বউ_মা_শাশুড়ি

বউমা, তোমার শ্যাম্পুর বোতলটা একটু দাওতো। আমার শ্যাম্পুর পাতাগুলো শেষ হয়ে গেছে।
আমার শাশুড়ি মা আমার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন।
আমি হাসিমুখে শ্যাম্পুর বোতলটা হাতে দিতেই মা আর কিছু না বলে তার রুমের দিকে চলে গেলেন।
পূর্বে কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা এতো ভালো ছিলো না। বেশিরভাগ ছেলের বউ আর শাশুড়ির মাঝে যে ঝগড়া-অশান্তির তেঁতো সম্পর্ক থাকে ততোটা না হলেও খানিক তেমনিই ছিলো। বিয়ের কয়েকমাস যেতে না যেতেই আমার শাশুড়ির সাথে আমার সম্পর্ক খুব খারাপ হতে শুরু করে। উনার সোজা কোনো কথাও যেন আমার গায়ে বাঁকা করে বিধে পরতো। এটা যে শুধু আমার ক্ষেত্রেই ঘটতো তা কিন্তু নয়, একই বিষয়গুলো উনার সাথেও ঘটতো। আমি একদিন তরকারিতে ঝাল কম দেওয়াতে আমার শাশুড়ি বেশ রেগেমেগেই বলে উঠেছিলেন,
রান্নার হাতটা এখনও তোমার ঠিক হলো না বউমা? তরকারি নামানোর আগে ঝোল কি একটু খেয়ে দেখা যায় না?
আমিও ঠাস করে উনার মুখের উপর বেয়াদবের মতো বলে দিলাম,
আমার ঝোল খেয়ে দেখার অভ্যাস নেই। আর হবেও না হয়তো।
আমার শাশুড়ি প্রতিত্তোরে চোখদুটো বড় বড় করে বললেন, এই তোমার শিক্ষা? এত এত ডিগ্রি নিয়ে কি করবে শুনি, যদি বড়দের সম্মান করতেই না পারো।
কথাগুলো বলে মা কিছুটা মন ছোটো করেই খাবার টেবিল থেকে উঠে গেলেন। আমার তখন নিজেকে একটু অপরাধী’ই মনে হচ্ছিলো। তবে বেশি গায়েও মাখাইনি।
সেদিন রাতে আমার শাশুড়ি আর নিজে থেকে খেতে আসেননি। অফিস শেষে আমার স্বামী বাসায় ফিরে আমার শাশুড়ির রুমে যায়। আমি তখন খাবার টেবিলে খাবারগুলো একে একে সাজিয়ে রাখছিলাম। কিছুক্ষণ পরেই আমার স্বামী আমার শাশুড়িকে সাথে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসে। খাবার টেবিলে তখন নিরবতা বিরাজমান। আমি খাবার খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আমার স্বামীর দিকে আঁড়চোখে তাকাচ্ছিলাম। কিসের জন্য তা জানি না, হয়তো তার মনে আদৌ কি চলছে সেটা বোঝার জন্য। নয়তো বা আমার শাশুড়ি তার ছেলের কান না জানি কত-শত কথায় ভারী করেছেন সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য। কিন্তু না, তেমন কিছুইতো লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
খানিক পরে আমার শাশুড়িই প্রথম কথা বলে উঠলেন। বউমা, এখন তরকারিটা ভালো হয়েছে। বলতে পারো বেশ।
আমি শাশুড়ি মা’র কথার কোনো জবাব না দিয়েই মাথা নিচু করে একনাগাড়ে খেতে থাকলাম। তবে ওনার কথাটা শুনে মনে মনে বেশ খুশিও হয়েছিলাম। কিন্তু ওদের কাউকে বুঝতে দেয়নি।
সংসারে এইভাবেই রোজকার কিছু না কিছু ভালো-মন্দ দন্দ লেগেই থাকতো। কখনো ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলে তা নিয়ে শাশুড়ির বাঁকা কথা, বাবার বাড়ি যেতে চাইলে সেটা নিয়ে হাজারটা কথা শোনানো অথবা স্বামী-স্ত্রী কোনো বিষয় নিয়ে রুমের মধ্যে উচ্চস্বরে হাসাহাসি করলে আমার স্বামীকে নির্লজ্জ বলা প্রতিদিনকার রুটিন। এসব সহ্য করতে করতে একটা সময় অতিষ্ঠ হয়ে উঠি।
একদিন দুপুর বেলায় তুমুল কথা কাটাকাটি হয় আমার শাশুড়ির সাথে। আমারও মুখে যা আসে বলে দেয় আমি। তারপর রাগে গজগজ করতে করতে আমার মা’কে কল করি। মা ওপাশে হ্যালো বলতেই আমি ফুপিয়ে কাঁদতে থাকি আর বলতে থাকি সবকিছু।
‘আমি আর পারবো না মা। এখানে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। হাঁপিয়ে উঠেছি আমি। এত কথা মানুষ শোনায় নাকি বলো? এক্ষুনি হয় তুমি এসো নয়তো বাবাকে পাঠাও আমি চলে যাবো। তার ছেলে যা করার করবে তবে আমি আপাদতো এখানে আর থাকতে পারছি না।’
আমার মা চুপচাপ ওপাশ থেকে কথাগুলো শুনছিলো। আমি যখন হ্যালো হ্যালো করতে লাগলাম মা তখন বললো,
একটু পরে তোমায় কল দিচ্ছি। আগে তুমি একটু শান্ত হও।
আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই মা লাইনটা বিচ্ছিন্ন করে দিলো। দেখতে দেখতে এক ঘন্টা চলে গেলো। এর মাঝেও আমার মা কল দিলো না। রেগেমেগে আমিই আবার কল দিলাম।
– হ্যালো মা, কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আর কি করছিলে শুনি? কখন কল দেওয়ার কথা ছিলো তোমার?
— আমার একটু কাজ ছিলো। তাছাড়া তখন তুমি অনেক রেগে ছিলেতো যা কিছুই বলতাম সব বৃথা হয়ে যেতো।
– হুম।
— মা’রে শোন এত রাগ ভালো না। কতবার বলেছি মেয়েদের এত রাগ-জেদ থাকতে নেই। আমিতো জানি তুই বাইরে থেকে যত শক্ত ভেতর থেকে তারচেয়েও নরম। আমার এমন ভদ্র-সভ্য মেয়েটার ধৈর্য্য কোথায় হারিয়ে গেলো? সংসারটা দুইদিনের না। আর সংসারটা ওতো সহজও না। চাইলেই থাকলাম না চাইলেই থাকলাম না ডিভোর্স দিয়ে সব ছেড়ে ছুড়ে চলে গেলাম তাতো নয়৷ বিয়ের আগে আমিওতো কত কথা নিয়েই বকাবকি করেছি তোকে, করিনি বল? মনে কর বিয়ের পরেও আমার মতোই কেউ এটা ওটা নিয়ে বকাবকি বা শাসন করছে। একটু ধরে নে না অসুবিধে কোথায়?
কেন ধরবি না নিজের মা নয় বলে? হুম এমনটা মনে হতেই পারে। আচ্ছা একটা কথা বলতো তোর শাশুড়ি কি সবসময়ই খারাপ ব্যবহার করে তোর সাথে? মানে তোর দোষ থাক বা না থাক?
– নাহ।
— তাহলে কেমন করে তার একার দোষ দেই বল? ধৈর্য্যশক্তিটা প্রবল কর মা। বলুক না সে তার মতো। যা ইচ্ছে, যতো ইচ্ছে। তুই কানে না তুললেইতো হলো। যা কিছুই করিস একটা কথা মাথায় রাখিস শাশুড়ির জায়গায় একদিন তুইও থাকবি। একটা মেয়ে প্রথমে বউ হয় তারপর মা আর সবশেষে শাশুড়ি। সংসারে একে একে এই ধাপগুলো পার হতে হয়।
সংসার জীবনে সংগ্রাম করেই টিকে থাকতে হয়। দিনশেষে যে সয়, সেই রয়। রাখছি এখন ভালো থাকিস মা।
মা আমার আর কোনো কথা শোনার প্রয়োজনবোধ না করেই ফোনটা কেটে দিলো।
এতক্ষণ মা’র কথাগুলো শুনে যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আচ্ছা আমি কি এতটাই খারাপ যে আমার মা আমার কথাগুলোকে গুরুত্ব দিলো না? নাকি আমার মা’ই সঠিক? মা’তো মিথ্যে কিছু বলেনি। আমি এমন ছিলাম না আগে? তাহলে এখন কেন এমন হলাম? রাগটা একটু বেশি কিন্তু অভদ্রতা, বড়দের সাথে বেয়াদবি এসবের সাথেতো আমার কোনো সম্পর্ক ছিলো না। তাহলে কি সংসার জীবনে এসেই আমার এই অধঃপতন?
বিছানায় শুয়ে খুব করে কাঁদছিলাম। কি ছিলাম আমি আর এখন? ছিহ ভাবতেও অবাক লাগছে। আমার মায়ের সবকথার মধ্যে যেই কথাটা আমার মাথায় গেঁথে গেলো সেটা হলো আমার শাশুড়িতো সবসময় আমার কাজে ভুল খোঁজেন না। বরং প্রায় সময় ভালোভাবেই কথা বলেন। আমি যদি নিজে থেকে গিয়ে ওনাকে কিছু জিজ্ঞেস করি বা হাসিমুখে কথা বলি উনি এতটা খুশি হন যে বলে বোঝানোর মতো নয়।
আমি রাতের খাবারটা বেড়ে শাশুড়ি মা’কে ডাকতে গেলাম। উনি অন্যদিক মুখ করে শুয়েছিলেন। যখনিই বললাম মা আসুন খাবার দিয়েছি আপনার ছেলে হাত-মুখ ধুয়ে আসতেছে।
মা তৎক্ষনাৎ আমার দিকে মুখ ঘুড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে উঠে বসলেন। আমার তখন নিজেকে এত ছোট মনে হচ্ছিলো। আমি রুম থেকে বের হয়ে আসার সময় মা বললেন, বউমা দেখো ওখানে দুপুরের ভাত রাখা আছে। একটু শুকনা মরিচ আর সরিষার তৈল দিয়ে ভাতগুলো মাখিয়ে দেবে? আমার খুব খেতে ইচ্ছে করছে।
কথাটা শোনার পর আমার ভেতর ঘড়ে কেমন যেন এক প্রকার মায়ার সৃষ্টি হলো।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, মা আপনার না দুপুরের ঔষধ আছে? তারমানে আপনি ঔষধ ও খাননি? আর এখন এই রাতের বেলায় যদি আপনার ছেলে ওই ভাত মাখা খেতে দেখে কি বলবে জানেন?
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই আমার স্বামী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললো,
আমি সব শুনেছি। ভাতগুলো মাখাওতো অনেকদিন যাবত আমিও ভাত মাখা খায় না। সবাই মিলে দুয়েক লোকমা করে খেলেইতো শেষ তারপরে না হয় রাতের খাবার খাওয়া যাবে।
সেদিনের পর থেকে আমার শাশুড়ির সাথে সম্পর্কটা আর নষ্ট করিনি। উনি যে আর কোনো ভুল ধরেনি আমার তাও কিন্তু নয়। তবে আমিই গায়ে মাখায়নি সেসব। ওই যে আমার মা একদিনই বলেছিলো আমিও শাশুড়ি হবো।
.
বউমা এই নাও বোতলটা।
– আহ মা আপনিও না। শ্যাম্পুর বোতলটা নিয়ে এই রান্নাঘরেই কি আসতে হবে? যাইহোক আপনি গ্যাসের ট্যাবলেটটা খেয়ে আসুন আমি খাবার দিচ্ছি।
আজকে দুপুরে কি রান্না করছোগো বউমা?
– ওইতো আপনার পচ্ছন্দের টাকি মাছ ভর্তা, চিংড়ির শুটকি ভর্তা আর পুঁইশাকের চচ্চরি।
খাবারগুলোর নাম শুনেই মা দ্রুত ঔষধ খেতে ওনার রুমে দিকে চলে গেলেন।
মানুষগুলো কত অদ্ভুত প্রকৃতির তাইনা? একটু ভালোবাসলে রাস্তার কুকুরটাও পিছু ছাড়ে না। আর আমরাতো মানুষ। আমরাই কিন্তু একটা সময় কেউ কারো কথা সহ্য করতে পারতাম না। অথচ এখন দেখে কে বলবে এমন বাজে সময় পার করে এসেছি আমরা?
এই ভালো সম্পর্কটার জন্য আমার মা’কে স্মরণ করি। সর্বদা স্মরণ করি। মনে মনে আমার মা’কে নিয়ে গর্ববোধও করি। কতটা ভালো মন-মানসিকতা আমার মায়ের। আজকাল নব্বই শতাংশ সংসারে অশান্তির সৃষ্টি হয় বউয়ের মায়ের কুপরামর্শের কারণে। তাছাড়া দিন দিন ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ার কথা আর নাই বা বললাম।
সেখানে আমার মা, আমার কোনো কথাকে গ্রাহ্য না করেই পুরোটা সময় আমায় বুঝিয়ে গেছেন সৎ-বুদ্ধি, সৎ পরামর্শ দিয়ে পাশে থেকেছেন।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প