দরজার ওপাশে(পর্ব ৪)

আমি দিশেহারা হয়ে মাটিতেই বসে পড়লাম। এরপর দুইহাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। আমার আর কোন আশা নেই, ভরসা নেই। আমার বাবা-মাই আমাকে রেখে চলে গেছেন। তারাই আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন। কেন আমার সাথে এই আচরণ তারা করছেন? আমি কি এমন অপরাধ করেছি? কতক্ষণ এভাবে কেঁদেছি আমি জানি না। হঠাৎ আমার কাঁধে কারো স্পর্শ টের পেলাম। মাথা ঘুরিয়ে দেখি সজীব সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। উনি আমাকে ধরে দাঁড় করালেন।
এরপর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন – তুমি এখানে এভাবে বসে কাঁদছ কেন রূপরেখা?
আমি হিসহিস করে বললাম – আপনি। আপনি সব নষ্টের গোড়া! আপনি ইচ্ছা করে আমাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছেন।
সজীব সাহেব বললেন – আমি জানতাম না ওইটা কিসের ওষুধ। বিশ্বাস কর ডাক্তার ওই ওষুধটাই দিয়েছিল।
আমি পাত্তা না দিয়ে বলতে লাগলাম- আপনি আর আপনার গিন্নীমা.. না..না.. আসলে আপনাদের পুরো পরিবারই ফালতু। আপনারা জোর করে আমাকে আটকে রেখেছেন। এই ভূতের বাসায় আমি থাকব না। থাকব না- আমি চিৎকার করে উঠলাম!
আমার চিৎকার চেঁচামেচিতে ভাইয়া, ভাবী, অনামিক চলে এল।
ভাইয়া বিরক্ত হয়ে বললেন – এসব কি সজীব? বাড়ির বৌ এভাবে সিন ক্রিয়েট করছে কেন? সবাই কি ভাববে? এই বাড়ির একটা সম্মান আছে।
আমি চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম – সম্মান মাই ফুট! ছয় বছর আগে কি হয়েছিল? বলুন কি হয়েছিল? আপনারা কি এমন করেছিলেন যে দরজা বন্ধ করে দিতে হয়েছে?
সাথে আমি বলতে যাচ্ছিলাম- কি এমন করেছিলেন যার জন্য ভূত আমাকে দেখা দিচ্ছে?
কিন্তু এটা বলার আগেই আমি আবার সেই মেয়েটাকে দেখলাম। সে মাথা নেড়ে আমাকে নিষেধ করল এই কথাটা বলতে! আমি হা করে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে সজীব সাহেবও সেদিকে তাকালেন। কিন্তু কিছু দেখলেন বলে মনে হল না।
ভাইয়াও চিৎকার করে বললেন – কি বেয়াদব মেয়েরে বাবা! ভাসুরের মুখে মুখে এভাবে তর্ক করছে! সজীব!! এসব কি?
আমি আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলাম সজীব সাহেব তার আগেই আমার মুখ চেপে ধরে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমি ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে লাগলাম! কিন্তু উনি খুবই শক্ত করে ধরে রেখেছেন। রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে তবেই উনি আমার মুখ ছাড়লেন।
এরপর বললেন – এবার বল! কি সমস্যা? কি হয়েছে? এরকম আচরণ করছ কেন?
আমার সব রাগ তার ওপর গিয়ে পড়ে। আমি কথা নেই বার্তা নেই সজীব সাহেবের হাত ধরে জোরে একটা কামড় বসিয়ে দিলাম!
সজীব সাহেব ‘আঁউ’ করে চিৎকার করে উঠলেন।
আমার দিকে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন – রূপরেখা তুমি কি পাগল?
তারপর দরজা খুলে বের হয়ে গেলেন। আমি দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ চিৎকার করে কাঁদলাম। মা, ভাবী আর অনামিকা কতক্ষণ ডাকাডাকি করল। আমি পাত্তা দিলাম না। কান্নাকাটি করে যখন একটু হালকা লাগল আমি তখন তুষারকে ফোন দিলাম।
– হ্যাঁ রূপ! তুমি এসেছ?
আমার কথা শুনে তুষার হতভম্ব হয়ে গেল!
– এটা তো অন্যায় রূপরেখা! উনারা তো এভাবে তোমাকে আটকে রাখতে পারেন না। সেই অধিকার উনাদের নেই।
– কোন লাভ নেই তুষার। ওরা জমিদার!
– জমিদার বলেই কি যা ইচ্ছা তাই করবে? তুমি ব্যাগ গোছাও। আমি কালকে তোমাকে নিতে আসব।
খুশিতে আমার চোখে পানি এসে গেল!
– সত্যি? তুমি কাল আমাকে সত্যি নিয়ে যাবে এই বাসা থেকে?
– অবশ্যই সত্যি! একটা চান্স পাওয়া মাত্র বেরিয়ে যাব।
– থ্যাঙ্কিউ।
আরো কিছু বলার আগেই সজীব সাহেব এসে পড়লেন।
আমি বললাম – আমি রাখছি। পরে কথা বলব।
সজীব সাহেব রুমে ঢুকে আমার দিকে একবারও তাকালেন না। তার হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা দেখলাম। আমি এখন মাথা ঠান্ডা করে বুঝতে পারলাম ঝোঁকের বশে উনাকে কামড় দেওয়াটা খুবই অন্যায় হয়েছে। এই বাসায় কেউ যদি আমার কেয়ার করে থাকে সেটা প্রথমটাই সজীব সাহেব। এরপর মা। আর আমি প্রায় সময়ই তার সাথে খ্যাচম্যাচ করি। কিন্তু উনি একবারও পাল্টা জবাব দেন না। কখনো খারাপ ব্যবহার করলেও মাফ চেয়ে নেন।
আমি এবার নিজেই জিজ্ঞেস করলাম- আপনার কি বেশি লেগেছে?
উনি চোখ তুলে আমার দিকে একটা ঠান্ডা দৃষ্টি দিয়ে আবার বের হয়ে গেলেন।
বিষয়টা ঠিক হল না। আমি এবার ভাবতে লাগলাম। এই বাসায় ছয় বছর আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনার পর এই বাসায় কোন ভূত এসেছে। আর দুইজন বাচ্চা হারিয়ে গেছে। ধরে নিলাম তারা মারা গেছে। অনামিকার ভাষ্যমতে ওই বন্ধ রুমের ভূত বাচ্চাগুলোকে ধরে নিয়ে গেছে। সেই ভূতদের না ঘাঁটালে ওরাও কিছু করে না। কিন্তু আমি তো পুরো উল্টো বিষয় দেখছি। আমি দুইটা বাচ্চাকে দেখতে পাচ্ছি। ওদের আর কেউ দেখে না। ধরে নিচ্ছি ওরা অনামিকার ভাইবোন দুটোই। ওরা হয়তো আমার ক্ষতি চায় না। করতে চাইলে এতক্ষণে করে ফেলত। তাহলে ওরা কি আমার কাছে সাহায্য চায়?
এই বিষয়টা ভাবা মাত্রই কেউ একজন বলে ওঠে – হ্যাঁ!
আমি চমকে উঠলাম। আশেপাশে তাকালাম। কেউই তো নেই। তাহলে কথা বলছে কে? আর আমি তো কথাগুলো মনে মনে বলছি! ব্যাপারটা কি? নাকি আমি নিজের মনেই উত্তর দিয়েছি?
আমি আবার ভাবলাম- ওই বাচ্চাগুলো কি ভূত?
আবার কেউ একজন বলল- হ্যাঁ!
আমি আবার চমকে উঠলাম! মনে হচ্ছে কোন বাচ্চার গলা!
আমি এবার ভয়ে ভয়েই মনে মনে বললাম- ওরা তাহলে ভাল ভূত!
এবার একটা বাচ্চা ছেলের গলা পেলাম – হ্যাঁ!
আমি এবার নিশ্চিত হয়ে গেলাম বাচ্চাগুলোই আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। আমার এখন ভয়ে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কথা! কিন্তু আমার এখন আর ভয় লাগছে না। যেহেতু ওরা উত্তর দিচ্ছে আমি মনে মনে কয়টা প্রশ্ন ভাবলাম! ওরা কিছু উত্তরও দিল!
– তোমরা কি অনামিকার ভাইবোন?
– হ্যাঁ।
– তোমরা কি সাহায্য চাও?
– হ্যাঁ।
– কি সাহায্য?
– নিশ্চুপ।
– তোমাদের আর কেউ দেখে না কেন?
– কোন উত্তর নেই।
– ওই দুই রুমে কি কিছু আছে?
– হ্যাঁ।
– কোন রহস্য আছে?
– হ্যাঁ।
– তার সাথে কি গিন্নীমা জড়িত?
– হ্যাঁ।
– সব প্রশ্নের উত্তর আমি কোথায় পাব?
– কোন উত্তর নেই!
– ওইটা কি আসলে নূপুরের শব্দ?
– না!
– কিসের শব্দ?
– নিরুত্তর।
– শব্দগুলো কি তোমরা কর?
– না!
আমি আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম- কে করে তাহলে?
– উত্তর নেই।
আমি আরও কিছুক্ষণ কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন উত্তর পেলাম না। ওরা আর কথা বলছে না। তার মানে সব কথার এককথা হল সব ঘটনার সাথে গিন্নীমা জড়িত। আর উনি একা নিশ্চয়ই এসব করেননি। এরসাথে ভাইয়া আর তৈয়ব চাচাও আছেন। বলা যায় না সজীব সাহেবও থাকতে পারেন!
রাতে খাওয়ার টেবিলে গিন্নীমা আমাকে থমথমে গলায় বললেন – তোমার সমস্যাটা কি?
– আমার?
– ন্যাকা সাজবে না। শিহাবকে কি বলেছ?
আমি আর চুপ করে থাকলাম। উনার সাথে কথা বলার সময় কোন জোর পাই না। উনার চোখের দিকে তাকালে মনে হয় আমি কি ভাবছি সেটা উনি বলে দিতে পারেন!
– আমাদের বাড়িতে বৌভাতের পর মেয়েরা যায় না।
পরে সজীব সহ গিয়ে ঘুরে আসবে। এত তাড়াহুড়োর কি আছে?
আমি আর কথা বললাম না!
– শিহাবের কাছে ক্ষমা চাও।
আমি মিনমিন করে বললাম – স্যরি ভাইয়া।
শিহাব ভাই বললেন – ঠিক আছে।
সজীব সাহেবের হাতের দিকে তাকিয়ে গিন্নীমা জিজ্ঞেস করলেন – ওমা! তোমার হাতে কি হয়েছে সজীব?
এই সেরেছে! আমি তো এবার শেষ!
সজীব সাহেব বললেন – কেটে গিয়েছে।
– কি করে কাটল?
– আম কাটতে গিয়েছিলাম!
আমি তার দিকে তাকালাম। উনি চুপচাপ খেতে লাগলেন।
রাতেরবেলা আমি উনাকে বললাম – স্যরি!
উনি মুখ তালাবন্ধ রেখেই শুয়ে পড়লেন।
আমি বললাম – স্যরি বললে মাফ করে দিতে হয়। আপনিই বলেছিলেন।
উনি তবুও কোন কথা বললেন না। আরে! কি যন্ত্রনা! আমি আর কথা বাড়ালাম না। আমার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি ভর করল! কথা বলবে না মানে? আমি কথা বলানোর ব্যবস্থা করিয়েই ছাড়ব!
ফোন চেক করে দেখলাম মা-বাবা অনেকবার ফোন দিয়েছিল। আমি আর ব্যাক করলাম না! আমাকে যখন কোরবানি দিয়েই দিয়েছে এই বাসায়। ঠিক আছে। আমিও আর তোমাদের সাথে যোগাযোগ রাখব না!
আজ রাতেও আমি নূপুরের শব্দ পেলাম। কিন্তু আমি এখন জানি এটা আসলে নূপুরের শব্দ নয়। এটা অন্যকিছুর শব্দ। দূর থেকে নূপুরের শব্দ বলে মনে হয়। কিন্তু সকালে গিন্নীমার ঘরে আমি শুনেছিলাম। তখন আমারও মনে হয়নি এটা নূপুরের শব্দ! ওই বাচ্চা দুটি আজ আর এল না আমার কাছে! আমিও এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম। আমার অনেক ভোরে ঘুম ভাঙল। ঘুম থেকে উঠে আমি জানি আমার কি করতে হবে। কাজটা করে আমি মনে মনে হেসে আবার ঘুমিয়ে গেলাম। ছয়টার দিকে সজীব সাহেবের ‘রূপরেখাআআ’ বলে চিৎকারে আমার ঘুম ভাঙল!
তার দিকে তাকিয়ে তার ভ্যাবাচেকা মুখ দেখে আমিই হেসে দিলাম।
উনি রাগে লাল হয়ে কোনমতে জিজ্ঞেস করলেন – কেন করেছ এটা?
– আপনি কেন আমার সাথে কথা বলছিলেন না? আমি তো স্যরি বলেছি! যাতে কথা বলেন তাই করেছি।
ভোরে উঠে আমি সজীব সাহেবের গোঁফ একসাইডে কেটে দিয়েছি। এমনভাবে কেটেছি যেন পুরোটাই ফেলে দিতে হয়!
সজীব সাহেব পা দাপিয়ে বললেন – উহহ! তুমি কি সত্যিই পাগল?
আমি হাসতে হাসতে বললাম- আপনার তো দেখি ম্যারাথন ঘুম! টেরও পেলেন না! বাই দ্য ওয়ে, একটা সেলুন খুলে ফেললে ভালই চলবে, তাই না?
– না! একদম না! এটা কোন কথা রূপরেখা?
আমি বললাম – আপনাকে এই মোচ সহ দেখতে একদম বুড়ো মানুষের মত লাগে! দেখতে ভাল লাগে না।
সজীব সাহেব হঠাৎ বললেন – আজ তো তুমি চলেই যাচ্ছ তুষারের সাথে! তাই আমাকে কেমন লাগবে সেটা দিয়ে কি আসে যায়?
আমি চমকে তাকালাম! কি করে জানলেন উনি এটা?
কোনমতে বললাম – আ..আপনি কি করে জানলেন?
– গতরাতে রুমে ঢোকার সময় শুনে ফেলেছি। আর তুমি আমাকে কামড় দিয়েছ বলে আমি রাগ করিনি। আমাকে ছেড়ে যাচ্ছ বলে কষ্ট পেয়েছি!
আমি মুখ নিচু করে চোরের মতো করে রাখলাম!
– তোমার বিব্রত হওয়ার কোন কারণ নেই। তোমাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেটা আমি আগে বুঝতে পারলে তোমাকে বিয়ে করতাম না!
– কে বলল আপনাকে যে আমাকে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়েছে?
– গতকাল তোমার মা ভাবীকে বলছিলেন তুমি রাজি ছিলে না। আর আমার প্রতি তোমার ব্যবহার দেখে আমার মনে হয়েছে। গতকাল তুষারের সাথে তোমার কথা শুনে একেবারে শিওর হয়েছি! তুমি চিন্তা কর না। আজ দরজা খোলা থাকবে! আমি বলে দেব!
আমি ধীরে ধীরে বললাম- স্যরি!
– একদমই স্যরি হওয়ার দরকার নেই। এভাবে মনের বিরুদ্ধে জোর করে থাকা যায় না!
– থ্যাংকস। আপনি অনেক ভাল। আপনার জীবনে একজন ভাল মানুষ যেন আসে!
সজীব সাহেব হঠাৎ উদাস হয়ে গেলেন!
– ভাল থেক রূপরেখা।
– আপনার কখনো কোন সাহায্য লাগলে অবশ্যই বলবেন! আর..
– আর কি?
আমি মৃদু হেসে বললাম – আর মোচটা কেটে আসুন তো দেখি আপনাকে কেমন লাগে!
সজীব সাহেব হেসে দিলেন।
দুপুরে তুষার আমাকে ফোন দিল। সজীব সাহেব কি কলকাঠি নেড়েছেন জানি না, আজ সকাল থেকে দরজাও খোলা আর তৈয়ব চাচাও নেই!
আমি সজীব সাহেবকে বললাম- আসি! অনেক করলেন।
– ভাল থেক।
– মোচ ছাড়া আপনাকে অনেক ইয়াং লাগে!
সজীব সাহেব হেসে বললেন – তাও তো আটকে রাখতে পারলাম না!
আমিও হেসে বললাম – বেটার লাক নেক্সট টাইম!
আমি বের হলাম। সাথে কোন ব্যাগ নেইনি। বের হয়ে তাড়াতাড়ি হেঁটে গেটের দিকে যাচ্ছিলাম হঠাৎ দেখি অণু আর ইমরান এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দিকে তাকিয়ে আমি হঠাৎই থমকে গেলাম! ওদের চোখমুখে অসহায়ত্ব! দুইজনের মুখ দেখে মনে হল ওরা কাঁদছে। আমার আবার হুট করে মনে হল ওরা তো সাহায্য চেয়েছিল। ওরা শুধু আমার কাছেই সাহায্য চেয়েছে। তার মানে আমি চলে গেলে ওদের আবার অপেক্ষা করতে হবে? ওরা কি এজন্যই বিচলিত? আমার কি উচিৎ ওদের সাহায্য করা? ভূত হোক আর আত্মা হোক, দুইটা বাচ্চা এভাবে সাহায্য চেয়েছে, আর আমি আমার ভালটা দেখে চলে যাব? আমি কি নিজে শান্তিতে থাকতে পারব? আমি ভাবতে ভাবতে রাস্তায় নেমে এলাম। এক সাইডে তুষার দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখে তাড়াতাড়ি এল!
-ওহ! রূপ! তুমি এসেছ! চল যাই!
তুষার আমার হাত ধরে টানে। কিন্তু আমি ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। নড়লাম না!
– কি হল? চল?
আমি হঠাৎ তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম – তুমি যাও তুষার! আমি যাব না!
– যাবে না মানে? কি বলছ এসব?
– তুষার এখানে দুইজনের আমার সাহায্য খুব প্রয়োজন!
– কার?
আমি তুষারকে সব খুলে বললে সে স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে- তুমি এক্ষুনি আমার সাথে চল। এরপর তুমি ডাক্তার দেখাবে।
– তুষার বিশ্বাস কর। আমি মিথ্যা বলছি না।
– তোমার মনে হয় এটা বিশ্বাস করার মত কথা? চল বলছি!
– তুষার প্লিজ! তুমি বোঝ!
তুষার হঠাৎই বলল- আচ্ছা রূপ ঘটনা কি অন্য?
– মানে?
– তুমি কি সজীবের টাকা দেখে তার প্রেমে পড়ে গেছ?
– না! প্রেমে পড়লে তোমাকে আসতে বলতাম?
– কিন্তু আসার পরেও তো ভূতপ্রেতের কাহিনি ফেঁদেছ!
– আমি সত্যি বলছি।
তুষার আমার দিকে তাকাল। তার সেই দৃষ্টির সাথে আমি চোখ মেলাতে পারলাম না! সে হঠাৎই উল্টো দিকে হাঁটা দিল! আমি ডাকলেও শুনল না! আমি ধীরে ধীরে ফিরে গেলাম।
সজীব সাহেব আমাকে দেখে চমকে উঠলেন। তিনি অসম্ভব খুশি হয়ে উঠলেন!
– তুমি..তুমি ফিরে এসেছ?
– আমি যেতে পারিনি!
– কেন রূপরেখা?
সজীব সাহেব কি আমার কথা বিশ্বাস করবেন? তুষার যাকে এত ভালবেসেছি সেই তো করল না!
আমি বললাম- জানি না!
গোঁফ ছাড়া সজীব সাহেবকে দেখে মা বললেন – আমার ছেলেটাকে তো অনেক সুন্দর লাগছে! তোর বয়স দশ বছর কমে গেছে!
সজীব সাহেব হাসলেন।
পরবর্তী দুইদিনের মধ্যে দুইটা খারাপ ঘটনা ঘটল।
একদিন আননোউন নম্বর থেকে একটা কল এল।
হ্যালো বলার পর একজন মহিলার কণ্ঠ পেলাম।
– আমি তুষারের মা বলছি।
– জ্বি আন্টি বলুন।
– গতকাল থেকে তুষার মিসিং। তুমি কি জান ও কোথায়?
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম!
– জ্বি না আন্টি!
উনি ধরা গলায় বললেন- দেখ রূপরেখা অনেক অনেক কষ্ট করে খোঁজ পেয়েছি ও তোমাকে আনতে গিয়েছিল। প্লিজ বল না কিছু জান?
– আন্টি আমি সত্যি কিছু জানি না। আমি ওর সাথে যাইনি। ও একাই চলে গেছে। আ..আমি কিছু জানতে পারলে জানাব।
ফোন রেখে আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। তুষার বাসায় না ফিরলে কোথায় গেছে?
আর ওইদিনই আমি খাওয়ার সময় ওপর থেকে নিচে নামতে গিয়ে পা পিছলে সিঁড়িতে আছাড় খেলাম। আমার কোমরে অনেক লেগেছে। ডাক্তার বেড রেস্টে থাকতে বলেছেন। সজীব সাহেবকে দেখে মনে হল আমি বুঝি কোন মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছি!
উনি একটুপর পর বলতে লাগলেন- রূপরেখা তোমার কি কষ্ট লাগছে? ব্যথা কি বেড়েছে? মালিশ করে দেব?
এরপর দুইসপ্তাহ পার হয়েছে। আমি এখন একটু সুস্থ। তবে তুষারকে সত্যি পাওয়া যায়নি। এই দুইসপ্তাহে সেই শব্দ পেলেও বাচ্চা দুইটিকে দেখিনি। আমার সাথে সজীব সাহেবের এখন বেশ ভাল ফ্রেন্ডশিপ হয়ে গেছে।আমি শিওর হয়ে গেছি এই পৃথিবীতে একটা কেউ যদি আমাকে সত্যিকারের ভালবাসে সেটা সজীব সাহেব। বাবা-মা মাঝখানে এসেছিলেন। আমি দায়সারা কথা বলেছি। আর ফোন করলেও আমি ধরি না।
আজকে আবার একটা আননোউন নম্বর থেকে কল এল।
-হ্যালো।
– আপনি কি রূপরেখা বলছেন?
– হ্যাঁ আপনি?
– আমি সাহির। তুষারের বন্ধু। চিনেছেন?
চিনতে পারলাম। তুষার ওর সাথে আমার বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছিল। ওর প্যারানরমাল বিষয়ে অনেক।পড়াশোনা আছে।
– জ্বি চিনেছি। বলুন। তুষারকে পাওয়া গেছে?
– না। আসলে তুষার আমাকে আপনার সমস্যাটা বলেছিল। তখন আপনার নম্বরটা রেখেছিলাম। তুষারকে পাওয়া যাচ্ছে না তাই আপনাকে কল দিলাম। আমাকে একটু বলবেন লাস্ট কি কথা হয়েছিল?
আমি সাহিরকে সব খুলে বললাম। সবকিছু।
সাহির আমাকে বলল- আসলে আমি না দেখে কিছু বলতে পারছি না। তবে আমি সাজেস্ট করব আপনি আপনার গিন্নীমার ঘরে গিয়ে আরেকবার খুঁজে দেখুন কিছু পান কি না! কোন ক্লু! আমি কি আপনার ওখানে আসতে পারি?
আমি বললাম – আমি আপনাকে পরে ফোন দিচ্ছি।
সজীব সাহেবের সাথে কথা না বলে কোনভাবেই সাহিরকে আসতে বলা যাবে না। একটুপর অনামিকা এল।
– কি খবর চাচী?
– এই তো! তোমার? আজকাল তো রুমের বাইরে যেতেই পারি না।
– আমরা ভাল আছিম তবে গিন্নীমার ভং আরো বেড়েছে।
– মানে?
– আগে দুইটা থালা নিয়ে খেত! দুইসপ্তাহ আগে থেকে তিনটা থালা নেয়! কি যে পাগল!
আমার একটু খটকা লাগল! দুইসপ্তাহ আগেই তো তুষার মিসিং হয়েছে! আর আমিও তখন পড়ে গেছি! আর গিন্নীমা কেন তাহলে তিনটা থালা নেন?
অনামিকা চলে গেলেও আমার মাথায় বারবার একই কথা ঘুরতে থাকে! সাহির ঠিক বলেছে। সব রহস্যের সমাধান আছে গিন্নীমার ঘরে। আমাকে ওখানে যেতে হবে।
আমি হঠাৎই মনে মনে বললাম- অণু আর ইমরান আমি তোমাদের কথা ভেবে যাইনি! কিন্তু এরপর থেকে তো তোমরা আমাকে আর দেখা দিচ্ছ না! আমাকে একটু বল আমি কি করে তোমাদের হেল্প করব! আমি কি ঠিক পথে এগোচ্ছি? গিন্নীমার ঘরেই কি সব আছে? প্লিজ বল!
কিন্তু কেউ কোন কথা বলল না। আমার হঠাৎই খুব ঘুম পেল।
আমি স্বপ্ন দেখলাম- গিন্নীমা তার ঘরের দরজাটা আটকেছেন। তিনি দুইটা প্লেটে খাবার বাড়লেন। এরপর তার শাড়ির আঁচলে থাকা চাবির গোছা থেকে একটা চাবি নিলেন। এরপর বাথরুমের পাশে যে জায়গাটা পর্দা দিয়ে ঢাকা, আমি ভেবেছিলাম সেখানে জানালা, সেটা সরালেন। আমি দেখলাম সেখানে আরেকটা দরজা! গিন্নীমা সেই দরজার লক খুলছেন।
আর তক্ষুনি আমার ঘুমটা ভেঙে গেল! নাহ! আমাকে যেতেই হবে ওইঘরে। প্রাচীন বাড়িতে এরকম চোরাকুঠুরি থাকে। আমার স্বপ্নটা হয়ত নিছক কোন স্বপ্ন নয়। বাচ্চা দুটোর ইশারা! এই দুপুরবেলা গিন্নীমা রান্নাঘরে থাকতে পারেন। আমি সাবধানে উঠলাম। এরপর পা টিপে টিপে গিন্নীমার রুমে গেলাম। গিন্নীমা ঘরে নেই। কিন্তু আজ উনার চাবির গোছা বিছানার ওপর আছে। আমি তাড়াতাড়ি চাবির গোছাটা নিলাম। পর্দা সরাব তার আগে চাবির গোছা আমার হাত থেকে পড়ে গেল। আর সব চাবি খুলে মেঝেতে ছড়িয়ে গেল। আমি পাগলের মত চাবি উঠাচ্ছি হঠাৎই আমার সামনে একজোট পা এসে থামল। আমি ওপরে তাকিয়ে চমকে গেলাম! কি সর্বনাশ! গিন্নীমা!!

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প