আয়না পর্ব:০৪(শেষ পর্ব)

আমি শুভর কথা শুনে হাসবো না রাগবো বুঝতে পারছিলাম না। বললাম,”শুভ এতো রাতে তোর রুমে ১টা মেয়ে,তোর বাবা জানলে কি হবে ভাব….আমি চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছি। আর, তুই মজা করছিস?”
শুভ বললো, খামোখা মজা করবো কেন?আমি এখানে আর থাকবো না মা।
আমি শুভ আর সারিনার দিকে তাকিয়ে আছি। কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার কেমন অদ্ভুত লাগতে লাগলো।এরপর কি হলো আমার মনে নেই।যখন চোখ খুললাম দেখলাম শুভর রুমের মেঝেতে পরে আছি।ও কোথায়?আমি কি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম?না… না মনে হয় সবটাই স্বপ্ন ছিল।শুভকে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু,ওর কোনো সাড়া নেই।ওর টেবিলের উপর ১টা ডায়েরী দেখতে পেলাম।এটা তো শুভকে আমি ই উপহার দিয়েছিলাম।ডায়েরী খুললাম।সেখানে এলোমেলো ভাবে অনেক কিছু লেখা।
“মা,ছোটো থেকেই আমি লক্ষ্য করেছি আমি সবার মতো নই। সবার মাঝে থেকেও আমার মনে হতো ,এরা কেউই আমার নিজের না।সবার সাথে মানিয়ে নিতে আমার খুবই কষ্ট হতো।আমি ভেবে পেতাম না কিভাবে তোমরা এতো প্রখর আলোয় বাইরে যাও। আমার তো খুবই কষ্ট হতো।আর, রাত হলে তুমি আমাকে ছাদে উঠতেও দিতে না।খালি বলতে,ভয় লাগে না তোর?আমি বুঝতে পারতাম না আঁধারে আবার ভয় কিসের? আঁধারে তো নিজেকে আড়াল করা যায়। স্কুল যাওয়া-আসা এসবে যে আমার কত সমস্যা হতো, তোমাকে কিভাবে বলবো।যাই হোক,এই পরিবেশে আমার যেমন থাকতে কষ্ট তেমনি তোমাদেরও আমাকে নিয়ে সমস্যায় পরতে হবে।তাই,আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি চলে যাবো। তোমাকে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিই।আমি যে মানুষ নই সেটা আমি প্রথমে জানতে পেরেছিলাম সারিনার থেকে। ও-ই আয়নায় দৃশ্যমান হয়ে আমার সাথে কথা বলতো।আর, আমার বাবা কখনোই মানুষ হতে পারে না।সে অবশ্যই আমাদের সম্প্রদায়ের কেউ।এ বিষয়ে তুমিই ভালো জানবে।আর,আমি সবসময়ই চেষ্টা করেছি আমার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে যেতে। কিন্তু, আমার মা যে মানবসম্প্রদায়ের তাই আমি সেখানে যেতে পারবো না কখনো সারিনা বললো। কারন, আমি নাকি মানুষের মতো হয়ে গেছি।তাই, নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে আমাকে ১জন মানুষ হত্যা করতে হতো। তাহলেই,ওরা বুঝতো আমি আসলেই মানুষ নই। আর, আমাকে বলা হল আমি যেন তোমার স্বামী অর্থাৎ তুমি যাকে আমার বাবা দাবি করো তাকে খুন করতে।সত্যি কথা বলতে উনাকে মেরে ফেলতে আমার একটুও কষ্ট হতো না। কিন্তু, তুমি তো আমার মা। তুমি কষ্ট পাবে ভেবেই আমি তা করিনি।আমি ভেবেছি,আগে তোমার চোখে উনাকে খারাপ প্রতিপন্ন করবো।যেন, তুমি উনাকে অপছন্দ করো।এরপর,উনি মারা গেলেও তোমার কষ্ট হবেনা।তাই ,আমি রেইনবো কেক,রিমি সব বানিয়ে বলেছি। আরো,নানা ভাবেই চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। তুমি ভাবছো আমি কত খারাপ না? আসলেই আমি খারাপ।তবে, তোমাকে আমি খুবই ভালোবাসি মা।যাইহোক,আমি যেহেতু মারতে পারলাম না তাই জ্বীন সম্প্রদায়ের প্রধান আমাকে বললো আমি যেন এখানেই থাকি।কারন, আমার মধ্যে মানুষের লক্ষণ বিদ্যমান।আর,কোনো জ্বীন যেন আমার সাথে যোগাযোগ না রাখে। কিন্তু, তবুও সারিনা আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। বিধায়,ওকে শাস্তি স্বরুপ মানুষের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল সমস্ত স্মৃতি মুছে।আর,তাই ও আমাকে হাসপাতালে চিনতে পারেনি।জ্বীনদের ২টা অনন্য ক্ষমতা হলো তারা আয়নায় প্রবেশ করতে পারে।আর, বিভিন্ন পশু-পাখির রূপ ধারণ করতে পারে।এই ২টা ক্ষমতার ১টাও আমার ছিল না। কিন্তু,শেষে অনেক চেষ্টার পর আমি দেখলাম আমি আয়নায় প্রবেশ করতে পারি।আর,এ কারনে হয়তো আমি আমার সম্প্রদায়ের কাছে ফেরত যেতে পারবো। আমাকে ক্ষমা করো মা।আমি তোমাকে ফেলে স্বার্থপরের মত চলে যাচ্ছি। কিন্তু, এখানে থাকতে আমার খুবই অস্বস্তি হয়। তুমি কি চাও আমার সারাটা জীবন অস্বস্তি-তে কাটুক?”
আমি আর পড়তে পারলাম না।ও কি সত্যিই মানুষ নয়?ও হওয়ার আগে আমি অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি।এমনকি এ যুগের মানুষ হয়েও কত-শত কবিরাজের কাছে গেছি।১জন মহিলা বলেছিল তার কাছে নাকি ৩ টা জ্বীন বন্দি।সে জ্বীনের সাহায্যে অনেক কিছু করে ফেলতে পারে।আমি তাকে আমার স্বর্নের রুলি দুটি দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, যেকোনো কিছুর বিনিময়ে আমি শুধু ১টা সন্তান চাই।উনি আমাকে কিছু খেতে দিয়েছিলো।তারপর, আমি ঘুমিয়ে পরেছিলাম। সন্ধ্যার দিকে ঘুম ভাঙলো।উনি হেসে বললো সামনের মাসেই তুই খুশি হয়ে যাবি দেখিস।সত্যিই তাই হলো।উনি আসলে কি করেছিল আমি জানি না। উনাকে আমি আর কখনো খুঁজে পাইনি।
সাদিক কে সবটা বলতে হবে।সত্যিই কি ও তবে শুভর বাবা নয়? আমার হাত-পা কাঁপতে লাগলো।আমি সাদিককে সব কিছু বললাম।ও চুপ করে শুনলো।বললো, কোথায় শুভর লেখা দেখাও?আমি দেখালাম।ও দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।এটা তো খালি পৃষ্ঠা। কোন লেখা নেই।আর শুভ হতচ্ছারা নিশ্চয়ই বকুনি খেয়ে আমার উপর রাগ দেখিয়ে বাড়ি থেকে চলে গেছে। চিন্তা করো না একটু পরই ফিরে আসবে।
আমি হতভম্ব হয়ে সাদিকের কথা শুনছি।কি বলছে ও?আমি তো স্পষ্ট লেখাগুলো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু,ও কেন পাচ্ছেনা।
শুভ কি শুধু চেয়েছে আমাকে সত্যিটা জানাতে?
দেখতে দেখতে অনেক দিন পার হলো। শুভ আর ফিরলো না।সাদিক থানায় রিপোর্ট করিয়েছে। কিন্তু,কাজ হয়নি ।হবে না সেতো আমি জানি ই।আমি সাদিক কে সবসময় সত্যি টা বলি।ও বিশ্বাস করে না।আমাকে মানসিক ডাক্তার দেখায়।সব নাকি আমার মনের ভুল।আমি সত্যিই বুঝতে পারি না কোনটা সত্যি কোন টা মিথ্যা।আমি প্রায়ই আয়নায় শুভ কে দেখি।ডাক্তার বলে এসব নাকি আমার কল্পনা। কিন্তু,শুভ সেতো আমার সন্তান ছিল।তাকে তো আমি কত কষ্ট করে বড় করেছি।তার কি মনে পরে না আমার কথা?
ডাক্তার বলে আমি না স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। যেহেতু আমি দেরীতে মা হয়েছি এবং জ্বীন পোষে এমন কারো কাছে সাহায্যের জন্য গিয়েছি তাই আমার মাথায় এটা ঢুকে গেছে যে আমার ছেলেটা হয়তো বা মানুষ না।জ্বীনই হয়তো আমার ছেলের বাবা। অবচেতন ভাবে এসব ভাবার কারনেই নাকি আমি ভুল ভাল কথা বলি,দেখি।
আমিও ডাক্তারের কথাই মেনে নিয়েছি।সবই হয়তো আমারই অবচেতন মনের ভাবনা।শুভ হয়তো আসলেই ওর বাবার উপর রাগ করে চলে গেছে।এরপর,কোনো বিপদে পরেছে হয়তো মারা গেছে।হয়তো সারিনা,শুভ,ডায়েরী যা সবই আমি দেখেছিলাম সব ভুল। কিন্তু, তবুও আমি জানি আমি ভুল নই।কারন, আমি আমার চারপাশে শুভর অস্তিত্ব অনুভব করি। আমি ১ দিন সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু,তখন আমার মনে হলো কেউ যেন আমার কানে কানে পরম মমতায় বলছে,এমন করো না মা….এমন করো না।
আমি ওকে স্বপ্নে দেখি।কত বছর কেটে গেছে।সবাই ওকে ভুলে গেছে। কিন্তু, আমি জানি ও বেঁচে আছে।ওর আর সারিনার খুব ফুটফুটে ১টা মেয়ে হয়েছে।স্বপ্নে ও আমাকে বলছে,মা তোমার নাতনির ১টা নাম রাখো।
আমি নামের বইয়ে নাম খুঁজি।সবাই আমাকে পাগল বলে।আমি মেনেও নিই।আমি পাগল হয়ে যদি আমার সন্তানকে দেখতে পাই তাহলে পাগল হওয়াটাই বা মন্দ কি…………

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প