প্রাক্তন পর্ব -০১

বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছি। আসলে মেয়েটা আমার জন্যই দেখা হচ্ছে। চার বছর আগে যখন আমার প্রাক্তন আমাকে ছেড়ে অন্য কারো হাত ধরেছিল তখন বিয়ে করার ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছিল।
তবে পরিবারের চাপে চার বছর তো বিয়ের কথা এড়িয়ে গিয়েছি তবে এখন আর পারছি না। তবে দেখতে গেলেই তো আর বিয়ে হচ্ছে না। এই বলেই স্বান্তনা দিয়ে তাদের হাসির সাথে মেতে উঠেছি।
তিন বছর আগেই পড়াশোনা শেষ করেছি। তবে চার বছর আগে যখন আমি আমার প্রাক্তন কে বিয়ে করতে চাই তখন প্রাক্তনের বাবা বড় গলায় আমাকে কথা শুনিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
শুধু টাকা আয় করতে পারতাম না বলে৷ আমরা সমবয়সী ছিলাম। তাই হয়তো এটাই কপালে লিখা ছিল। ওর বিয়ে একটা বড়লোক ছেলের সাথে ঠিক করে।
সেদিন রাতে ও আমাকে ফোন দেয়। ফোন কানে রেখে প্রায় ঘন্টা তিনেক আমরা কথা বলিনি। শুধু কেঁদেছি। তারপর দু’জনেই পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করি।
সে বয়সে সেটা আবেগ বা মোহ ছিল না। ছিল না কোন শারীরিক চাহিদা। শুধু ছিল ভালোবাসা। তবে সব ভালোবাসার পূর্ণতা হয় না। কিছু কিছু ভালোবাসা অপূর্ণই থেকে যায়।
পালিয়ে যাওয়ার তারিখও ঠিক। ওর কবুল বলে বিয়ে করার ঠিক ১ঘন্টা আগে আমরা এ শহর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবো। তবে সেদিন রাত ১১টার ট্রেনের টিকিটও কেটে রেখেছিলাম।
তিস্তা এক্সপ্রেস ছিল ট্রেনটি। কোথায় নামবো তার নিশ্চয়তা ছিল না। তবে স্বপ্ন ছিল এই রাত ও ট্রেনটি নিয়ে। তবে,
ঘড়ির কাটা ১১টায় পৌঁছে যায়, তিস্তা এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মে চলে আসে আবার সঠিক সময় প্ল্যাটফর্ম খালি করে। তবুও সে আসেনি।
এয়ারপোর্ট থেকে এই ট্রেনটিই সর্বশেষ ট্রেন ছিল সেদিনের। সকাল অবধি নির্ঘোম ভাবে কাটিয়ে দেই তবে তার দেখা মিলেনি আর। তবে ফোনে ভিডিও মেসেজ পেয়েছিলাম একটি।
যেটা পাওয়ার পর গিয়েছিলাম তার বাড়ি। তবে সেখানে কেউ ছিল না। বাড়ি বিক্রি নাকি অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে। আর তারাও নাকি শহর ছেড়ে দিয়েছে।
কিছু প্রশ্নের আর উত্তর মেলেনি সেদিন। খুঁজিওনি তাকে আর। আর স্বপ্নগুলো অপূর্ণ রয়ে যদি তার স্বপ্ন পূর্ণতা পায় তাহলে সেটাই সই।
আজও সেই তিস্তা এক্সপ্রেস। সেই আগের মতোই কালো অন্ধকার রাত। ছুপছুপ করে আপন গতিতে ট্রেন চলছে। আর তার ভেতরেই বসে আছি আমি।
নভেম্বরের শেষের দিক। হালকা শীতের আবাশও পাওয়া যায় রাতের গভীরতার সাথে। তবে বাইরে দৃশ্যটা মন জুড়িয়ে যাওয়ার মতো।
বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একটা চাদর গায়ে দিয়ে কখন ঘুমিয়ে গেছি বলতেই পারিনা। তবে চোখ খুললো মানুষের কোলাহলে।
চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি জামালপুর স্টেশনে ট্রেনটি দাঁড়িয়ে আছে। তখন সময় সকাল ৫টা। কতক্ষণ সময়ে জন্য দাঁড়িয়েছে না জেনেই।
ট্রেন থেকে থামবো কি নামবো না বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে যখন জামালপুরে পা রাখবো তখনই ট্রেনের হুইশেলটা বেজে উঠে উঠলো। আর পিঠে কেউ হাত রাখলো।
পিছনে ফিরে দেখি ভাবি। তাকে দেখে শুঁকনো একটা হাসি দিয়ে ট্রেনের দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। তারপর নিজের জায়গায় এসে বসলাম।
আমার সাথে ভাইয়া ঘুমাচ্ছে। ভাবি ভাইয়াকে ডেকে তুলে তার সিটে পাঠিয়ে দিল। আর এসে আমার পাশে বসলো।
ভাবির কোন ভাই নেই। বলতে গেলে তার মা ছাড়া আর কেউ নেই। ভাবি আমাকে তার ছোট ভাই ভাবে। আমার যেহেতু বোন নেই তাই ভাবিকেই বোনের থেকে বেশি ভাবি।
ভাবি আমার হাতটা ধরে বললো,
এখনো ভুলতে পারিসনি অতীত? এই ক্ষতগুলো প্রকাশ্যে না থাকলেও ভেতরে এর পরিমান কতটা বুঝতে পারছি। (ভাবি)
আমি শুকনো হাসি দিয়ে বললাম,
থাক না ভাবি। অতীত তুলেই বা কি লাভ? যতটা ভুলে থাকা যায় ততটাই মঙ্গল। (আমি)
নিজের দিকে একবার খেয়াল কর। তর মনের অবস্থা জানতে চাইবো না। তবে যে সিধান্ত নিবি সেটাতে যাতে তর খুশিটা থাকে। (ভাবি)
নিজের খুশির জন্যই তো করছি। (আমি)
নিজের মনকে প্রশ্ন করে দেখ? উত্তর টা তুই আমার থেকেও ভালো জানবি। হয়তো আমাদের খুশির জন্য তুই বিয়ে করার সিধান্ত নিলি এবং বিয়েও করে নিলি। তবে যেদিন সবার সামনে সবটা প্রকাশ পাবে সেদিন সবাই কষ্ট পাবে। শুধু সেই মেয়েটা যে তর জীবনে জড়াবে বরং আমি,বাবা,মা তর ভাইয়া সকলেই। (ভাবি)
কোন উত্তর ছিল না আমার কাছে। কারণ আমি এ সিধান্তে খুশি ছিলাম না। পরিবারের জন্যই এতদূর আসা।
দেখ তর সময় লাগলে তুই নিয়ে নে। তবুও আমাদের খুশির জন্য নিজের খুশিটা বিসর্জন দিছ না। অন্যকে খুশি রাখতে গেলে আগে নিজেকে খুশি থাকতে হবে। (ভাবি)
ভাবির কথায় লজিক আছে বলতে হবে। তবে আমি না ওকে ভুলতে পারছি না কাউকে আপন করে নিজের জীবনে জড়াতে পারছি।
হঠাৎই চলন্ত ট্রেন থেমে যায়। আর আমার ভাবনার অবসান ঘটে। জানালা দিয়ে বাইরে মাথা বের করে দেখি দেওয়ানগঞ্জ বাজার লেখা দেখা যাচ্ছে। তার মানে এটাই আমাদের গন্তব্য।
আর তার থেকেও বড় কথা ট্রেনটি আর আগে যাবে না। কারণ এটাই এই পথের শেষ। হিমেল হাওয়ায় ঠান্ডা লাগছে তবে স্টেশনে ঘুমানো মানুষদের দেখে সেটাও চলে গিয়েছে।
সময়ের অনেকটা আগেই পৌঁছে গিয়েছি। সবাই ব্যাগগুলো আমাকে দিয়ে নাস্তা করতে চলে গেল। কারণ জায়গাটা নতুন কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। তাই পরিপূর্ণ ভাবে আলো ফুটবার আগে স্টেশন ছাড়া যাবে না।
আমি বসে ফোন চাপছিলাম। তখনই একজন গর্ভবতী মহিলা এসে হাত পাতে আমার কাছে,
সাহেব আমার সন্তান পেটে। ভালো মতো কিছু খাইতে পারি না। যদি কিছু দিতেন। (মহিলাটি)
আমার নানা সবসময় একটা কথা বলতেন,”যদি তোমার কাছে কেউ হাত পাতে তাহলে তাকে ফিরিয়ে দিও না।”
উনার হাতে টাকা না থাকলেও উনি কাউকে খালি হাতে ফিরাতেন না। উনি সব সময় টাকা বাংটি করে চালের ডামে,বৈয়মের ভেতর ও নানা জায়গায় রেখে দিতেন। যখন কেউ এসে চাইতো তখন বের করে দিয়ে দিতেন।
তাহলে এখন আমিই বা একজন গর্ভবতী মহিলাকে কি করে ফিরিয়ে দেই? যখন ৫০০ টাকার নোটটি বের করে তার হাতে দিব। তখন তার দিকে তাকাতেই নোটটি পড়ে যায়। সেও আমার দিকে বিস্ময় প্রকাশ করে।
এতক্ষণ মাথা নিচে দেওয়ায় ও আবছা আলোয় চেহারা দেখতে পায়নি। তবে যখন দেখেছে সে সেখান থেকে উল্টো ঘুরে হাঁটতে থাকে।
গর্ভবতী মহিলাকে দেখে আমার হৃৎস্পন্দনের মাত্রাই বেড়ে যায়। কারণ সে ছিল ছায়া আমার প্রাক্তন। এভাবে তার সাথে দেখা হবে কল্পনা করিনি। আর তাকে এ অবস্থায় দেখবো সেটাও ভাবিনি কখনো।
সে চলে যেতে নিলে তার হাতটা ধরে তাকে আমি আঁটকে ফেলি। মনের মাঝে হাজারো প্রশ্নের ঝড় উঠেছে। এই ঝড় সহজে থামবার নয়। কি হবে এখন বা আগে?
তুমি? (আমি)
অপরদিকে ঘুরে নিঃশব্দে কাঁদে। তবে একটা কথাও বলে না।
আজও চুপ করে থাকবে? কেন আজও কিছু বলবে না? (আমি)
এইবার আমার দিকে ফিরে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আমার হাত থেকে তার হাত ছাড়িয়ে বলে,
কি বলবো? এখনো কি বলার মতো কিছু রয়েছে? আজও আমার থেকে শুনতে চাও? (ছায়া)
হ্যা শুধু আজ নয় স্বপ্নটা শেষ নিশ্বাস অবধি বলার মতো দেখেছিলাম। তবে কেন? আমার মনে যে প্রশ্নের ঝড় বইছিল সেটা তো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আজ আবারও সেই ঝড় তুলে কেন পালিয়ে যাচ্ছো? (আমি)
শান্ত গলায় আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
মাহিন তোমার প্রশ্নের জবার আমার কাছে নেই। আর কিই বা বলবো আমি? আর কেনই বা তুমি বিশ্বাস করবে? (ছায়া)
আজ তোমায় বলতেই হবে। যে সম্পর্ক পূর্ণতার জন্য তখন এত কিছু করেছিলে!! কি এমন হয়েছিল যে তা অপূর্ণই রাখতে হল? ছায়া আজ তোমায় মুখ খুলতেই হবে। (আমি)
আজও কি সেই সময় আছে? অনেকটা দেরি হয়ে গেল না প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করার জন্য? চার বছর কিন্তু কম সময় না মাহিন? (ছায়া)
চার বছর? নাহ্ ছায়া, চার বছর পাঁচ মাস সাতাশ দিন আট ঘন্টা পয়ত্রিশ মিনিট। সময়টা কি খুবই অল্প? (আমি)
দু’জনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিরব দর্শক হয়ে যাই। ততক্ষণে পরিবারের সকলেই আবার স্টেশনের ভেতর প্রবেশ করেছে।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প