ভয়ঙ্কর সেই মেয়েটি (২য় পর্ব)

ফরহাদকে খুনের অভিযোগে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো তার স্ত্রী তানিয়া এবং খালাতো ভাই রাকিবকে। পরকীয়া প্রেম, তা থেকে নৃশংস খুন, একটি বাচ্চা মেয়ের করুণ খুনের সাক্ষী। পুরো বিষয়টাই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করল সবার মাঝে। সবাই যা জানে তার চেয়ে বেশি কিছু জানতে আগ্রহী হয়ে উঠলো। রিপোর্টাররাও তাই হুমড়ি খেয়ে পড়লো বৃষ্টির সাক্ষাৎকার নিতে। মেয়েটার বয়স ভুলে ভালো শিরোনামের খোঁজে করে চলল আজব সব প্রশ্ন। তার যেহেতু কোনো অভিভাবক ঢাকায় নেই , প্রতিবেশী ফ্ল্যাটের মানুষরাই তাকে নিজেদের কাছে নিয়ে রাখলো। বিরক্ত হলো তারা মেয়েটাকে এমন উৎপাত করায়। ঝগড়া, বকা-বাজি করে দূর করতে লাগলো সাংবাদিক আর অতি উৎসাহী মানুষ দের।
ফরহাদের ফ্ল্যাটের ঠিক বিপরীত পাশের ফ্ল্যাটে বাস করা ইঞ্জিনিয়ার খোরশেদ আলম আর তার স্ত্রী রেহানার সাথে সুসম্পর্ক ছিল বৃষ্টির পরিবারের। তারা কারো অনুরোধ ছাড়াই এসব ঝামেলা যতদিন না মিটছে বা বৃষ্টির আত্মীয়ের খোঁজ না পাওয়া যাচ্ছে ততদিন বৃষ্টিকে পালন করার দায়িত্ব নিলেন। এরমধ্যে বৃষ্টির বাবা ফরহাদ এবং মা তানিয়ার গ্রামের বাড়ির আত্মীয়রা খবর পেয়ে ছুটে আসে ঢাকায়। তারা বৃষ্টিকে তাদের সাথে নিয়ে যেতে চাইলে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সে। সে জানায় কিছুতেই এই বিল্ডিং ছেড়ে যাবে না সে কোথাও। রেহানাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, বলে ‘আমি তোমার সাথে থাকবো কাকি! ওদের কাছে যাবো না, প্লিজ!’ এত মিষ্টি একটা মেয়ে, এক অদ্ভুত মায়া আর টান অনুভব করে রেহানা মেয়েটার প্রতি।
সে বৃষ্টির আত্মীয়দের অনুরোধ করেন মেয়েটার মানসিক ধাক্কা সামলাতে সময় লাগবে। এখন কিছুদিন এখানেই থাক। রেহানার একমাত্র ছেলে রাব্বির সাথেও বেশ ভালো বন্ধুত্ব আছে বৃষ্টির। দুজনে একি স্কুলে পড়ে। মেয়েটা যেহেতু নিজের অধিকাংশ সময় শহরে কাটিয়েছে, আত্মীয়দের প্রতি টান সৃষ্টি হয়নি। তাই এই অবস্থায় অপরিচিত কোথাও নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না! তারাও আপত্তি করেনি। উল্টো তাদের দেখে মেয়েটা ভয় পেয়ে দূরে সরে গেল বুঝতে পেরে লজ্জা পেয়ে গেল। এরপর থেকে রেহানার পরিবারের সাথেই থাকতে শুরু করে বৃষ্টি। অন্যান্য ফ্ল্যাটের সবার ভালোবাসার নজরও রইলো ওর উপর। পুলিশি তদন্ত, আইনি মামলা থেকে ছোট এই মেয়েটিকে দূরে রাখার ব্যবস্থা করে চলল তারা।
প্রায় এক মাস কেটে গেল। সমবয়সী ছেলে রাব্বির সাথে ঘরেই খেলে, টিভি দেখে, রেহানার কাছে নানান গল্প শুনে দিন কাটায় এখন বৃষ্টি। এরমধ্যে ভুল করেও কখনো বাবা-মা বা রাকিব কাকার প্রসঙ্গ তোলেনি সে। একদম স্বাভাবিক শিশুর মতো আচরণ করছে। এতে স্বস্তিই অনুভব করলেন খোরশেদ আর রেহানা। রোজ রাতে ডান পাশে রাব্বি আর বাম পাশে বৃষ্টিকে নিয়ে গল্প শোনাতে শোনাতে ঘুম পাড়ান রেহানা। মাঝেমধ্যে রাব্বি আর বৃষ্টির আড়ালে ফিসফিস করতে দেখা যায় খোরশেদ আর রেহানাকে। তারা জটিল একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ভাবছেন। যদিও বুঝতে পারছেন না। এরমধ্যে আইনি ঝামেলা থাকবে কতটুকু, বৃষ্টির নানা বা দাদার বাড়ির আত্মীয়রা কতটুকু সমর্থন দেবেন বা এত দ্রুত সময়ে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবে কিনা। বৃষ্টিকে ভালোবেসে ফেলেছে তারা।
তারা নিজেদের ২য় সন্তান হিসেবে দত্তক নিতে চান মেয়েটিকে। একটি পূর্ণাঙ্গ পরিবার না পেলে মেয়েটার সারা জীবন যে নষ্ট হয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যত বড় হবে সে তত গাঢ় ভাবে বুঝতে পারবে তার অস্বাভাবিক অনাথ হওয়ার কারণ। দিন কাটতে লাগলো।
একরাত। রাব্বি আর বৃষ্টিকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে রেহানা। কথাচ্ছলে রেহানা বৃষ্টির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলো, ‘ আমাদের তোমার কেমন লাগে আম্মু ?’
হাসতে হাসতে বৃষ্টি জবাব দিল, ‘অনেক অনেক ভালো।’
‘তুমি সারা জীবন আমাদের সাথে থাকতে চাও? রাব্বির সাথে খেলবে, এক স্কুলে পড়বে? তোমাকে আমরা তোমার বাবা-মার মতো করে বড় করে তুলবো।’
বৃষ্টি এক মুহূর্তে চুপসে গেল। রেহানা বৃষ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেল। বাবা-মায়ের প্রসঙ্গ তোলা ভুল হয়েছে হয়তো। এক মুহূর্তে মেয়েটার পুরো মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ঠোঁট যেন ক্রোধে কাঁপছে। সে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘আমি কোনো বন্ধি না যে কারো সাথে সারাজীবন থাকবো! অনেক দিন বন্ধি থেকেছি আর নয়! তোমরা আমাকে আর বন্ধি করে রাখতে পারবে না!’
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল রেহানা এই সামান্য কথায় মেয়েটার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে। এক মুহূর্তের জন্য রেহানার মনের ভুল হলো মেয়েটার চোখ দুটো লাল আকার ধারণ করে জ্বলছে। বৃষ্টি বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে অন্য ঘরে চলে গেল। রেহানা হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। এমন আচরণ বৃষ্টিকে কখনো করতে দেখেনি সে এত দিনে। রাব্বি ঘুমিয়ে পড়েছিল তাকে আলতো করে শুইয়ে দিয়ে বৃষ্টির পিছু নিল সে। বৃষ্টি এসে দাঁড়িয়েছে বেলকনিতে। কেমন একটা অজানা ভয় কাজ করল হঠাৎ রেহানার মনে। এখনো বাড়ি ফেরেনি খোরশেদ। ঘড়িতে ১০টা ৩০ বাজে।
বৃষ্টির একদম পেছনে এসে দাড়ালো রেহানা। আলতো করে মেয়েটার কাঁধ স্পর্শ করে বলল, ‘ রাগ করো না আম্মু, আমি এমনিতেই বলছিলাম, তুমি যদি না চাও আমরা তোমাকে আটকে রাখবো না। তুমি যেখানে চাও সেখানেই যেতে দেব তোমাকে।’
বৃষ্টি এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ধীরে ধীরে ঘাড় সামান্য বাঁকা করে রেহানার দিকে তাকালো। তার চোখে এমন দৃষ্টি দেখে রেহানার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। বৃষ্টির দুচোখ ঠিকরে বের হচ্ছে লাল আভা। কি হিংস্র লাগছে এইটুক বাচ্চা মেয়েটাকে। কয়েক পা পিছিয়ে এলো রেহানা আৎকে। বৃষ্টি খিলখিল করে হেসে উঠলো, এরপর বিদ্রুপ করে বলতে লাগলো, ‘বিশ্বাসঘাতক! তুমি কী ভেবেছ, তোমার সম্পর্কে কিছুই আমি জানি না!’
অসাড় হয়ে এলো রেহানার পা। এই কণ্ঠ কী আসলেও বৃষ্টির কিনা বুঝতে পারছে না। বৃষ্টি বলে চলল, ‘তুমি একটা ধোকাবাজ, নষ্টা মহিলা! রাব্বি আসলে তোমার ছেলে কিন্তু ওর বাবা খোরশেদ কাকা না। অন্য কেউ! তুমি এতদিন এটা লুকিয়ে গেছ! তোমার সম্পর্ক আছে অন্য এক পুরুষের সাথে। তুমি ধোকা দিয়েছ নিজের স্বামী আর সন্তানকে। আজ রাতেই তোমার স্বামী আর ছেলে জানতে পারবে সমস্ত কথা। তোমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না ওরা! আমাকে তুমি সারাজীবন বন্ধি করে রাখবে,না! দেখ কী মজা হয় এখন!’
এইসব কথা একটা ৭ বছরের বাচ্চা মেয়ের মুখ থেকে বের হতে পারে তা স্বচক্ষে কেউ না দেখলে বিশ্বাস করবে না। বৃষ্টির চোখ থেকে বের হওয়া লাল আভা দেখার পর থেকেই একটা ঘোরে চলে গেছে রেহানা। তার চিন্তা করার শক্তি লোপ পেয়েছে, চলার বা কথা বলার শক্তিও তার নেই। হতভম্ব হয়ে বিস্ফোরিত চোখ মেলে দাঁড়িয়ে রইলো সে। রেহানা অনেক কষ্টে বিড়বিড় করে বলল, ‘আমি ধোকাবাজ! রাব্বি, খোরশেদের ছেলে নয়! ও আমার অবৈধ সন্তান! এমন কথা তুমি কী করে বলতে পারলে বৃষ্টি আম্মু! ‘
বৃষ্টি এগিয়ে এলো তার আরো কাছে, ফিসফিস করে বলল, ‘ এটাই সত্যি কাকি, তুমি ভাবো, বিশ্বাস করো। এখনই তোমার স্বামী চলে এসে সব জেনে যাবে। তোমার সন্তান বাকি জীবন তোমাকে অভিশাপ দেবে। ভেবে দেখ তোমার এখন কী করা উচিত! লজ্জা, লজ্জা!’
‘কিন্তু সে কী করে জানবে, তুমি কী করে জানো এসব, তুমি যা বললে তাতো আমি নিজেই জানতাম না! আমি কী সত্যিই নষ্টা আর ধোকাবাজ!’ ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে কথাগুলো বলল রেহানা। তার চিন্তা শক্তি ফিরে আসছে। বৃষ্টি চঞ্চল হয়ে উঠল, বলল, ‘ তুমিই নষ্টা, ধোকা দিয়েছ স্বামীকে এতগুলো বছর! তুমিই তাকে জানাবে সত্যিটা! এখন তোমার যা করণীয় তা কর!’
‘কী করণীয় আমার!’
‘সম্মান বাঁচাও!’
ঘুমের ঘোরে মানুষ যেভাবে হাঁটে সেভাবে হেঁটে রিডিং টেবিলের কাছে চলে এলো রেহানা। একটা কলম আর খাতা তুলে নিল সামনে। টেবিলের দিকে ঝুঁকে ৫মিনিট সময় ব্যয় করে কিছু একটা লিখল। কলম দিয়ে ওটা চাপা দিয়ে হেটে হেটে ফিরলো আবার বেলকনিতে। হঠাৎই ঘাড়ের পেছনে শীতল একটা বাতাস অনুভব করলো সে। চোখের সামনে ভেসে উঠল রাব্বি, খোরশেদ আলমের মুখ,আর ফরহাদের লাশের ছবি। বিড়বিড় করে বললেন, ‘পাপ করেছি আমি, এর প্রায়শ্চিত্ত আমাকেই করতে হবে। আমি নষ্টা, ধোকাবাজ! আমার শাস্তি চাই!’
খিলখিল করে হেসে উঠলো বৃষ্টি। আর কিছু ভাবলো না রেহানা। এক মুহূর্তে ছুটে গিয়ে বেলকনির রেলিং টপকে ঝাঁপিয়ে পড়লো রাস্তায়। মুখ থুবড়ে পড়লো রাস্তায় তার শরীরটা কয়েক মুহূর্তেই। হয়তো কয়েক মিনিট প্রাণ ছিল তার দেহে। ছটফট করলো শরীরটা। এরপরই মারা গেল সে। মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে রয়েছে, রক্তে ভিজে যাচ্ছে রাস্তাটা। খুব বেশিদিন হয়নি এই রাস্তাটাই শুষে নিয়েছিল সেদিন ফরহাদের তাজা রক্ত। সময়টাতে মানুষের চলাচল বেশ ভালোই ছিল। সকলে চমকে উঠলেন ভারী কিছু পড়ার শব্দে। ছুটে আসলেন লাশটার কাছে। এমন বীভৎস মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন মুহূর্তেই লোকগুলো। তবুও লাশটা ফেলে পালিয়ে যাওয়া যায় না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সবাই।
সেখানে দাঁড়িয়ে হেসেই চলেছে বৃষ্টি। যেন খুব মজার একটা ঘটনা ঘটেছে। মানুষকে কত সহজে মিথ্যা বিশ্বাস দিয়ে প্রভাবিত করা যায়! এমন কী নিজেকেও পুরোপুরি বিশ্বাস করে না সে। তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে রাব্বি। ঘুম থেকে জেগে কী ঘটছে বুঝতে পারেনি, চোখ ডলতে ডলতে অবাক হয়ে বৃষ্টির হাসি দেখছে। মা কোথায়!
বৃষ্টি ঘুরে তার দিকে তাকাতেই ভয়ে কুকড়ে উঠলো রাব্বি। একই চেহারা হলেও এযে তার চিরচেনা খেলার সঙ্গী বৃষ্টি নয় এক মুহূর্তে বুঝে ফেলল সে। বৃষ্টি তার দিকে এগিয়ে এলো। বলল, ‘একটা মজার জিনিস দেখবে রাব্বি! বারান্দার রেলিং দিয়ে উকি দাও, দেখ তোমার মা কী করছে!’ রাব্বি বিস্মিত হলো। প্রায় ঠেলতে ঠেলতে তাকে বেলকনিতে পাঠাল বৃষ্টি। নিজে আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলো। মা-বাবার করা নিষেধ আছে ছোটদের বেলকনিতে যাওয়া যাবে না। বৃষ্টি বলল, ‘রেলিং ধরে উঁচু হয়ে নীচে উকি দাও, মজার একটা দৃশ্য দেখবে।’ সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে সে, মাথায় কিছুই ঢুকছে না। রেলিং এর কাছে যেতে তার ভয় করছে। বৃষ্টি ধমকে উঠলো। কিছুটা এগিয়ে রেলিং ধরে উঁচু হয়ে ঝুকে দেখার চেষ্টা করলো সে রাস্তাটা।
নিচ থেকে একটা লোক উপরে তাকিয়েই অসতর্কভাবে ছোট ছেলেটাকে রেলিং এ উঠতে দেখলো। চেঁচিয়ে উঠলো সে, ‘এই ছেলে পড়ে যাবে তো!’ বাকিরাও লাশের দিক থেকে চোখ সরিয়ে উপরে তাকালো। অনুমান করলো ওখান থেকেই লাফিয়ে পড়েছে মেয়েটা। চিৎকার করলো একত্রিত হয়ে সবাই, ‘এই ছেলে! কী করছো তুমি! নীচে নেমে মায়ের কাছে যাও।’
বৃষ্টি হেসে উঠলো আবার। বলল, ‘মায়ের কাছে যাও খোকা!’ পরমুহূর্তেই রাব্বি গলার পেছনে শীতল একটা হাতের স্পর্শ পেল। ওটার ধাক্কায় তাল হারিয়ে ফেলল সে। পা উঠে এলো রেলিং এর খাঁজ থেকে উপরে, মাথা ঝুকে পড়তে লাগলো সামনে। রেলিং টপকে নীচে নামতে লাগলো তার ছোট শরীর। রাস্তার লোকগুলো হতভম্ব হয়ে ছুটে গেল ছেলেটাকে ধরার জন্য। কিন্তু তার আগেই রাস্তায় আছড়ে পড়ল ছেলেটির শরীর! থেতলে গেল ছোট্ট শরীরটা! আর্তনাদ আর হৈচৈ এ অস্থির হয়ে উঠলো রাস্তা, পরিবেশ। ছুটে আসতে লাগলো মানুষ। যারা দুটো ক্ষত বিক্ষত লাশ দেখল তারা যে এরপর কতরাত ঘুমাতে পারেনি এর হিসাব মেলা অসম্ভব! এতই বীভৎস দেখালো ওগুলোকে।
নিজের স্ত্রী আর একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে উন্মাদের মতো ছটফট করে কাঁদতে লাগলো খোরশেদ আলম। সমস্ত রাগ এসে পড়ছে ছোট ওই মেয়েটার উপর। বৃষ্টি মেয়েটাই অপয়া! কিন্তু মেয়েটার উপর রাগ করে কী লাভ! ওর যে কোনো দোষ নেই ওদের মৃত্যুর পেছনে তাও বুঝতে পারছে সে। এইটুকু বাচ্চা মেয়ে জীবন, মৃত্যুর কী বোঝে! পুলিশ অবশ্য স্বীকার করে নিয়েছে এটা একটা আত্মহত্যা। লাশ দুটো ময়না-তদন্ত করতে পাঠানোর পরই পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে পুরো ফ্ল্যাটটায়। সহজেই খুঁজে পেয়েছে সুইসাইড নোট।
কিন্তু যেকারণে রেহানা আত্মহত্যা করেছে তা অবিশ্বাস্য লাগছে খোরশেদের কাছে। মেয়েটা শুধু তার স্ত্রী নয়, কলেজের বান্ধবী, প্রেমিকা এরপর এই সম্পর্কে জড়িয়েছে তারা। রেহানা তাকে ধোকা দেয়ার চেয়ে নিজের মৃত্যুকে আগে বেছে নিত। সে কিনা সম্পর্কে জড়াবে অন্য কোনো পুরুষের সাথে! রেহানা আত্মহত্যা পত্রে লিখেছে, ‘তার অগোচরে আরেকজন পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়ায় সে অনেক বছর আগে। আবেগের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তার গর্ভে আসে রাব্বি। নিজের ভুল বুঝতে পারে সে হঠাৎ। কিন্তু খোরশেদের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার ভয়ে এতদিন জানায়নি সে। কিন্তু মানসিক চাপ আর পাপবোধ তাকে গিলে খাচ্ছে। তাই আত্মহত্যা করছে সে। রাব্বি তাদের সন্তান নয়। এ মুখ কাউকে দেখাতে পারবে না সে।’
হাতের লেখা যে রেহানার তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু খোরশেদ মনে-প্রাণে জানে এসব মিথ্যা। কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন নেই এটা বিশ্বাস করতে রাব্বি তার আর রেহানার সন্তান। কিন্তু রেহানা এমন টা কেন লিখবে! কেন আত্বহত্যা করবে জীবন নিয়ে এত আশাবাদী থাকা মেয়েটা! ছোট্ট রাব্বি কী দোষ করেছিল!
বৃষ্টি জানায় সে ঘুমিয়েছিল। হঠাৎ রেহানা কাকীর কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। উঠে দেখে রাব্বিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে কাকি। বলছে , ‘ ওকে বলিস আমায় ক্ষমা করে দিতে।’ এরপরই ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে রেহানা বেলকনি থেকে। বৃষ্টি কিছু বুঝে উঠার আগেই তার পিছু পিছু ছুটে গিয়ে লাফিয়ে পড়ে রাব্বিও। পুলিশ অনেক খুঁজেও আর কোনো নতুন তথ্য জোগাড় করতে পারে না। ছোট মেয়েটার কথা অবিশ্বাস করারও কিছু নেই।
প্রাচীন কুয়োটার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন প্রফেসর আমির হোসেন। রাত নেমে এসেছে, কেমন একটা অস্থিরতা কাজ করছে তার মনের ভেতর। এই কুয়োটার ভেতরে যেন লুকিয়ে রয়েছে অনেক রহস্য। যার কিছুই তিনি জানেন না। তার মন বলছে কুয়োর ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়লেই কেবল জানতে পারবেন সেই রহস্যটা কী! আজকাল প্রায় রাতেই দুঃস্বপ্নে এই কুয়োটাকে দেখতে পান তিনি। কেউ যেন তাকে ডাকছে এর ভেতর থেকে, বলছে ভেতরে নেমে আসো। তিনি ভেতরে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য পুরো প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেন। তখনই আচমকা ঘুম ভেঙে যায় তার। ধড়ফড় করে জেগে ওঠেন তিনি।
ফরহাদের মৃত্যু রহস্য সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বৃষ্টির সেরাতে কুয়ো থেকে উঠে আসার বিষয়টাও মাথা থেকে যায়নি। এরমধ্যে অবশ্য বৃষ্টির সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তবে ওই বিল্ডিং এর যে পরিবারটি তাকে আশ্রয় দিয়েছেন তারা কারো সঙ্গেই দেখা করতে দিচ্ছে না মেয়েটিকে। সাংবাদিক থেকে শুরু করে নানান কৌতূহলী মানুষ নাকি প্রায়ই মেয়েটার সঙ্গে দেখা করার জন্য তাদের বিরক্ত করেন। প্রফেসর বুঝতে পারছেন পরিবারটি যা করছে বৃষ্টির ভালোর জন্যই করছে। তাই আর বিরক্ত করলেন না পরিবারটিকে। কী দরকার মেয়েটার জীবনে ঘটা ভয়াবহ ঘটনাটা খুঁচিয়ে তার সামনে বারবার উপস্থিত করা। হয়তো মেয়েটা সম্পর্কে তার মনের সন্দেহ অমূলক! কিন্তু তাকে বেশ বিরক্ত করছে এই কুয়োটা! একটা নেশার মতো টানছে তাকে।
তিনি ধীরে ধীরে কুয়োটার আরো কাছে এগিয়ে গেলেন, উকি দিয়ে তাকালেন অন্ধকার গহ্বরের ভেতর। একটা ছোট হাত যেন সেই মুহূর্তে বেরিয়ে এলো অন্ধকার ফুঁড়ে, তাকে আহ্বান করছে কুয়োয় নামতে। খিলখিল একটা পরিচিত হাসির শব্দ ভেসে এলো কানে। …………………………………………………….

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প