারবো।