ক্যালেন্ডার

দরজার ফাঁক গলে কেউ ক্যালেন্ডারটা রেখে গেছে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে ক্যালেন্ডারে কোন কোম্পানির নাম লেখা নেই। ছয় পাতার ক্যালেন্ডার। প্রতি পাতায় পাখির ছবি। প্রথম পাতায় একটা বিশাল বাজ পাখি। এতো জীবন্ত ছবি, মনে হয় এখনই ক্যালেন্ডার থেকে বের হয়ে উড়াল দেবে।
ইমা হাই তুলছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে এখনও ঘুম শেষ হয় নি। সে বলল, কে দিলো ক্যালেন্ডারটা?
সিয়াম বলল, জানি না। ঘুম থেকে উঠে দেখি ড্রয়িং রুমের দরজার সামনে রাখা। দরজার ফাঁক দিয়ে কেউ ভিতরে দিয়েছে। ভালই হলো বছরের কেবল শুরু একটা ক্যালেন্ডার বাসায় থাকা দরকার।
ইমা আর একবার হাই তুলল, হু। তুমি এক কাজ কর ক্যালেন্ডারটা আমাদের বেড রুমে টানিয়ে ফেল। আমি দেখি কি নাস্তা তৈরি করা যায়।
সিয়াম একবার বলতে যাচ্ছিল, বেড রুমে কেনো, ড্রয়িং রুমই তো ভালো। পরে ভেবে দেখল, বেডরুমেও একটা ক্যালেন্ডারের দরকার আছে, অনেকটা সময় তাদের সেখানেই কেটে যায়। সে তাদের বিছানার পাশে ক্যালেন্ডার টা টানিয়ে দিল। আগে থেকেই একটা পেরেক পোঁতা ছিল সেখানে, কাজ সহজ হয়ে গেল।
সেদিন রাতে অফিস থেকে ফিরে রাতের খাবার খেয়ে যখন ঘুমাতে যাবে সিয়াম, তখন ইমা একটা অদ্ভুত কথা বলল, সিয়াম তুমি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ ক্যালেন্ডারের পাখিগুলো কেমন জীবন্ত।
— কি হাস্যকর কথা বলো ইমা। ছবি কেমন করে জীবন্ত হয়? তবে হ্যাঁ ছবিগুলো তুলেছে চমৎকার। মনে হচ্ছে পাখিগুলো আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।
ইমা আর কিছু বলল না। সিয়াম ক্লান্ত ছিল, ঘুমিয়ে গেল তাড়াতাড়ি। অনেক রাতে ইমার ধাক্কায় তার ঘুম ভাঙ্গল।
–সিয়াম সিয়াম। পাখি………
সিয়াম জেগে গেল। ঘরের ভিতর ডিম লাইট জ্বলছে, সে এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছুই দেখল না। ইম তার পাশে বসে কাঁপছে।
—-কি হয়েছে? ভয় পাচ্ছ কেনো? স্বপ্ন দেখেছ?
ইমা ভয়ার্ত গলায় বলল, বুঝতেছি না। মনে হলো দেখলাম ক্যালেন্ডারের ভিতর থেকে একটা পাখি বের হয় উড়ে গেল আমার উপর দিয়ে।
—-আরে ধুর। চুপ করে শুয়ে পড়। দুঃস্বপ্ন দেখেছ।
ইমা মাথা ঝাঁকিয়ে শুয়ে পড়ল উল্টো দিকে মুখ করে। ভয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছে সে।
সিয়ামের ঘুম ভেঙ্গে গেলে ঘুম আসতে সময় লাগে । সে এপাশ ওপাশ করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর তার অস্বস্তি লাগা শুরু হলো। মনে হলো কেউ দেখছে তাকে। অস্বস্তি কাটাতে চোখ খুলে সে চমকে গেল।
ডীম লাইটের আলোয় দেখল একটা বাজ পাখি খাটের উঁচু স্ট্যান্ড এর উপর বসে আছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল শরীর দিয়ে। চোখ বন্ধ করে সিয়াম নিজেকে বলল, হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। ইমার স্বপ্ন তার উপরও চাপ তৈরি করেছে। চোখ খুললেই দেখব কিছু নেই।
সে চোখ খুলল। পাখিটা বসে আছে। জ্বল জ্বল করছে চোখ। সে ঘুরে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালো। পাখির ছবি ওয়ালা পাতাটা সাদা, কিছু নেই সেখানে।
সিয়াম ভয়ে ইমার দিকে ফিরে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেল।
পরদিন সকালে ঘুম ভাংগতেই চোখ গেল ক্যালেন্ডারের দিকে। বড় বাজ পাখিটার ছবি ক্যালেন্ডারে। জীবন্ত অনেকটা। তবু ছবি ওটা। ইমা জেগে আছে। সেও ক্যালেন্ডারটার দিকে তাকিয়ে আছে। সিয়াম ইমার দিকে তাকিয়ে হাসল।
ইমা লজ্জা পেল । বলল, ধুর। স্বপ্নই দেখেছি রাতে। দুইজনই স্বস্তির হাসি হাসল।
রাতে বাসায় ফিরে ঘুমাতে গিয়ে সিয়াম দেখল ইমা দাঁড়িয়ে আছে ক্যলেন্ডারটার দিকে তাকিয়ে।
ইমা বলল, একটা ব্যাপার দেখলাম। ক্যালেন্ডারের ছয় পাতার প্রতি পরের পাতায় দ্বিগুন হয়েছে পাখির সংখ্যা। প্রথম পাতায় একটা বাজ পাখি। দ্বিতীয় পাতায় দুইটা চিল। তৃতীয় পাতায় চারটা শকুন। এই রকম।
সিয়াম হেসে বলল, হু, ভালো কম্বিনেশন। প্রতি পাতায় ডাবল হচ্ছে।
— আর একটা ব্যাপার, সবগুলোই হিংস্র পাখি।
— হু। এই রকম ক্যালেন্ডার কোন কোম্পানী বানালো আর কেই বা দিয়ে গেল আমাদের বাসায় সেটাই বোঝা গেল না।
ইমা বলল, প্রতিটা পাখিই কি জীবন্ত। দেখে মনে হয় এখুনি বের হয়ে আসবে ক্যালেন্ডার থেকে। কেমন অস্বস্তি লাগছে তাকাতে।
সিয়াম বলল, এক কাজ করি এই ক্যালেন্ডার আমাদের বেড রুমে রাখার দরকার নেই। ড্রয়িং রুমে রেখে আসি।
সে ক্যালেন্ডার খুলে নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঝুলিয়ে রেখে এলো। ইমার মুখে স্বস্তি।
সিয়াম ঘুমানোর সময় বেড রুমের দরজা আটকে দিলো। দুই রুমের এই ছোট ফ্ল্যাটে তারা দুইজন ছাড়া কেউ থাকে না। তবু সে তাদের বেডরুমের দরজা আটকে দিলো ।
ইমা মুখ টিপে হেসে বলল, কি পালোয়ান, ভয় পাইতেছ নাকি?
–জ্বী না। আমার জন্য না। তুমি রাত বিরাত ঘুম ভেঙ্গে যাতে আর পাখি দেখতে না পাও সেজন্য ।
–হু বুঝেছি, বীর পুরুষ আমার।
তারা দুইজন হাসাহাসি করে শুয়ে পড়ল। তাদের বিয়ে খুব বেশীদিন হয় নি। সামনের মাসে এক বছর পুর্তি হবে। এখনও গভীর প্রেম চলছে। অল্পতেই খুনসুটিতে মেতে ওঠে দুইজন।
গভীর রাতে ঘুম ভাঙল সিয়ামের। চোখ মেলে দেখল তার পায়ের কাছে আছে একটা কিছু, কালো ছায়ার মতো। নীল ডিম লাইটের আলো চোখে সয়ে আসতে সে দেখতে পেল বিশাল একটা শকুন বসে আছে। অন্ধকারেও জ্বল জ্বল করছে চোখ। খাটের উপরে স্ট্যান্ডে তাকিয়ে বুঝল সেখানে বসে আছে একটা বাজ পাখি।
সিয়াম একবার ভয়ে ভয়ে ঘরের ভিতর তাকালো। আশ্চর্য হয়ে দেখল দেয়ালে ঝুলছে ক্যালেন্ডারটা। অথচ কাল রাতেই নিজ হাতে সেটা ড্রয়িং রুমে লাগিয়ে এসেছে। অথচ এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বেডরুমের দেয়ালে ঝুলছে সেটা। পাখির ছবিগুলো নেই, সাদা সেখানটা। মনে হলো ক্যালেন্ডারটা থেকে প্রত্যকেটা পাখি বের হয়ে এসেছে। সারা ঘরের নানা জায়গায় বসে আছে সেগুলো এখন।
সিয়াম ভয়ার্ত গলায় অস্ফুট শব্দ করে পাশ ফিরল। পাশে ঘুমাচ্ছে ইমা। একটু পর সে আবার চোখ মেলল।
তীক্ষ্ণ চিৎকার করে তার গা ঘেঁষে উড়ে গেল একটা ঈগল। কি তীব্র পাখার ঝটপটানি!
এতো শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেছে ইমার। সে চারপাশে দেখে নিয়ে ভয় পেয়েছে ভীষণ। শক্ত করে সিয়ামকে জড়িয়ে ধরে গোঁ গোঁ করতে লাগল।
সারা রাত পাখিদের ওড়াওড়ির শব্দ পাওয়া গেল। ভোরের দিকে শান্ত হয়ে গেল সব। সকালের রোদ এসে ঘরের ভিতর আলোকিত করার পর সিয়াম উঠল। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখে সেখানে ঝুলছে ক্যালেন্ডারটা। কে আনলে তাকে এই রুমে? ভালো করে দেখল সে। প্রতি পাতায় পাখিগুলো দেখা যাচ্ছে অথচ রাতে সেগুলো ফাঁকা ছিল।
অফিস যাওয়ার পথে সিয়াম ক্যালেন্ডারটা গুটিয়ে হাতে নিল।
ইমা বলল, কি করছ?
—ফেলে দিয়ে আসি। এই যন্ত্রণা রাখার মানে হয় না।
বাসা থেকে বহু দূরের এক ডাস্টবিনে সে ফেলে দিল ক্যালেন্ডারটা।
সেদিন রাতে ফিরতে দেরি হলো সিয়ামের। বাসায় ইমা একা থাকে তাই দ্রুত ফেরার চেষ্টা করে সে। সেদিন পারল না, অফিসে কাজের চাপ অনেক । রাত নয়টার দিকে বাসায় ফিরে দেখে ইমা বসে আছে ড্রয়িং রুমে। সুন্দর করে শাড়ি পরেছে মেয়েটা। এতো চমৎকার লাগছে।
রাতে খেয়ে তারা মুভি দেখতে বসল। আগামীকাল ছুটি, অফিস যাওয়ার তাড়া নেই। নেটফ্লিক্সে চমৎকার একটা থ্রিলার মুভি দেখল তারা। ঘুমাতে গেল অনেক রাতে।
গভীর রাতে তীক্ষ্ণ ‘কী ই ই ই…………… চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গল সিয়ামের। সে জেগে দেখল খাটের উঁচু স্ট্যান্ড থেকে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই বাজ পাখিটা। দেয়ালের দিকে চোখ পড়তেই তার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। সেখানে ঝুলছে ক্যালেন্ডারটা। অথচ সে আজ নিজ হাতে সেটাকে বহুদূরের ডাস্টবিনে ফেলে এসেছে।
রাত বাড়ার সাথে সাথে পাখিদের চিৎকার বেড়ে গেল। সারা ঘর জুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে হিংস্র সব পাখি। ইমা জেগে গেছে। ভয়ে জড়িয়ে ধরে রেখেছে তাকে। পাখিদের মনে হলো আগের দিন থেকে অনেকবেশি ভয়ঙ্কর। কিছু পাখি নীচু হয়ে উড়ে এলো, ঠুকরে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল। ভোর বেলা যখন থামল এই হুটোপুটি তখন ভয়ের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে দুজন।
সকালের দিকে উঠল সিয়াম। দেয়াল থেকে ক্যালেন্ডার খুলে নিয়ে গুটিয়ে ফেলল। ইমা ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, কি করো?
—এটা বিদায় করে আসি।
—কিভাবে? আবার ফিরে আসবে?
–নাহ আসবে না। যেভাবে এসেছে ঠিক সেইভাবে বিদায় করব।
*******
সকালের নাস্তা করছিলেন ফরহাদ সাহেব। তার স্ত্রীর ডাক শুনলেন।
—দেখো, সুন্দর একটা ক্যালেন্ডার। কে যেনো দিয়ে গিয়েছে দরজার ফাঁক দিয়ে।
—কিসের ক্যালেন্ডার?
—পাখির ছবি। অনেক ছবি আছে। আচ্ছা শুনো , এইটা আমি আমাদের বেডরুমে রাখব।
ফরহাদ সাহেব কিছু বললেন না। তার স্ত্রীর বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে, তবু মাঝে মাঝে এমন আহ্লাদি গলায় কথা বলে যে শুনতে অদ্ভুত লাগে। একটা ক্যালেন্ডার বেডরুমে টানাবে এটা এতো গুরুত্ব দিয়ে বলার কি আছে?

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প