রিনার শাশুড়ি মারা যাবার আগে বলে গিয়েছিলেন, ‘আমি মারা যাবার পর সংসারের কিছুই পাল্টাবা না। ঘরের সবকিছু যেমনভাবে রেখে যাচ্ছি, ঠিক সেভাবেই রেখো।’
শাশুড়ি মারা যাবার পরের সপ্তাহেই রিনা ঘরের সবকিছু পাল্টিয়ে ফেললো। নিজের মতো সাজালো ঘর। তার শ্বশুর তাকে সাপোর্ট করলো। স্বামী করেনি। রাশেদ সোজাসুজিই বলে দিলো, ‘মায়ের সাজানো ঘর তুমি যেভাবে ওলোটপালোট করছো, আমি তোমাকে জীবনেও ক্ষমা করবো না।’ রিনা রাশেদের কথার গুরুত্বই দিলো না। এ সংসার এখন তার। এই বাড়ি এখন তার। সে সব কিছু নিজের মতো রাখবে।
রিনা এমনটা করতে চায়নি কখনো। যখন ওর বাসায় প্রথম বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো, ওর খুব ভালো লাগছিলো ও একজন শাশুড়ি পাবে জেনে। রিনা মায়ের আদর কখনো পায়নি। জন্মের সময় ওর মা মারা যায়। বাবা আর বিয়ে করেননি। ওকে একাই মানুষ করেছেন। ওকে আদরে রেখেছিলেন সবসময়। কিন্তু মায়ের অভাব তো আর তিনি পূরণ করতে পারবেন না শত চেষ্টা করেও। রিনার মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করতো মায়ের আদর পেতে। ওর বান্ধবীরা যখন মায়েদের নিয়ে গল্প করতো, মা এটা করেছে সেটা করেছে, সে বান্ধবীদের সামনে থেকে সরে যেত। কাউকে তার মা আদর করছে দেখলেই তার চোখে পানি চলে আসতো। কোনোভাবেই সে সেই কান্না আটকাতে পারতো না।
ওর বিয়ের প্রস্তাবগুলো আসবার সময় থেকেই ও একটা ব্যাপারে খুব আনন্দে ছিলো। যে বাড়িতেই যাক, ও একজন শাশুড়ি পাবে। শাশুড়ি আর মা নাকি সমান হন না। সে এসব কথা মানবে না। শাশুড়িকে সে একদম মায়ের মতো দেখবে। মায়ের আদরের সবটুকু সে আদায় করে নিবে শাশুড়ির কাছ থেকে।
রিনার বিয়ে হলো রাশেদের সাথে।
বিয়ের পরদিন সকালবেলা, খুব ভোরেই রিনার শাশুড়ি তাকে ডাকতে এলেন। দরজা জোরে জোরে বাড়ি দিতে লাগলেন। রিনার তবুও ঘুম ভাঙছিলো না। বাবার বাড়িতে ওর দেরিতে ওঠার অভ্যাস। রাশেদই শেষ পর্যন্ত ওর ঘুম ভাঙিয়ে দিলো, ‘এই, মা ডাকছে।’
রিনা দরজা খুললো। খুলেই দেখলো, শাশুড়ি ভয়ানক রাগী চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
‘নবাবের বেটি হয়েছো? শাশুড়িকে এতোক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছো দরজার সামনে। বাপে ভদ্রতা শেখায়নি?’
রিনা অবাক হয়ে গেলো। কিন্তু তার অবাক হবার আরো বাকি ছিলো। ওর শাশুড়ি বললেন, ‘এখনই গোসল করে রান্নাঘরে এসো।’
ডিসেম্বরের শেষ। শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। রিনা বললো, ‘মা, একটু গরম পানি করে দিবেন?’
রিনার শাশুড়ি তার দিকে এমনভাবে তাকালেন, যেন সে এখনই একটা মানুষ খুন করে আরেকটাকে খুন করার পারমিশন নিচ্ছে।
তিনি ভয়ানক গর্জে উঠে বললেন, ‘পানি চাও? গরম পানি? চামড়া কি টিস্যু পেপার দিয়ে তৈরি করা, একটু শীতেই গরম পানি লাগবে? পানি গরম করতে গ্যাস খরচ হয় না? নবাবের বেটি এসেছে, এতো খরচের হিসাব সে কি করে বুঝবে? শুনো, সাফ কথা, এ বাসায় থাকতে হলে চামড়া শক্ত করে থাকতে হবে। গন্ডারের মতো শক্ত চামড়া। নাইলে কিন্তু বাসায় টিকতে পারবা না একদম।’
বলেই তিনি হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন।
রিনার খুব খারাপ লাগছিলো। ওর চোখে একদম পানি চলে এলো। ও অবাক হয়ে রাশেদের দিকে তাকালো। রাশেদ বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রাতে এই মানুষটাই ওর কানে কি মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছিলো। এখন ওর মা যে এতোগুলো কথা বলে গেলো রিনাকে, রাশেদট সব শুনেছিলো, কিন্তু একটু প্রতিবাদও করলো না।
রিনা সেদিনই বাড়ির সবার পরিচয় পেয়ে গিয়েছিলো।
রিনার শাশুড়ির নাম ছিলো কামরুন্নাহার। তিনি এমনভাবে সংসার সামলাতেন, যা দেখলে স্বয়ং হিটলার লজ্জা পেয়ে যেত। সে বলতো, ‘কামরুন্নাহারের সংসার চালানোর মতো আমি জার্মানি চালালে এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমার ভরাডুবি হতো না।’ পান থেকে চুন খসলেও কামরুন্নাহার পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলতেন। একটা মানুষকেও তিনি নিস্তার দিতেন না।
কামরুন্নাহারকে রিনা ভয় পেতো। রাশেদ ভয় পেতো। রিনার শ্বশুড় ভয় পেতেন। রিনা একবার শুনেছিলো, ওর শ্বশুড়ের মা, মানে তার শাশুড়ির শাশুড়িরও তাকে ভয় পেতেন। মারা যাবার সময় নাকি তিনি তার ছেলেকে বলেছিলেন, ‘মাফ করে দিস বাবা। তোকে কষ্টের মধ্যে রেখে গেলাম।’ তিনি নিজেই কামরুন্নাহারকে ছেলের বউ হিসেবে পছন্দ করেছিলেন।
এই ভয়ানক জাঁদরেল মানুষটা কোভিডের কাছে ধরাশায়ী হয়ে গেলেন। করোনায় প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছিলেন বেচারি। কিন্তু তার ঠাটবাট তবুও কমেনি। শেষ সময়ে রিনাকে যে তার সংসারের সবকিছু একইরকম রাখার আদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, সেটাও খুব কড়া ভাষায়। সেই কণ্ঠটা মনে পড়লে রিনা আজও ভয়ে কেঁপে ওঠে।
কামরুন্নাহার মারা গেলেন। রিনা হঠাৎ কেমন একটা অদ্ভুত স্বাধীনতা পেয়ে গেলো। সেই স্বাধীনতার শক্তিতেই পুরো বাড়ির সবকিছু পাল্টে ফেললো সে।
রাশেদ যদিও ব্যাপারটা মানতে পারলো না। মাকে ভয় পেলেও খুব মা ভক্ত ছিলো সে। মা চলে যাবার সাথে সাথে মায়ের সাজানো ঘরের এতো পরিবর্তন হয়ে যাবে, সে ভাবতে পারেনি। রিনার ওপর রাগ করলো সে। কিন্তু রিনাকে দূরে ঠেলে দিতে পারলো না। এতোদিনে রিনা খুব সুন্দরভাবে বুঝে গেছে, রাশেদ কিসে খুশি হয়।
তাদের জীবন আবার স্বাভাবিকভাবে চলতে লাগলো।
একদিন, রাতের বেলা। রিনা রাশেদের পাশ ঘেঁষে শুয়ে আছে। রাশেদ ওর অফিসের গল্প করছে। কোন এক কলিগ নাকি বউ বাচ্চা থাকতেও ফেসবুকে কোন মেয়ের সাথে প্রেম করে, সেই গল্প। গল্পটা বেশ মজার। রিনা মন দিয়ে শুনছিলো। সেই কলিগের ওয়াইফ আর গার্লফ্রেন্ড একইসময় অফিসে চলে এসেছে, গল্পে যখন এমন একটা অবস্থা এসেছে, রিনা তন্ময় হয়ে শুনছে গল্প, ওর মনে কেবল চিন্তা এখন গল্পে কি হবে, ঠিক সেই সময় পাশের ঘর থেকে ও একটা শব্দ পেলো। কাশির শব্দ। ওর শাশুড়ি মারা যাবার আগে করোনার সময় যেভাবে কাশতেন, ঠিক সেরকম এক শব্দ। ওর শাশুড়ি পাশের ঘরটাতেই মারা গিয়েছিলেন। ঐ ঘরে কেউ থাকে না।
রিনা ভয়ে কাঠ হয়ে গেলো। রাশেদ জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে?’
‘তুমি পাশের ঘরে কোনো শব্দ পেয়েছো?’
‘না তো।’
‘কাশির শব্দ?’
‘উহু।’
‘আমার মনে হলো। কে যেন কাশলো।’
‘বাইরের কোনো শব্দ শুনেছো মনে হয়।’
রাশেদ আবার গল্প বলা শুরু করলো। রিনার কানে আর গল্পের একটা শব্দও ঢুকলো না। সে কান খাঁড়া করে রইলো পাশের রুমে কোনো শব্দ হয় কিনা শোনার জন্য। কোনো শব্দই আর পাওয়া গেলো না।
সারারত রিনা জেগে রইলো। পাশের রুম থেকে কোনো শব্দ আসে কিনা শোনার চেষ্টা করলো। না, আর কোনো শব্দই এলো না। তবুও রিনার ঘুম এলো না। তার বারবার মনে হচ্ছিলো, চোখ বুজলেই সে শব্দটা পাবে। তার কেন যেন ভয় লাগছিলো। খুব ভয়।
পরদিন রিনার বাড়ির ঝুটা বুয়া সুরমার মা আসলেন। তিনি দেখেন, প্রতিদিন রিনা তার সাথে থেকে থেকেই সব কাজ করিয়ে নেন, কোনো কোনোদিন নিজেও হাত লাগায়। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা অন্যরকম। আজকে রিনা কেন যেন মাঝের ঘরটায় যেতে চাইছে না।ও সুরমার মাকে কেবল বলে দিলো, ‘খালা, ঘরটা আপনিই ঝাড় দিয়ে মুছে ফেলেন। আমি ঐ ঘরে ঢুকবো না।’
সুরমার মা ঘরটায় ঢুকলেন। তেমন কোনো পরিবর্তন দেখতে পেলেন না। আগের চাচি-আম্মা মারা যাবার পর রিনা ঘরটা যেভাবে সাজিয়েছিলো, এখনও তেমনই আছে ঘরটা। ঘরটার জানালার পাশে বিছানা, একটা শোকেস, একটা টেবিল চেয়ার। কেবল জানালায় পর্দা টানানো দেখে ঘরটায় আবছা অন্ধকার। এই ঘরটা গেস্টরুম। কেউ এমনিতে থাকে না। চাচি-আম্মার করোনা হবার পর থেকে উনাকে এখানে রাখা হয়েছিলো। উনি এই ঘরেই মারা যান।
সুরমার মা ঘর পরিষ্কার করে ফেললেন। ঘর থেকে বের হবার সময় দেখলেন, রিনা কেমন আতংকিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রিনার এমন মুখ সুরমার মা আর দেখেননি। দুখী মুখ দেখেছে। চাচি-আম্মা বেঁচে থাকতে রিনার মুখে কেমন একটা দুঃখ দুঃখ ভাব লেগে থাকতো। তিনি সেজন্য রিনাকে দোষ দিতে পারেন না। চাচি-আম্মাটা পুরো এক দজ্জাল মহিলা ছিলেন। সুরমার মা নিজে তার জ্বালায় কয়েকদিন এই বাড়ির কাজ ছেড়ে দিতে চেয়েছিলো। তখন কাজের অভাব ছিলো দেখে পারেননি। এখন রিনার হয়ে কাজ করতে তার খুব ভালো লাগে। মেয়েটা ভীষণ ভালো।
রিনা জিজ্ঞেস করলো, ‘সুরমার মা, আপনি ঐ ঘরে কাজ করার সময় কোনো শব্দ শুনেছিলেন?’
সুরমার মা বললেন, ‘না তো আপা। তেমন কিছু শুনি নাই।’
‘আচ্ছা, যান।’
সুরমার মা চলে আসলেন। আসার সময় দেখলেন, রিনার মুখের আতংক ভাবটা একটুও যায়নি।
কয়েকদিন পরের কথা। রাতের বেলা। রাশেদের আজ রিনাকে খুব কাছে টানতে মন চাচ্ছিলো। কিন্তু রিনা একদম সাড়া দিলো না। রাশেদের একটু রাগ লাগলো। কয়েকদিন ধরেই এমন করছে রিনা। কি হয়েছে ওর?
রাশেদ রিনাকে জিজ্ঞেসই করে ফেললো, ‘তোমার কি হয়েছে, বলোতো? সারারাত তো দেখি ঘুমাও না।’
রিনা বললো, ‘আমার কিছু হয়নি।’
‘নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। কিছু না হলে তুমি এমন আতংকে থাকো কেন সারাদিন?’
‘কই আতংকে থাকি?’
‘থাকো। আমি তো বুঝি। বলো তো, কি হয়েছে তোমার?’
রিনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে কেমন ভয় পাওয়া গলায় বললো, ‘আচ্ছা রাশেদ, তুমি কি রাতে পাশের রুমে কোনো শব্দ পাও?’
‘না তো।’
‘সত্যিই পাও না?’
‘না। একদম কোনো শব্দই পাই না।’
রিনার মুখটা হঠাৎ পাল্টে গেলো। ভয়ানক আতংকের ছাপ সেই মুখটায়। রিনা ফিসফিস করে বললো, ‘আমি না একটা শব্দ শুনি। ঘরে হেঁটে বেড়ানোর শব্দ। কে যেন সারারাত পাশের রুমে হেঁটে বেড়ায়।’
‘কি বলো? সত্যিই এমন শব্দ পাও?’
‘হু।’
‘আচ্ছা, আমিও আজকে সারারাত জাগবো। দেখি কোনো শব্দ পাই কিনা।’
রাশেদ সত্যিই সারারাত জাগলো। একটা শব্দও পেলো না। শেষরাতে শুধু মনে হলো, কিছু একটা দৌড়ে যাচ্ছে ওর রুমের মাঝখান দিয়ে। ও ভয়ে চমকে উঠলেও শব্দের উৎস পেতে দুমিনিটও লাগলো না। একটা ইঁদুর।
রিনার ক্ষেত্রে এমনটা হলো না। সে কিছুক্ষণ পরপরই চমকে উঠছিলো। রাশেদের হাত শক্ত করে চেপে ধরে ভয় পাওয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগলো, ‘শুনতে পাও? শুনতে পাও?’
রাশেদের মাথা ঝাঁকানো ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না।
রিনার শ্বশুর খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠেন। মসজিদে নামাজ পড়ে হাঁটতে বের হন। ঘন্টাখানেক হাঁটার পর বাসায় ফেরেন। আজ বাসায় ফেরার পর তিনি যখন দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকবেন, তখন দেখলেন রিনা দাঁড়িয়ে আছে। মুখ শুকনো। চোখ লাল।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঘুম হয়নি মা?’
রিনা মাথা নাড়লো।
‘কিছু হয়েছে?’
রিনা প্রথমে ভেবেছিলো তার শ্বশুরকে কিছু জানাবে না। কিন্তু পরে তার মনে হলো, উনাকে জানালে হয়তো তিনি কিছু একটা সমাধান দিতে পারবেন। রিনা তাকে সব জানালো। শ্বশুর চিন্তিত মুখে বললেন, ‘ঐ রুমে কে হাঁটবে রাতের বেলায়? আমি তো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাই, কোনো শব্দই পাই না। আচ্ছা, দেখি আজকে রাতে কি হয়।’
সেদিন রাতের বেলায় রিনা পাশের রুম থেকে কেমন একটা শব্দ পেলো। ভারি কোনো কিছু পড়ে যাবার শব্দ। ও তো রাতে জেগেই ছিলো, শব্দটা শুনতে কোনো সমস্যা হয়নি। রাশেদ ঘুমাচ্ছিলো। রিনা রাশেদকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললো, ‘এই, পাশের রুমে একটা শব্দ হয়েছে।’
রাশেদ ভয়ানক রেগে গিয়ে বললো, ‘তোমার এই ঢং প্রত্যেকদিন ভালো লাগে না। সারটাদিন অফিস করে এসে রাতে ক্লান্ত হয়ে একটু ঘুমাই। এই ঘুমটাও কি ঠিকমতো ঘুমাতে দিবে না?’
‘প্লিজ, আমি সত্যি বলছি। তুমি একবার দেখো।’
রাশেদ বিরক্তিতে রাগে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে পাশের রুমে ছুটে গেলো। প্রথমে সব নীরব। রিনা কোনো শব্দ পেলো না। এরপর হঠাৎ রাশেদের চিৎকার শুনলো। রিনা আর ঘরে বসে থাকতে পারলো না। ছুটে গেলো পাশের ঘরে।
গিয়ে দেখলো, দরজার কাছে তার শ্বশুর উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। চোখদুটো খোলা। বড় বড় হয়ে আছে চোখগুলো, ভীষণ আতংকে। শ্বাস নিচ্ছেন ধীরে ধীরে। গতবছর তার মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হয়েছিলো, ডক্টর বলেছিলেন বড় কোনো শক যেন না পান। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তার আবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।
তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হলো। অ্যাম্বুলেন্সে বসে তিনি রাশেদ আর রিনাকে কি যেন বলতে চাইলেন। কিন্তু গরগর বাদে তার মুখ থেকে আর কোনো শব্দ বেরুলো না। হাসপাতালে নিয়ে দ্রুত তাকে ইমারজেন্সিতে ঢোকানো হলো। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। ডাক্তাররা ইমারজেন্সি রুম থেকে বের হয়ে জানিয়ে দিলেন, তিনি মারা গেছেন।
রিনা আর রাশেদ একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলো। এতো দ্রুত এমন কিছু হয়ে যাবে, তারা ভাবতেও পারেনি।
শ্বশুরের দাফন-কাফনের সব কাজ শেষ হলো। রিনা তার ঘোর লাগা অবস্থা থেকে বের হলো একটু একটু করে। রাশেদ বেরোতে পারলো না। বাবা মা দুজনকেই হারিয়ে ও কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থের মতো হয়ে গেলো। অফিসে যায়, অফিস থেকে আসে। এসে চুপচাপ বসে থাকে। কিছু করে না। রিনা খাবার বাড়লে চুপচাপ খেয়ে নেয়, এরপর বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। রিনা অনেক চেষ্টা করলো তাকে স্বাভাবিক করার। ও স্বাভাবিক হলো না।
রিনার পাগল পাগল অবস্থা। একে তার স্বামীর এই পরিস্থিতি। তার উপর, সে পাশের ঘরে শব্দটা রোজই পায়। সে নিশ্চিত, তার শ্বশুর পাশের ঘরে কিছু একটা দেখেই প্রচন্ড শক পেয়ে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু কি, সে জানে না। পাশের ঘরে সে যেতেই পারে না, ভয়ে। ঘরটা পরিষ্কার করার কাজ সে সুরমার মার হাতেই ছেড়ে দিয়েছিলো। তিনিই প্রতিদিন এসে ঘরটা পরিষ্কার করেন।
রিনির শ্বশুর মারা যাবার পনেরদিন পরের কথা। সুরমার মা এসেছেন ঘর পরিষ্কার করতে। ওদের মধ্যের ঘরটাতে তিনি যথারীতি ঢুকলেন। আসবাবপত্রের ধুলো ঝাড়লেন। ঘর ঝাড়ু দিলেন। ঘর মুছলেন। ঘর মুছতে মুছতে তিনি খাটের কাছে চলে এলেন। খাটের নিচটাও একটু মুছে দেয়া দরকার। তিনি ঘর মোছার ন্যাকড়াটা ঘর মোছার বালতিতে ডুবিয়ে বিছানার নিচে একপাক মুছে নিলেন। মোছার জন্য তাকে বিছানার নিচে ঢুকতে হলো। বিছানার নিচে মাথা ঢুকিয়েই তার মনে হলো, বিছানার ওপর কেউ বসে আছে।
সুরমার মার যে কি ভয় লাগলো, বোঝানো যাবে না। তিনি তাড়াতাড়ি মাথা বের করে বিছানার ওপর তাকালেন। দেখলেন বিছানায় কেউ নেই। তিনি দ্রুত ঘর মোছার ন্যাকড়া বালতিতে ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। ঘর থেকে বের হওয়ার মুহুর্তে তার মনে হলো, পেছন থেকে একটা কাশির শব্দ শুনলেন। শব্দটা তার চেনা। আগের চাচি-আম্মা এভাবে কাঁশতেন। তিনি ঘাড়ের উপর দিয়ে পেছনে তাকালেন। এক মুহূর্তের জন্য দেখলেন, বিছানার ওপর কেউ একজন শুয়ে আছে। চাচি আম্মা যেভাবে থাকতেন। মুহুর্তেই সে অদৃশ্য হয়ে গেলো। আর তাকে দেখা গেলো না।
সুরমার মা ঘর থেকে বেরিয়েই বললো, ‘আপা, আমি আর আপনার বাসায় কাম করুম না।’
রিনা জিজ্ঞেস করলো, ‘কেন?’
‘কইতে পারুম না আপা। তয় এখানে আর আমি কাম করুম না।’
রিনা সুরমার মাকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু সে কিছুতেই বুঝলো না। সে একদম চলে গেলো এই বাড়ির কাজ ছেড়ে দিয়ে।
সন্ধ্যায় রাশেদ বাড়ি ফিরলো। যথারীতি চুপচাপ বসে রইলো। রাতে রিনা খেতে ডাকার পর খাবার টেবিলে এসে বসলো। চুপচাপ খাবার খাওয়া শুরু করলো। রিনাও প্রতিদিন এমন চুপচাপ করেই খাবার সারে। আজকে ও অনেকদিন পর কথা বললো।
‘জানো, সুরমার মা আজকে কাজ ছেড়ে চলে গেছে।’
রাশেদ কিছু বললো না।
‘ঐ ঘরটা থেকে বের হবার পরই হঠাৎ ও আমাকে কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা বললো।’
রাশেদ তবুও কিছু বললো না।
রিনাও কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শুরু করলো। দু লোকমা ভাত মুখে দিয়েই হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো সে।
রাশেদ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কি হয়েছে।’
রিনা কাঁদতে কাঁদতেই বললো, ‘কিছু না।’
রিনার কান্না দেখে রাশেদ চমকে গিয়েছিলো। আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘বলো, কি হয়েছে?’
রিনা রাশেদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি ভুলে গেছো যে তোমার বাসায় একটা মানুষ আছে। তারও কারো সাথে কথা বলার ইচ্ছা হয়। তারও কষ্ট লাগে। এইসব জিনিস আমি আর নিতে পারছি না। তুমি যদি আমার সাথে থাকতে না চাও, সোজাসুজি বলো। আমরা আলাদা হয়ে যাই।’
রাশেদ হঠাৎ শক্ত করে রিনার হাত চেপে ধরলো। এরপর বললো, ‘তুমি আমার কাছ থেকে আর কোথাও যেতে পারবা না। আমি মাকে হারিয়েছি। বাবাকে হারিয়েছি। তোমাকে আমি কিছুতেই হারাতে দিবো না।’
সেই রাতটা তাদের জন্য অন্যরকম রাত ছিলো। রাশেদ আর রিনা আবার কাছাকাছি এলো, অনেকদিন পর। রাশেদ তার সবটুকু দিয়ে রিনাকে কাছে টানলো। রিনাও পুরোপুরি সাড়া দিলো। তারা দুজন দুজনার মধ্যে ডুবে রইলো অনেকক্ষণ।
যখন আর কিছু সময় বাকি, রাশেদ পুরোপুরি নিমগ্ন রিনাতে, তখন হঠাৎ রাশেদ থেমে গেলো। রিনা জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে?’
রাশেদ বললো, ‘কোনো শব্দ পাও?’
‘না তো।’
‘ভালোমতো শোনো। পাশের রুমে কে যেন কাঁশছে।’
রিনা কান খাঁড়া করলো। হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছে। এতোক্ষণ রাশেদের সাথে থাকায় কিছু শুনতে পায়নি। এখন শুনলো। সেই পরিচিত শব্দ। যেটা এতোদিন ও শুনতে পেতো, কিন্তু রাশেদ শুনতে পেতো না।
রাশেদ বিছানা ছেড়ে উঠলো। রিনা জিজ্ঞেস করলো, ‘কই যাও?’
‘দেখে আসি, কে কাঁশছে এভাবে।’
‘না, আমি তোমাকে যেতে দিবো না।’
‘কেন?’
‘পাশের রুমে কে আছে, এটা দেখতে গিয়েই বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমি আর তোমাকে হারাতে চাই না।’
রাশেদ কথাটা জানতো না। এটা শুনেই তার জেদ চেপে গেলো। সে বললো, ‘তাহলে তো আমি দেখবোই। কে আছে আমার দেখতে হবে।’
‘তাহলে দাঁড়াও। আমিও যাবো তোমার সাথে। তোমাকে আমি একা ছাড়বো না।’
ওরা দুজন আস্তে আস্তে পাশের ঘরের দিকে এগোলো। পাশের ঘরে কাশির শব্দ এখন আরো স্পষ্ট। সত্যিই কেউ একজন আছে পাশের ঘরে। পাশের ঘরে দরজার সামনে পর্দা দেয়া। ওরা পর্দার সামনে দাঁড়ালো। ওপাশে কিছু দেখা যাচ্ছে না। রাশেদ আস্তে করে পর্দা সরালো। রিনা রাশেদের হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। পর্দা সরাতেই ঘরের ভেতরের অংশে চোখ পড়লো ওদের। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। অন্ধকার চোখে সয়ে আসতে কয়েক মুহুর্ত সময় লাগলো। এরপরই, ঘরের ভেতরের মানুষটাকে দেখতে পেলো ওরা।
ওরা দেখলো, ঘরের ভেতরের বিছানায় মা শুয়ে আছেন। কামরুন্নাহার। যিনি কয়েক মাস আগে মারা গেছেন করোনায়।
ওরা দুজন ভয়ে আর আতংকে জমে গেলো। কি করবে বুঝতে পারছে না।
কামরুন্নাহার বিষদৃষ্টিতে বউয়ের দিকে তাকালেন। এরপর চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘বলেছিলাম না, আমার সংসার আমি যেমন রেখে গিয়েছিলাম তেমনই রাখতে। কেন সবকিছু পাল্টেছিস? কেন?’
রিনার বুক ভয়ে হিম হয়ে গেলো। এই গলাটা কতো রাত তাকে ঘুমাতে দেয়নি। কামরুন্নাহার মারা যাবার আগে যে গলায় তাকে আদেশ করে গিয়েছিলেন, সেই গলা।
কামরুন্নাহার মেঝেতে পা রাখলেন। তারপর বিছানা থেকে উঠে আস্তে আস্তে এগোতে লাগলেন রিনার দিকে। বলতে লাগলেন, ‘সংসার তোর, ঘর তোর, তাই না? এতো সাহস তোর হলো কিভাবে? সবকিছু আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবি তাই না? আমার ছেলেকেও আমার থেকে নিয়ে যাবি, তাই না?’
কামরুন্নাহার হঠাৎ দ্রুত রিনার দিকে ধেয়ে আসতে লাগলেন। রিনার ভেতর থেকে কেউ তখন বলছিলো, ‘পালাও, পালাও এক্ষুণি। নইলে কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না।’ অথচ রিনা পালাতে পারলো না। তার পা যেন মাটির সাথে গাঁথা হয়ে গেছে একদম।
রিনা করুণ চোখে রাশেদের দিকে তাকালো। রাশেদ কিছুই করলো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। আগে যেমন মায়ের দুর্ব্যবহারের সময়ে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতো, ঠিক সেরকম।
রিনা সামনে তাকালো। কামরুন্নাহার তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার টকটকে লাল চোখ থেকে যেন আগুন ঝড়ছে। রিনা আতংক নিয়ে তাকিয়ে আছে। এখন যেকোন কিছু ঘটতে পারে। যেকোন কিছু।
***
রিনার বাবা আজ অনেকদিন পর মেয়ের বাড়ি যাচ্ছেন। তার মনটা খুশিখুশি। মেয়েটা বাড়ি থেকে যাওয়ার পর তার রিটায়ার্ডের সময়ও চলে আসে। বাসায় অলস বসে থেকে বিভিন্ন উদ্ভট কাজে তিনি মনোনিবেশ করেন। গতমাসে দেশীয় গাছের বনসাই বানানোর কাজে হাত দিয়েছিলেন। প্রজেক্টটা একদমই টেকেনি। এ মাসে তিনি নতুন একটা কাজে হাত দিয়েছেন। একটা বই লিখছেন, সুপারন্যাচারাল এনসাইক্লোপিডিয়া। এখানে তিনি জগতের যতো অদ্ভূতুড়ে জিনিস ঘটেছে, তার বিবরণ লিখে রাখছেন। বাংলা ভাষায় এমন বই আর একটাও লেখা হয়নি বলেই তার ধারণা।
তিনি এখন লিখছেন ডপেলগেঞ্জার নিয়ে। অদ্ভুত এক জিনিস। ঠিক এক ব্যক্তির মতো অন্য এক ব্যক্তিকে দেখতে পাওয়া। এমন অনেকেই দেখছে। বিখ্যাত ব্যক্তিরাও দেখছেন। পার্সি বিশি শেলি নিজেকে দেখেছিলেন। রাশিয়ার রাণী ক্যাথেরিনও নাকি নিজেকে দেখতে পেয়েছিলেন। এসব ঘটনার একটা জ্বীন-সংক্রান্ত ব্যাখ্যাও তিনি পেয়েছেন। মানুষের সাথে নাকি একজন কারিন জ্বীন থাকে। সে নাকি এরকম অন্যের রুপ ধরে মানুষের সামনে দেখা দেয়। অনেক ব্যক্তিকে এজন্য মৃত্যুর পরও দেখা যায়। আবার অনেকে নাকি নিজেরাই তুকতাক করে নিজেদের কারিন জ্বিনকে মৃত্যুর পরও রেখে যান, তিনি বেঁচে না থাকলেও তার কাজকর্ম যেন ঠিকঠাক চলে তা দেখার জন্য।
রিনার বাবা মনে মনে হাসেন। এসব যদি সত্যি হতো তবে রিনার মায়ের কারিন জ্বিনকে তিনি রেখে দিতেন। সেই জ্বিনের সাথেই সংসার করতেন। মেয়েটাকে পালতে তাহলে এতো কষ্ট করতে হতো না।
তিনি মেয়ের বাড়ির সামনে এসে বেল বাজালেন। রিনা দরজা খুললো। বললো, ‘অনেকদিন পর এলে বাবা। কেমন আছো?’
রিনার বাবা চমকে উঠলেন। মেয়ের মুখটা একদম ভাবলেশহীন। কোনো অনুভূতি নেই সে মুখে। ঠিক রোবটের মতো।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই ঠিক আছিস মা?’
মেয়ে তেমনি আবেগহীন কণ্ঠে জবাব দিলো, ‘জি, ঠিক আছি।’
বাবা ঘরে ঢুকলেন। ঢুকেই একটা ধাক্কা খেলেন। রিনার শাশুড়ি মারা যাবার পর রিনা পুরো ঘর নিজের মতো সাজিয়েছিলো। এখন রিনার বাবা দেখলেন, সেই সাজানোর চিহ্ন মাত্র নেই। ঘর আবার পাল্টে গেছে। রিনার শাশুড়ি যেভাবে সাজিয়ে রাখতেন, ঠিক সেরকম।
রাশেদই হয়তো জোর করেছে এভাবে ঘর সাজাতে। রিনার ঘর সাজানো রাশেদের পছন্দ হয়নি, এটা বাবা জানতেন।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাশেদের সাথে এখন তোর কথা হয় মা?’
‘হ্যাঁ, খুব হয়। এখন আমাদের মাঝে সব স্বাভাবিক।’
‘বাহ, খুব ভালো। কিন্তু আমার যে মনে হচ্ছে, সব স্বাভাবিক হয়নি মা।’
‘কেন বাবা?’
বাবা মেয়েকে নিয়ে সোফায় বসে বললেন, ‘তোর মুখটা এমন কেন? কোন আবেগ নাই। কিছু কি হয়েছে?’
‘নাহ। কিচ্ছু হয়নি।’
‘সত্যি করে বল। তোকে এমন অবস্থায় কখনো দেখিনি। শাশুড়ি বেঁচে থাকতে যখন একটা দুখী দুখী ভাব নিয়ে থাকতি, তখনও না।’
রিনা হঠাৎ চমকে উঠে বললো, ‘না বাবা। মা থাকতে আমি দুখী দুখী ভাবে কেন থাকবো। আমার শাশুড়ি মা খুব ভালো ছিলেন। খুব সুখে ছিলাম আমি। তার মতো শাশুড়ি আর হয় না।’
রিনার বাবা চমকে গেলেন। এমন কথা রিনা কেন বললো? তিনি কান খাঁড়া করে শুনলেন, কে যেন পাশের রুমে হাঁটছে। ঐ রুমে তো কেউ নেই। তাহলে, কে হাঁটে ওভাবে?
বাবা রিনার দিকে তাকালেন। রিনার মুখটা আগের মতোই ভাবলেশহীন। কিন্তু তার চোখে একটা অনুভুতি ফুটে উঠেছে। সেই অনুভূতি হলো ভয়, প্রচন্ড ভয়। সেই অনুভূতির উৎস কি, রিনার বাবা জানেন না।