ঝাপসা চোখে আবছা হয়ে আসা সামনের দৃশ্যগুলোকে আরও একটু পরিস্কার করার জন্যে কয়েকবার চোখের পাতা ফেললাম। আমার মৃতদেহের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আমি। সামান্য দুরে কেমন এক আলুথালু ভঙ্গীতে পুরো শরীর গুটিয়ে পড়ে আছে আমার দেহটা। চেহারাটা প্রায় থেঁতলে গিয়েছে, তবুও আমি এখান থেকে চিনতে পারছি। ওটা আমারই দেহ।
রজত বুঝতে পারলো আমার শরীরের কাঁপুনিটা, আলতো হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অভয় দিলো। আমাদের দুজনের দুইপাশে বাকী সব বন্ধুরা, দাঁড়িয়ে আছে খানিকটা নির্বাক হয়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই খানিকটা বাকরুদ্ধ, সেইসাথে আমাকে কিভাবে স্বান্তনা দেবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা। কেউ কেউ এগিয়ে এসে চেষ্টা করেছে, ঠিক রজতের মতই। কিন্তু গভীরে গোপনে থাকা সত্যিটা যদি কেউ জানতে পারতো তবে স্বান্তনা দেয়ার মত কোনো ভাষা কারও মুখে জোগাতো বলে আমার মনে হয়না।
২.
বছর তিনেক আগে যখন বাবা চাকরী সুত্রে এই শহরে বদলী হয়ে এলেন তখন আমাকেও বছরের ঠিক মাঝে এসে নতুন স্কুলের মাঝারি ক্লাসে পুরোনো সব বই নিয়ে বেঞ্চ দখল করতে হলো। সাধারনত এতটা দামী স্কুলে আমি কখনো পড়িনি কিন্তু সেইবার বাবাকে বাধ্য হয়েই এই স্কুলটা বেছে নিতে হয়েছিলো। অন্য কোন স্কুলে সীট খালি ছিলোনা, বছরের মাঝামাঝি এসে নতুন ছাত্রীকে কেউ উটকো ঝামেলা মনে করলে খুব বেশী দোষ দেয়া যায়না। তাই বাবাকে ব্যাংক থেকে সামান্য ব্যালেন্স কমিয়ে আমার ওই বছরের বাকী পড়াটা নিশ্চিত করার অন্য কোনো উপায় বা পথ খোলা ছিলনা।
প্রথমদিনই পরিচয় হয়েছিলো ফারিয়ার সাথে। আমিই প্রথম গিয়ে ওর বেঞ্চে বসেছিলাম।
“শোনো, এরপরের ক্লাসে যে ম্যাম আসবেন উনি কিন্তু খুব খাড়ুস টাইপ!”
“খাড়ুস! এর মানে কি?” আমি বলেছিলাম।
“আহ্ তুমি খাড়ুস মানে জানোনা! খান্ডারনী টাইপ আর কি!”
আমি চুপ করে গিয়েছিলাম, যদি বলতাম আমি খান্ডারনি মানেও জানিনা তাহলে সম্ভবত আমাদের দোস্তির ওখানেই সমাপ্তি হতো। কিন্তু নতুন ক্লাসে আমি একটা বন্ধু চাই, এবং সবার মাঝে এক পলক তাকিয়ে এই মেয়েটাকেই আমার বন্ধু বানাতে মন চেয়েছে।
“শোনো আমার নাম ফারিয়া। তোমার নাম কি?”
“আমি নাদিয়া। এই স্কুলে আমার আজই প্রথমদিন।”
“সেতো বুঝতেই পারছি। তোমার বাসা কোথায়? আর এইরকম বছরের মাঝেই বা ভর্তি হলে কেন?”
“বাবা সরকারি চাকরি করেন তো, বদলী হয়ে এসেছেন এই শহরে। আমার এইরকম অভ্যাস আছে।”
“তোমরা কোথায় উঠেছো? মানে কোন এলাকায় থাকো?”
“সরকারী কোয়ার্টারেই থাকা হয় সবসময়। রুমগুলো ছোটো হলেও চারদিকে খেলার মাঠ আছে, বেশ খোলামেলা। আমার ভালোই লাগে।”
“আমি আবার কোনোভাবেই ছোটো রুমে থাকতে পারিনা, কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসে।”
“তোমরা কোথায় থাকো?”
আমার এমন প্রশ্নের উত্তরে ফারিয়া যে জায়গাটার নাম বললো তা সম্ভবত পুরো দেশের মাঝেই সবচেয়ে অভিজাত আলিশান এলাকা। অবশ্য স্কুল ইউনিফর্মের মাঝেই ওর চুলের ক্লীপ, জুতো জোড়া, সামনে বেঞ্চে রাখা ব্যাগ বা জ্যামিতি বক্স তাড়স্বরে চিৎকার দিয়ে জানান দিচ্ছিলো যে, ফারিয়া সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেয়া পরিবারের মেয়ে।
সরকারি চাকুরে বাবার আয় রোজগারে মোটামুটি চেষ্টা করে আমরা আমাদের গায়ে মধ্যবিত্তের চাদরটা জড়াতে পারি, কিন্তু তারচেয়ে বেশী কিছু কখনো দাবী করতে পারিনা। সমাজের উচুঁ তলার মানুষগুলোর জীবন বা চাহিদাটা কেমন তা জানতে ইচ্ছে করতো। তাই আরও আগে থেকে আমার বড়লোক মানুষগুলোর প্রতি একটা আগ্রহ কাজ করতো। ইচ্ছে ছিলো, আমার কোনো একদিন একজন বড়লোক বন্ধু হবে। তাই আজ সকালে যখন দেখেছিলাম সবচেয়ে বড় গাড়িটা যেই মেয়েটিকে স্কুলের গেইটে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে, সে আমার ক্লাসেই পড়ে এবং তার পাশের সীটটা খালিই আছে তখন আর দেরী করিনি। বসে পড়েছিলাম। এখন শুধু বন্ধুত্বের অপেক্ষা, দেখা যাক হয় কিনা।
“আচ্ছা তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে?”
ক্লাস এইটে পড়া মেয়ের মুখ থেকে এমন সোজাসুজি প্রশ্ন, তাও ক্লাসের মাঝে শুনব, এমনটা আশা করিনি। আমি মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,
“না তো। কেন, তোমার আছে নাকি?”
“একটু ডানদিকে তাকাও, দুটো কলাম পরে ওই যে ছেলেদের বেঞ্চে ফরসা করে লম্বা ছেলেটা বসে আছে, দেখেছো? ওকে আমি লাভ করি।”
আমি এক নজর দেখলাম সামান্য আড়চোখে। আসলেই ছেলেটা বেশ স্মার্ট, মাথাভরা কেমন রেশমী চুল, ঢুউ খেলে আছে। হাতের ঘড়িটা ঢাউস সাইজের, যেকারোও চোখে পড়বে। সম্ভবত ব্র্যান্ডের। এই ছেলেও নিশ্চিত বড়লোক। আসলে এখানে থাকা সবাই সম্ভবত সমাজের একটা নির্দিষ্ট সীমায় বাস করা উচ্চবিত্ত শ্রেনীর, শুধু আমিই গোত্রছাড়া।
“ও তোমাকে ভালোবাসে?”
“এখনো বাসে না তবে সামনেই বাসবে, নিশ্চিত থাকো।”
“এতটা নিশ্চিত কিভাবে হচ্ছো? আর ও তোমাকেইবা ভালোবাসে না কেন এখনো?”
“এইবার দুটো বেঞ্চ সামনে তাকাও। স্ট্রেইট করা, পাফি, ফোলানো চুলের মেয়েটাকে দেখেছো?”
“ওই যে ওই মেয়েটা? বেশী ফরসা আর বেশ লম্বা মনে হচ্ছে।” আমি বললাম ফারিয়াকে।
“হুম, ওই মেয়েটাই। ও হচ্ছে জেবা। এখন আমার দিকে তাকাও। তুমিই বলো, তুমি ছেলে হলে কাকে পছন্দ করতে?”
“আহ্ হা এইভাবে হয় নাকি! মানলাম জেবা বেশী সুন্দর কিন্তু প্রেম কি শুধু সুন্দর দেখে হয় নাকি।”
“এই তো তুমি একেবারে আমার মনের কথাটা বলেছো। তোমার সাথে আমার জমবে মনে হচ্ছে। কিন্তু জেবাটার ধারণা, ও ওর রুপ দিয়েই মন ভোলাবে। কিন্তু আমিও এত সহজে ছাড়বোনা। ছেলেটার হাতের ঘড়িটা দেখেছো, আমার গিফট দেয়া। আমি ওকে দামী সব উপহার দিয়ে ভোলাবো। তুমি দেখে নিও।”
আমি ঢোক গিললাম, প্রেম শুধু সুন্দর দেখে হয়না এটা বোঝাতে চেয়েছি কিন্তু তাই বলে টাকার গরম দিয়ে প্রেম কেনার বুদ্ধিটা কতটা নির্বুদ্ধিতার লক্ষন তা মনে প্রশ্ন তুললেও সেইটা ফারিয়ার সামনে প্রকাশ করলাম না। ফারিয়া যেহেতু নিজ থেকেই বলেছে, আমাদের মাঝে জমবে বেশ, তাহলে তা আর নষ্ট না করি।
“আচ্ছা তোমার পছন্দের ছেলেটা যে, ওর নাম কি?”
ফারিয়া মুখ খুলতে যাচ্ছিলো এমন সময়ে ওর ভাষায়, আমাদের খাড়ুস ম্যাম ক্লাসে ঢুকলেন।
৩.
তিন বছর আগের আমার নতুন স্কুলের প্রথম দিনের পরে সেইদিনের রাত, বেশ গভীর, বাসার সবাই মানে বাবা মা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি রুমের দরজা বন্ধ করে আমার বিছানার নীচে রাখা ছোট্ট তালা দেয়া ট্রাঙ্কটা খুললাম। ভিতরে থাকা অদ্ভুত নীলচে রঙের চামড়ায় মোড়ানো একটা ডায়েরী হাতে নিলাম। ভিতরের পাতা গুলো বহুল ব্যাবহারে কেমন বিবর্ন হয়ে গিয়েছে। তবুও অনেকগুলো পাতার প্রত্যেকটা অক্ষর আমার মুখস্থ। বছর দুয়েক আগে এমনই একটা রাতের কথা আমার। মনে পড়ে গিয়েছিলো সেইদিন।
সামান্য শীত ঘরের বাইরে, দোচালা কাঠের ঘরের ভিতরটা কিছুটা উষ্ম, রাতের দ্বিপ্রহর পেরিয়েছে, প্রহরের ব্যাপারটা আমি বুঝতাম না। তবে আমার নানী শিখিয়েছিলো আমাকে। কিভাবে কোন কোন লক্ষণ দেখে রাতের প্রহর গুনতে হয়। হারিকেনের টিমটিমে আলোতে অল্প দুরে শুয়ে থাকা মানুষটা আমার নানী। আপন নানী। বলা যায় পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে আপন মানুষ। বহুবার জেদ ধরেছি আমি, এই মানুষটার সাথে এই গ্রামে থাকার জন্যে। কিন্তু আমাকে বড় হতে হবে, জগৎ জয় করতে হবে, সেইজন্যেই শহরে বাবা মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। ভালো স্কুল আর ভালো পরিবেশের আশায়।
ঘরের ভিতরে থাকা একটা বড় তক্ষক ডেকে উঠলো,
নানী চোখ মেললেন।
“নাদিয়া জাইগা আছিস?”
“হ্যা নানুমনি। তোমার শরীরটা এখন একটু ভালো মনে হচ্ছে? সন্ধ্যায় তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।”
“আমার দিন এহন গোনারে নাদু। তুই পাশে আইসা বয়। তোর সাথে আইজ আমার জরুরী কথা আছে।”
আমি কাছে গিয়ে বসতেই আমার হাতে একটা কি যেন ধরিয়ে দিলেন। নিয়ে আলোতে মেলে দেখি একটা পুরোনো ডায়েরী।
“নাদিয়া, তোর বয়স কত হইলো এইবার?”
“নানী, বারো শেষ হয়ে তেরোতে পড়লাম।”
“তোর কি শরীর খারাপ হওয়া শুরু হইছে? মানে মাইয়া থাইকা নারী হইছোস?”
আমি প্রবল লজ্জা পেলাম। নানীর কাছে আমার কোনো কিছুই গোপন নেই কখনো। বরং মাস তিনেক আগে প্রথমবার যেবার হলো, নানীর কাছ থেকেই ভয় আর বিব্রতবোধ তাড়ানোর মন্ত্র পেয়েছিলাম। তবুও এমন আচমকা প্রশ্নে আমি হকচকিয়ে গেলাম। মাথা আর চিবুক নুইয়ে বুকের মাঝে মিশিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।
“তাইলে এই ডায়েরী এখন তুই পড়তে পারবি। তোর জন্যে এই ডায়েরীটা আমি এতদিন আগলায়ে রাখছি।”
আমি হারিকেনের সলতেটা সামান্য বাড়িয়ে দিয়ে পাতা গুলো চোখের সামনে মেলে ধরলাম। কার ডায়েরী এটা! নানীর নিজের নাকি আমার মায়ের? কিংবা অন্য কারও? কয়েকটা পাতা উল্টে নিয়ে হতাশ হলাম। বেশিরভাগ লেখাই তো বিজাতীয় ভাষায়। সেইসাথে প্রচুর নকশা আর আরও কিসব হিজিবিজি লেখা। কিছুই বুঝতে পারলাম না। তাকালাম নানীর দিকে।
“এত সহজে হাল ছাড়লে হইবো! তোরে কিছু সুত্র দিমু কাইল সকালে। এখন থেইকা সারাদিন সারাবেলা এই ডায়েরী নিয়াই পইড়া থাকবি। তয় কারও সামনে না। কাউরে আগ বাড়ায়ে দেখানোর দরকার নাই। তোর জীবন এখন থাইকা, আজ থেইকা পাল্টায়ে গেলো। এই ডায়েরির উপর ভরসা কইরাই বাঁচবি। এইটাই তোরে তোর লক্ষ্যে নিয়া যাইবো।”
কিছু না বুঝেই মাথা ঝাকালাম। জানিনা নানী কিসের লক্ষ্যের কথা বলছে। কোথায় পৌঁছুনোর কথা বলছে।
চোখের সামনে থেকে নানীর ঘরের সেই রাতের দৃশ্যগুলো মুছে যাচ্ছিলো ওই রাতে। গত দুই বছরে আমি ডায়েরির প্রতিটা অক্ষর বুঝতে শিখেছিলাম, অবশ্যই আমার নানীর দেখানো পথ শিখে নিয়ে। আর সম্ভবত আমি আমার প্রথম গন্তব্যের দেখাও পেয়ে গিয়েছিলাম সেইদিন আমার নতুন স্কুলের প্রথম দিনে।
৪.
গত তিন বছরে ফারিয়া আর আমি পুরো স্কুল বা কলেজের মাঝে সবচেয়ে ভালো বন্ধুতে পরিনত হয়েছি। হরিহর আত্মা যাকে বলে। মাধ্যমিক পেরিয়ে এই স্কুলের কলেজ শাখায় আছি আমরা সবাই। আজ কলেজের ফাস্ট টার্মের ডেট দিয়েছে। সবাই আগামী কিছুদিন আড্ডা কম পড়ালেখা নিয়েই বেশী ব্যাস্ত থাকবে।
লেইজার পিরিয়ডে আমি আর ফারিয়া কলেজ বিল্ডিংয়ের সামনের লনে বসে আছি। ঠিক মাথার উপরে কাঠবাদামের একটা গাছ অল্প ছায়া দিচ্ছে।
“ফারিয়া, আমি একটা ম্যাজিক জানি। মানে নতুন শিখেছি। তোকে দেখাতে চাই।”
“তুই আবার ম্যাজিক শিখলে কবে? কি ম্যাজিক, হাতের মাঝে কয়েন গাপ করে দিবি?”
“নাহ্ ওইসব শিশুতোষ ম্যাজিক না। একেবারে ভিন্ন ধরনের। আমার নানীর কাছ থেকে শিখেছিলাম।”
“তাহলে কি ব্ল্যাক ম্যাজিক টাইপ কিছু? ওটা হলে অবশ্য মন্দ হয়না। ওটা দিয়ে তাহলে জেবাকে ভ্যানিশ করে দিতে পারবি?” বলেই ও অট্টহাসি দিলো।
“কেন তুইতো তোর পছন্দের মানুষকে পেয়েই গিয়েছিস, জেবাতো এখন আর তোদের ডিস্টার্ব করেনা।”
“নাহ্ তা করেনা। জাস্ট দুষ্টুমি করলাম। বাদ দে, তুই তোর ম্যাজিক দেখা।”
“এইটা কিন্তু আসলে দেখার না, অনুভব করার বিষয়।”
“সেইটা কিরকম?” ফারিয়া প্রশ্ন করে বুঝতে চাইলো।
“আমি মন্ত্র পড়ে আমাদের দুজনের মাঝের আত্মাটাকে অদল-বদল করে ফেলতে পারবো।”
কিছুক্ষনের জন্যে অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হো হো হাসিতে ভেঙ্গে পড়লো ফারিয়া।
“গুল মারার আর জায়গা পাস নাই, তাই না!”
এমন প্রতিক্রিয়াটা আমার কাছে আশানুরুপই ছিলো। তাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বললাম,
“আয় প্রমান দেই। তোর শরীরে আমি ঢুকে যাবো আর আমার শরীরে তুই। অর্থাৎ ফারিয়ার শরীরে নাদিয়া থাকবে এবং আমার অর্থাৎ নাদিয়ার শরীরে তুই মানে ফারিয়া থাকবি।”
“কর দেখি, পারলে করে দেখা। মন্দ হয়না। একই বাসায় একই বাবা মায়ের সাথে থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাচ্ছি। তারচেয়ে কয়েকদিন তোর বাসায় থেকে আসি, খারাপ হবেনা।”
বলতে বলতে ফারিয়ার ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি বলে দিচ্ছে, ও আমার কথা একবিন্দুও বিশ্বাস করেনি। ওর দোষ নেই, এমন দাবী বিশ্বাস করাটা কষ্টকর।
কিন্তু সেদিন বিকেলে কলেজ থেকে ক্লাস শেষে আমি গিয়ে উঠলাম খুব দামী একটা গাড়িতে, অতি অবশ্যই ফারিয়ার শরীরটাকে ভর করে। ড্রাইভার ফারিয়া ভেবে আমাকে দরজা খুলে দিলো। আর আমারই চোখের সামনে দিয়ে ফারিয়া আমার বাবা মটরসাইকেলের পিছনে বসে চলে গেলো আমার বাড়ির দিকে। বাবার কোনো সমস্যা হচ্ছেনা, বাবাকে ধরে রেখেছে তার মেয়ে নাদিয়ার হাত, শুধু ওই হাতের মালিক এখন ফারিয়া।
৫.
পরের কয়েকটা দিন কল্পলোকের জগতে ভাসলাম আমরা দুজন। আমার অনেকদিনের স্বপ্ন, খুব বড়লোকী জীবন যাপন করবার, তা পুরণ হতে থাকলো আমি ফারিয়ার বাবা মায়ের সাথে তাদের মেয়ে হিসেবেই ডিনার করলাম, লিভিং রুমে টিভি দেখলাম, আড্ডা দিলাম। ধরে নিচ্ছি, আমার মধ্যবিত্ত জীবনের গরীবি যা কিছু ব্যাপার আমি এতদিন ফারিয়ার কাছে গোপন রাখতাম তার সবকিছু ও এই কদিনে জেনে গিয়েছে। আমার ঘরের ফার্নিচারের বেহাল দশা কিংবা বাথরুমের ঢিলা হয়ে যাওয়া প্যাচওয়ালা কল যেটা দিয়ে সারাদিন টপটপ করে পানি পড়ে, এইসবই নিশ্চয়ই ফারিয়ার সামনে এসে ধরা দিয়েছে। ফারিয়ার বেডরুমের সাথে এটাচড বাথরুমের দামী শাওয়ারে ভিজতে ভিজতে আমি এগুলো ভাবতাম।
তবে ওদের বাড়ি বা গাড়ি ব্যাবহারের চেয়েও সবচেয়ে বেশী মজাটা আমি পেতাম কলেজে। ফারিয়া ভীষন বড়লোক আর ওর বাবার কিছুটা রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তির জন্যে ও সবসময় কিছুটা প্রিভিলেজ পেতো, ওটা আমি এই কয়দিন খুব উপভোগ করছি।
আগেও দেখেছি সবাই ফারিয়ার সান্নিধ্যে পেতে চায়, ওর মত ড্রেসের ডিজাইন থেকে শুরু করে ওর প্রতিটা অঙ্গভঙ্গি সবাই কপি করতে চায়। ফারিয়ার শরীরের উপরে কমপক্ষে দশ জোড়া চোখ সারাটাক্ষন লেপটে থাকে। কিছু না করেও ও সত্যিকারের সেলিব্রিটি আমাদের ছোট্ট ক্যাম্পাসে। ফারিয়ার শরীরে আশ্রয় নেয়া এই আমি নাদিয়া, গত কিছুদিন ধরে একই অনুভূতির আবেশ অনুভব করছি প্রতিটা মুহূর্ত। এই অন্যরকম আবেশটা কেমন যেন নেশা ধরানো।
“দোস্তো, কেমন লাগতেছে তোর নতুন জীবন?” ফারিয়ার এমন প্রশ্নে আমি কিছুক্ষণ উদাসী হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
“অন্যরকম বন্ধু। তুই কতটা সুখী জীবন যাপন করিস তা তোর বেডরুমে ঢুকলে বোঝা যায়। অথবা তোকে নিতে আসা প্রাডো গাড়িটার হিমশীতল বাতাসে নিজকে যখন এলিয়ে দেই, তখন তোকে বা তোর ভাগ্যকে সামান্য হিংসে লাগে।”
“কথা সত্যি, প্রিভিলেজ কিছুটা পেয়েছি। তবে তোর জীবনের যে রোমাঞ্চ সেটাও আমার ভালো লাগছে।”
“তাহলে থেকে যা ওভাবেই, আমিও তোর জায়গায় থেকে যাই। কি বলিস?” হাসতে হাসতে বললাম আমি।
“উহ্ হু, ওটা হবার নয়। আমার খুব বেশী আপত্তি ছিলো না। তবে তাহলে তো আমার রজতকে হারাতে হবে।”
“থাক বাবা, তুই তোর রজত আর প্রিভিলেজ নিয়ে থাক। আমরা তাহলে আগামীকাল আমাদের শরীর চেঞ্জ করে নিবো ঠিক আছে? আজ রাতে শেষবারের মত আরাম করে তোর স্নানঘরের বাথটাবে ঘন্টাভর শুয়ে থাকবো।”
বলেই আমি হেসে উঠলাম।
৬.
দুটো লেকচার ক্লাস হয়ে গিয়েছে কিন্তু ফারিয়া মানে নাদিয়ার শরীরটা নিয়ে এখনো কলেজে আসেনি। আমি ফারিয়ার শরীরে আটকে থাকা নাদিয়া সামান্য উৎসুক চোখে ক্লাসরুমের দরজার দিকে ক্ষণে ক্ষণে তাকাচ্ছি। আজ লেইজার পিরিয়ডে আমরা আমাদের যার যার পুরোনো শরীরে অর্থাৎ পুরোনো পরিচয়ে ফিরে যাবো।
কিন্তু ও আজ আসছেনা কেন এখনো?
ঠিক এমন সময় প্রিন্সিপাল সহ বেশ কয়েকজন টীচার দৌড়ে এলেন আমাদের রুমে। ডায়াসে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যাডামের সাথে কিছুক্ষণ ফিসফিস করলেন। তারপর প্রিন্সিপাল স্যার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যা বললেন, তার জন্যে ক্লাসরুমের একজনও প্রস্তুত ছিলোনা। তবে বাকী সবার চমকে যাওয়ার সাথে আমার চমকে যাওয়ার যে অনেক পার্থক্য।
কিছুক্ষণ পরে আমাদের সবাইকে দেখা গেলো কলেজ থেকে মাত্র মাইল খানেক দূরে একটা বড় রাস্তায়। আমি ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছি আমার মৃতদেহের দিকে। পৃথিবীর সবার কাছে ওটা নাদিয়ার মৃতদেহ, আর তার সামনে ফারিয়া দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আমার কাছে ওটা আমারই মৃতদেহ। আমি চিন্তা চেতনে নাদিয়া হয়ে ফারিয়ার শরীরে আটকে থেকে নাদিয়ার মৃতদেহের সামনে দাড়িয়ে আছি। দুইপাশে পড়ে আছে আমার বাবা মায়ের মৃতদেহ। একটা আস্ত ট্রাক আমার বাবা মা এবং ফারিয়াকে বয়ে নিয়ে আসা গোটা সিএনজিটাকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়।
আমার আশেপাশে যেই কয়জন উপস্থিত, সবাই আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। নাদিয়া-ফারিয়ার বন্ধুত্বের খবর সবাই জানে। আমার চোখ ভর্তি তাই জল। রজত পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এই কয়দিন আমি ইচ্ছে করেই রজতের থেকে সামান্য দূরে ছিলাম। রজত তার প্রেমিকা ফারিয়ার কাছে আসতে চেয়েছে বারংবার কিন্তু ওকে কিভাবে বলি, শরীরটা ফারিয়ার হলেও আমি আসলে নাদিয়া।
তবে এখন এই ভয়ঙ্কর, অসম্ভব দুর্ঘটানাটা চাক্ষুষ করার পরে আমার রজতের কাছ থেকে সাপোর্টের বড্ড প্রয়োজন। স্মার্ট এবং চৌকস রজতের কাছ থেকে নিজেকে দুরে সরিয়ে রেখেছিলাম যার জন্যে তার আত্মাটা আমার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে অল্প আগে। তাই এখন রজতের ঘনিষ্ঠ হলে বাধা দেয়ার কেউ নেই, প্রয়োজনও নেই।
ভর সন্ধ্যাকাল, আমি ফারিয়ার ঘরের টানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। এই ঘরে আজ আমার ফিরে আসার কথা ছিলোনা। কিন্তু এসেছি, এবং তা প্রায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মত। অন্তত আমি যতদিন চাইব।
ফারিয়ার বাবা মা এখন থেকে আমার বাবা মা।
তাহলে নানীর প্রতিটা কথাই ঠিক ছিলো। তার হেয়ালী ভরা কথাগুলো অনেক গভীর অর্থে ভরা ছিলো, তখন বুঝিনি। নানীর কথা যদি সত্যি হয় তবে আমি এখন আছি আমার তৃতীয় বাবা মায়ের কাছে। যারা আজ সকালে মারা গেলেন তারা ছিলেন আমার প্রথম পালক বাবা মা। সত্যিকারের বাবা মায়ের চেহারা, না আমি কোনোদিন দেখতে পেয়েছি, না তারা আমাকে দেখতে পেয়েছেন। তার আগেই নানী আমাকে আলাদা করে ফেলেছিলো, সুদুরবর্তী কোনো এক পরিকল্পনায়।
প্রত্যেক নির্দৃষ্ট বয়সের পরপর ডায়েরির কিছু পাতা আমার জন্যে উন্মুক্ত হবে, আমার ক্ষমতায় আরও ডালপালা যোগ হতে থাকবে। ডায়েরীর হিসেব অনুযায়ী আরো পাঁচবার আমার পরিচয় বদলে আমি এই পুরো পৃথিবীর রাজদন্ডের সিংহাসনে বসব! হয়তোবা পুরো বিশ্ব দরবারের অধিপতি বা প্রেসিডেন্ট হয়ে কিংবা কোনো ধর্মগুরু বা বিশাল কোনো ব্যাবসা সম্রাজ্যের সিইও হয়ে এবং এটা অবশ্য ভবিতব্য। কোনো কিছুই এই অমোঘ নিয়তি খন্ডাতে পারবেনা!
আপাতত সব ভুলে গিয়ে আমি নীচের লম্বা লনের দিকে তাকালাম, গাড়ি বারান্দায় অনেক গুলো গাড়ি। সবই নাকি আমাদের। দুজন মালি ঘাস ছেটে দিচ্ছে।
মোবাইলে একটা ফোন কল এলো, তাকিয়ে দেখি রজতের ছবি। ছেলেটা আসলেই রাজপুুত্রের মত দেখতে। ছোটোবেলায় গল্পের বইয়ে পড়তাম, রাজপুত্র অনেক বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে রাজকন্যা সহ অর্ধেক রাজত্ব লাভ করে।
আর আমি আজ একজন সাধারণ কন্যা থেকে রাজপুত্র সহ পুরো রাজত্ব বিনা যুদ্ধেই দখলে নিলাম।