স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে চোখ যেতেই আমার বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠলো। রাত ১১ টা বেজে ৫৬ মিনিট। আর কিছুক্ষণের মধ্যে ১২ টা বেজে যাবে। অথচ আমার খেয়ালই ছিল না ব্যাডমিন্টন খেলতে খেলতে কখন এত রাত হয়ে গেল। রাত ১১ টা ৫৯ মিনিটে আমি নিজের মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে তাই রওনা হলাম বাড়ির উদ্দেশ্য। কিছুদুর যাওয়া পর দেখতে পেলাম একটা অদ্ভুত কান্ড। বিশাল মাঠের মাঝে অনেকে মিলে ব্যাডমিন্টন খেলছে। তবে সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার হলো এরা কেউ কোনো কথা বলছে না। শুধু মুখ দিয়ে শব্দ করছে। সেটা আমি এত দূর থেকে বুঝতে পারছিনা ঠিকমত। আমার মনে হঠাৎ একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ইচ্ছে জাগলো। সেটা হলো তাদের সাথে বেড মিন্টনের একটা মেচ খেলতে। আমি তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। তাদের কাছে গিয়ে আমি বললাম ‘ভাইয়ারা আপনাদের সাথে আমি কি একটা মেচ খেলতে পারি?’
আমি দেখলাম আমার প্রশ্ন শুনে তারা তাদের রানিং মেচ রেখে আমাকে একটা সাইডে হাত ইশারায় যেতে বললো। আমি বুঝে নিয়েছিলাম। তারা সম্মতি প্রকাশ করেছে এবং আমাকে তাদের দলে নিয়েছে। কি তাদের বেড মিন্টন কোডের কেউ কোনো কথা আমার সাথে বলছিল না দেখে আমার খুব অদ্ভুত লাগছিল। যা হোক, আমি তাদের সাথে খেলতে আরম্ভ করে দিলাম। আমি খেয়াল করে দেখলাম, পয়েন্ট হলে তারা হাত ইশারায় নিজেদের মধ্যে কিছু একটা ভাষা আদানপ্রদান করতো আর আউট হলে মুখে আ- আ- শব্দ করতো। এভাবে জানিনা আমি কতক্ষণ খেলেছি।
হঠাৎ..!
হঠাৎ কারেন্ট চলে যাওয়ায় সব কিছু স্তব্ধ হয়ে গেল সাথে সাথে। যেন নিশীথে একাকিনী বিরাজ করছে সর্বত্র। আমি তৎক্ষনাৎ মোবাইলের ফ্লেস লাইটটা অন করে দেখি কেউ নেই। ডানে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই, বামে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। পেছনে তাকিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার আত্মারাম খাঁচা থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। দেখি একটা বেশ বড় আর পুরোনো কালীর মূর্তি। আমি সাথে সাথে সেখান থেকে আমার মোটরসাইকেলের দিকে দৌড়ে গেলাম। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দেখি গাড়িটা স্টার্ট নিচ্ছে না। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না এখানে কোনো গন্ডগোল রয়েছে। বহু চেষ্টার পর আমার মোটরসাইকেলটি স্টার্ট নিল। আমি গাড়িতে বসে কিছুদূর এগোতেই গাড়ি আবার বন্ধ হয়ে গেল। আমি দেখছি এই প্রচন্ড শীতেও ভয়ে আমার শরীর ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। তারপর অনেক চেষ্টা করেও গাড়ি আর স্টার্ট দিতে পরিনি। সেল্ফ নেয় কিন্তু আবার থেমে যায়। এভাবে চেষ্টার ফলে আমার শরীরের শক্তিও কমে যায়। আমি মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে যা দেখি তাতে আমি হৃদপিন্ড থেকে যায়। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি রাত ২ বাজে। কিন্তু আমি তো এই কিছুক্ষণ আগেও দেখলাম রাত সাড়ে বারোটা বাজে। তাহলে কিন্তু আমি এতক্ষণ ধরে গাড়ি চালু করার চেষ্টা করছি? আমি ভয়ে তখন গাড়ি ছেড়ে দৌড় দেই। কিন্তু দৌড়ের মাঝো হঠাৎ কিছু একটার সাথে হোটচ খেয়ে ওখানেই পরে অজ্ঞান হয়ে যাই।
যানিনা কতক্ষণ পরো আমার জ্ঞান ফিরেছে। চোখ খুলে দেখি মোবাইলটা আমার থেকে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পরে আছে। মোবাইলের ফ্লেস লাইটের আলোয় দেখলাম একটা প্রকান্ড বট গাছ। দৌড়ের সময় এরই সাথে ধাক্কা লেখে হয়তো আমি পরে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। আমি মোবাইলটা হাতে নিয়ে আবারও কিছুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা আমার মোটরসাইকেলের কাছে যাচ্ছিলাম ঠিক তখন মনে হলো কেউ যেন বট গাছের সমস্ত পাতা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে নারাচ্ছে। কিন্তু পিছনে ঘুরে দেখলার সাহস আমার নেই। আমি মনে মনে যা পারছি সূরা পড়ার চেষ্টা করছি কিন্তু ভয়ের কারণে কোনো সূরাই আমার আর ঠিকভাবে মনে পরছিল না। আমি কোনমতে গাড়ির কাছে এসে গাড়ি স্টার্ট দিলে সাথে সাথে গাড়ি চালু হয়ে যায়। কিন্তু সেখান থেকে মেইন রোডে উঠার পরই গাড়িটা আবার বন্ধ হয়ে যায়।
আমি ধরেই নিয়েছিলাম আজ আমার শেষ দিন। আমি মনে মনে সবকিছু ভুলে আল্লাহকে ডাকার চেষ্টা করছি। একসময় ফজরের আজান আমার কানে আসলো। আমি মুরব্বিদের কাছ থেকে শুনেছিলাম আজানের সময় কোনো অপশক্তি তাদের শক্তি ব্যাবহার করতে পারে না। মনে সাহস নিয়ে আমি গাড়িতে সেল্ফ দিতেই গাড়ি স্টার্ট হয়ে যায়। আমি গাড়ি চালিয়ে সোজা আমাদের বাড়ির সামনে এসে আবারও জ্ঞান হারাই।
এরপর যখন চখ খুললো আমি তখন বিছানায় শোয়া। আমার পাশে আমার মা আর বড় বোন বসে আছে। ওদের কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব তার আগেই আমার বড় বোন বলতে শুরু করে আমার বাড়িতে না ফেরার চিন্তায় তারা ঘুমাতে পারেনি। ফজরের আজানের পর যখন গাড়ির আওয়াজ তাদের কানে যায় তখন দৌড়ে নিয়ে নেমে এসে দেখে গাড়ি সমেত আমি মাটিতে পরে আছি। এরপর ধরাধরি করে তারা আমাকে বিছানায় শোয়ায়।
এরপর সাতদিন কেটে গেছে। আমার আজ শরীর থেকে জ্বর সেরেছে। এতদিনের জ্বরে আমার শরীর তাই দূর্বল হয়ে পরেছে।
বিকেলের দিকে আমি দোতলার বারান্দায় একা বসে আছি। আমার সাথে কেউ নেই। সন্ধ্যা গড়িয়ে আসার পর আমি দেখতে পেলায় আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা সামনের এগিয়ে একটা নারিকেল গাছ আছে, সেটায় কেউ একজন দ্রুত গতিতে উঠে পরলো। তবে ভয় এবং রহস্যের বিষয় হলো সেখানে শুধু সাদা কাফনের কাপড় ছাড়া আমি কিছু আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। মাকে তাই ডাক দিলে তিনি এসে দেখে সেখানে কিছুই নেই। তবুও আমার মায়ের মনে ভয় ছিল এই বিষয়টা নিয়ে তাই আমাকে সেই রাতেই এলাকার হুজুরের কাছে নিয়ে যায়।
হুজুর আমাকে বেশ সময় নিয়ে পর্যাবেক্ষণ করার পর বলে সেই রাতে তোমাকে যারা ভয় দেখিয়েছিল তারা খুব দুষ্ট জ্বীন ছিল। এরা তোমাকে ছাড়তে চাইছে না। (একটা কথা বলে রাখি আমি দেখতে খুবই সুদর্শন।) হুজুর আমাকে বলছেন তোমাকে তারা যেভাবেই হোক সাথে নিয়ে যাবে। এটা শুনে আমার মা স্তম্ভিত হয়ে হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। আমি তখন কি করবো কিছুই মাথায় আসছিল না। একপর্যায়ে হুজুর আমার মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন ‘মাগো, তুমি কেঁদো না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।’ তারপর তিনি আমার দিকে ঘুরে বললেন ‘তোমাকে আমি বাঁচাতে পারি তবে এতে তোমার কিছু না হলেও আমার প্রাণ সংকট হতে পারে। কিন্তু আমি সেসব পরোয়া করিনা। আল্লাহ আমাকে যে জ্ঞান এবং শক্তি দিয়েছে সেটা হয়তো এ দিনের জন্যই। এটা শুনার পর আমি নিজের উপর কিছুটা ভরসা ফিরে পাই। হুজুর বললেন ‘আমি তোমাকে দু একদিনের ভেতর খবর দেব। তুমি তোমার মা কে সাথে নিয়ে আমি যেখানে বলবো সেখানে চলে যাবে। সাথে করে অবশ্যই তোমার পরিবারের অন্য কাউকে আনতে হবে যে খুব কামেল ব্যক্তি। তোমার যদি ভাইবোন থাকে তবে তাদের বাড়িতেই থাকতে হবে। যাবতীয় পরামর্শ সাথে নিয়ে আমরা সম্মতি জানিয়ে হুজুরের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
বাড়ি ফিরে ভাবতে লাগলাম, আমাদের পরিবারে এরকম কামেল ব্যক্তি আছে? আমার বাবা ধার্মিক ছিলেন কিন্তু তিনি মারা গেছেন আমরা ছোট রেখেই। আমাদের বাপ মরা পরিবারের হাল তখন থেকে আমার মা-ই নিজ হাতে তুলে নিয়েছে। আমাদের কাপড়ের ব্যাবসা ছিল আর সেটাই মা চালু রাখে৷ এ-সব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পরলো আমার বড় চাচা যিনি ঢাকায় একটা কোম্পানিতে চাকরি করে। ইচ্ছে না থাকলেও তাকে খবর দিয়ে আনতে হচ্ছে কারণ আমার জীবন বিপন্ন অবস্থায়। বড় চাচা আমাকে ছোট থেকেই অনেক আদর করতেন। এখনও করেন কিন্তু তিনি সবসময় যেহেতু ঢাকায় থাকেন তাই আমাদের সাথে খুব একটা যোগাযোগ নেই। তিনি খুব ধার্মিক একজন মানুষ। আল্লাহর উপর তার বিশ্বাস প্রবল এবং তিনি সবসময় আমল করেন।
পরদিন সকালে তিনি এলেন। চাচাকে সব ঘটনা খুলে বললাম। তিনি শুনার পর আমাকে বললেন চিন্তা না করার জন্য। ওইদিন রাত্রে আমি ঘুমাতে পরিনি, আমার বোন আর মা কেউই না। তারপর নির্ঘুম রাত কাটিয়ে সকালের দিকে ভোরবেলা উঠে পরলাম। নামাজ পরে অপেক্ষা করতে লাগলাম হুজুরের ডাকের জন্য। কারণ তিনি আমাকে আজই একটা খবর দিবেন বলেছিলেন।
বেশ বড় একটা পুকুরের কাছে একটা ডিঙ্গি নৌকা বাঁধা। তিনজন বলশালী লোক দাঁড়িয়ে হুজুরের সাথে কথা বলছেন। হুজুর তাদের বললেন আমি পুকুরে নামার পর কিছু আমল করবো তখন অতিপ্রাকৃত কারণে পরিবেশের পরিবর্তন ঘটতে পারে। হুজুর একটা স্টিলেন বাটিতে পড়া তেল রেখে পুকুরে নামার আগে বললেন ‘আমার পুকুরে থাকা অবস্থায় কেউ যেন পুকুরের ধারে কাছেও না আসে। আর আমি মুখ দিয়ে শব্দ করার পর আমাকে সঙ্গে সঙ্গে ডিঙ্গি নৌকা করে পুকুর থেকে উঠিয়ে আনবে সাথে সাথে। আর যদি দেখ আমি অজ্ঞান হয়ে গেছি তাহলে এই পড়া তেল আমাকে মালিশ করবে।’ আমি দেখলাম সেই তিনজন বলশালী লোক তাতে সম্মতি জানিয়ে ডিঙ্গি নৌকায় উঠে প্রস্তুতি নিল। ইতিমধ্যে অনেকে এসে জড় হয়েছে এই দৃশ্য নিজ চোখে দেখার জন্য। হুজুর তাদের সবাইকে সাবধান করে পানিতে নেমে পরলেন এবং দুই হাতের নিচে কলা গাছের ভেলা নিয়ে মাঘ পুকুরে চলে গেলেন। দূর থেকে সবাই তখন আগ্রহের দৃষ্টি নিবন্ধন করে আছে। এভাবে পাঁচসাত মিনিট কাটার পর হঠাৎ পুকুরের শান্ত পানিতে বিশাল বড় বড় ঢেউ উঠতে দেখা গেল। আমার সাথে তখন আমার মা আর চাচা দাঁড়িয়ে। তারাও অবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখছে। আমার ভয়ে শরীরে কাঁপুনি উঠে গেল।
টানা অনেকক্ষণ ধরে পানিতে থাকার পর হুজুর মুখ দিয়ে একটা শব্দ করলেন। সাথে সাথে হুজুরকে পুকুর থেকে ডাঙায় নিয়ে এসে সেই তিনজন লোক সেই পড়া তেল মালিশ করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর হুজুর স্বভাবিক হলেন। তিনি জ্ঞান হারাননি। তবে বোঝা গেল এতক্ষণ পুকুরে থাকতে থাকতে অনেকটা ধকল গিয়েছে হুজুরের উপর দিয়ে। আমার চাচার কাজ ছিল একটা একটা সম্পূর্ণ সাদা আর সম্পূর্ণ কালো মুরগী জবাই করে। তিনি এই কাজটা করলেন। হুজুরের বলা মুরগীর সন্ধান করতে করতে এক পর্যায়ে একজনের বাড়িতে একটা সম্পূর্ণ সাদা মুরগীর দেখা পেলাম। কিন্তু সেই মুরগী আনতে যে কসরত করতে হয়েছে তা আর কি বলবো। অবশেষে সম্পূর্ণ সাদা মুরগী পাওয়ার পর আল্লাহর রহমতে সম্পূর্ণ কালো মুরগীও পেলাম। আমাদের মুরগীর খোয়ারে সেই সম্পূর্ণ কালো মুরগীটা ছিল।
আমার বোন সম্পূর্ণ রিচুয়ালের সময় বাড়িতে উপস্থিত ছিল। (শেষ বেলায় এই সিদ্ধান্ত)
হুজুরকে আমরা বাড়িতে নিয়ে আসলাম। বাড়িটাকে বাঁধিয়ে দেওয়ার জন্য। আর তাকে আমার জীবন রক্ষার মাধ্যম হওয়ার জন্য হাদিয়া দিতে চাইলেও তিনি তা নেননি। শুধু বলে ছিলেন ‘আমি পুকুরে সেই জ্বীনর উপস্থিতি পাওয়ার পর তার সাথে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পরি। কিছুতেই ওই জ্বীনকে তোমাকে ছেড়ে যেতে চাইছিল না। কিন্তু আমি তো জানি আমাকে কি করতে হবে, আর আমি তাই করলাম। (অপ্রকাশ্য)
তারপর অনেকদিন পেড়িয়ে গেছে। আমাদের আর কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু একটা ঘটনা আমাকে খুব করে ভাবিয়েছে আর কষ্ট দিয়েছে। আমাকে জ্বীনের হাত থেকে যিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে বাঁচিয়েছিলেন, তিনি আজ একসপ্তাহ আগে মরা গেছেন। আমি তার জানাজায় অব্ধি যেতে পারিনি। কারণ খবরটা আমি পেয়েছি গতকাল। আমরা এক মাসের মত ঢাকায় ছিলাম। তারপর বাড়ি ফিরেই এই দুঃসংবাদ জানার পর আমিসহ আমার পুরো পরিবার শোকাহত। তবে হঠাৎ করে যেই তথ্য আমিসহ আমার পুরো পরিবারের মধ্যে চিন্তা এবং ভয়ের উদ্বেগ সৃষ্টি করে সেটা ছিল গতবছর ঠিক যেদিনটায় হুজুর আমাকে জ্বীনের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল এবছর ঠিক ওই দিনটাতেই হুজুর মারা যায়।