ঘুমিয়ে আছে ভালোবাসা

গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে রিকশায় উঠেই বুঝলাম রিকশা চালক আমার বাবা। তিনি একবার আমার দিকে চেয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, কিরে কই নিয়ে যাবো? এইদিকে আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। আব্বার কথা শুনে রূপা একটু নড়চড়ে বসে আমার দিকে মুখ করে বললো, উনি কি তোমাকে চিনে? আমি হ্যা সূচক মাথা নাড়ালাম।
রিকশা থামলো একটা রেস্টুরেন্টের সামনে। রূপা অবাক হয়ে আব্বার দিকে তাকিয়ে বললো,আংকেল আমরাতো এখানে নামবো না। আব্বা গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো, আমি জানি আম্মা! তোমার পাশে যেই গাধাটা বসে আছে সে আমার ছেলে। রূপা এই কথা শুনে আমার দিকে বড়বড় চোখে তাকিয়ে থাকলো।এইদিকে আমি মুখ ফ্যাকাশে করে অন্য দিকে তাকিয়ে আছি। আব্বা আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, চলো রেস্টুরেন্টের ভিতরে যাই।
আব্বা আর রূপা দুইজনেরই মধ্যে ভাব হয়েছে। আব্বা রূপাকে আম্মাজি বলে ডাকে। এইদিকে রূপা আমার সাথে কথা বলা ওফ করে দিয়েছে। সম্পর্কে যাওয়ার আগে আমি রূপাকে বলেছিলাম, এই পৃথিবীতে আমার আপন বলতে আব্বাই আছে, তিনি ছোট একটা চাকরি করেন। কিন্তু তিনি যে রিকশা চালান সেটা আমি বলিনি ভয়ে। রূপাকে আমার করে না পাওয়ার ভয়।
ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে রূপা। যারা উচ্চ বিলাসিতা না করতে পারলেও আইফোনের মতো দামি মোবাইল অনায়াসে কিনতে পারে। রূপা কঠিন মেজাজের মেয়ে। যদি শুনে আমার বাবা রিকশা চালায় তাহলে আমার মতে সে ডাইরেক্ট আমার সাথে সম্পর্ক শেষ করবে, এবং সাথে সাথে ছোটলোকের বাচ্চা বলে পা থেকে দামি ব্রান্ডের জুতা খুলে গালে ঠাস করে বাড়ি বসিয়ে ফেলবে। কিন্তু এতো সাবধানে থাকার পরেও হঠাৎ করেই যেনে গেল। এবং সেইদিন কিনা আব্বা আমাদেরকে রেস্টুরেন্টে খাইয়েছে।
রূপা যে আমার সাথে সম্পর্ক করে সেটা তার পরিবার জেনে গেছে। রূপার বাবা কানাডা প্রবাসি ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করে রেখেছিল রূপাকে না জানিয়ে। ছেলে দেশে আশায় রূপার বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। রূপা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, পর্ব আমি বাসা থেকে চলে এসেছি। আমি চাচ্ছি আজকেই আমরা বিয়ে করে ফেলবো। আমি রূপার দিকে তাকিয়ে আমতাআমতা করছিলাম। রূপা আমার হাত চেপে বললো, আমি তোমার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই পর্ব। তুমি ছোট চাকরি কর তো কী হয়েছে! এতেই আমার চলবে।
আমি আর রূপা বিয়ে করেছি। আব্বা সাথে ছিলেন। কাজী অফিস থেকে বের হতেই রূপা আব্বাকে বললো, আব্বা আজকে সারা শহর আপনার রিকশা দিয়ে ঘুরব। আব্বা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, আচ্ছা আম্মাজি।
আব্বা আর রূপা শব্দ করে হাসছেন, পাশে থাকা রিকশার লোক তাকিয়ে তা দেখছে। এক জায়গায় রিকশা থামিয়ে আব্বা রূপাকে বললেন, চল আম্মাজি তোমারে ফুচকা খাওয়াই। তাঁরা দুইজন চললো। আমি ভ্যাবলার মতো রিকশায় বসে থাকলাম। রাস্তার বামপাশে রিকশা থামিয়ে আব্বা আর রূপা গেছে রাস্তার ডানপাশে ফুচকা খেতে।
আব্বা আর রূপা ফুচকা খেয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। আমি শান্ত চোখে ওঁদের দেখছি। শান্ত চোখ হঠাৎ অশান্ত হয়ে গেল। যখন দেখলাম একটা বড় ট্রাক দুইজনকে আলাদা করে দিয়েছে। রূপা একপাশে ছিটকে পড়েছে, অন্য পাশে আব্বা। আমি চিৎকার দিয়ে তারাতাড়ি রিকশা থেকে নামতেই হোটচ খেয়ে পড়ে গেলাম। চারপাশের লোকজন দৌড়াদৌড়ি করে এসেছে। আমি রূপার কাছে গিয়ে দেখলাম একটু নিশ্বাস নিচ্ছে। আব্বা কোনো নিশ্বাস নিচ্ছে না। মাথা দিয়ে রক্ত বেয়ে পড়ছে। আমি এইসব দেখে মাথা ঘুরিয়ে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
আব্বা আর রূপার কবরটা পাশাপাশি। রূপার বাবা আমাকে ঝাপটে ধরে কাদছে। আমি শান্ত ভঙ্গিতে দুইটা কবর দেখতে লাগলাম। আহ কি শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে দুইজন আমাকে পাহাড় সমান কষ্ট দিয়ে। এই পৃথিবীতে আমি এই দুইজনকেই বেশি ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু আল্লাহ করলেন কী! এই দুইজনকে একসাথেই উঠিয়ে নিলেন।
রূপার বাবার ধারণা আমি পাগল হয়ে গেছি। আমাকে একটা ঘরে ওঁরা বন্ধি করে রেখেছে। আমি নাকি মানুষের সামনে গেলেই চিৎকার দিয়ে উঠে বলি, আমার বাবা আর রূপাকে এনে দিবে? ওঁরা যদি কথার জবাব না দেয় আমি নাকি মারতে যাই ওদের। কিন্তু আমিতো পাগল হইনি। আমি আগের মতোই স্বাভাবিক আছি। ওরা কী এই মনের কথা কখনো জানবে? জানবে কী এই দুইজন মানুষের জন্য আমার মনে কত ভালোবাসা জমা আছে।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প