ওয়াদা

বিয়ের তিন বছর পর যখন জানতে পারলাম, আমি কখনো মা হতে পারব না।
যে আমি পরিবারের প্রিয় পুত্রবধূ, চোখের মনি ছিলাম তার প্রতি ধীরে ধীরে সবার ব্যবহার বদলাতে শুরু করল। হঠাৎ একদিন আমার শাশুড়িমা, যে সব সময় বলতো আমি নাকি তার ছেলের বউ না তার মেয়ে। তিনি দুপুরবেলা খেতে বসে তরকারিতে একটু লবণ কম হয়েছিল বিধায় আমাকে সেটা নিয়ে বকতে বকতে চলে গেলেন আমি মা হতে পারবো না কেন সেই বিষয়ে এবং বলেই ফেললেন যে আমাকে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে নতুন একজন বউ নিয়ে আসতে, যে তাদের বংশের প্রদীপ জন্ম দিবে। ইরাদ সেদিন রাগ হয়ে গেছিল এবং খাবার শেষ না করে উঠে চলে গিয়েছিল।
প্রায় ৪-৫ দিন হয়ে গেছে আস্তে আস্তে দেখলাম আমার স্বামীর ব্যবহারও আমার প্রতি কেমন যেন অন্যমনষ্ক হয়ে গেছে। হওয়াটাই হয়তো স্বাভাবিক উঠতে-বসতে সবাই শুধু বলে আমি বাচ্চা জন্ম দিতে পারব না। আমার মত মেয়েকে দিয়ে তাকে বিয়ে করিয়ে ভুল করেছে। সেও একজন মানুষ হয়তো সে ও ভাবতে শুরু করেছে আমাকে বিয়ে করে তার ভুল হয়ে গেছে। আমার মনটা এখন অনেক বেশি খারাপ থাকে। ইরাদ আর আমার বিয়েটা প্রেমের বিয়ে ছিল। পাঁচ বছর প্রেম করে আমরা বিয়ে করেছিলাম। সেদিন সকালে আমার খালা শাশুড়ি এসেছিলেন। এমনিতে যখন তিনি বাসায় আসতেন সব সময় আমার সাথে খুব গল্প করতেন কিন্তু সেদিন খালাম্মা আমার সালামের জবাব টা পর্যন্ত দেননি। আমার কাছে এখন নিজেকে চোরের মত লাগে,মনের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে। সবার রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে। আমি রান্না ঘর গোছাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে আসলো বাবাকে ওষুধ দিইনি, এখন দিয়ে আসি, বসবার ঘরের কাছে যেতেই দেখি তারা দরজাটা ভিরিয়ে রেখেছিলেন। ভিতরে মা, বাবা, খালাম্মা, আর ইরাদ। বাইরে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলাম, খালাম্মা আজকে কয়েকজন মেয়ের ছবি নিয়ে এসেছেন ইরাদকে বিয়ে করানোর জন্য, আর মা কান্নাকাটি করছিলো ইরাদের হাত ধরে যে সে যদি এই বংশের প্রদীপ না দেয় তাহলে মা বিষ খাবেন।
কথাটা শুনেই আমার হাত-পা সাথে সাথে ঠান্ডা হয়ে গেল। শরীর একদম ভারী হয়ে আসতে শুরু করলো। আমি কিছু না বলে চুপচাপ রান্নাঘরে চলে গেলাম। আস্তে আস্তে সব কাজ শেষ করলাম, রাতে যখন ঘরে গেলাম দেখি ইরাদ ল্যাপটপে বসে কাজ করছে। সে এখন আমার সাথে খুব বেশি কথা বলে না। আজকে আমার দিকে তাকাচ্ছে ও না।
আমিও কোন কথা না বলে শুয়ে পড়লাম। সারারাত ঘুম হলো না, উঠে ফজরের নামাজ পড়লাম। তারপর দেখি মাথাটা খুব ঘুরাচ্ছে ভাবলাম একটু শুই, ঘুম থেকে উঠে নাস্তা বানাবো। চোখ খুললো ঠিক বিকেল ৪ টায়। তাকাতে পারছিলাম না মাথা ঝিমঝিম করছিল, শরীর আগুনের মত গরম, বুঝতে পারলাম হয়তো জ্বর এসেছে। ঘর থেকে বের হলাম, দেখি বাসায় কেউ নেই। আমি রান্নাঘরে গিয়ে রান্না করলাম, রাত প্রায় ৮টা বেজে গেলো তখন মা, বাবা, খালাম্মা, তমা(ননদ) বাসায় ফিরলো। কিছুক্ষন পর
আমার শাশুড়ি আমাকে দেখে বললেন- তোমার জমিদারি দেখি দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। তোমাকে দিয়ে এখন আর কোন আশাই আমরা করিনা। সারা দিন ঘুমিয়ে কাটাও কোনো কাজের না তুমি।
ছেড়ে চলে যেও না কেন এই বাড়ি? আমাদের শান্তি দাও না কেন? অশান্তি করে ফেলছো জীবনটা। আমার ছেলে কে ধ্বংস করেই এই মেয়ে শান্তি পাবে যা দেখছি।
আমি চুপচাপ দাড়িয়ে ছিলাম।
মা আরও বললেন- তুমি ইরাদকে ডিভোর্স করে দাও, ও আর তোমার সাথে থাকতে চায় না। ৩ বছর আগে করা ভুল এখন আমার ছেলে শুধরাতে চায়। লজ্জা থাকলে চলে যাও এখান থেকে। আমি ইরাদের জন্য মেয়ে ঠিক করেছি ওকে সামনের সপ্তাহে বিয়ে করাবো।
একটা বিশ্বাস ছিলো ইরাদ আমাকে ছাড়া আর কাউকে কখনও ভালোবাসতে পারবেনা।
কিন্তু কালকে যখন ওকে বিয়ের কথা বলছিলো ও চুপচাপ দাড়িয়ে ছিলো। তাহলে কি ও চায় আমাকে ছেড়ে দিতে?
আস্তে আস্তে ঘরে চলে আসলাম কিছুক্ষণ পরে দেখি ইরাদ বাসায় এসেছে, কিন্তু ও ঘরে আসছিলো না, আগে ইরাদ বাড়ি ফিরলেই আমাকে খুঁজতো। ইরাদ সবসময়ই কম কথা বলতো তবে দিনে ৩-৪বার কল দিতো আমি কি করছি তা জানতে আর এখন সারাদিনে একটা কল ও করে না,
একদম কাটায় কাটায় ১১টা বাজে তখন ইরাদ রুমে আসলো, এসে ফ্রেশ হলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম খাবার দিবো কি না?
সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো- রুহি, তুমি কালকে তোমার বাসায় যাবা
সকালে রেডি হয়ে নিও, আর হ্যাঁ সব কাপড় গুছিয়ে নিও।
আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না।
আমি আচ্ছা বলে সরে গেলাম।
বারান্দায় বসে রইলাম অনেকক্ষন শুধু হাউমাউ করে কান্না করলাম, আর বারবার তাকাচ্ছিলাম যে ইরাদ যদি একটাবার আমার সামনে আসতো। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে হয়তো বলতাম তুমি আমাকে সত্যি ছেড়ে থাকতে পারবে? কিন্তু ও আসেনি।
আমি তাহাজ্জুদ নামাজের পরে
ঘরের সব কাজ করলাম প্রতিটা ইটের কোণা আমার কত আপন। আমার কত স্বপ্ন, আজ সব ছুটে যাচ্ছে।
কিছুদিন পরে আমার জায়গায় নতুন কেউ আসবে, সবাই হয়তো আমাকে ভুলে যাবে কিন্তু আমি কি করে ভুলবো সব? ইরাদের আর আমার সব কিছু আমি তো ভুলে থাকতে পারবো না,,
এসব ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে গেলো।
ফজরের নামাজ পড়ে আল্লাহকে বললাম, আল্লাহ পাক আমাকে সাহায্য করেন, আমি আর এই কষ্ট সহ্য করতে পারছিনা,, কিছুক্ষনপরে গোসল করলাম নিজেকে আয়নায় তাকিয়ে দেখলাম খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। আম্মু আব্বু এই অবস্থায় আমাকে দেখলে কি ভাব্বে? গোলাপি বেগুনী ছাপার একটা শাড়ি পরে,
মাথাটা পরিপাটি করে বাধলাম, ঠোঁটে ভেসলিন দিলাম।
যেই ঘরে গেলাম দেখি ইরাদ উঠে গেসে, লাগেজ গুছানো শেষ।
রুহি-নাস্তা দিবো?
ইরাদ-না, চল।
বের হয়ে মা খালাম্মা কে সালাম করলাম কেউ কোনো কথা বললেন না,,
বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন সুখী হও মা।
ইরাদ আর আমি গাড়িতে বসে ছিলাম, নিজেকে অনেক প্রশ্ন উত্তরের জন্য তৈরি করছিলাম, মা বাবা ভাইয়া ভাবী সবাইকে কি ভাবে কি বলবো এসব ভাবছিলাম আর আমার কান্না পাচ্ছিলো গাড়ির গ্লাস খুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে কান্না করছিলাম।
কিছুক্ষণ পরে দেখি ইরাদ আমাদের বাসা যেদিকে সেদিকে গাড়ি না নিয়ে অন্য রাস্তায় নিলো। সেখানে না আমার বাসা, না তার অফিস।
২ মিনিট পরে একটা বাড়ির সামনে এসে থামলো গাড়ি।
ইরাদ- রুহি নামো।
রুহি- এখানে?
ইরাদ- আসো বলছি।
ভিতরে যাওয়ার পরে ইরাদ বললো আজ থেকে এটা তোমার বাসা।
আমরা এখানেই থাকবো।
আমি অবাক চোখে ওর দিকে তাকালাম।
ইরাদ-রুহি তুমি অনেক সহ্য করেছো, তুমি আমার বউ, তোমাকে আমি ভালোবাসি। তুমি একটা মানুষ, কোনো বাচ্চা জন্ম দেওয়ার মেশিন না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি সবাইকে বুঝাতে কিন্তু পারিনি।
তাই আমি আমাদের জন্য আলাদা বাসা নিয়েছি।
বাচ্চা না থাকলে আমরা দত্তক নিতে পারবো কিন্তু তুমি না থাকলে আমি ও থাকবো না।
বিয়ের সময় ওয়াদা করেছিলাম আজীবন সাথে থাকবো এতো তাড়াতাড়ি কি ভুলে যাবো?
ইরাদের কথা শুনে আমি আর কিছুই বলি নি শুধু ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম অনেক বেশি ভালোবাসি তোমাকে। আমি মরে যাবো তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প