ছোটবেলা থেকেই আমার ভয়ডর কম। ঘোর অমাবস্যায় শ্যাওড়া গাছের নিচে বসে রাত কাটিয়েছি, ভূতুড়ে পোড়ো বাড়িতে কাঁথা বালিশ নিয়ে দু’তিন রাত ঘুমিয়ে এসেছি, যেই সেতুর নিচে জলদানো আছে বলে মাছ ধরা মানা, গভীর রাতে সেখানে গিয়ে জাল ফেলে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ তুলে নিয়ে এসেছি। ভয় তো দূরের কথা, গা ছমছমও করেনি একটি বার।
তবে একবার ভয় পেয়েছিলাম, বেশ ভয়। সে গল্পটাই বলি।
আমাদের পাশের গ্রামে প্রতি বছর বৈশাখী মেলা বসে, সেবারও বসেছিলো। দল বেঁধেই গিয়েছিলাম মেলাতে, কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে দলছুট হয়ে গেলাম। এর উপর সেবার যাত্রা পার্টি এসেছিলো, সেটা দেখতে দেখতে রাত হয়ে গেল। ভেবেছিলাম যাত্রার প্যান্ডেলেই সব বন্ধুদের পেয়ে যাবো, কিন্তু বিধিবাম। ওরা যাত্রা না দেখেই চলে গিয়েছিলো, পরে জেনেছিলাম। ওরা তো নেই-ই, গ্রামের একটা লোককেও পেলাম না একসাথে বাড়ি ফেরার জন্য। কি আর করা, একা একাই বাড়ির পথ ধরলাম।
বৈশাখ মাস, সন্ধ্যায় আকাশ কালো হয়েছিলো, আমি অর্ধেক রাস্তা আসতেই দেখলাম কালবৈশাখী শুরু হলো। প্রথমে তো খুব হাওয়া শুরু হলো, একটা গাছের নিচে গিয়ে কোনোরকমে সামলালাম। এরপর শুরু হলো খুব জোরে বৃষ্টি আর বিদ্যুৎ চমকানি। ও এলাকায় আমার পরিচিত কেউ ছিলো না, তাই বাড়ি ফেরা ছাড়া কোনো উপায়ও ছিলো না।
আমাদের গ্রামে ঢোকার আগে মোটামুটি একটা বড় মাঠ পার হতে হয়। মাঠটা রাতে কেউ পার হতে চান না, সবার বিশ্বাস এখানে ভূতুড়ে ব্যাপার স্যাপার ঘটে। এর একটা কারণ হলো, মাঠের এক কোণাতে এক পুরনো গোরস্তান আছে। আমারতো এসব ভয়টয় নেই আগেই বলেছি, নিশ্চিন্তেই মাঠ পার হচ্ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল হলো, মাঠের যেদিকে পুরনো গোরস্তানটা আছে, সেদিকে দুজন লোক সারা গায়ে চাদর পেঁচিয়ে, মাথাটুকুও চাদরে ঢেকে, গুটিগুটি পায়ে হাঁটছে। অন্ধকার আর বৃষ্টিতে এতদূরের জিনিস দেখতে পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু বারবার যে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিলো,তাতেই ও দৃশ্য আমার চোখে পড়ে। ব্যাপারটা দেখে বেশ অবাক লাগলো, কারণ বৈশাখ মাসের গরমে এভাবে চাদর মুড়ি দেয়া খুবই বেমানান ব্যাপার। যদিও বৃষ্টি, তবুও এমন কিছু শীত পড়েনি যে একেবারে চাদর মুড়ি দিতে হবে। বুঝলাম লোকগুলোর অন্য উদ্দেশ্য আছে। খুব কৌতূহল হল, আস্তে আস্তে ওদের পিছু নিলাম কি করে দেখার জন্য।
দেখলাম লোকগুলো সেই গোরস্তানের ভিতর যাচ্ছে। আমিও সেদিকে গেলাম। গোরস্তানে বেশ পুরনো মোটা মোটা গাছ ছিলো,সেগুলোর একটার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম কি করে লোকগুলো।
লোকদুটোর মধ্যে একজন কোদাল দিয়ে একটা গর্ত খোঁড়া শুরু করলো। বেশ কিছুক্ষণ খোঁড়ার পর নেমে পড়লো গর্তে। এরপর গর্ত থেকে কিছু হাড় বের করে নিয়ে আসলো।
এরপর দুজন মিলে হাড়গুলো সাজালো। একজন একটা ম্যাচ জ্বালিয়ে আগুন ধরালো হাড়গুলোতে। উপরে গাছপালা ঘন হয়ে ছিলো, তাই বৃষ্টির পানি আগুনে পড়লো না, আগুন জ্বলতে লাগলো।এরপর দুজনে আগুনের দুধারে বসে কি কি মন্ত্র আউরাতে লাগলো।
বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলাম, কিছুই ঘটলো না। বিরক্ত হয়ে চলে যাবো কিনা ভাবছি, এরপরই একটা জিনিস দেখলাম।
একটা লোক তার পাশে রাখা একটা ব্যাগ সামনে নিয়ে আসলো, এতোক্ষণ খেয়াল করিনি ব্যাগটা। এরপর উনি ব্যাগটা খুললেন। ব্যাগের ভেতর থেকে কিছু একটা বের করে নিয়ে আসলেন। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, এক ছোট বাচ্চা। খুবই ছোট, হয়তো কয়েক মাস বয়স। বাচ্চাটা নড়াচড়া করছে না, কিন্তু ওর বুক শ্বাস নেয়ার জন্য ওঠানামা করছে। বুঝলাম হয় বাচ্চাটি ঘুমিয়ে আছে, নাহলে তাকে অজ্ঞান করে রাখা হয়েছে। বাচ্চাটিকে ব্যাগের বাইরে রেখে লোকটা একটা লম্বা ছুরি বের করলেন। এরপর শান দিতে লাগলেন ছুরিতে।
কালো জাদু, প্রেতচর্চা এসব ব্যাপারে কিছু কিছু শুনেছিলাম। ওসবে নাকি নরবলি-টলি দেয়ার ব্যাপার থাকে। কেন যেনো মনে হলো, এটাও তেমন কিছু। এই দুজন লোক বাচ্চাটাকে খুন করবে এখন।
বাচ্চাটাকে বাঁচাতে হলে কিছু করতে হবে, কিন্তু কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। ওরা দুজন লোক, একজনের সাথে আবার ছুরিও আছে, আর এদিকে আমি একা।
এসময় একটা কথা মনে পড়ল। মেলা থেকে কয়েকটা হাউই বাজি কিনেছিলাম, পকেটে আছে এখনো। বাজিগুলো পলিথিনে প্যাঁচানো ছিলো, তাই বৃষ্টিতেও ভিজে নি। একটা বুদ্ধি এলো মাথায়। আমার পাশেই একটা আমগাছ, সেটার একটা মোটা ডাল লোকগুলো যেখানে বসে আছে, তার উপর পর্যন্ত ছড়িয়েছে। আস্তে আস্তে গাছে উঠে পড়লাম। এরপর ডাল বেয়ে বেয়ে লোকগুলো যেখানে রয়েছে তার কাছাকাছি গেলাম। একজন ছুরি ধার দেয়ায় এবং আরেকজন মন্ত্র পড়ায় ব্যস্ত, আমার ডালের উপরে নড়াচড়া হয়তো তাই টের পেলেন না। পকেট থেকে বাজি বের করে ছুড়ে দিলাম আগুনে। বিকট শব্দ হলো, আগুনটাও ঝলসে উঠলো, লোকদুটো দুধারে ছিটকে পড়লেন। আমি এ সুযোগটুকু ছাড়লাম না, ডাল থেকে লাফ দিয়ে নিচে নেমে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম। লোকদুটো চিৎকার করতে করতে আমার পিছু নিলো। কিন্তু ভারি বৃষ্টি আর কাদার মধ্যে আমার সাথে পেরে উঠলো না।
গোরস্তান থেকে বেরিয়ে বেশকিছুটা দূরে চলে এসেছি, আমাদের গ্রামের সীমানায়। আরেকটু সামনে গেলেই হারুনদের বাড়ি। এখন লোকগুলো কিছু করতে পারবে না আমার, নিশ্চিন্ত হয়েই একটা গাছের নিচে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম, বাচ্চাটা আমার কাঁধে ছিলো। ও একটু নড়ে উঠলো, বুঝলাম ঘুম ভেঙেছে। ওকে আমার কোলে নিয়ে আসলাম। কিন্তু ওর দিকে চোখ পড়তেই ভয়ে আমার শরীর হিম হয়ে আসলো।
দেখলাম বাচ্চাটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ওর চোখের মণি নেই, চোখদুটো একদম সাদা। মুখে ধারালো দাঁতের সারি। ওর হাসিটুকু যে কি ভয়ঙকর ছিলো তা যে না দেখেছে তাকে বোঝানো যাবে না।
আমি কোল থেকে ওকে ফেলে দিলাম। ও নিচে না পড়েই সটান দুপায়ে দাঁড়িয়ে গেল। আমি ভয়ে জমে গেছি যেন, কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। এসময়ই লোকদুটো আমার পাশে চলে এলো। বাচ্চাটাকে দেখেই বললো, ‘সর্বনাশ, প্রেতটা জেগে গেছে, ওকে তো মারা যাবে না এখন।’ বাচ্চাটা লোকটার দিকে এক মুহূর্ত তাকালো, তারপর লাফিয়ে উঠে ওর টুঁটি কামড়ে ধরলো। পাশের লোকটা চেষ্টা করলো ওকে ছাড়ানোর, কিন্তু পারলো না। বাচ্চাটা কামড়ে ওর গলা ছিড়ে ফেললো।
আমি আর দাঁড়ালাম না। চিৎকার করতে করতে গ্রামে ঢুকে পড়লাম, এরপর এক দৌড়ে সোজা আমার বাড়িতে। আমার আর কিছু মনে নেই।
সে রাতে আমার প্রচন্ড জ্বর এসেছিলো। তিনদিন ছিলো সেই জ্বর। জ্বর কমলে পরে শুনেছিলাম, গ্রামের বাইরে দুটো লোকের লাশ পাওয়া গেছে ছিন্নভিন্ন অবস্থায়। আমার কাহিনী কেউ বিশ্বাস করলো, কেউ হেসে উড়িয়ে দিলো। পুলিশি তদন্তে বেশ হ্যাপা পোহাতে হলো, তবে ওসব কথা থাক।
যাই হোক, আমার গল্প এটুকুই। এরপর থেকে আর কখনো ঐ মাঠ রাতে একা পার হইনি। এখন তো গ্রামেও থাকি না। তবে গ্রামের লোকজন বলেন, এখনও নাকি গভীর রাতে মাঠটি পার হওয়ার সময় তারা গোরস্তানের ভিতর থেকে কোনো এক ছোট বাচ্চার হাসির শব্দ শুনতে পান।