নবম মাত্রার গোবট

মহামান্য ভভু! সুপারটম্পিউটার টিটিটি বলেছে, সূর্যোদয়ের পরেই বিপর্যয় ঘটে যাবে। একটা গোবট বিগড়ে গেছে। সে নিজেকে ভূত ভাবতে শুরু করেছে!’

ধপধপে সাদা সিনথেটিক আলোর তৈরি উজ্জ্বল পোশাকে মহামান্য ভভু ওরফে ভয়ানস্কি ভুতোকভকে দেখাচ্ছে সন্ন্যাসীর মতো।

‘মামদোনিয়া, আজ কত তারিখ?’

‘চব্বিশ অমাবস্যা তিন হাজার সাড়ে তেপ্পান্ন যোগ দুই সাল। কিন্তু মহান ভভু আপনি একটা কিছু..!’

‘পৃথিবীতে আর মানুষ নেই তাই না?’

‘না মহামান্য ভভু, সবাই অ্যান্ড্রোমিডার ঘুটাং গ্রহে চলে গেছে।’

‘কিন্তু মানুষ না থাকলে কী করে হবে। এলিয়েনদের ভয় দেখানো তো ভূতদের কাজ নয়।’

‘এই জন্যই তো আমরা গোবট তৈরি করেছি। আপনিই বলেছিলেন, মানুষ তার কাজের সুবিধার জন্য এককালে রোবট বানিয়েছে। আর আমরাও ভয় দেখাতে বানিয়েছি..।’

‘তুমি বড্ড বেশি কথা বল মামদোনিয়া।’

ঘুরে দাঁড়ালেন ভয়ানস্কি। তার চোখে মুখে বেশ আমুদে ভাব। কদিন আগেই তিনি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সকল ভূতগোষ্ঠীর প্রধান হয়েছেন। আর কাজ শুরু করতে না করতেই কিনা দেখা দিল সমস্যা।

‘চিন্তার বিষয় হলো মেছোট্রন-৮৪০ নামের ওই নবম মাত্রার গোবট, যেটা আপনি নিজ হাতে করলার বিচি আর তেলাপোকা দিয়ে বানিয়েছিলেন, ওটা মানুষকে ভয় দেখাতে ঘুটাং গ্রহে যাবে।’

ভয়ানস্কি কিছু বললেন না। চিন্তায় পড়ে গেছেন তিনি। গোবটটা যদি সত্যিই এমন আচরণ শুরু করে তবে তার দেখাদেখি অন্যরাও ছুটবে মানুষের পেছনে। কিন্তু মানুষ যে এখন আর ভূতের ভয় পায় না তা তারা জানে না।

‘মেছোট্রনকে এখুনি আসতে বল।’

‘মঁহামাঁন্য ভঁয়ানস্কি ভুঁতোকভ। আঁমি এঁসে গেঁছি!’

চমকে উঠলেও তা প্রকাশ করলেন না ভয়ানস্কি। ডাকার আগেই চলে এসেছে গোবটটা। নিজেকে ভূত প্রমাণ করার জন্য নাকি সুরেও কথা বলছে সে!

‘মেছোট্রন-৮৪০! তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?’

‘কাঁরণ আঁমি ভূঁত মহামান্য। হাঁউ মাঁউ খাঁউ মানুষের গঁন্ধ পাঁউ।’

‘অসম্ভব! পৃথিবীতে এখন আর মানুষ নেই। সবাই অনেকদূরের গ্যালাক্সিতে চলে গেছে। তুমি ওদের গন্ধ পাচ্ছো না। তোমার সার্কিটে গন্ডগোল আছে মেছো।’

‘কিন্তু মহামান্য আমি ভূত। মানুষকে ভয় দেখাতে চাই! পি¬ঁইইইজ।’

‘তুমি আমার বানানো নবম মাত্রার গোবট! আমি আদেশ করছি তুমি শীতল চেম্বারে ফিরে যাও!’

‘আমি নবম মাত্রার, তাই সব আদেশ মানতে বাধ্য নই ভভু!’

মেছোট্রনের জবাব শুনে ভয়ানস্কি ঢোক গিললেন।

‘ঠিকাছে মেছোট্রন। কাকে ভয় দেখাতে চাও তুমি?’

‘মানুষকে ভয় দেখাতে চাই। আপনার সেরা আবিষ্কার হয়ে মানুষকে ভয় দেখালে সবাই আপনাকেই শ্রদ্ধা করবে।’

কথাটা শুনে গর্বে ভয়ানস্কির পেট ফুলে উঠলো। তবে তিনি উড়ে গেলেন না। শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘কিন্তু আমি চাই না, আমার বানানো সেরা গোবটটাকে মানুষ মেরে ফেলুক।’

‘ওহ না মহামান্য। আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন আমি নবম মাত্রার গোবট। ভয় দেখানো কোনো ব্যাপারই না। এখন আমি যাব। মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য ভেতরটা টো টো করছে। ভাল কথা, আমার পুরো মিশনটা কিন্তু দেশবাসী লাইভ দেখবে। সবাই বুঝবে, ভূতের ভয় আসলে ফুরিয়ে যায়নি।’

ভয়ানস্কি জানেন বাধা দিয়ে লাভ নেই। মেছোট্রন যাবেই।

পৃথিবীর সব ভূতের চোখ ভেলকিভিশনে। এক হাজার বছর পর আবার ভূতের ভয় পেতে যাচ্ছে মানুষ। ভয়ানস্কি নিজেও বিশাল বড় পর্দায় দেখতে পাচ্ছেন মেছোট্রন-৮৪০ নামের গোবটটাকে। অবিকল মানুষের মতোই দেখাচ্ছে। তার পেছনে ভন ভন করে উড়ছে একটা গোবট মাছি। ওটার চোখজোড়া হলো ভিডিও ক্যামেরা। তাতেই লাইভ ভিডিও দেখছে পৃথিবীর ভূতবাসী।

ঘুটাং গ্রহে মধ্যরাত। বড় বড় টাওয়ার থেকে ভেসে আসছে ঘুম পাড়ানি গান। সেই গানের তালে মেছোট্রন নামের গোবটটা বড় করে হাই তুলল। নিখুঁত অভিনয়! বিড় বিড় করে বললেন ভয়ানস্কি।

একটা উঁচু ভবনের নিচে দাঁড়িয়ে মেছোট্রন-৮৪০। গোয়েন্দাদের মতো লম্বা কোট আর হ্যাট পরে আছে। ভবনের সবচেয়ে ওপরের ঘরটার সামনে দাঁড়াল। দরজায় নক করল। ভেতর থেকে শোনা গেল একটা ছোট ছেলের গলা।

‘এতরাতে কে রে!’

‘আমি এক হতদরিদ্র রোবট। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি চার্জ ফুরিয়ে গেছে। দয়া করে যদি একটু চার্জ দিতেন।’

‘যাও যাও! মাফ করো!’

চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল মেছো। একটু পর দরজা খুলল। মেছোকে দেখেই লাফিয়ে উঠলো ছেলেটা।

‘একি তু তু তুমি যাওনি!’

‘একটু চার্জ…।’

‘ঠিকাছে। আসো।’

ঘরে ঢুকেই এদিক ওদিক দেখে নিল মেছো। ছেলেটা একা ঘুমাচ্ছিল। বাকিরা অন্য রুমে।

‘এই নাও প¬াগ। তবে বেশি চার্জ নিও না। আমাদের রোবট চিম্পুরও চার্জ লাগবে।’

‘হুম। তোমার রোবটটা কোথায়? ও কি ঘুমোচ্ছে?’

‘জানি না। ও মহা পাজি। মাঝে মাঝে ভূত সেজে ভয় দেখায়।’

কথাটা শুনে মেছোর সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলো গোটা ভূত সমাজ। মানুষের ভেতর থেকে তাহলে পুরোপুরি ভূতের ভয় কাটেনি।

‘তাই নাকি! ওকে ডেকে নিয়ে এসো।’

মেছোর চোখেমুখে দুষ্টু হাসি। একটা বুদ্ধি পেয়েছে সে। হাত বাড়িয়ে বিদ্যুতের তারটা নিল। গোবটদের চার্জ দিতে বিদ্যুত লাগে না। তাদের লাগে ফকফকা চাঁদের আলো। একটু পর ছেলেটার পেছন পেছন এল চিম্পু নামের রোবটটা। মেছোর দিকে তাকিয়েই পলিমারের চোখগুলো কুঁচকে ফেলল। মেছোও তার ঘাড় বাঁকিয়ে মাথাটা আরেকটু টাইট করে নিল।

‘আমার নাম চিম্পু। আমি কখগ সিরিজের ৫০ নম্বর রোবট। তোমার সমস্যা কী শুনি!’

‘আমি অমাবস্যা সিরিজের মেছোট্রন মডেলের রোবট। আমার সমস্যা হলো কদিন ধরে পেটটা খুব চুলকোচ্ছে। চার্জ দিতে গেলেই বমি আসে।’

এই বলে মেছো তার স্বচ্ছ পলিথিনের তৈরি পেটটা চুলকাতে লাগলো।’ খানিকটা ভয় পেয়ে গেল চিম্পু। সঙ্গে ছেলেটাও।

‘রো রো রোবটের বমি আসবে কেন!’

‘বিশ্বাস না হলে এই যে দেখ।’

বিদ্যুতের তারটা কামড়ে ধরল মেছো। ভীষণ এক ঝাকুনি খেল। যেন খুব শক লেগেছে। নিখুঁত অভিনয়। মুগ্ধ হয়ে দেখছেন ভয়ানস্কি। মেছো কেঁপেই যাচ্ছে। কাঁপছে তার পলিথিনের তৈরি পেটটাও। যেকোন মুহূর্তে ফেটে যাবে ওটা। সেদিকেই তাকিয়ে আছে চিম্পু আর ছেলেটা। দুজনই আতঙ্কিত। এই বুঝি পেট ফুড়ে সার্কিট বেরিয়ে এল! ধুড়ুম! একি! এত দেখি করলার বিচি! হা হয়ে গেল চিম্পুর ধাতব মুখখানা। ছেলেটাও অবাক। এমন রোবট জীবনেও দেখেনি সে। মেছোর পেট থেকে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এল একগাদা করলার বিচি আর একরাশ মরা তেলাপোকা! মেছোকে বেশ লজ্জিত দেখাচ্ছে। তার মুখটা হাসি হাসি। একটা রোবটের পেট থেকে এতগুলো তেলাপোকা দেখে আর জ্ঞান রাখতে পারল না চিম্পু। ধড়াম করে আছড়ে পড়ল তার ধাতব শরীরটা। আর ছেলেটা?

‘ভূ ভূ ভূ ভূত! মা! ভূত! মা রোবটকে ভূতে ধরেছে! ই ই ই!’

মেছো তার আসল রূপে ফিরে এসেছে। সেই আগের মতো চারটে জ্বলজ্বলে চোখ, খড়ের তৈরি তিনটে লিকলিকে হাত। মেঝে থেকে কুড়িয়ে পেটের ভেতর আবার ঢুকিয়ে দিল করলার বিচি আর মরা তেলাপোকাগুলো। মুখে অমায়িক হাসি। ভয়ানক এক কাকতাড়ুয়ার মতো দেখাচ্ছে তাকে। ছেলেটা চোখ বন্ধ করে চেঁচানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না।

এদিকে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন মহামান্য ভভু। বিভিন্ন এলাকা থেকে ভূতদের উল¬াসের খবর আসছে। হাজার বছর পর মানুষ আবার ভূতের ভয় পেয়েছে। খুশিতে ভয়ানস্কির গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দুফোঁটা চিরতার রস।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প