চুক্তির ছায়া

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার কোন এক গ্রামের এক সাধারণ পরিবার। বাবা নেই, মা আর তিন ভাইবোন মিলে কোনো রকমে সংসার চলে। বড় বোন, নাম তার শিমু, পড়াশোনার প্রতি বরাবরই সিরিয়াস। ভেড়ামারা আর পাবনার মাঝে শুধু রুপপুরের ব্রিজ।তাই আপু পাবনার একটি কলেজে পড়ে, হলে থাকে। প্রতিবার বৃহস্পতিবার ছুটি পেয়ে বাড়ি চলে আসে, শুক্রবার মা’কে সাহায্য করে, আর শনিবার সকালে ফিরে যায়।
গত দুই মাস ধরে সব বদলে গেল।
শুক্রবারে আর আসে না, রবিবার দুপুরে হঠাৎ হঠাৎ এসে আবার তড়িঘড়ি ফিরে যায়। মা প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো পড়াশোনার চাপ। কিন্তু ধীরে ধীরে মা’র চোখে পড়তে থাকে আপার শরীরী কিছু পরিবর্তন—চোখে ক্লান্তি, শরীর ভারী, আচরণে একধরনের পালিয়ে থাকার চেষ্টা।
মা একদিন রেগে গিয়ে চিৎকার করে, “তুই কি করিস রে শিমু? কেন আর শুক্রবার বাড়ি আসিস না?”
শিমু চুপ। মাথা নিচু করে করে থাকে।
তারপর শুরু হয় খোঁজ। মা, আর আমি মিলে লোকজন ধরতে থাকি, কুষ্টিয়া আর রূপপুরে পরিচিত মানুষের কাছে খবর নিতে থাকি।
রাশিয়ানদের কর্মকাণ্ড নিয়ে আগে থেকে কিছুটা জানতাম—ওরা নাকি স্থানীয় মেয়েদের সাথে চুক্তিভিত্তিক বিয়ে করে। ৩ মাস, ৬ মাস বা ৩ বছর পর্যন্ত মেয়াদ হয়। বিনিময়ে মেয়েটিকে দেয় ৫ থেকে ২০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত।
অবশেষে একদিন বাড়িতে এনে অনেক প্রশ্ন, অনেক জেরার, অনেক চাপের মুখে অবশেষে শিমু আপু মুখ খোলে।
বললো—
“হ্যাঁ, আমি ৫ মাসের চুক্তিতে বিয়ে করেছি একজন রাশিয়ান ইঞ্জিনিয়ারকে। ৯ লক্ষ টাকা পেয়েছি। শুক্রবার-শনিবার তার ছুটি থাকে, আমি তখন ওর বাসায় থাকি। বিয়েটা কাগজে-কলমে হলেও সেটাই আমার বাস্তব।”
মা যেন কেঁপে উঠলেন। তার বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে এলো।
“তোর এতটা প্রয়োজন ছিল? আমরা কি এতটা গরিব?”
শিমু বললো, “গরিব বলেই তো মা…। পড়াশোনার খরচ, নিজের স্বপ্ন… আমি শুধু কিছুটা সহায়তা চেয়েছিলাম ভাগ্য থেকে।”
কথা শেষ হওয়ার আগেই মা শিমুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলেন।
সম্মানের ভয়ে কিছুই বাইরের কাউকে বলেননি। ভেতরে ভেতরে পুড়তে থাকেন।
আমাদের পরিবারে এখন এক অদৃশ্য ছায়া—যেটা নাম ধরে ডাকা যায় না, কিন্তু প্রতিদিনকার বাতাসে টের পাওয়া যায়।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প