তিথি হঠাৎ বায়না ধরলো, ময়না পাখি কিনবে। ওর ক্লাসের একটা মেয়ের নাকি ময়না পাখি আছে। কেউ গেলেই বলতে থাকে, ‘আই লাভ ইউ’। মেয়েটা ওই ময়নার গল্প ক্লাসের সবাইকে বলে বেড়ায়। তিথি একদিন গিয়ে ঐ ময়না পাখি দেখে এলো। এরপর থেকেই ওর ময়না পাখি কেনার আবদার শুরু হয়েছে।
আগামী পরশু তিথির জন্মদিন। পাঁচ বছর হবে মেয়েটার। দেখতে দেখতে কিভাবে মেয়েটার পাঁচ বছর হয়ে গেলো, টেরই পেলাম না। মনে হলো, এই সেদিন আমি আর ওর মা ওকে তোয়ালে পেঁচিয়ে হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে এলাম। এভাবেই মেয়েটা একদিন বড় হবে। এরপর পড়ালেখার জন্য হয় বিদেশ পাড়ি দিবে, নয়তো যাবে অন্য কারো বাড়ি। এরপর মাঝে মাঝে ওর দেখা পাবো। ও হয়ে যাবে আমাদের কাছে পরজন। এই ব্যাপারগুলো ভাবতে চাই না, কিন্তু ব্যাপারগুলো কেন যেন মাথার মধ্যে চলে আসে। আর তখনই মনটা খারাপ হয়ে যায়।
আমি শারমিনকে বললাম, তিথিকে এবার একটা ময়না কিনে দেবো।
শারমিন বললো, তোমার ব্যাংকে এখন কতো টাকা আছে? সামনের মাসে সাভারে প্লট বুকিং দেবার টাকা হবে তোমার?
হবে। না হলেও ম্যানেজ করবো। মেয়েটা একটা শখ করেছে, এই শখটা আগে আমার পূরণ করতে হবে।
শারমিন বললো, ‘ঠিক আছে। তবে মেয়েকে কিন্তু তুমি বেশি আস্কারা দিচ্ছো। ওকে এতো আস্কারা দেওয়া ঠিক না।’
দুদিন পর, অফিস থেকে ফেরার পথে তিথির জন্য একটা ময়না কিনে নিয়ে এলাম। সাথে একটা খাঁচা। ময়না পাখিকে দেখে তিথির চিৎকার আর থামে না। ও এঘর ওঘর দৌড়ে বেড়ায়। ময়না পাখিটাও তিথির অনুকরণ করে চিৎকার করা শুরু করে দিয়েছে। তিথির আনন্দ দেখে যেন খুব মজা পাচ্ছে সে।
আমি তিথিকে বললাম, ‘মা, ময়না পাখিটার একটা নাম দাও।’
তিথি বললো, ‘ওর নাম নয়ন মাঝি।’
তিথি কিছুদিন আগে একটা ছবির নাম শুনেছে নয়ন মাঝি নামে। এরপর থেকে সবকিছুর নাম ও নয়ন মাঝি দিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি অন্য কিছু নাম দিতে বললাম। তিথি মানলো না। বললো, ময়না পাখির নাম নয়ন মাঝিই রাখতে হবে।
পাখিটার নাম নয়ন মাঝি রাখা হলো। যদিও পাখিটা মেয়ে।
নয়ন মাঝি আমাদের সাথেই থাকে। ওকে প্রতিদিন প্রচুর খাবার-দাবার দেয়া হয়। খাবারে আলু, আপেল, আঙুর যেমন থাকে, তেমন আমিষের সুষম চাহিদা মেটানোর জন্য পোকামাকড়ও দেয়া হয়। তিথি খুব আগ্রহ নিয়ে পোকামাকড় ধরে। নয়ন মাঝিও খুব আনন্দ নিয়ে তিথির দেয়া খাবার খায়।
নয়ন মাঝি এর মাঝে বেশ কথা বলা শিখে গেছে। ওর কমন কথা হলো, ‘তিথি তুমি কই? খেতে দাও।’ এছাড়া ও সব কথা অনুকরণ করে বেড়ায়। ময়না পাখি যে এতো কথা অনুকরণ করতে পারে আমার জানা ছিলো না। আমি ভাবতাম অনেকদিন ধরে ধরে তাকে কথা মুখস্থ করাতে হয়। এরপর তার মুখে বুলি ফুটে। কিন্তু দেখলাম না, নয়ন মাঝি যা শুনে তাই বলে বেড়ায়। আমি যদি বলি, ‘কি করো?’ সেও বলে, ‘কি করো?’ আমি যদি বলি, ‘ঘুমাতে যাও।’ সেও বলে, ‘ঘুমাতে যাও।’ শুধু মুখের কথা না, সে আরো অনেক শব্দ নকল করে। একদিন কলিংবেলের শব্দ শুনে তিনবার দরজা খুলেও কাউকে দেখতে পেলাম না। ভাবলাম পাশের বাসার ফাজিল ছেলেটা কলিংবেল বাজাচ্ছে। হঠাৎ টের পেলাম, শব্দটা আসছে ঘরের ভেতর থেকেই। নয়ন মাঝি যেখানে আছে, সেখান থেকে। ওর কাছে গিয়ে দেখলাম, ঠিক। ও নিজেই মুখ দিয়ে কলিংবেলের শব্দ করছে।
আমি চিন্তা করেছিলাম নয়ন মাঝিকে কিছু গালিও শিখিয়ে দেই। পারলাম না। শারমিন হুমকি দিলো, পাখির মুখ দিয়ে একটা গালি বের হলে ও বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।
নয়ন আর আমাদের মধ্যে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। কিন্তু বন্ধুত্বটা বেশিদিন টিকলো না। একদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো।
একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরছি। সেদিন আবার সকালে বৃষ্টিতে ভিজে একটু জ্বর জ্বর লাগছিলো। বাসায় এসে প্যারাসিটামল খেয়ে একটু শুয়েছি। তিথি এসে বললো, ‘আব্বু, নয়ন মাঝি খুব আজেবাজে কথা বলছে।’
‘কি বলছে মা?’
‘বলছে আমরা সবাই খারাপ। আমাদের সবাইকে ও খু*ন করে ফেলবে।’
‘ওকে বলো, বেশি কথা বললে ওকে রোস্ট করে খেয়ে ফেলবো। যাও এখন। আব্বুকে একটু ঘুমাতে দাও।’
তিথি আবার এসে কি কি বললো। আমার মাথায় ঢুকলো না। আমি একদম ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। ঘোর কাটলো সকাল বেলায়। জ্বর একটু কমেছে। বিছানা থেকে উঠে দেখলাম, শারমিন চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে।
আমি বললাম, ‘কি হয়েছে?’
‘তোমাকে বলেছি না পাখিটাকে গালি শিখাবা না।’
‘শিখাই নাই তো।’
‘তাহলে ও গালি শিখলো কার কাছ থেকে?’
‘গালি শিখেছে?’
‘গালি শিখেছে মানে? কুৎসিত কুৎসিত সব গালি শিখেছে। কাল সারারাত ধরে গালি দিয়েছে পাখিটা। আমার তো ইচ্ছা করছিলো ধরে ছুড়ে বাইরে ফেলায় দেই। তোমার মেয়ের জন্য পারলাম না।’
‘গালি শিখালো কে?’
‘তা তুমি জানো। আজ তোমার জ্বর ছিলো বলে বাড়ি ছাড়লাম না। নাইলে এখনই ব্যাগ গুছিয়ে বাবার বাড়ি চলে যেতাম।’
শারমিন তিথিকে নিয়ে স্কুলে চলে গেলো। আমি বাসায় থাকলাম। জ্বর বলে অফিসে গেলাম না।
নয়ন মাঝি চুপচাপ বসে আছে। ঝিমুচ্ছে মনে হয়। আমি পাখিটাকে দেখছি। ও গালি শিখলো কার কাছ থেকে? আমরা বাদে কেউ কি আসে এ বাসায়? কে আসবে?
নয়ন মাঝি চোখ মেললো। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এখানে লাশটা লুকানো। পালা তোরা পালা।’
আমি অবাক হয়ে গেলাম।
পুরো বেলা নয়ন মাঝি এই কথা বলে বেড়ালো। আমি ঘুমিয়ে কাটালাম সারাদিন। তবু পাখিটার কথা কানে বেজে চললো। এই কথার কোনো অর্থ আমি বের করতে পারলাম না।
শারমিনরা এলো বিকেলে। আমার জ্বর তখন নেই। শরীরটা একটু দুর্বল। শারমিন জিজ্ঞেস করলো, ‘পাখিটা কিছু বলেছে?’
‘বলেছে, কিন্তু তার কথা বুঝিনি।’
‘পাখিটাকে আজকেই বিদায় করো। আমি বাড়ি ঢুকতেই আমাকে একটু কুৎসিত গালি দিয়েছে। একে আর আমি বাসায় রাখবো না। এখনই বিদায় করো।’
‘আজকে রাতটা থাকতে দাও। কাল সকালেই কাঁটাবনে রেখে আসবো।’
রাতে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ শুনলাম, পাখিটা চিৎকার করছে। আমি উঠলাম। শারমিন ঘুমাচ্ছে। ঘর থেকে বের হয়ে দেখলাম, পাখিটা প্রচন্ড জোরে পাখা ঝাপটাচ্ছে। আর বলছে, ‘পালা। পালা।’
পাখিটা আমাদের ড্রয়িংরুমে রাখা। ড্রয়িংরুমে একটা ডিমলাইট জ্বালানো। কমলা রঙের লাইট। ওটা বাদে পুরো বাড়ি অন্ধকার। তিথি আমাদের সাথে শোয়। ঘুম থেকে ওঠার সময় ওকে আমার পাশে দেখিনি। ওকে দেখলাম নয়নের খাঁচার সামনে দাঁড়ানো।
নয়ন তিথির দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, ‘পালা। পালা।’
তিথি আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আব্বু, নয়ন মাঝি এসব কথা কার কাছে শিখলো, জানো?’
‘না। কার কাছে?’
‘ও ঐ পাশের ঘরে আছে।’
তিথি আমাদের গেস্টরুম দেখালো। রুমটা অন্ধকার। অন্ধকারে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। আমার পুরো শরীর ভয়ে জমে গেলো। আমি চিৎকার করে বললাম, ‘কে? কে ওখানে?’
কে যেন হেসে উঠলো। আর কোনো শব্দ পেলাম না।
নয়ন বলতেই থাকলো, ‘লাশটা এখানে। তোরা পালা। লাশটা এখানে। তোরা পালা।’
পাশের ঘরে ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে। কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে। একটু পরেই ঘরের বাইরে চলে আসবে। যে আসবে, সে নিশ্চয়ই আমাদের বন্ধু হবে না।
আমি শারমিনকে জাগালাম। ও উঠে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু সময় নেই আমাদের হাতে। আমি ওকে আর তিথিকে নিয়ে দ্রুত দরজার দিকে এগোলাম। দরজা লক করা। চাবি দেয়ালের পাশে ঝোলানো। চাবিটা আনতে গিয়েই শুনলাম, নয়ন চিৎকার করে বলছে, ‘সময় শেষ। সময় শেষ। আমি আসছি। আমি আসছি।’ চাবিটা দরজায় লাগিয়ে লক ঘুরালাম। লক খুললো না। ডিম লাইটটা হঠাৎ নিভে গেলো। আর নয়ন আমাদের বুক পর্যন্ত হিম করে দিয়ে ঠিক মানুষের মতো হো হো করে হেসে উঠলো।
শেষ মুহূর্তে আমি লক খুলতে পেরেছিলাম।
দরজা দিয়ে বেরিয়ে যখন দরজা লাগাচ্ছি, স্পষ্ট শুনেছিলাম কেউ একজন অন্ধকারে দৌড়ে আসছে আমাদের দিকে। আরেকটু দেরি হলেই হয়তো আমাদের ছুঁয়ে ফেলতো। একটুর জন্য পারলো না। আমি দরজা লাগিয়ে ফেলেছিলাম।
সেই রাতটা আমরা আমার ভাইয়ার বাসায় ছিলাম। সকালে পুলিশ নিয়ে গেলাম আমাদের বাসায়। এক্ষেত্রে পুলিশের সাহায্য হয়তো এতো তাড়াতাড়ি পাওয়া যেত না। আমাদের কথা তারা বিশ্বাসই করতো না। সাহায্য পাওয়া গেলো, তার একটা কারণ ভাইয়ের বন্ধু এই থানার এসপি ছিলেন। পুলিশ পুরো বাড়ি খুঁজে কিছু পেলো না। পাখিটা শুধু পাগলের মতো উল্টোপাল্টা বলছিলো। ওকে ধরে ছেড়ে দেয়া হলো। তিথিও আর আপত্তি করলো না। আমরা সেদিনই বাড়িটা ছেড়ে দিলাম।
এই ঘটনার দুবছর পর, একদিন টিভিতে একটা খবর শুনেছিলাম। আমাদের যে বাসার ঘটনা বললাম, সেই বাসা সংস্কার করতে গিয়ে নাকি একটা মানুষের কংকাল পাওয়া গেছে। দেওয়ালের ভেতর প্লাস্টার করে কংকালটা রাখা হয়েছিলো। পুলিশ ধারণা করছে কংকালটা এক খুনির। খুনির নাম যদু খান। সে তার পার্টনার বুলি মিয়ার সাথে একটার পর একটা খুন করতো। এরপর একদিন সে হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যায়। তার আর কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিলো না। খবর রটে যায়, বুলি মিয়া নিজে যদু খানকে খুন করে লাশ কোথাও গুম করে ফেলেছে। কোথায় লাশ গুম করেছে তা কেও জানতো না। বুলি মিয়াকে পুলিশ আটক করেছিলো। কিন্তু সে খুনের কথা স্বীকার করেনি।
পুলিশ কংকালটা নিয়ে তদন্ত করছে। এখনো কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি।
তিথি আর কখনো ময়না পাখি কিনতে চায়নি।