দীর্ঘতম রাত (প্রথম পর্ব)

–আজ ২১ শে ডিসেম্বর? ওহ হো খেয়াল ছিল না। বাসায় যাই। তপু তুমিও চলে যাও বাসায়। আজ রাতে ফ্ল্যাট থেকে বের হবে না।
রাজন ভাইয়ের কথায় আমি একটু অবাক হলাম। ২১ শে ডিসেম্বর এর মাহাত্ম্য কি? মনে পড়ল আজ আমাদের কর্কটক্রান্তীয় অঞ্চলে সবচেয়ে দীর্ঘ রাত্রি। বছরের এ সময় সুর্য এই অঞ্চল থেকে অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি হেলে থাকে তাই দিন সবচেয়ে ছোট আর রাত দীর্ঘতম হয়। কিন্তু সেজন্য এতো ভয় পাওয়ার কি আছে? আমি রাজন ভাইয়ের সাথে কথা বলার আগেই দেখি সে হাওয়া। দ্রুত ছাদ থেকে নেমে চলে গেছে। মনে হলো তাকে ভুতে ধাওয়া করেছে।
তাকিয়ে দেখি সূর্য প্রায় ডুবতে বসেছে। দূরের বোটানিক্যাল গার্ডেনের ওপাশ দিয়ে লাল হয়ে শেষ বিদায় জানাচ্ছে সেটা। ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। সারাদিন মেঘলা আবহাওয়া ছিল। শেষ বেলায় সূর্য দেখা দিয়ে চলে যাচ্ছে। কুয়াশা ঘিরে ধরছে ধীরে ধীরে। ভালই শীত পড়েছে। চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দেখি রাহাত আংকেল এসেছেন ছাদে। কান টুপি আর মোটা সোয়েটার পরে ভালই প্রস্তুতি নিয়ে ছাদে এসেছেন। আমি চলে যাচ্ছি দেখে বললেন,
ইয়াং ম্যান চলে যাচ্ছ কেনো? এতো শীত লাগলে চলবে? তোমাদের বয়সে এই রকম শীত একদম পাত্তা দেইনি। একটা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে ঘুরে বেরিয়েছি।
— না আংকেল। আমার ঠান্ডা ধাত। হুট করে এটাক করে বসবে। তার উপর আজ দীর্ঘ রাত্রি।
— দীর্ঘ রাত্রি মানে কি?
— আজ ২১ শে ডিসেম্বর। সবচেয়ে বড় রাত।
রাহাত আংকেল একটু চমকে গেলেন। বললেন, ওহ হো আজ ২১ শে ডিসেম্বর রাত? ভুলেই গেছিলাম। যাই বাসায় যাই।
–কেনো আংকেল? ২১ শে ডিসেম্বর রাতের সমস্যা কি?
আংকেল একটু থতমত খেয়ে বললেন, না সমস্যা কিছু না। তবু সতর্ক থাকা ভালো।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কিসের সতর্ক?
রাহাত আংকেল একবার দুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে তাকালেন। এইমাত্র সূর্য ডুবে গেছে সেদিকে। আমাকে নীচু গলায় বললেন, তুমি তো অল্প কিছুদিন এসেছ এই বাসায়, এক বছর তো হয়নি তাই না?
আমি মাথা নাড়লাম। মিরপুরের এই বাসা ভাড়া নিয়েছি আট নয় মাস আগে। চমৎকার বাসা। ভাড়াও অল্প , প্রতিবেশীরা ভালো। সবকিছু মিলিয়ে ভালো আছি। কিন্তু আজ এদের কান্ড কারখানা রহস্যজনক লাগছে।
রাহাত আংকেল একটু এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ি কোঠায় গিয়ে লিফটের সামনে দাড়ালেন। আমিও গেলাম সাথে সাথে। ভালই ঠান্ডা বাতাস। বাসায় গরম কাপড়ের জন্য এমনিতেই যেতে হবে। লিফট কল দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
রাহাত আংকেল নীচু গলায় বললেন, আজ রাতে ফ্ল্যাট থেকে বের হইয়ো না তপু। সতর্ক থাকা ভালো।
আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, কি ব্যাপার একটু খুলে বলেন না আংকেল। তখন রাজন ভাইও কি জানি বলছিল এমন। কি সমস্যা আসলে?
লিফট এসে গেছে। রাহাত আংকেল ভিতরে ঢুকে গেলেন। আমিও ভিতরে ঢুকলাম। আমি তাকিয়ে আছি তার দিকে রহস্যময় কথাবার্তার কারণ জানতে।
উনি বললেন, তেমন কিছু না। গত তিন বছর টানা এই রাতে এই ফ্ল্যাটে একটা না একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে।
–আমি বললাম, কি রকম দুর্ঘটনা। কাকতালীয় নিশ্চয়ই।
লিফট খুলে গেল। ছয়তলা । রাহাত আংকেল ছয়তলার ফ্ল্যাটে থাকেন। রাহাত আংকেল নেমে গেলেন, ঘুরে একবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাকতালীয় কিনা জানি না, তবে কেউ না কেউ মারা গেছে।
লিফট বন্ধ হয়ে গেল। পুরা ঘটনা না বলেই কেটে পড়লেন রাহাত আংকেল। আমি চার তলায় আমার ফ্ল্যাটে এলাম চিন্তিত মুখে।
দরজায় কলিং বেল দিতেই নীলা দরজা খুলল উদ্বিগ্ন মুখে। –তুমি কই ছিলে এই ঠান্ডার মধ্যে? মোবাইল নিয়ে যাওনি কেনো?
আমি কিছু বললাম না। ফ্ল্যাট টা একটু ছোট। এক হাজার স্কয়ার ফিট। কিন্তু আমাদের ছোট ফ্যামিলি তাই বেশ চলে যায়। আমি, নীলা আর আমার সাত বছরের মেয়ে টিনা।
টিনা টিভি দেখছিল। তার স্কুল পরীক্ষা শেষ, সারাদিন তেমন কিছু করার নেই। টিভি দেখে সময় কাটায়। ভাবছিলাম তাদেরকে টিনার নানা বাড়ি ফরিদপুর রেখে আসব। আমি সময় করে উঠতে পারিনি। সামনের সপ্তাহে নিয়ে যাব।
নীলা রান্না ঘরে ছিল। কিছুক্ষণ পর এসে বলল, কাজের বুয়া আসে নাই । আমাকে ফোনে বলে আপা আজ রাতে বাসা থেকে বের হইয়েন না।
আমি চমকে গেলাম। বললাম, মানে কি?
নীলা শুকনো হাসি হেসে বলল, সেটা কি জানি। ফোন দিয়েছিলাম কেনো আসে নাই শুনতে, তখন বলল আজ আপনার বাসার আশেপাশে যাওয়া নিষেধ। আপনারাও সাবধান থাইকেন, রাতে বের হইয়েন না।
—কি সব আজব কথাবার্তা। রাতে বের হবো না মানে কি?
নীলা বলল, সেটার আমি কি জানি। কাজের বুয়ার মাথায় ছিট আছে মনে হয়। তার ছেঁড়া কথাবার্তা।
আমি চুপ হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছে এই বাসার একটা রহস্য আছে। কিন্তু কেউই ঠিক মতো বলছে না। একবার ভাবলাম নীলার সাথে আলোচনা করি ব্যাপারটা পরে ভাবলাম দরকার নাই, খামাখা ভয় পেতে পারে নীলা। সে এমনিতেই ভীতু, এইসব আলোচনা শুনলে ভয় পেয়ে যাবে।
কিন্তু নীলা জেনে গেল। তাকে জানালো নীচ তলার ভাবী। এই বিল্ডিং এ নীলার একমাত্র বান্ধবী। ইন্টার কমে তারা মাঝে মাঝে দীর্ঘ আলাপ করে। আজও ইন্টার কম বেজে উঠলো রাতে। নীলা কথা বলতে গেল। কিছুক্ষণ পর যখন ফিরল তখন তার মুখে ভয়ের ছাপ। আমাকে বলল, এই রিনা ভাবি তো ভয়ংকর এক কথা বলল।
আমি ভাব করলাম কিছু জানি না। বললাম, কি বলল?
—এই বাসায় নাকি গত তিন বছর ধরে ২১ শে ডিসেম্বর রাতে একজন করে মারা গেছে। তিনজনকেই ছাদে পাওয়া গেছে । ডাক্তার বলেছে হার্ট এট্যাক। কিন্তু সবার চেহারায় নাকি আতংকের ছাপ ছিল। দেখে মনে হয়েছে কিছু দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়েছে।
আমি অভয় দেয়ার চেষ্টা করলাম, বললাম, ধুর এই সব গুল গপ্পো। অতিরিক্ত হরর সিনেমা দেখার ফল। এই রকম ঘটনা ঘটলে সেটা পেপার পত্রিকায় আসত না? তাছাড়া এখন ইন্টারনেটের যুগ। কিছু ঘটলেই ভাইরাল হয়ে যায়। কই এরকম কিছু শুনেছ কোথাও?
নীলা বলল, আমি এতো কিছু জানি না। আমার ভয় লাগছে। রিনা ভাবি বলেছে আজ রাতে কোন অবস্থাতেই যেনো বাসার দরজা না খুলি। নীচের দারোয়ানও নাকি দশটার পর গেট বন্ধ করে শুয়ে পড়বে। আর ছাদে যাওয়া যাবে না কোন ভাবে। উফফ আমার খুব ভয় করছে। তুমি বাসা নেয়ার সময় কেনো ঠিক মতো খোঁজ খবর নিলে না।
আমি কি বলব ভেবে পেলাম না। উঠে গিয়ে মেইন দরজা বন্ধ করে দিয়ে এলাম ভালো করে। আমাদের বিল্ডিং টা দশ তলা। বিল্ডিং এর সামনে রাস্তা। দুই পাশে অন্য বিল্ডিং কিন্তু সেগুলো তিন তলা হওয়ায় আমাদের চার তলা থেকেও আশে পাশে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। পেছনে ফাঁকা জায়গা এবং তার পরেই বোটানিক্যাল গার্ডেনের দেয়াল। অন্যদিন সেদিকে তাকালে গাঢ় অন্ধকারে গাছপালা দেখতে ভালো লাগত। আজ সেদিকে তাকিয়ে ভয় ভয় লাগছে। আমি পেছনের রুমটা বন্ধ করে দিলাম।
রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ার প্ল্যান করলাম আমরা। রাতটা খুবই নিস্তদ্ধ। নীলা একবার বলল, চারিদিকে কোন শব্দ নেই কেনো? গাড়ির কোন হর্ন নেই, পোকার ডাক নেই।
আমি বললাম, ধুর তোমার মনে ভয় ঢুকে গেছে। এই শীতে কে বের হবে রাস্তায়?
বললাম বটে কিন্তু আমার কানেও নিস্তদ্ধতা অস্বাভাবিক লাগছিল। বিছানায় শুয়ে পড়ছি এই সময় ফোন বাজল। তাকিয়ে দেখি সাজ্জাদ ফোন দিয়েছে।
—দুলাভাই, কেমন আছেন? আমি আসতেছি। নীচের গেট খোলা রাইখেন।
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, সাজ্জাদ, তুমি আজ এসো না। একটা ঝামেলা আছে। আগামীকাল আসো।
—কি বলছেন দুলাভাই? আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমার মোবাইলে চার্জ ফুরিয়ে যাচ্ছে। আসতেছি আমি, আধা ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাব। তখন শুনব আপনার কথা।
ফোন কেটে গেল। সাজ্জাদ আমার একমাত্র শ্যলক।
নীলা উদ্বিগ্ন মুখে বলল, কি বলল সাজ্জাদ?
–আসতেছে এখন।
—কি বলো? তুমি মানা করলে না?
— করলাম তো। শুনল না। মোবাইলের চার্জ নাই বলল।
নীলা ভয়ের গলায় বলল, এখন কি হবে? এই রাতে কেনো আসতে হবে ওর। উফফ
আমি ঘড়ি দেখলাম রাত প্রায় সাড়ে দশটা। বললাম, বেশি রাত হয়নি। ভালই হলো, সাজ্জাদ এলে আমরা লোক সংখ্যায় বেশি হবো তখন ভয় কমবে।
আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। রাত সাড়ে এগারটা বাজল, সাজ্জাদ এলো না। মোবাইলে ফোন দিলাম, সেটা বন্ধ।
আমাদের উদ্বেগ বাড়তে লাগল। নীলা এক সময় অস্থির হয়ে পড়ল। আমাকে বলল, সাজ্জাদের কি হলো? এখনো এলো না কেনো? তুমি এক কাজ করো নীচে গিয়ে দেখো। দারোয়ান ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই, গেটের সামনে হয়ত দাঁড়িয়ে আছে সাজ্জাদ। মোবাইল বন্ধ থাকায় ফোনও দিতে পারছে না।
আমি ভাবলাম সাজ্জাদ নীচ থেকে চিৎকার করে ডাকলে আমরা চারতলা থেকে অনায়াসে শুনতে পাওয়ার কথা।
ঠিক তখন সাজ্জাদের চিৎকার কানে ভেসে এলো, আপা আ……
এটা ডাক নাকি ভয়ার্ত চিৎকার বুঝলাম না। নীলা আমাকে তাড়া দিল, শীগগির যাও, সাজ্জাদ নীচে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি মোবাইল নিয়ে দরজা খুলে বের হলাম। নীলাকে বললাম, দরজা শক্ত করে আটকে রাখতে, আমি মোবাইলে ফোন না দেয়া পর্যন্ত দরজা না খুলতে।
নীলা দরজা বন্ধ করে দিল। আমি লিফট ডেকে উঠলাম। লিফটে ওঠা মাত্র ইলেক্ট্রিসিটি চলে গিয়ে চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেল।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প