আলেয়া খালা

আসসালামু আলাইকুম। আমি জারিয়াত মানহা। আচ্ছা, আপনারা জ্বিন বিশ্বাস করেন? হয়তো অনেকেই করেন। আমি বিশ্বাস করতাম মোটামুটি ভাবে, কিন্তু যদি আপনার সামনেই কেউ জ্বিন দ্বারা আক্রান্ত হয়ে শেষ হতে থাকে, তখন তো আপনি বিশ্বাস করবেন?
আমার আম্মু যখন ছোট ছিলেন তখনকার ঘটনা এটি। আমার নানাবাড়ির পাশের বাড়িতে এক নানী থাকতেন, তার তিন ছেলে ছিলো। সেই নানীর নাকি খুব শখ ছিল তার একটি কন্যা সন্তান হোক। তিনি যখন সাত মাসের গর্ভবতী, তখন তিনি তার বোনের বাড়িতে গিয়েছিলেন কোন একটা কাজে, তো কাজ শেষ হতে অনেক সময় লেগে যায়। একদম সন্ধ্যা হয়ে গেছিল, তো নানীর সেই বোন নাকি নানীকে বলেছিল, আজকে তাদের বাড়িতে থেকে যেতে, কাল সকালে যেতে। কিন্তু নানী কোন কথা না শুনে চলে এসেছিলেন। নানী আর নানা পথে যেতে যেতে একটা শ্মশান ঘাট তাদের পথে পড়লো, তার পাশেই ছিলো নাকি একটা বট গাছ। তখন তো যাতায়াতের এত ভালো ব্যবস্থা ছিল না, গরুর গাড়ি করেই অনেকে যাতায়াত করতো। হঠাৎ গরুর গাড়ি নাকি থেমে গেছিল। গরু গুলো সামনে যেতে চাচ্ছিল না। নানী আর নানা গাড়ি থেকে নেমে চালককে বললেন, কি হয়েছে, গাড়ি কেন থামালেন?
তখন চালক বললেন, গরু গুলো সামনে যেতে চাচ্ছে না, অনেক চেষ্টা করছি।
হঠাৎ নানীর নাকি পেটে ব্যথা শুরু হয়েছিল, আর নানী নাকি ঐ বট গাছের নিচে একটু বসে ছিলেন। বসার একটু পরেই নাকি নানীর খুব গরম লাগছিল, এমন মনে হচ্ছিল যেন সব গরম নানীর আশেপাশে ঘুরছে। নানা নানীকে বট গাছের নিচে বসাতে রাগ করলেন এবং উঠে আসতে বললেন। কোন কারণ ছাড়াই গরু গুলো নাকি আবার চলতে শুরু করেছিল, নানীরা বাড়ি পৌছে গেলেন। এভাবে অনেকদিন পার হলে নানী একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। নাম রাখা হয় তার আলেয়া।
সকলের নয়নের মণি ছিলো আলেয়া। কারণ তিন ভাইয়ের একমাত্র বোন আলেয়া। যত বড় হতে লাগলো আলেয়ার মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ বাড়তে লাগল। হঠাৎ করেই নাকি আলেয়াকে খুঁজে পাওয়া যেত না। সারা বাড়ি সবাই খুঁজতো, কিন্তু আলেয়াকে পাওয়া যেত না। তারপর অনেকক্ষণ পরে নাকি পাওয়া যেত তাদের বাগানের উঁচু ডালের ওপর বসে আছে আলেয়া। এমন প্রায়ই হতো। নানা নানী নাকি বেশ চিন্তায় থাকতেন, কেন এমন হচ্ছে। তারা অনেক হুজুর দেখালেন, সকলে ঝাড়ফুঁক করত, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হতো না। আলেয়ার বয়স যখন ১৪, তখন তার পাগলামি আরও বাড়তে লাগল। সে একা একা বিড়বিড় করত, কেউ কাছে এলে তাকে গালাগাল করত, মারতে যেত।
শেষমেশ নানা নানী সিদ্ধান্ত নিলেন, অনেক হয়েছে, আর না। এবার ভালো কোন হুজুরের সন্ধান করতে হবে। তাদের আদরের মেয়ে তাদের চোখের সামনে এভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে, তারা কিভাবে সহ্য করবেন? আলেয়ার বড় ভাই তখন বিয়ে করেছিল এক হুজুর পরিবারে, সেই পরিবারের সকলেই খুব ধার্মিক ছিলেন। আলেয়ার এই অবস্থা দেখে তারা এক ভালো হুজুরের সন্ধান দিলেন। নানা নানী খুব শীঘ্রই আলেয়াকে তার কাছে নিয়ে গেলেন। হুজুর সবটা শুনে বললেন, আপনারা কাল আসবেন, আমি আমার পালিত জীন দ্বারা আগে দেখি বিষয়টি কি। পরদিন নানা নানী আলেয়াকে নিয়ে হুজুরের কাছে গেলেন। আলেয়া রীতিমতো হুজুরকে গালাগাল করছিল, নিজে নিজে হাসছিল। নানী আলেয়াকে নিয়ে পাশের রুমে আসলেন। নানা হুজুরের সাথে কথা বললেন, যে কিছু জানতে পেরেছেন কিনা সে।
হুজুর যা বললেন, নানার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। হুজুরের ভাষ্যমতে, আপনার মেয়ের সাথে যে আছে, সে এক জ্বিনের সন্তান। আপনার বিবি যখন সাত মাসের গর্ভবতী ছিলেন, তিনি যে গাছের নিচে বসেছিলেন, ঠিক সেই গাছটায় এক জ্বিন দম্পতি থাকতো। তাদের সন্তানের নজর পড়েছিল আপনার বিবির গর্ভে থাকা বাচ্চাটির উপর, এবং এই জ্বিনের বাচ্চাটা এখন আলেয়ার শরীরের সাথে আস্তে আস্তে মিশে গেছে। এখন আলেয়া যত বড় হবে, জ্বিনের বাচ্চাটাও ওর সাথে বড় হবে। ওকে তাড়ানো সম্ভব নয়, আপনারা অনেক দেরি করে ফেলেছেন।
হুজুর আরও বললেন, আমি যাই করি না কেন, এখন তা সাময়িকভাবে আলেয়ার ওপর কাজ করবে, তারপর আবার ও আগের মতো আচরণ করবে। কারণ জ্বিনটা ওর শরীরের সাথে মিশে গেছে। নানা নানী এরপর আলেয়াকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। নানী সবসময় কাঁদত আর বলত, ঐ দিন তার বোনের কথা যদি শুনত, তাহলে এত কিছু ঘটত না।
আলেয়া এভাবেই বড় হতে লাগল। একে মারত, ওকে গালগাল করত। ঘরে আটকিয়ে রাখলে কিভাবে যেন সে পালিয়ে যেত। নানা এভাবে আলেয়াকে নিয়ে চিন্তা করতে করতে একসময় মারা গেলেন। আমার মায়ের কাছ থেকে এতটুকু শুনে ছিলাম। বড় হওয়ার পরে যতবার নানাবাড়ি যেতাম, দেখতাম আলেয়া খালা খাল পাড়ে একা একা কথা বলছে, সারা বাগানে ঘুরছে। মাঝে মাঝে শুনতাম, আলেয়া খালাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, আবার পরদিন নাকি তাকে বাঁশ বাগানে পাওয়া যেত। আমি সবসময় ভাবতাম, তার হয়তো কোন মানসিক রোগ আছে, তাই হয়তো এমন করছে। কিন্তু না, সেবার নিজেদের চোখে যা দেখেছি, এরপর বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি যে আলেয়া খালার কোন মানসিক রোগ নেই, সে অন্য কিছু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
একবার আমি আর আমার বোন নানাবাড়ি গেছিলাম। নানাবাড়ি গেলে আমরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাঘুরি করি, তো আমার নানাবাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটা নদী আছে। আমরা বেড়াতে গেলে সেখানে ঘুরতে যাই। তো আমি আর আপু মিলে সেখানে হাঁটতে গেলে, হঠাৎ দূর থেকে দেখলাম আলেয়া খালা নদীর পাশে একটা বাঁশ বাগান আছে, সেখানে চলে যাচ্ছে। আমরা বেশি ভাবলাম না, কারণ সে এভাবেই একা একা হাটাহাটি করে। তো আমরা অনেকক্ষণ নদীর পাড়ে হাটাহাটি করে বাসার দিকে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ কোথা থেকে জানি আলেয়া খালা আমাদের সামনে এসে আমার আপুর হাত খপ করে ধরে বলল, চল আমার সাথে ঐ বাঁশ বাগানে।
আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। আপু রীতিমতো চিতকার করছিলো, যেহেতু শেষ বিকেল ছিলো, নদীর পাড়ে মানুষ ছিলো না তেমন। আমি আপুর হাত আলেয়া খালার হাত থেকে ছাড়িয়ে আপুকে নিয়ে দৌড় লাগালাম। আলেয়া খালাও আমাদের পিছনে দৌড়ে আসতে লাগল। এরমধ্যে আমরা আমাদের বাড়ির মসজিদের কাছাকাছি এসে পড়েছিলাম, তখন পিছে ফিরে দেখলাম আলেয়া খালা নেই। পরে বাসায় ফিরে আম্মুকে সব জানানোর পর, আম্মু বকাবকি করল, কেন আমরা একা নদীর পাড়ে গেছিলাম।
আমি আর আপু কখনো ভুলব না ঐ দিনের ঘটনা, কারণ আপুর ভাষ্যমতে, আপুর হাত যখন আলেয়া খালা চেপে ধরেছিল, তার হাত নাকি অস্বাভাবিক ঠান্ডা ছিল, খালার মুখ থেকে লালা ঝরছিল।
এখন আলেয়া খালার মা, মানে সেই নানী, ও মারা গেছেন। আজও নানাবাড়ি গেলে দেখি, সে একা একা হাসছে, কথা বলছে।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প