প্রাক্তন পর্বঃ ০৫

ছায়ার বাবা লিলুকে বুঝানোর চেষ্টা করছে। তবে সে উচ্চস্বরে সবাইকে ডাকাডাকি শুরু করে। আমিই ছায়ার বাবাকে ইশারা করে কিছু বলতে মানা করে দেই।
মধ্যরাতে সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে আছি। আগে কি হবে? বা পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে তা সবার অজানা।
লিলু সবাইকে ডেকে জড় করেছে। কি করতে চাচ্ছে? সেটা আর আমার কাছে ঘোলাটে নয়। তবে সেখানে থাকা বাকি সদস্যজন একটা ঘোরের মাঝে রয়েছে।
সবাইকে এভাবে এত রাতে ডেকে তুলাতে তারাও কিছুটা হলে বিভ্রান্ত হয়েছে। তবে লিলুর সেদিকে কোনরকম ভ্রুক্ষেপ নেই। সে কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে বলতে শুরু করলো,
তোমরা এই ছেলেকে আমার জন্য ঠিক করেছো? এই ছেলে তো আগেই একটি মেয়ের সাথে সম্পর্ক করেছে। না জানি কত কি করেছে? আর আমি তো বলেছি অতীতে এমন কেউ আছে কোন ছেলের। তাহলে আমি তাকে বিয়ে করবো না। (লিলু)
লিলুর পরিবার ও আমার পরিবার সবাই চুপ করে রয়েছে। কারণটা অজানা আমার কাছে। কারণ খুঁজতে যখন ভাবনার সাগরে ডুব দিলাম। তখনই লিলুর মা আমাকে বললো,
কি দরকার ছিল বাবা? তোমার অতীত সম্পর্কে ওকে বলার? (লিলুর মা)
কি সব বলছেন আন্টি? অতীত সম্পর্কে জানার অবশ্যই তার প্রয়োজন আছে। (আমি)
মাঝখানে মা ধমক দিয়ে উঠলো,
অনেক হয়েছে থাম তো। ভবিষ্যৎ ঘরতে যাচ্ছিছ সেখানে অতীতকে টেনে এনে সুখটাকে নষ্ট করার প্রয়োজন আছে কি? (মা)
এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম নিশ্চয়ই এ নিয়ে তাদের আগেই কথাবার্তা হয়েছে। আমাকে জানাতে শুধু ভুলে গেছে।
এমনিতেও বিয়ে করার ইচ্ছে আমার নেই। তবে সুযোগটা যখন পেয়েছি তখন কেনই বা হাতছাড়া করবো। তাই এই সুযোগটাকেই কাজে লাগালাম।
কি বলছো কি? আচ্ছা ধরো তোমাদের কথা মেনে নিলাম। কিন্তু ওর সাথে বিয়ে হলে সারাজীবন তো আমার সাথে থাকতে হবে। তখন যদি বিষয়রা জেনে গিয়ে এমন রিয়েক্ট করতো আর সেটা অনেক বড় রুপ ধারণ করতো তখন কি করতে? (আমি)
মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে তারপর তারা সবটা মানিয়ে নিতে শিখে যায়। (লিলু মা)
তার মানে এই যে সারাটা জীবন সে চুপ করে থাকবে আর আমি আমার সিধান্ত গুলো ওর উপর চাপাতে থাকবো? (আমি)
সেটা কেন হতে যাবে? ও কি এতটাই বোকা? (মা)
ওহহ মা তুমি এই কথা বলছো? একটা প্রবাদ তো জানোই, ” যার হয় না নয়ে,তার হয় না নব্বইয়ে।” আশা করি ভেঙে এর অর্থটা বুঝাতে হবে না। (আমি)
বাহ্!! খুব ভালোই বলতে পারেন। আমি এই বিয়ে করবো না। (লিলু)
আমিও আপনাকে বিয়ে করার জন্য লাফালাফি করছি না। সবাই শুনে রাখো যে অতীত কে নিয়ে এত বড় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে সে আর যাই হউক আমার বউ হবার যোগ্যতা রাখে না। (আমি)
এই বলে সেখান থেকে চলে আসলাম। লিলুও চলে গেল। মাঝ খানে পরিবারের সবাই একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। তারা পিছন থেকে ডেকেছে তবে এখন উত্তর নিলে তো চলবে না।
তারপর ঘুমিয়ে যাই। চোখ খুলি সকালে কারো হাতে স্পর্শে। তাকিয়ে দেখি নিপা মেয়েটা।
আঙ্কেল আপনাকে নিচে খেতে ডাকছে। অনেক বেলা হয়ে গেছে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসেন। (নিপা)
বলেই সে চলে যায়। তার যাওয়ার দিকে তাকাতেই মনে পড়ে যায় ছায়ার বাবা কথা। সম্পূর্ণ কথাটা তার থেকে শুনাই হয়নি।
তাই ফ্রেশ নাস্তা না করেই বেরিয়ে যাই। ছায়ার বাবাকে টেবিলে দেখতে পেলাম না। বাড়ির বাইরে বের হয়ে টং দোকানে গিয়ে সিগারেট ধরাই। একটা টান দিয়ে যখন এক পা সামনে দেই তখনই দেখি ছায়ার বাবা উদাস মনে ধোঁয়া উড়াচ্ছে।
আমিও সেখানে যাই। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে সে কিছু বলে না। একবার আঁড়চোখে তাকিয়ে আবারও ধোঁয়া উড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
আমাদের মাঝে নিরবতায় কেটে যায় অনেকটা সময়। তারপর ছায়ার বাবাই বলতে শুরু করে,
অসমাপ্ত গল্পের সমাপ্তি জানতে চাও? (ছায়ার বাবা)
মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক সম্মতি দেই।
তোমার মনে হয়তো প্রশ্ন জাগছে ছায়ার তো বোন নেই। তাহলে নিপা কে? আর যদিও বোন থাকতো তাহলে মিথ্যে কেন বলবে? (ছায়ার বাবা)
হুম (আমি)
নিপা ছায়ার বড় বোনের মেয়ে। হ্যা অস্তিত্ব ছিল তবে মুছে দেওয়া হয়েছে মায়ার অস্তিত্ব। কারণ সে ছিল ধর্ষিতা। (ছায়ার বাবা)
কথাটা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। অবাক দৃষ্টিতে অপলকভাবে তাকিয়ে রইলার তা দিকে।
হ্যা ঠিকই শুনতে পেয়েছো। ছায়ার বড় বোন মায়া। ওদের বয়সের পার্থক্য চার বছরের। বড় মেয়ে হিসেবে আদরটা একটু কম পাওনা থাকা উচিত ছিল হয়তো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়েছিল। মায়াই আদর ও স্নেহ বেশি পেত। এর মানে এই নয় যে ছায়াকে ভালোবাসতাম না। (ছায়ার বাবা)
তারপর!!! আমার ঘটনার সাথে এ ঘটনার সূত্রপাত কোথায়? (আমি)
তারপর যখন ছায়া ক্লাস টেনে উঠলো ঠিক তখন থেকেই ঝড় চলতে থাকে। মায়াকে যে ধর্ষন করে সে ছায়ার খুব প্রিয় মানুষ। তবে অদ্ভুত বিষয় ছিল এটাই ছায়ার সামনেই হয়। ছায়া হয়তো বুঝে উঠতে পারেনি যে মায়া সবটা দেখে নিয়েছে। (ছায়ার বাবা)
কিহহ!!! (আমি)
হ্যা। তবে যে ছেলে ধর্ষণ করে সে আর কেউ নয় বরং রাব্বি। অবাক হইয়ো না। নিপা রাব্বির সন্তান নয়। মায়ার বিয়ে হয়েছিলো। সুখেই চলতেছিলো। মায়ার স্বামী সবটা জেনেও মায়াকে খুব ভালোবাসতো। তবে নিপার জন্মের সাত বছর পর এক এক্সিডেন্টে দু’জনই মারা যায়। (ছায়ার বাবা)
কিন্তু ছায়া এত সব কেন করলো? মায়া বা ছায়া এদের মধ্যে কাউকে কি পালক হিসেবে এনেছিলেন নাকি? (আমি)
কথাগুলো তোমার কাছে গল্প মনে হচ্ছে? তবে ছায়ার এমন হয়ে উঠার পিছনে কিছুটা আমাদের ও দোষ রয়েছে। আমরাই ওদের দু’জনের মধ্যে মেধার পার্থক্য বের করতে গিয়ে ছায়াকেই দূরে ঠেলে দেই। যা অজান্তেই হয়ে যায়। আর ছায়াও এরকমভাবেই বেড়ে উঠে। (ছায়ার বাবা)
তবে আমার কাছে এখনো অজানা রয়ে গেল কেনই বা সে আমার সাথে এমনটা করলো? (আমি)
সে শুরু থেকেই এমন একজনকে খুঁজতেছিলো যে তার মত হবে একদম। কিন্তু সেরকমকে খুঁজতে গিয়ে সে তোমার প্রেমে পড়ে যায়। তোমার প্রেমে থাকা অবস্থায় তার মধ্যে কিছু পরিবর্তন আনে। কিন্তু তোমাদের ঝগড়ায় বিষয়টা বিগড়ে যায়। (ছায়ার বাবা)
কিভাবে? (আমি)
ছায়া ও রাব্বি একে অপরকে ভালোবাসতো না। বরং তাদের কথা বার্তা ও চেহারায় আকৃষ্ট ছিল। যা শুরু থেকে ছিল না। বরং তোমাদের সম্পর্কে যখন একটা বড় ঝড় যায় আর দুদিন কথা ছাড়া ছিলে তখনই আবারও রাব্বি ফিরে আসে ছায়ার জীবনে। (ছায়ার বাবা)
আবারও ছায়ার বাবা বলতে শুরু করে,
তুমি যখন কক্সবাজার ঘুরতে গেলে পরিবারের সাথে। ১৫ দিনের দূরত্বে আজ তোমরা কত দূরে দেখছো? ১৫ দিন তোমাদের কম কথা হয়েছে। কিন্তু রাব্বি ও ছায়া একে অপরের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তোমাদের দূরত্ব ব্যস্ততা যতই বেড়েছে ততই সম্পর্কের জাল ছিঁড়তে শুরু করেছে। আর তাইতো চার মাসের নতুনত্বের কাছে তোমার চার বছরের ভালোবাসা হেরে যায়। (ছায়ার বাবা)
কথাগুলো শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। তবে এখনও চাইলে হইতো সব ঠিক করা যাবে। কিন্তু ফেলে আসা চারটা বছর কি পাওয়া যাবে?
মরিয়ম চরিত্রের কথা মনে আছে? মরিয়মই ছায়ার ছদ্মনাম। যা প্রয়োজনে একটা চরিত্রও ধারণ করে। বেশি ভেবোনা কারণ তোমার সকল প্রশ্নের উত্তর তার কাছেই রয়েছে। তুমি বুদ্ধিমান এতক্ষণে তোমার সবটা বুঝে যাওয়া উচিত!!! (ছায়ার বাবা)
এতগুলো চরিত্র!!! তবে তার বোনের সাথে যা করেছে তার কি ক্ষমা আছে? শুধু ঘৃণার জন্য এতবড় পথ বেছে নিয়েছে?
তবে আপনি এত কিছু কি করেই বা জানলেন? আজই বা কেন বলতেছেন? সেদিন কেন বললেন না? (আমি)
আমি জানতাম তুমি এই প্রশ্ন আমায় করবে। (ছায়ার বাবা)
হুম বলেন!! (আমি)
জানো মানুষ যতই ভালো হউক না কেন? নিজের দোষটা সবসময় লুকিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে ছায়াও একই কাজ করেছে। তেমার সাথে সম্পর্ক যদি সত্যিটা বলে নষ্ট করতো তাহলে সবার চোখে ছায়া খারাপ হয়ে যেত। তাই সে আমাকে খারাপ বানিয়ে ভালো সেজেছে। আর রইলো এত কিছু কিভাবে জানলাম? এই দুটো ডায়রি ছায়া ও মায়ার। এখানেই লেখা আছে অতীত। (ছায়ার বাবা)
ব্যাগ থেকে ডায়েরি দুটো বের করে আমায় দেয়। আমি জানতাম ছায়া ডায়েরি লিখে। কিন্তু কখনো পড়া হয়নি।
আমি ডায়েরি দুটো নিয়ে যাই। ছায়ার বাবার কাছ থেকে যখন বিদায় নিয়ে চলে আসবো তখন তিনি আমায় বললেন,
স্টেশনে থাকা অসহায় ছায়ার প্রতি তোমার একটুও মায়া হয় না? ভালো না বাসতে!! তাহলে কেন দূর থেকেই নজর রেখে চলে আসো? একটু যেয়ে কথা বলো। হতে পারে আমাকে না বলতে পারা কথা গুলো তোমায় বলবে। (ছায়ার বাবা)
আমি তার কথায় অবাক হই না। কারণ আমি ছায়াকে স্টেশনে দেখার সময়ই ছায়ার বাবাকে আসেপাশে দেখেছি।
আমি মুচকি হেসে বললাম,
হৃদয় তো অনেক আগেই ভেঙে গিয়েছে। এখন সময় পাহাড় সমান অভিমানকে চাপা দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। (আমি)
সেও আমার দিকে তাকিয়ে হাসে।
তারপর আমি চলে আসি। তবে আসার সময় পার্কের দিকে নজর যায়। পার্কে লিলু একটি ছেলের সাথে খুব কাছাকাছি ভাবে বসে আছে।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প