আমার পাশের মানুষটিকে ডেকে তুলব কি না ভাবছি। এমন সময় হঠাৎ মনে হল আমি কারো পায়ের শব্দ শুনলাম! যেন কেউ নিচ থেকে ওপরে উঠে আসছে! অনামিকা বলেছিল রানু ছাড়া বাসার অন্য সহকারীরা নিচে আলাদা থাকে। আর রাতেবেলা কেন কেউ ওপরে আসবে?! আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল! পায়ের শব্দটা আমার ঘর পার হয়ে আরও দূরে চলে গেল! আমার মেরুদন্ড দিয়ে ভয়ের শীতল স্রোত নেমে গেল! হঠাৎই আমি আর কোন শব্দ পেলাম না। এই নিস্তব্ধতাও আমার অসহ্য লাগতে থাকে! আমার বুক ধকধক করছে! এমন সময় আবারও নূপুরের ঝমঝম শব্দ শুনতে পেলাম। আমি আর পারলাম না। চমকে উঠে সজীব সাহেবের হাত খামচে ধরলাম!
নেইল আর্টস করার জন্য নখগুলো বেশ বড় বড় রেখেছিলাম। আমার খামচি খেয়ে সজীব সাহেব ‘উহহ’ করে উঠে বসলেন!
আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করতে গেলেন – পাগল হয়ে গেছ?
কিন্তু তার আগেই আমি ভয়ে ফুঁপিয়ে উঠলাম!
তিনি তড়িঘড়ি করে টেবিল ল্যাম্প জ্বালালেন! এতে অন্ধকারটা কাটল! আমার ভয়ও কিছুটা কমল!
সজীব সাহেব উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন – ভয় পেয়েছ?
আমি কোনমতে মাথা নাড়লাম।
– কিসের শব্দ শুনেছ?
আমি অবাক হয়ে তাকালাম! সে কি করে বুঝল আমি শব্দ শুনেছি?
– ঝমঝম শব্দ? নূপুরের?
আমি আবারও মাথা নাড়লাম!
– এরপর কারো পায়ের শব্দ? নিচ থেকে ওপরে উঠে এসেছে?
– হ্যাঁ!
সজীব সাহেব এবার হাসতে হাসতে বললেন- আর তাতেই তুমি ভয়ে আধমরা হয়ে গেছ?
আমার এবার ভীষণ রাগ হল! আমাকে সে ভীতু বলতে চাইছে! আমি নিজেকে বেশ সাহসী ভাবতাম। একা একা নেটফ্লিক্সের ভূতের মুভিগুলোও রাতে দেখেছি। কিন্তু মনে হচ্ছে আমার সেই সাহস আমার ঢাকার চার কামরার ফ্ল্যাটে ল্যাপটপের স্ক্রীনেই সীমাবদ্ধ ছিল! আজ রাতে এই ভূতের গল্পের বইয়ের মত বাড়িতে ঝমঝম আওয়াজ আমার সাহসের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে!
আমি সজীব সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম – রাতেরবেলা আপনাদের বাসায় নূপুর পরে কে হাঁটে?
সজীব সাহেব চোখে রহস্য ফুটিয়ে বললেন – তোমার কেন মনে হচ্ছে আমাদের বাসায় যারা থাকে তারা সবাই মানুষ?
তার কথা শুনে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে!
– কে..ক..কেন ভ..ভয় দেখাচ্ছেন?
– আমি ভয় দেখাচ্ছি না! সত্যি কথা বলছি! বলেছিলাম না সকালে সব বলব? এখন ঘুমাও!
পাগল নাকি? এই ঘটনার পরে আর ঘুম আসে?
আমার হতবিহ্বলতা দেখে সজীব সাহেব বললেন – রূপরেখা শোন! এগুলো শুনতে শুনতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি! ওদের না ঘাঁটালে ওরাও কিছু করে না!
আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম!
– এই বাসায় থাকতে হলে অনেক সাহসের প্রয়োজন! একসময় থাকতে থাকতে তোমারও অভ্যাস হয়ে যাবে!
ইশশ! মামাবাড়ির আবদার! ‘তোমারও অভ্যাস হয়ে যাবে’- এমন যে আমি এই বাসায় থাকব! আমি তো পরশু বৌভাতের পরেই বিদায়। এখন অবশ্য বৌভাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতেও কোন ইচ্ছা করছে না। আজকের এই ঘটনার পর আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে চাই না। কোন ভূতের সিনেমার নায়িকা হওয়ার ইচ্ছা আমার নেই! একদম না!
সজীব সাহেব জিজ্ঞেস করলেন- ল্যাম্পটা বন্ধ করে দেই রূপরেখা?
আমি আবার ভয় পেলাম! আবার সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যাক ঘরটা আমি সেটা চাই না। আমার মুখ দেখে উনি কি বুঝলেন জানি না!
কিন্তু বললেন – আচ্ছা। জ্বালানো থাক! আমি ওয়াশরুম থেকে আসি!
আমি প্রায় চিৎকার দিয়ে বললাম- নাআ! একদম আমাকে রেখে যাবেন না!
সজীব সাহেব মৃদু হেসে বললেন – ওরে আমার সাহসী রে!
আমি এবার পুরোপুরি রেগে গিয়ে বললাম – শুনুন আমার আসলেই অনেক সাহস!
ঠোঁট টিপে হেসে সজীব সাহেব বললেন – সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি!
– আমার সাহস আছে। কিন্তু এই ভূতের বাড়ির মধ্যে আমি সেটা প্রমাণ করতে যাব না। এমন না যে আপনি আমার বন্ধু আর আমি আপনার সাথে বেট ধরেছি!
আমার কথা শুনে সজীব সাহেব হেসে দিয়ে বললেন – তুমি খুব মজা করে কথা বল! আচ্ছা তুমি ঘুমাও! আমি পরে যাব!
আমার যে আর ঘুম আসবে না সে ব্যাপারে আমি একশ ভাগ নিশ্চিত! তবুও চোখ বন্ধ করে শুলাম! ঘুরেফিরে শুধু এই ঘটনার কথাই মনে পড়ছে। মনটাকে অন্যদিকে কনভার্ট করতে হবে। তুষারের কথা ভাবা যায়। রাতের পর রাত গেছে আমি তুষারের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়েছি। রাতের পর রাত আমি তার সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে ঘুমায়ইনি! কত গল্প ছিল আমাদের!
তুষার বলতো- আচ্ছা রূপ রাখি! রাত হয়েছে!
বলেই সে একটা নতুন টপিক শুরু করত- ও! ওই কথাটা তো বলিনি! শোন সেদিন রাজুকে দেখলাম…
আহা! কি মধুর ছিল সেইদিনগুলো!
তুষার আমাকে প্রপোজ করেছিল একটা কাশবনে! না কোন আংটি বা গোলাপ দিয়ে নয়।
সে হুট করে মাটিতে বসে একজোড়া নূপুর আমার পায়ে পরিয়ে বলেছিল- আমাকে ভালবাসলে এটা কাল পরে আসবে। আর না বাসলে পরবে না!
আমি চমকে উঠলাম! আমার চিন্তাটা আবার নূপুর কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে! আর এই কথাটা মাথায় এতেই মনে হল আমি আবার নূপুরের শব্দ পেলাম! আরে এ তো মহা জ্বালা হল! আমি কি আসলেই শব্দটা শুনছি নাকি নূপুর নিয়ে চিন্তা করছি বলে এরকম মনে হচ্ছে? আমি আবার উঠে বসলাম। আমার পাশের মানুষটি আবার যথারীতি নাক ডাকতে শুরু করেছে। অসহ্য! গোঁফ ধরে টান দেব নাকি? আমি কান খাড়া করে রাখলাম! এবং সত্যি আমি আবার নূপুরের শব্দ শুনলাম! আমার মনে হচ্ছে চিৎকার করে আমি এই বাসা থেকে পালিয়ে যাই! কিছুক্ষণ ভয়ে ভয়ে চুপচাপ বসে থাকার পর মনে হল আওয়াজটা আর হচ্ছে না। সারারাত আমার আতংকের মধ্যে কাটল! আমার যখনই একটু নিদ্রাভাব হয় তখনই মনে হয় এই বুঝি শব্দ এল! শব্দটা যেন মাথায় ঢুকে গেছে!
সকালে ফজরের আজানের পর আমি ঘুমালাম! সজীব সাহেবের ঘুমও আজানের সময় ভাঙল!
আমার দিকে তাকিয়ে বলে- এবার ঘুমাও!
আমি মনে মনে বললাম- অবশ্যই ঘুমাব এবং দশটার আগে উঠব না! আমি এই বাসায় মানসিক অত্যাচারেই মারা যাব!
সজীব সাহেব নামাজ পরার প্রস্তুতি নিলেন। আমি সেসব দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেলাম।
একসময় টের পেলাম অনেক দূর থেকে কেউ আমাকে ডাকছে- রূপরেখা! এই যে রূপরেখা!
আমি চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি সজীব সাহেব!
আমি ঘুম ঘুম চোখে বিরক্ত হয়ে বললাম – কি?
– ছয়টা বাজে!
– তো?
– উঠতে হবে। কিছু করার নেই। আমাদের এখানে সাড়ে সাতটায় নাস্তা দেয়!
আমার এত মেজাজ খারাপ হল যে বলার নয়! এটা কি হোস্টেল নাকি? নাকি জেলখানা! আমার তো এটাকে জেলখানাই মনে হচ্ছে। আর গিন্নীমা হলেন সেই জেলখানার পাহারাদার পুলিশ! সজীব সাহেব তার চ্যালা!
– ওঠ রূপরেখা!
আমি কঠিন গলায় বললাম- আমি উঠব না। না না না। দশটার আগে আমি বিছানা ছাড়ব না।
এই বলে আমি আবার ঘুমিয়ে গেলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর যা হল সেটার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না! আমার ওপর আমি হঠাৎই ঠান্ডা পানি টের পেলাম! আমি লাফ দিয়ে উঠলাম! উঠে দেখি সজীব সাহেব হাতে পানির মগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেলাম!
উনি বললেন – স্যরি! আমার আর কোন উপায় ছিল না! তুমি এছাড়া উঠছিলে না!
আমি ঠান্ডা চোখে এই লোকটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার বাবা কেন এই ভিলেন টাইপের মানুষটার গলায় আমাকে ঝুলিয়ে দিলেন!
– চেঞ্জ করে নাও। হাতমুখ ধুয়ে এসো!
আমার ইচ্ছা করল আমি সত্যি এবার তার গোঁফ টান মেরে ছিঁড়ে দেই! হাতটা বাড়িয়েও দিয়েছিলাম কিন্তু তখনই কেউ নক করল! আমার শ্বাশুড়ি মায়ের গলা পেলাম! সজীব সাহেব দরজা খুলতে গেলেন আর আমি ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম! ওয়াশরুম থেকেই শ্বাশুড়িমা আর রানুর গলা পেলাম। আমি বের হয়ে দেখি এলাহি কারবার! বিছানার ওপর অর্ধেক জুড়ে শাড়ি গহনা রাখা!
সজীব সাহেব বললেন – মা এই গোলাপি শাড়িটা আর গহনাগাঁটি পরে তৈরি হতে বলেছেন।
আমি এতক্ষণ পরে মুখ খুললাম- আমি একা একা শাড়ি পরতে পারি না। আপনি ভাবীকে ডেকে দিন!
সজীব সাহেব চমকে উঠে বললেন – না না না না না! এটা করা যাবে না!
– মানেহ? করা যাবে না মানে টা কি?
– রূপরেখা শোন। তুমি যে শাড়ি পরতে পারো না এই কথা যদি বাইরে যায় তাহলে কি হবে বুঝতে পারছ?
আমি মাথা নেড়ে বললাম – না বুঝতে পারছি না! কি হবে?
– গিন্নীমা অনেক রাগ করবেন!
– আশ্চর্য! এতে রাগ করার কি আছে? আমি শহরে বড় হয়েছি! আমার আম্মুকেই আমি সেভাবে শাড়ি পরতে দেখিনি কোন অনুষ্ঠান ছাড়া! সেখানে আপনার গিন্নীমা আশা করছেন আমি একা শাড়ি পরব! এত নাক উঁচু যখন তখন আমাকে আনতে গেলেন কেন বৌ করে?
কথাগুলো বেশ জোরে জোরেই বললাম!
সজীব সাহেব হঠাৎই আমার মুখ চেপে ধরে বলে- আস্তে! তুমি তো আমারও বারোটা বাজিয়ে দেবে! তোমার জন্য আমাকে কথা শুনতে হবে!
আমি সাথে সাথে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম – ভাবীকে ডাকুন!
– স্যরি! এটা সম্ভব না!
– ঠিক আছে। আমিই ডেকে নিয়ে আসি!
আমি পা বাড়াতেই সজীব সাহেব আমাকে হাত ধরে টান দিয়ে ভেতরে নিয়ে আসলেন!
– পাগল হয়ে গেছ নাকি? নতুন বৌ এভাবে বের হয়?
আমি মাথা ধরে বললাম – উফফ! আমি আসলেই পাগল হয়ে গেছি! আপনাদের এই ভূতুড়ে বাড়ি এবং সেই বাড়ির এই আশ্চর্য নিয়মকানুন আমার মাথাটাই খারাপ করে দিচ্ছে!
সজীব সাহেব বললেন – দুইটা উপায় আছে। এক হল আমি তোমাকে শাড়ি পরিয়ে দেই আর দুই হল..
সে দুই নাম্বার বলার আগেই আমি ফেটে পরলাম! এক নাম্বার অপশন শুনেই আমার মাথায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে!
আমি তার পাঞ্জাবির গলা খামচে ধরলাম- এত্ত বড় সাহস আপনার!
সজীব সাহেব প্রথমে চমকে গেলেন!
এরপর আমার হাত ছাড়িয়ে মোবাইলে কিছু একটা করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বললেন – আর এটা দ্বিতীয় অপশন!
রাগে আমার মুখ লাল হয়ে গেছে। আমি মোবাইলে তাকিয়ে দেখি উনি ইউটিউবে শাড়ি পরার টিউটোরিয়াল বের করেছেন। বাইরে থেকে আবার নক পেলাম।
সে সাথে রানুর গলাও পেলাম- বৌমনি তাড়াতাড়ি আসেন একটু!
আমি এবার বললাম – বাইরে যান। আমি শাড়ি পরব। আর ভেতর থেকে লক করে যান।
টিউটোরিয়াল দেখে শাড়ি পরতে লাগলাম আর সেই সাথে বাবাকে দোষারোপ করতে লাগলাম। একটা পাগলাগারদে আমাকে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য! কুঁচি পর্যন্ত আসতেই আমার অনেক সময় লেগে গেল। আর এরপর আমি কুঁচি কিছুতেই ঠিক করতে পারলাম না! আমি কুঁচি দিতে নাস্তানাবুদ হচ্ছি আর হঠাৎই আমি আমার সামনে একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখলাম! চমকে তাকিয়ে দেখি গেটের সামনেই ছয় সাত বছরের বাচ্চা মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে! দুইটা ঝুটি করে রেখেছে। এই মেয়েটি এখানে কি করে আসলো? কে এটা? আর তার চেয়েও বড় কথা মেয়েটা এখানে ঢুকেছে মানেই সজীব সাহেব গেট লক করে যাননি! গাধা টাইপের লোক তো! এই মেয়েটার জায়গায় অন্য কেউ চলে এলে কি হত? মেয়েটার চেহারার সাথে কার চেহারার যেন মিল আছে ঠিক বুঝতে পারলাম না!
আমি যথেষ্ট বিরক্ত হয়েই বললাম – কে তুমি? আর জিজ্ঞেস না করে ভেতরে ঢুকেছ কেন?
মেয়েটা উত্তর না দিয়ে ফিক করে হেসে দেয়। তার একটা দাঁত নেই!
হঠাৎই আমার ফোনটা বেজে ওঠে! আমি পেছন ফিরে মোবাইলটা হাতে নিয়ে সামনে ঘুরতেই দেখি মেয়েটা নেই! গায়েব! আশ্চর্য তো! মেয়েটা ঘরে ঢুকল তখনও আমি দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম না। সে যে বেরিয়ে গেল তখনও পেলাম না! ব্যাপারটা কি?
আর এবার সত্যিই আমার শ্বাশুড়ির গলা পেলাম – নতুন বৌ হয়েছে?
আমার আম্মু ফোন করেছিলেন। কিন্তু আমি রিসিভ না করে তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুললাম। সজীব সাহেব যাই বলুক না কেন কেউ সাহায্য না করলে আজ আর আমার শাড়ি পরা হবে না! দরজাটা খুলতে গিয়ে আমি আরেকটা ধাক্কা খেলাম! দরজাটা ভেতর থেকে লক করা! আমি পুরো হা করে তাকিয়ে রইলাম! গেট খুলেও আমি অবাক হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছি!
মা জিজ্ঞেস করলেন – কি হয়েছে নতুন বৌ?
– না মানে.. মা আপনাকে কি কেউ আসতে বলেছে? কোন বাচ্চা?
– বাচ্চা?! না আমি তো এমনি দেরি দেখে দেখতে এলাম।
মা অবাক হয়ে বললেন – আমাদের বাসায় তো কোন বাচ্চা নেই!
বলার সময় তার কণ্ঠটা একটু উদাস হয়ে গেল আমি খেয়াল করলাম!
তিনি জিজ্ঞেস করেন- কেন? তুমি কি কাউকে দেখেছ?
আমি মাথা নেড়ে বললাম – নাহ! কিছু না! আমি শাড়িটা ঠিক করতে পারছি না।
আমার শ্বাশুড়ি হেসে বললেন- আমি করে দিচ্ছি!
বাচ্চাটাকে দেখার ব্যাপারটা চেপে গেলাম! হয়তো কোন কাজের মানুষের বাচ্চা ওপরে উঠেছিল- এইটা ভেবে মনকে বুঝ দিলাম! কিন্তু দরজার লকের ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না!
শাড়ি পরা হয়ে গেলে আমাকে গহনা পরতে বলে আমার শ্বাশুড়ি চলে গেলেন। আমি গলার বড় সেটটা পরছিলাম আর তখনই আমি বাচ্চাদের হাসির আওয়াজ পেলাম! আমি পেছনে ঘুরে দেখি এবার একটা ছোট ছেলে! তার চেহারাটা দেখতে মেয়ে বাচ্চাটার মতই। জমজ ভাই-বোন নাকি? কিন্তু হলেও ওরা কে? আর কেনই বা ভেতরে ঢুকছে? ছেলেটাও মেয়েটার মত ফিক করে হেসে বেরিয়ে গেল। তার সামনের দুইটা দাঁত ফোকলা! এবার সে দরজা খুলেই বের হল।
আমি হারটা রেখে ‘এই ছেলে দাঁড়াও’- বলে বের হলাম! ওমা! বের হয়ে দেখি কোথাও কেউ নেই! আচ্ছা আমি কি পাগল টাগল হয়ে যাচ্ছি নাকি? হ্যালুসিনেশন নয় তো?
হঠাৎই পেছন থেকে একটা ডাক পেলাম- নতুন বৌ!
ঘুরে তাকিয়ে দেখি গিন্নীমা দাঁড়িয়ে আছেন! কি প্রখর তার দৃষ্টি! তার দৃষ্টি দিয়ে তিনি আমাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলেন। এরপর এগিয়ে এসে আমার মাথায় ঘোমটা তুলে দিলেন!
থমথমে গলায় তিনি বললেন – সকালে উঠে গোসল করনি, মাথায় কাপড় নেই, হাত-কান-গলা খালি! গহনা পরনি! এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছ! কেন? এটা কি কোন নতুন বৌ-এর মত কারবার?
আমি কি বলব বুঝতে পারছি না। উনার কথা বলায় এমন কিছু একটা আছে যে আমি সহসাই কোন উত্তর দিতে পারলাম না!
আমি কিছু বলার আগেই নিচ থেকে সজীব সাহেব উঠে এলেন।
আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন – গিন্নীমা আসসালামু আলাইকুম। ও আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা চেয়েছিলাম সকালে একসাথে আপনাকে সালাম করতে! আসলে আপনাকে খুঁজতেই বের হয়েছে..
গিন্নীমা বললেন – এভাবে?
– ও বুঝতে পারেনি গিন্নীমা। ওর পক্ষ থেকে আমি মাফ চাইছি!
গিন্নীমা কোন কথা বললেন না।
সজীব সাহেব আমাকে বললেন – এসো। সালাম করি!
আমি সব ব্যাপার দেখে এতটাই শকড যে আমি কথা বলতেই ভুলে গেছি!
গিন্নীমা বললেন – যাও! আর পনের মিনিটের মধ্যে নিচে এসো।
রুমের ভেতরে ঢুকে দরজাটা আটকে সজীব সাহেব বললেন – সমস্যাটা কি তোমার? শাড়ি পরেই বেরিয়ে গেছ কেন? গয়না পরনি কেন? মাথায় কাপড় দেওনি কেন? তোমাকে না বলে গেলাম?
আমিও সমান তেজে বললাম – গোসল করার কথা বলেছিলেন?
সজীব সাহেব আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে বলে- না! আসলে অনেক বছর বাসায় নতুন বৌ আসেনি তো তাই মনে ছিল না! কিন্তু বাইরে কেন গিয়েছিলে?
পুরো ঘটনা মনে পড়ল! এটা তাকে বলব কিন্তু এখন সময় নেই।
আমি হঠাৎই তাকে জিজ্ঞেস করলাম- আচ্ছা আপনি কি করে জানলেন শাড়ি কিভাবে পরাতে হয়?
আমার প্রশ্নটা শুনে উনার হাস্যজ্বল মুখটা হঠাৎ থমথমে হয়ে গেল!
বেশ রাগ হয়েই সে উত্তর দিল – সন জানতে চেও না। সবকিছু তোমার না জানলেও চলবে!
সে হনহন করে বেরিয়ে গেল! আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম! কি এমন বলেছি আমি? বেহুদা এত রাগ করল!
সাজসজ্জা শেষ করে বের হলাম। সেখানে অনামিকা আর আমার শ্বাশুড়িকে দেখলাম।
– চল চাচী যাই।
ডাইনিং টেবিলে গিয়ে আমার মাথা ঘুরে পড়ে যাবার দশা হলো! বিশাল বড় টেবিলের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত জুড়ে দুনিয়ার সব আইটেম!
– বস মা।
ভাবীকে দেখলাম।
আমার হাত ধরে বললেন – বস নতুন বৌ।
ভাবীর চুড়িগুলোর ফাঁকে হঠাৎই চোখ গেল। হাতে কেমন কালশিটে পড়ে আছে!
আমি জিজ্ঞেস করলাম- ভাবী কি হয়েছে আপনার হাতে?
ভাবী হাতটা তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেলে বলে- না না কিছু না! তুমি বস!
সবাই আসল। এরপর গিন্নীমা এলেন। উনাকে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে গেল! উনি এসে বসার ইশারা করলেন। আমিও এবার সবার সাথে সজীব সাহেবের পাশে বসলাম! আমার আজকাল মনে হচ্ছে আমি কোন গল্পের নায়িকা!
সবাই খাওয়া শুরু করল। কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখলাম গিন্নীমা কিচ্ছু খেলেন না। তিনি চুপচাপ বসে রইলেন। আমি আশেপাশে সবার দিকে তাকালাম। কারো কোনো সমস্যা নেই। তার মানে গিন্নীমা সবার সাথে খান না। কিন্তু কেন? জিজ্ঞেস করব কি না ভেবে জিজ্ঞেস না করাই সমীচীন মনে করলাম। পরে অনামিকাকে জিজ্ঞেস করব।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হল।
গিন্নীমা আমাকে বললেন – নতুন বৌ! তুমি বাড়ি ঘুরে দেখ। এরপরে গোসল করে রেডি হয়ে থেক। সবাই আসবে তোমাকে দেখতে!
এ তো ভীষণ অসহ্য ব্যাপার হল!
অনামিকা বলল- চাচী চল! তোমাকে বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাই!
আগে ওপর থেকে শুরু করি। এসো।
ওপরে ওঠার সময় দেখি রানু গিন্নীমার জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছে। আমি ভীষণ অবাক হলাম! উনি একা মানুষ তার জন্য এত বেশি খাবার! তাও নাহয় ঠিক আছে কিন্তু খাওয়ার প্লেট দুইটা কেন?!
আমি অবাক হয়ে অনামিকাকে জিজ্ঞেস করলাম- আচ্ছা গিন্নীমা সবার সাথে খান না কেন?
– আরে! পাগল মহিলা মনে হয়! বাদ দাও তো! একাই খায়, সাথে দুই-তিনটা প্লেট নেয়!
ওর উত্তর শুনে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না!
ওপরে উঠে অনামিকা একদিকের সব ঘুরিয়ে দেখাল। এটা গিন্নীমার ঘর, এটা দাদীর রুম.. এরপর সে নিচে যেতে নিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম- কি হল? ওইদিকটা গেলাম না যে?
– এই এই চাচী! ওদিক ভুলেও যাবে না!
– কেন?
– ওইপাশে যাওয়া নিষেধ!
– কেন? কি আছে ওখানে?
– একেকজন একেকটা বলে। কেউ বলে পিশাচ, কেউ বলে জ্বিন, ভূত, আত্মা! আসলটা জানি না। ওইদিকে দুইটা রুম আছে। ওইরুম দুটোর দরজা একেবারে বন্ধ করা! তবুও যাওয়া নিষেধ! তোমাকে রাতে বললাম না একা যেও না? অনেকসময় অনেক আওয়াজ আসে ওই রুমগুলো থেকে! গতরাতের কথা মনে হয়ে আমার আমার গায়ে কাঁটা দিল!
– এসো নিচে যাই!
অনামিকা ঘুরতেই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম!
– তোমার কোন ভাইবোন আছে অনামিকা?
সে অবাক হয়ে বলে- তোমাকে কে বলল?
– মানে আছে। কোথায় তারা?
অনামিকা মাথা নেড়ে ধরা গলায় বলল – নেই। তবে ছিল। জমজ ভাইবোন ছিল!
– নেই মানে? কো..কোথায়?
– জানি না! ছয় বছর ছিল ওদের।
– তার মানে?
– চাচী ওরা এই বন্ধ দরজার কাছে গিয়েছিল। ছয় বছর আগের কথা এটা! ওইপাশে গিয়েছিল। এরপর থেকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি! পুরো গ্রাম খোঁজা হয়েছে। ওদের স্যান্ডেল রুমের বাইরে পাওয়া গেছে! কিন্তু ওরা ছিল না! হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন! ওরা অনেক কিউট ছিল। অণুর একটা দাঁত পড়ে গিয়েছিল। ও সবসময় দুইঝুটি করে থাকত আর ইমরানের দুইটা! ওরা আর ফিরে আসেনি। সবাই বলে ওই রুমের ওই খারাপ জিনিসটা ওদের খেয়ে ফেলেছে। তাই তো ওই জিনিসটাকে ঘাঁটাতে হয় না!
অনামিকা আরও কি কি যেন বলছিল! কিন্তু আমার কান দিয়ে কিচ্ছু ঢুকল না! ওই বাচ্চা দুটো যে আমি সত্যি দেখেছি এবং কিছুই যে আমার হ্যালুসিনেশন নয় সেটা বুঝতে পারলাম। কিন্তু ওরা যদি হারিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে এখানে এল কি করে? আমার মেরুদন্ড দিয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত নেমে গেল!