পাপ(পর্ব ১)

১.
কুমারখালি বাস স্ট্যান্ডে নামার পর ঘড়ি দেখল দীপ। রাত প্রায় আড়াইটা, চারদিকে শুনশান। একটা ভ্যান পর্যন্ত নেই। ঢাকা থেকে দুপুর চারটার বাসে রওনা দিয়েছিল, ফেরীতে বিশাল জ্যাম। তাই এত দেরি হল। বাসটা ওকে নামিয়ে দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল। পুরো জায়গাটাই ফাঁকা, কোন জনপ্রাণী নাই। দিনের বেলা কত গ্যাঞ্জাম থাকে, এখন কেমন যেন গা ছমছমে পরিবেশ।
মোবাইলে কল এসেছে। সীমা কল দিয়েছে।
হ্যালো।
এই কোথায় তুমি, পৌছাইছো বাসায়?
এই মাত্র বাস স্ট্যান্ডে নামলাম।
ওহ, আচ্ছা বাসায় যেয়ে ফোন দিও।
ঠিক আছে।
বাসা অবশ্য বাস স্ট্যান্ড থেকে খুব বেশি দুরে না। মিনিট পনেরো লাগে হেটে গেলে। বাসা বলতে এটা আসলে দীপের নানার বাড়ি। মামা-খালা বা কাজিনরা কেউ থাকে না। বড় বাড়ি প্রায় ফাঁকাই পড়ে আছে। সুজনের মা বলে এক মহিলা ভাড়া থাকে এক দিকের দুইটা রুম নিয়ে, উনিই দেখাশোনা করেন বাড়ির।
দীপ কুমারখালি আবহাওয়া অফিসে চাকরি করে। সেই সূত্রেই নানা বাড়িতে থাকে। এত বড় বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে, তাই আর অন্য কোথাও বাসা ভাড়া নেয়নি। আর কুমারখলি দীপের খুব ফেবারিট জায়গা। নানা নানি যখন বেঁচে ছিলেন, প্রতি ঈদে ও চলে আসত। এখানকার খোলা মাঠ, গাছ-পালা, পুকুর ওকে খুব টানে। তাই স্থানীয় ছেলেপুলেদের সাথে অনেক আগে থেকে ওর বন্ধুত্ব। তাছাড়া দীপ ব্লগে লিখালিখি করে, খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে। জানে অনেক কিছু, বই পড়ার নেশা ছোটবেলা থেকেই। যেকোন চায়ের আড্ডায়, তর্কে দীপ মধ্যমনি। তাই এখানকার এই চয়ন,সৌরভ,ফারুকরা শুধু ওর বন্ধু না, শুভাকাঙ্ক্ষী আর ভক্তও বটে। অনেক রাতে, ওরা সবাই আবহাওয়া অফিসের পিছনের বিলে মাচার উপর বসে আড্ডা দিয়েছে; অনেক রাত পর্যন্ত লালনের গান গেয়েছে। তারপর বাসায় ফিরেছে; তাই রাত করে বাড়ি যাওয়াটা দীপের নতুন না, কিন্তু অন্যদিন বন্ধুরা সাথে থাকে আর আজ একা, সাথে পরিবেশটাও কেমন যেন গা ছমছম করা।
সীমার সাথে ওর বিয়ে বেশিদিন হয়নি, সব মিলিয়ে আট মাস হবে। দীপ লালন ফকিরের ভক্ত, ওর বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না। বিয়ে মানে বাধাধরা বদ্ধ, বন্ধ জীবন। সকালে নাকে মুখে কিছু গুজে অফিসে যাও, বিকালে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে ফিরে আসো, সন্ধ্যায় চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় গল্প আর রাতের বেলা চুইংগাম। বেশতো চলছিলো, নতুন নতুন মেয়ে, নতুন নতুন প্রেম আর নতুন নতুন জীবন। তাছাড়া সাধু সন্যাসিদের সংগ দীপের খুব পছন্দ, গঞ্জিকা সেবনেরও অভ্যাস আছে। আর ও কড়া নাস্তিক, ধর্ম বিরোধী সব লিখালিখি দিয়ে ফেসবুক গরম করে ফেলে। কার দায় পরেছে এমন নাস্তিক নেশাকরা ছেলের কাছে মেয়ে গছানোর?
তবে সীমা মেয়েটা অন্যরকম, সব জেনে বুঝেই দীপের জীবনে এসেছে। দীপের সাথে ফেসবুকে পরিচয়, দীপের লিখা সব কিছুতে কমেন্ট করতো। বেশ গঠনমুলক সব মন্তব্য, দীপের মতামত গুলোকে শ্রদ্ধা করে সীমা, তবে সব কিছু মাথা নিচু করে মেনে নেয় না। ওর নিজস্বও চিন্তা ভাবনা মতামত আছে, ব্যাক্তিত্ত্ব আছে। এক্কেবারে এতিম মেয়ে, নিজের বলে কেউ নাই, এতিমখানায় মানুষ। বেশ কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছে, এখন একটা সিমেন্ট কোম্পানির একাউন্টস সেকশনে আছে। মহাখালীতে ওর অফিস, গ্রীন রোডে ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া করেছে ওরা বিয়ের পরে। বৃহস্পতিবার ওখানে মানে ঢাকা গিয়েছিল দীপ, আজ শনিবার ফিরেছে। ফেরিতে দেরি না হলে রাত এগারোটা নাগাদ পৌছে যেত।
একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটা দিল দীপ, উপজেলা পরিষদের অফিসটা পার হয়ে ডান দিকে বিশাল একটা পুকুর। পুকুর না বলে দীঘি বলা ভালো, পাড় বাঁধান, এখন অবশ্য ফাটল অনেক জায়গায়। ছোট বেলায় এই পুকুরে অনেক ধোড়া সাপ দেখেছে ও, পুকুরটার চারপাশে বড় বড় কয়েকটা সেগুন গাছ।
একটা বাদুর যেন সেই গাছের মাথায় ডানা ঝাঁপটাল, দীপ একটু চমকে গেল। এমনিতে এই রাস্তা হাতের তালুর মতো চেনা, কিন্তু আজকের পরিবেশ, এই নিস্তব্ধতা চমকাতে বাধ্য করলো। ওর মনে হলো পিছনে কেউ যেন আসছে। মাথা ঘুরিয়ে দেখে, দুইটা কুকুর। রাস্তার দুই পাশে, সামন্তরাল ভাবে এগিয়ে আসছে।
দীপের কেন যেন ব্যাপারটা ভালো লাগল না, সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে দ্রুত পা চালাল। সামনে রাস্তা বামে বাঁক নিয়েছে, ওই খানেই হাই স্কুল। স্কুল শেষ হলেই তালেব মোল্লার মুদিখানার দোকান আর বাড়ি, তারপরেই মসজিদ। মসজিদ থেকে একটু এগিয়ে গিয়েই বাম দিকে দীপের নানার বাড়ি, ওর গন্তব্যস্থল।
দীপের মনে হলো পিছনে মানুষের পায়ের শব্দ, ও তখন রাস্তার বাঁকের মুখে পৌছে গেছে। সাহস করে একটু পিছনে ফিরল, না কেউ তো নেই। কুকুর দুইটা আসছে। দীপ দাঁড়িয়ে গেল, দুইটা কুকুর একই গতিতে রাস্তার দুইপাশে হাঁ টছে…কেমন যেন ব্যাপারটা। কুকুর দুইটা অনেকটা কাছে চলে এসেছে, রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দীপ দেখতে পেল। দুইটা কুকুর, হ্যাঁ রাস্তার বাম পাশেরটা তো কুকুর, কালো রঙের; কিন্তু ডান পাশেরটা! ওটা তো কুকুর না!
ওটা একটা ছাগল, হ্যাঁ, ছাগলই তো! কালো আর বাদামি মিশিয়ে রং, মাথায় শিং আছে অল্প। প্রাণী দুটি ওর দিকে এগিয়ে আসছে, বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে। দীপের মেরুদণ্ড দিয়ে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেল একটা… কেউ যেন বলল পালাও! ওরা অশুভ, খুব বিপদ তোমার…
উল্টো ঘুরে উর্ধশ্বাসে দৌড় দিল দীপ…দৌড় দেয়ার আগে চোখের কোণা দিয়ে দেখলো যেন, প্রাণী দুটি এক হয়ে সাদা পোশাকের একটা কালো মানুষ হয়ে গেল। স্কুল পেরিয়ে তালেব মোল্লার দোকানের কাছে আসতেই কে যেন প্রচন্ড জোরে গুতা দিল পিছনে। জোরে একটা চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালো ও।
২.
আজ শরীরটা একটু ভালো লাগছে দীপের। গত দুইদিন বেশ ব্যাথা ছিল। ওই রাতে পড়ে যেয়ে মাথায় চোট পেয়েছিল, দাঁতে দাঁত লেগে ঠোঁটও কেটে গেছিল। শরীরের পিছনে, পিঠসহ সারা শরীরেই ব্যাথা ছিল।
ওর চিৎকার শুনে ওই রাতে তালেব মোল্লা বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে, দেখে দীপ রাস্তার পাশে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মাথা কেটে বেশ অনেকটা রক্ত বের হয়েছিলো।
ডাক্তার দেখেছে ওকে, চোট তেমন মারাত্মক না। এন্টিবায়োটিক দিয়েছে। সুজনের মা মহিলা এই কয়দিন ওর অনেক যত্ন করছে, একটু আগেই মাল্টার রস দিয়ে গেল।
পুরো গ্রামে ছড়িয়ে গেছে দীপকে জ্বীনে তাড়া করে গুতা মেরেছে, জ্বীনটা নাকি ছাগলের রুপ ধরে ছিল। দীপের নানা বাড়ি বলে আশেপাশে লতাপাতায় আত্নীয়ের অভাব নাই। সবাই আসছে এক এক করে, সান্ত্বনা দিচ্ছে, নীতি বাক্য শোনাচ্ছে। ওর ভাই-ভাবি, বোন-দুলা ভাই ও ফোন করে খোঁজ নিয়েছে। দীপের বাবা মা অবশ্য বেঁচে নেই।
একটু আগেই হেলেন খালা ঘুরে গেল। উপদেশের সাথে বলে গেলেন,
তোমার নানি খুব অসুস্থ, একটু শেষ দেখা দেখে এসো। আর আমাদের ওখানে আজ রাতে খেয়ো।
হেলেন খালা ওর আপন খালা না, মায়ের মামাতো বোন। পাশেই বাসা।
সন্ধ্যার দিকে তালেব মোল্লার দোকানে গিয়েছিল সিগারেট কিনবে বলে। তালেব মোল্লার দুই মেয়ে বড়টার বিয়ে হয়ে গেছে, ছোটটার বিয়ে দিতে বাকি, হাই স্কুলের ক্লাস নাইনে পড়ে। আর একটা ছেলে আছে বছর দশেকের, খোড়া, ঠিকমতো হাটতে পারে না। এটা তালেব মোল্লার নিজের ছেলে না, এক দূরসম্পর্কের আত্নীয়ের। ছেলেটার মা জন্মের সময়ই মারা যায়, তারপর তালেব মোল্লা আর ওর বউ নিয়ে আসে ছেলেটাকে। দীপ খুব স্নেহ করে ছেলেটাকে, মাঝে মাঝেই রিকশা করে ঘুরতে নিয়ে যায়, এটা ওটা কিনে দেয়।
আজ দোকানে যেয়ে বসতেই মসজিদের ইমাম সাহেব এসে বসলেন পাশে। দীপ এসব মানুষদের একটু এড়িয়ে চলে। নিজে নাস্তিক, ধ্যান-ধারণা আলাদা, এইসব ধর্ম-ভীরু মানুষদের সাথে কথা বলা শুরু করলেই ঝগড়া বেধে যায়। তবে ইমাম সাহেব খুব ভালো মানুষ, এই গ্রামের কেউ উনার সম্পর্কে একটা খারাপ কথাও বলতে পারবে না। খুব রাশভারি চেহারা, লম্বা দাড়ি। হজ্ব করে এসেছেন, বয়সও অনেক হয়েছে। দীপকে মাঝে মাঝে নামাজ পড়ার জন্য পাকড়াও করেন, পোশাক ঠিক নাই, ওযু করে আসি, এইসব বলে পালিয়ে বাঁচে।
কেমন আছ বাবা?
ভালো, আপনি?
আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমার শরীর এখন কেমন?
এখন অনেকটা ভালো।
হুম, একটা কথা জান বাবা, মৃত্যুর কোন জবাব নেই। এই পর্যন্ত কোন ওষুধ বের হয়নি যেটা মৃত্যু ঠেকাতে পারে। মরতে সবাইকে হবে, তুমি গরিব হও বা ধনী, রাজা হও বা প্রজা, তোমাকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। আজরাইল ফেরেশতা আসবেই তোমার জান কবয করতে।
দীপ চুপ করে থাকে।
আর এই মৃত্যুর পরও একটা জীবন আছে। আমরা সেটা বিশ্বাস করি, তোমরা করো না। এমনও হতে পারে তোমাদের বিশ্বাসটাই ঠিক। তাতে আমাদের আস্তিকদের কোন ক্ষতি নাই। কিন্তু আমাদের বিশ্বাসটা ঠিক হলে কিন্তু তোমাদের পুড়তে হবে দোজখের আগুনে।
তাই বলি আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখো, এতে তো তোমার কোন ক্ষতি নাই। এর জন্য সরকারকে তো কোন ট্যাক্স দিতে হবে না, তাই বিশ্বাস করলে ক্ষতি কি?
মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে যাচ্ছে, ইমাম সাহেব উঠলেন। দীপের হঠাৎ চোখ গেল ইমাম সাহেবের পিছনে.. ওটা কে দাঁড়িয়ে আছে? কালো একটা লোক, পুরো শরীর কাফনের কাপড়ে মোড়া। ইমাম সাহেব উঠলে, লোকটা একটু সরে গেল, ইমাম সাহেব ওযু খানার দিকে গেলেন। লোকটা ইমাম সাহেবের পিছু পিছু গেলো।
দীপের সারা শরীর কাঁটা দিচ্ছে, চোখ কচলে তাকাল। মাগরিবের আযান দিল, অনেক মুসুল্লি আসছে নামাজ পড়তে। না তো কারোর পিছে নেই লোকটি। ওকি ভুল দেখল নাকি? এত বাস্তব আর স্পষ্ট দেখেছে, ভুল হতেই পারে না।
তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরল দীপ। বাসায় ফিরে দীপ ওর বন্ধু শশীকে কল দিল। শশী দীপের স্কুলের বন্ধু, এখন একটা কলেজে ফিজিক্স পড়ায়।
সব শোনার পর শশী বললো,
আসলে পরিবেশটাই ছিল ভয় পাওয়ার মতো, তুই কেন…যে কেউই ভয় পেত। আর প্রথম বার তুই হয়তো ভালোকরে খেয়াল করিসনি, ওটা ছাগলই ছিল।
কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো ছাগল দেখে আমি ভয় পাব কেন? এটা তো বাঘ না।
হুম, আসলে তুই ধরে নিয়েছিলি ওটা কুকুর, হটাৎ দেখিস ছাগল, তাই হয়তো। আর ছাগল গৃহপালিত প্রাণী, ওই সময়ে ওই খানে ছাগল দেখাটা স্বাভাবিক না। কেউ এক্সপেক্ট করে না, কারন ছাগলতো সন্ধ্যা হলেই মালিক ঘরে বেঁধে রাখবে। তাই হয়তো তোর অবেচেতন মন তোকে সাবধান করে দিয়েছে, বলেছে পালাও।
কিন্তু আমি তো বেশ জোরে দৌড়েছিলাম, ছাগলটা কিভাবে এসে গুতা মারবে?
হয়তো ছাগল গুতা মারেনি, তুই হোঁচট খেয়ে পরেছিস।
কিন্তু তাহলে আমার শরীরের পিছন দিকে এত ব্যাথা কেন হবে? পাছা, পিঠ এমনকি মাথার পিছনেও প্রচন্ড ব্যাথা। হোচট খেয়ে উপুড় হয়ে পরলে তো শুধু সামনে চোট পাওয়ার কথা?
হুমম, তুই যে কিভাবে পরেছিস কেউ তো দেখেনি, তোরও ঠিক মনে নাই। আচ্ছা দীপ, এমন হতে পারে না, ছাগল-টাগল কিছু না, আসলে তোকে মেরেছে মানুষ।
মানুষ! মানে কি? কেন?
ওই ছিনতাইকারি টাইপের হবে হয়তো। তোকে মেরে লুটতে চেয়েছিল।
কিন্তু আমার মানিব্যাগ-মোবাইল কিছুইতো খোয়া যায়নি। হুম, তবে আমার একটা ব্যাপার খুব খটকা লাগছে।
কি?
দুইটা প্রাণী সেইম গোত্রের না, তারা রাস্তার দুইপাশে একই রিদমে হাঁটবে কিভাবে?
দীপ চুপ করে থাকে। একবার ভাবে ইমাম সাহেবের পিছনে দেখা কালো লোকটার কথা শশী কে বলবে…তারপর ভাবে না থাক, ওটা মনের ভুল হতে পারে।
শশী বলে চলে, যাইহোক তুই চিন্তা করিসনা। একটু সাবধানে চলাফেরা করবি। আর একটা জিনিস মনে রাখিস, ভূত বলে কিছু নাই।
ভূতে তো দীপও বিশ্বাস করে না। ও চরম নাস্তিক, বিধাতার অস্তিত্ব নিয়েই সন্দিহান,ভূততো কোন ছাড়। কিন্তু এই ঘটনার পর দীপের মনে হচ্ছে, ওর সাথে সবসময় কে যেন আছে, ওর পাশেই, কিন্তু ও দেখতে পারছে না, শুধু অনুভবে বুঝতে পারছে।
একটু পরেই সুজনের মা এসে জানাল,হেলেন খালা লোক পাঠিয়েছেন, উনার ওখানে যেতে হবে।
খালা চালার আটার রুটি আর গরুর গোশত রান্না করেছেন, দীপের জন্য। সাথে দুধ-চিতই পিঠা। রাতের খাওয়াটা জমলো ভালোই।
নানির অবস্থা বেশ খারাপ। অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে, ডাক্তারও হাল ছেড়ে দিয়েছে। উনাকে দেখতে বোধহয় অনেকেই আসে, তাই উনার রুম জুড়ে অনেক ফলমুল। স্যালাইন চলছে, কানেও কম শুনেন। হেলেন খালা দীপকে নিয়ে যেয়ে কানের কাছে জোরে জোরে বললো,
মা দীপ এসেছে, আমাদের শেলি আপার ছেলে।
নানি বিড়বিড় করে কি যেন বললো। দীপ বুঝতে পারল না।
নানির খাটটা অনেক পুরাতন, কিন্তু সুন্দর ফুল পাতার ডিজাইন করা। দীপের দৃষ্টি খাটের কোনার দিকে গেল।
ওকি!
ওই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, অবিকল একি রকম যাকে ইমাম সাহেবের পিছনে দেখেছিলো। কালো শরীরটা সাদা কাফনের কাপড় মোড়া। মাজার কাছ থেকে দেখা যাচ্ছেনা, কারণ খাটের ওপাশে নানির মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
দীপের সারা মেরুদণ্ড বেয়ে আবার সেই ভয়ের স্রোত নেমে গেল। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল চোখ বুজে, চোখ খুলতে ভয় লাগছে। কতক্ষণ ছিল জানে না, হেলেন খালা এসে ডাকল ওকে।
দীপ, এই দীপ৷ তোমার কি শরীর খারাপ।
নাহ ঠিক আছি।
বাসায় ফিরে ওই রাতে ঘুমাতে পারেনি দীপ। বার বার মনে হচ্ছে কেউ আছে ওর সাথে, সেটা কি ওই লোকটা? কালো… মুখটা বোঝা যায় না…সারা শরীরে সাদা কাফনের কাপড় মোড়ান…
চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে। ভয়ে চোখ খুলে ফেলেছে বারে বারে।
ভোরে একটু চোখের পাতা লেগে গেল। সকালে ঘুম ভেঙে দেখে বেশ বেলা হয়ে গেছে।
সুজনের মা এসে জিজ্ঞেস করলো,
মামা কি খাবেন? পরোটা আর ডিম ভাজব?
নাহ, দুধ রুটি খেতে ইচ্ছা করছে।
একটু পরে নাস্তা দিয়ে গেল সুজনের মা।
মামা, কাল রাতে দুইজন মারা গেছে।
কে কে? রুটি চিবোতে চিবোতে জিজ্ঞেস করল দীপ।
আপনার সেই নানি আর মসজিদের ইমাম সাহেব।
দীপের রুটি চিবানো বন্ধ হয়ে গেল।
৩.
ঘটনাটি বেশ আগের,দীপরা তখন সৈয়দপুরে থাকে, বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে। সুফিয়াকে নিয়ে আসে ওর মা, দীপদের বাসায় কাজের জন্য। সুফিয়া, ফর্সা, মোটাসোটা, গোলগাল। পরিবারে ওর মা আর ছোট একটা বোন ছিলো, ছোট বোনটাও ওর মতো গাব্দা-গুবদা ছিল। প্রতি মাসের প্রথমে সুফিয়ার মা ওর ওই বোনকে নিয়ে আসত দীপদের বাসায় , সুফিয়ার বেতন নিয়ে যেত। ওর বোনটা ছোট হলেও অনেক ভাত খেতো, দীপের মনে আছে; অনেক গরিব ছিল ওরা।
সেই সুফিয়া, দীপদের বাড়ি থেকে খেয়ে পরে, তেল সাবানে, আরো বেশি সুন্দর হয়ে গেল। গায়ের রংটা আরও উজ্জল হলো, গ্রামের মেয়ে বলে একটু বাড়ন্ত ছিলো শরীর। শরীরে যৌবন এসে গেল তাড়াতাড়ি; দীপ তখন ইন্টার ফাস্ট ইয়ার, নাকের নিচে গোঁফের সরু রেখা। নিষিদ্ধ বই পড়া ধরেছে, নারী শরীরের প্রতি অমোঘ আর্কষন। সুফিয়া ফ্রক পরতো, বাড়ন্ত শরীর বলে বুকটা উঁচু হয়ে থাকত। দীপের চোখে পড়ে গেল, বয়সের দোষে ওকে ভেবে মাস্টারবেট করতো। একদিন বাসায় কেউ ছিল না, আব্বা-আম্মা একটা দাওয়াতে গেছে, বোন ইউনিভার্সিটিতে, ভাই বাইরে। ফাঁকা বাসা পেয়ে সুফিয়াকে চেপে ধরলো দীপ। প্রচন্ড বাধা দিল সুফিয়া, কান্নাকাটি করলো। দীপ তখন প্রথম নারী শরীরের ছোঁয়া পেয়ে উত্তেজিত, উন্মত্ত আর মরিয়া। কোন বাধা মানলো না, তবে কাজটা শেষে অনেক ভয় পেয়েছিল। সুফিয়াকে অনেক ভয় দেখিয়েছিল, কাউকে না বলার জন্য। ও বলেনি, পরে আরও কয়েকবার সুযোগ বুঝে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দীপ। গোলমালটা বাঁধে মাস তিনেক পর, সুফিয়ার পেটে বাচ্চা চলে আসে। দীপের আম্মা একদিন ওকে ধরে বেদম পেটায়, তারপর সুফিয়ার মাকে ডেকে অনেকগুলো টাকা হাতে ধরিয়ে বিদায় করেন।
দীপের জীবনের প্রথম বড় অন্যায়, বড় একটা পাপ। তারপর অনেক পাপ করেছে ও, তবে এটার কথা ভুলতে পারে না। পাপ কে করে না, সবাই করে। কেউ কম, কেউ বেশি। আজ গ্রীন রোডের বাসায়, রাতে বসে বসে সেই সব ভাবছিল দীপ।
সীমা ঢুকল দুই কাপ কফি নিয়ে। দীপ অফিস থেকে দশ দিনের ছুটি নিয়ে ঢাকা চলে এসেছে। এখানে এসে ভালোই আছে, ওই সাদা কাফনের কাপড়ে মোড়া লোকটাকে আর দেখেনি।
সীমা প্রত্যেক দিন সকালে উঠে একবারে সকালের নাস্তা আর দুপুরের তরকারি রান্না করে অফিস যায়। দীপ দুপুরের ভাতটা নিজেই ফুঁটিয়ে নেয়। বিকালে সীমা ফিরলে এক সাথে চা খায়। বেড়াতে যায়… ধানমন্ডি লেক, বসুন্ধরা সিটি, হাতিরঝিল সব ঘোরা হয়ে গেছে। একদিন নিউমার্কেটে শপিংয়ে গেছিলো, রাতে পুরান ঢাকার হাজির বিরিয়ানি খেয়েছে দুইজনে।
শোন কাল দুপুরে তুমি আমার অফিসে যাবে। আমার কলিগরা তোমাকে দেখতে চেয়েছে। আমি কাল হাফ ছুটি নিব, অফিস থেকেই যমুনা ফিউচার পার্কে যাবো। মুভি দেখে, রাতে খেয়ে ফিরব। সীমা বলে।
কফিতে চুমুক দিতে দিতে দীপ মাথা নাড়ে।
পরদিন দুপুরে সময় মতো সীমার অফিসে গেল দীপ, মহাখালী ডিওএইচএস এর মধ্যে অফিস। সুন্দর, সাজানো গোছানো, ছিমছাম। সীমার কলিগরাও বেশ আন্তরিক, দীপের জন্য স্পেশাল নাস্তার ব্যাবস্থা করেছে। বের হওয়ার আগে সীমা বললো, চলো তোমাকে সিএফও স্যারের সাথে পরিচয় করিয়ে দি। আর বের হাওয়ার আগে বসকে বলে বের হই।
পুরু কাঁচের দরজা ঠেলে সিএফও স্যারের এয়ার কন্ডিশন রুমে ঢুকেই চমকে উঠলো দীপ। ওইতো, উনার চেয়ারের পিছনে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। কালো, সাদা কাফনের কাপড় পড়া, চেয়ারের পিছনে বলে শরীরের অর্ধেক দেখা যাচ্ছে। উনার রুম থেকে বের হয়ে যমুনা ফিউচার পার্ক, মুভি, রাতের খাবার কিছুতেই ঠিক মতো মনযোগ দিতে পারলো না দীপ। শুধু মনে হচ্ছে, কে ওই লোকটা, দীপ ওকে কেন দেখছে? এর আগে যাদের পিছনে দেখেছিলো তারা মারা গিয়েছে…তাহলে কে ওটা? মৃত্যু? নাকি সেই আজরাইল ফেরেশতা?
বাসায় ফিরে বিছানায় বসে এইসব ভাবছিল ও। বাইরে মাইকে কি যেন বলছে ; করনা নামের একটা ভাইরাসে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে, চীনে এর উৎপত্তি , সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। আজ বাংলাদেশেও তিন জনের শরীরে পাওয়া গেছে করনা ভাইরাস। সেই সংক্রান্তই কোন ঘোষনা হবে হয়ত।
সীমা ওয়াশ রুম থেকে বের হলো। একটা পাতলা সুতির শাড়ি পড়া শুধু, ব্লাউজ ছাড়া। একটু মোটা বলে মাজার কাছে ভাঁজ হয়ে রয়েছে, এতে ওকে আরও আর্কষনীয় লাগছে। একটু মোটা হলেও ওর চেহারা খুব মিষ্টি, এক মাথা চুল, এখন খোলা রেখেছে, পুরো চুল পিঠের উপর ছড়িয়ে আছে।
এই তোমার কি হয়েছে, কি ভাবছ এতো? আমাকে কি বলা যাবে? আজ তোমাকে অনেক অন্যমনষ্ক লাগছে…সীমা লাইট নিভিয়ে ডিম লাইট জ্বেলে দীপের পাশে ঘন হয়ে বসল। দীপের গালে ওর আঙুল ছোঁয়াল।
দীপের ভাবনায় ছেদ পরল, সীমা দু হাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরেছে, দীপের মুখের খুব কাছে ওর মুখ, ওর গরম নিঃশ্বাস এসে দীপের মুখে পড়ছে। দীপ সীমার কোমরে হাত দিয়ে আরো কাছে টেনে নিলো। সীমার শাড়ির আঁচল কিছুটা সরে গেছে, একটা স্তন্যের অনেকটা দেখা যাচ্ছে।
মাইকিং এখন বেশ জোরে শোনা যাচ্ছে, যে রিকশায় করে মাইকিং করে সেটা মনে হয় এখন ওদের বাসার সামনে…
দীপের কান দিয়ে কিছুই ঢুকছে না, আসলে এমন বন্ধ ঘরে ডিম লাইটের অল্প মায়াবী আলোয় অর্ধনগ্ন কোন জলপরীকে পাশে নিয়ে অন্য আর কিছুতে মনযোগ দেওয়া যায়না…
৪.
সেই শুনশান রাস্তা, দীপ একা হাটছে। পিছনে ফিরে দেখে সেই কুকুর আর ছাগলটা। রাস্তার দুইপাশে, একই গতিতে ঠিক যেন ছন্দ মিলিয়ে দীপের পিছনে পিছনে আসছে। প্রাণী দুটি হিংস্র না, ছুটে আসার মধ্যে কোন আক্রোশ নেই, মনেই হচ্ছেনা ওরা কাউকে আক্রমণ করবে বা ঝাঁপিয়ে পড়বে। তারপরও ওদের ছুটে আসার মধ্যে কি যেন একটা আছে, ভয়ের…বলে বোঝানো যাবে না…অমন পরিবেশে নিজেকে আর প্রাণী দুটিকে কল্পনা করলে ভয়ের ঠান্ডা স্রোত, শিরদাঁড়া বেয়ে আপনাআপনি নেমে যাবে। দীপ ওদের দেখে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো, ওরাও মনে হলো গতি বাড়ালো, আর সেটা দীপের থেকে বেশি। কারন দুরত্ব ক্রমশ কমছে, প্রাণী দুটি দীপের অনেক কাছে এসে পরেছে, হঠাৎ প্রাণী দুটি এক হয়ে সেই সাদা কাফনের কাপড় পরা কালো লোকটা হয়ে গেল…দীপের একদম পিছনে…
দারুণ চমকে ঘুম ভাংলো দীপের। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। দীপ বিছানা থেকে উঠে ওয়াশ রুমে গেল, দুপুরে ভাত ঘুম দিয়েছিলো। দুঃস্বপ্নে ঘুম ভাংলো, এখন বেলা পরে গেছে।
সীমা আর দীপ দুইজনেই এখন কুমারখালির বাড়িতে। দেশে অঘোষিত কারফিউ চলছে, করনা ভাইরাসের প্রভাবে। সবাইকে বাসায় থাকতে বলা হচ্ছে, কারণ ছাড়া বের হলে পুলিশ ধরে পেটাচ্ছে। সীমা ছুটি ঘোষণার সাথে সাথেই কুমারখালি চলে এসেছে। বন্দী বাসায় ওদের নব দম্পতির সময় খারাপ কাটছে না।
ওই রাতেই সীমাদের অফিসের সিএফও স্যার সুইসাইড করে, কেন করে কারণটা জানা যায়নি। তবে তার মৃত্যুর খবরে দীপ বিচলিত হয়নি, তার মৃত্যু যে সন্নিকটে এটা তো আর কেউ না জানলেও দীপ জানতো। তবে তারপরে দীপ ফোন দিয়ে শশীকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। সব শুনে শশী বলে,
আমার এখন মনে হচ্ছে ওই রাতে তোকে কোন মানুষই মেরেছিল। তার চেহারা তুই আবছাভাবে দেখেছিলি, সেই মানুষটাকেই তুই কল্পনা করছিস।
আচ্ছা বুঝলাম, আমি কল্পনা করে ওই মানুষটাকে দেখছি, কিন্তু যাদের পিছনে দেখছি তারা মারা যাচ্ছে কেন? এটার কি ব্যাখ্যা দিবি?
দেখ যে মানুষ গুলো মারা গেছে, তারা হয়তো এমনিতেই মরতো। তুই ওই লোকটাকে দেখেছিস বলে মারা গেছে এমন নয়। লোকটা ছিল তোর কল্পনা, কারন তুই ছাড়া আর কেউ লোকটাকে দেখেনি। আর যে মানুষগুলির পিছনে দেখছিস, তারা মারা যাওয়ার ব্যাপারটা কাকতালীয়। আর যে তিনজন মারা গেছে তাদের মধ্যে দুইজন ছিলেন অনেক বয়স্ক, একজন তো মৃত্যু পথযাত্রি ছিলেন বলা যায়। তাই এটা নিয়ে ভাবিস না আর, দেখিস তাহলে আর দেখবি না। আর তারপরও যদি আরো কয়েকজনের পিছনে দেখিস আর তারা মারা যাই, তাহলে বুঝবো, তোর কোন সুপারন্যাচারাল পাওয়ার আছে। কিন্তু চিন্তার জায়গা অন্যখানে…
কি?
তোর উপর এট্যাক করলো, কিন্তু তোর কিছু নিয়ে গেল না, লোকটার মতলব কি ছিল? যাইহোক তুই খুব সাবধানে চলাফেরা করবি।
দীপ করেও অবশ্য, খুব প্রয়োজন ছাড়া বের হয় না, বাসা থেকে। আজ অবশ্য ওয়াশ রুম থেকে বের হতেই সীমা বললো,
এই একটু বাজারে যেতে হবে। ডিম শেষ, একটু বেশি করে নিয়ে এস, পুডিং বানাবো। আর ওই জিনিসটা শেষ হয়ে গেছে, মনে করে নিয়ে এসো। বলে মুচকি হাসল।
অনিচ্ছা সত্বেও দীপ বের হলো। তালেব মোল্লার দোকানে ওর খোঁড়া ছেলেটা বসে আছে, ওইখান থেকে সিগারেট কিনে পকেটে পুরলো দীপ। ওই দোকানে ডিম নাই, থাকলে কিনে ফেলতো। দুইটা লেবু লজেন্স কিনে একটা ছেলেটাকে দিয়ে অন্যটা মুখে পুরে চুষতে চুষতে বাজারের উদ্দেশ্য হাটা দিলো দীপ।
বাজারে মানুষ একদম কম। নেই বললেই চলে, অন্যসময় বাজারটা গমগম করে। এই বাজারে রেললাইনের পাশে এক ধরনের ঝাল মুড়ি পাওয়া যায়। এগারো থেকে বার রকমের মসলা, ভেজা ছোলা আর পেঁয়াজু দিয়ে বানায়।খুবই সুস্বাদু আর মুখোরোচক।
ওষুধের দোকান থেকে প্রটেকশন কিনে, মুদিখানার দোকান থেকে দুই হালি ডিম কিনল দীপ।
দীপ মামা, কেমন আছেন?
দীপের পরিচিত নাপিত ছেলেটা ডাকল। দীপ ওর দোকান থেকেই চুল কাটায়। খুব ভাল মাথা ম্যাসাজ করে ছেলেটা।
এই তো ভালো, তোমার কি খবর।
ভালো না মামা, আজ তিনদিন পর দোকান খুললাম, তাও কুনো কাস্টমার নাই। আবার ডরও লাগে, কখন পুলিশ এসে মাইর দেয় দোকান খুলছি বলে। এই রকম চললি না খেয়ে মরব।
দীপ কি মনে করে ওর দোকানে ঢুকলো, আয়নায় দেখে নিজের চুল ঠিক করতে যাবে কিন্তু আয়নার দিকে তাকিয়েই দারুণভাবে চমকে উঠল।
একি! ওই লোকটা, হ্যাঁ, একদম ওই লোকটা। কালো, সাদা কাফনের কাপড় পড়া, দীপের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। দীপ চকিতে পিছনে ঘুরল, কই কেউতো নাই। আয়নায় আবার দেখল, না, ওই লোকটাই, দীপের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।
ফ্যাকাসে মুখে নাপিত ছেলেটার কাছে যেয়ে দীপ বললো,
আমার খুব বিপদ ভাই। আমাকে একটু বাসায় পৌছে দিবে?
কি যে বলেন মামা, এখন কিসের বিপদ? চুর ডাকাত কিচ্ছু নাই গা। রাত বেশি হয়নি, চইলা যান গা। দোকানে কেউ নাই গা, দোকান ফাঁকা রাইখ্যা আপনার সাথে যাওন যাইব না।
দীপ একে একে সব গুলো বন্ধুকে ফোন দিল। কেউই এখন বাসা থেকে বের হতে রাজি হলো না। আসলে ওরা বুঝছে না, দীপের কত বড় বিপদ, আর দীপ বোঝাতেও পারছে না।
শেষ-মেশ সীমাকে ফোন দিলে ও সাহস দিয়ে বললো,
ভয়ের কিছু নাই। তুমি চলে আস, আমি সুজনের মা কে নিয়ে তালেব মোল্লার দোকানের সামনে আছি।
দীপের খুব অসহায় লাগছে। ওর এত বড় বিপদ অথচ কাউকে পাশে পাচ্ছে না। মৃত বাবা-মার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে, গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে।
বাস স্ট্যান্ড পার হলো। সামনে সেই শুনশান রাস্তা, এবার স্বপ্ন নয়, বাস্তব। দীপ কড়া নাস্তিক হলেও আজ এখন মনে হচ্ছে ঈশ্বর বলে আসলেই একজন আছেন, মানুষ সব হারিয়ে যার কাছে হাত পাতে। মনে পড়ছে ছোট বেলার কথা, পাঞ্জাবি পায়জামা আর টুপি পরে আব্বার সাথে নামাজ পড়তে যেত শুক্রবারে। রোজার সময় তারাবির নামাজে সিজদা দিয়ে আর উঠতো না। মানুষ ভোরের সুখের ঘুম নষ্ট করে নামাজ পড়তে কেন যায় বুঝতে পারছে। মৃত্যু ওর খুব কাছে, মনের ভেতরে জোরে জোরে কলেমা তাইয়্যিবা পড়তে লাগলো।
দীপ বার বার পিছনে তাকাচ্ছে, ওর মনে হচ্ছে বিকেলে দেখা স্বপ্নের কথা। ছাগল আর কুকুরটা মনে হয় এখনই তেড়ে আসবে ওর দিকে। দিঘিটার কাছে আসতেই একটা বিড়াল যেন কোথায় কেঁদে উঠলো। দীপ খুব চমকে গেলো।
ছোট বেলায় আম্মা বলতেন, আজরাইল ফেরেশতা যখন দুনিয়াতে কারো জান কবয করতে আসেন, তখন উনি যে বাহনে আসেন, সেই বাহনের শব্দ তরংগ নাকি অনেক বেশি। মানুষ শুনতে পায় না, কিন্তু কুকুর বিড়াল বুঝতে পারে, তাই কেঁদে উঠে।
আজ না জানি কার জান কবয হবে, দীপের নয়তো?
ভয়ের সেই শিরশিরে অনুভূতি পুরো শরীরটাকে অবশ করে দিল। দীঘির পাশে দাঁড়িয়ে দীপ আবার পিছনে ফিরল, সেই ছাগল আর কুকুরটা আসছে কিনা দেখার জন্য।
হয়তো জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে বসল ও, কারন দীঘির পাশে লাগানো সেগুন গাছের আড়াল থেকে সাদা পোশাক পড়া মিশমিশে কালো একটা লোক বের হয়ে আসলো। দীপ যদি সামনে তাকাতো, তাহলে হয়তো লোকটিকে দেখতে পেত, কিন্তু ও তখন অন্য দিকে ঘুরে আছে। এই সুযোগে সাদা পোশাকের সেই মিশমিশে কালো লোকটা বিড়ালের মতো নিঃশব্দে এগিয়ে গেল দীপের দিকে…

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প